Hasina-Rehana fled the country
Advertisements

যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশের ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ বলয়ের সাবেক মন্ত্রীসহ রাজনীতিক ও ব্যবসায়ীদের বিপুল পরিমাণ সম্পত্তির খোঁজ মিলেছে।

দেশটির আবাসন খাতে তাদের লগ্নি করা সম্পত্তির আর্থিক মূল্য ৪০ কোটি পাউন্ড (ছয় হাজার কোটি টাকা) বা আরো অনেক বেশি হতে পারে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে।

তদন্তকারীরা বিশ্বাস করেন, ব্যাংক থেকে নেয়া ঋণ পরিশোধ না করে বাংলাদেশ থেকে হুন্ডির মাধ্যমে পাচার করা অর্থ দিয়েই এসব সম্পত্তি কেনা হয়েছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরসহ সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, হাসিনা সরকারের আমলে দেশ থেকে কমপক্ষে ১৭ লাখ কোটি টাকা বিদেশে পাচার করা হয়েছে। এর একটি উল্লেখযোগ্য পরিমাণের গন্তব্য হয়েছে লন্ডন তথা যুক্তরাজ্য।

তবে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ও দুর্নীতি দমন কমিশন সংস্কার কমিশনের প্রধান ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক গভর্নর ব্যাংক খাত থেকে ১৭ বিলিয়ন ডলার পাচার হওয়ার কথা বললেও বাস্তবে তার পরিমাণ আরো বেশি।

নভেম্বরের শুরুতে ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের আমলে বছরে রাষ্ট্রীয় কাঠামো ব্যবহার করে সরকারের সাথে ঘনিষ্ঠ প্রভাবশালীরা ব্যাংক খাত ও বাণিজ্যের আড়ালে প্রতি বছর ১২ থেকে ১৫ বিলিয়ন ডলার পাচার করেছে। যদিও শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার ক্ষমতায় থাকাকালে কী পরিমাণ টাকা পাচার হয়েছে, এর প্রকৃত হিসাব কোথাও নেই।

ব্রিটিশ দৈনিক অবজারভার ও বার্লিনভিত্তিক দুর্নীতিবিরোধী প্রতিষ্ঠান ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের যৌথ অনুসন্ধানে এসব তথ্য উঠে এসেছে। শনিবার যুক্তরাজ্যের দৈনিক দ্য গার্ডিয়ান এই অনুসন্ধান নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অবজারভার ও ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের যৌথ অনুসন্ধানে যুক্তরাজ্যে শেখ হাসিনা-ঘনিষ্ঠ কয়েকজন ব্যক্তির নামে প্রায় ৩৫০টি সম্পত্তির তথ্য পাওয়া গেছে।

অফশোর কোম্পানির মাধ্যমে কেনা এই সম্পত্তির অনেকগুলোর মালিকানায় রয়েছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান ও বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহানের পরিবারের সদস্যরা। এছাড়া সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী, নাসা গ্রুপের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার ও তাদের পরিবারের সদস্যরা।

এর মধ্যে মাঝারি মানের ফ্ল্যাট থেকে শুরু করে সুবিশাল অট্টালিকা (ম্যানশন) পর্যন্ত রয়েছে। যুক্তরাজ্য ও দেশটির বাইরের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের (অফশোর কোম্পানি) নামে সম্পত্তিগুলো কেনা হয়েছে।

বেক্সিমকো গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান সালমান এফ রহমান বর্তমানে বাংলাদেশে কারাবন্দী অবস্থায় রয়েছেন। তার বিরুদ্ধে অর্থ পাচারের অভিযোগে বাংলাদেশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) তদন্ত করছে। এছাড়া সালমান ও তার পরিবারের সদস্যদের ব্যাংক হিসাব জব্দ করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা বিভাগ বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)।

অনুসন্ধানে প্রাপ্ত তথ্য থেকে জানা যায়, সালমানের পরিবারের সদস্যদের লন্ডনের মেফেয়ার এলাকার গ্রোসভেনর স্কয়ারে সাতটি বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্টের মালিকানা বা মালিকানায় অংশীদারত্ব রয়েছে। এগুলোর বেশিভাগই অফশোর কোম্পানির মাধ্যমে কেনা।

এর মধ্যে ২০২২ সালের মার্চ মাসে দুই কোটি ৬৭ লাখ ৫০ হাজার পাউন্ডে একটি অ্যাপার্টমেন্ট কিনেন সালমানের ছেলে আহমেদ শায়ান রহমান। সেখানে তিন কোটি ৫৫ লাখ পাউন্ডে কেনা তার একটি ফ্ল্যাটও রয়েছে। ২০২২ সালে শেখ হাসিনার বোন শেখ রেহানা লন্ডনে শায়ান রহমানের একটি বাড়িতে বিনা ভাড়ায় থাকতেন বলে খবর বেরিয়েছিল।

গ্রোসভেনর স্কয়ারে এবং এর কাছাকাছি এই পরিবারের আরেক সদস্য আহমেদ শাহরিয়ার রহমানের কোটি ৩০ লাখ পাউন্ড মূল্যের আরো চারটি সম্পত্তি রয়েছে। এসব সম্পত্তি অফশোর কোম্পানির মাধ্যমে কেনা হয়েছে। এ বিষয়ে শায়ান রহমান ও শাহরিয়ার রহমানের আইনজীবীরা বলেছেন, মানি-লন্ডারিং আইনসহ আর্থিক বিধিবিধান পুরোপুরি মেনেই সম্পত্তিগুলো কেনা হয়েছে।

গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যুক্তরাজ্যের ভূমি নিবন্ধন কর্তৃপক্ষের তথ্য অনুযায়ী, দেশটিতে সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী ও তার পরিবারের তিন শ’টির বেশি সম্পদ রয়েছে। এগুলোর মূল্য কমপক্ষে ১৬ কোটি পাউন্ড।

কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরা গত সেপ্টেম্বরে সাইফুজ্জামান চৌধুরীর বৈশ্বিক সম্পত্তি নিয়ে ‘দ্য মিনিস্টার্স মিলিয়নস’ শিরোনামের একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সেই প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিদেশে তার আনুমানিক ৫০ কোটি মার্কিন ডলার মূল্যের সম্পত্তির রয়েছে।

বিএফআইইউ বাংলাদেশে সাইফুজ্জামান চৌধুরীর ব্যাংক হিসাবও জব্দ করেছে। তার ও তার পরিবারের সদস্যদের স্থাবর সম্পত্তি জব্দ করার নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। সরকার সাইফুজ্জামান চৌধুরীর ওপর দেশত্যাগের নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। এছাড়া দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তার বিরুদ্ধে অবৈধভাবে বিপুল অর্থ অর্জনের অভিযোগ তদন্ত করছে।

গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে বলা হয়, রাজনীতিকদের বাইরে বাংলাদেশের ধনী ও প্রভাবশালী ব্যবসায়ীদেরও যুক্তরাজ্যে সম্পত্তি রয়েছে। এর মধ্যে যুক্তরাজ্যের সারে এলাকায় বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহানের পরিবারের সদস্যদের দু’টি সম্পত্তি রয়েছে। এক কোটি ৩০ লাখ পাউন্ড দিয়ে অফশোর কোম্পানির মাধ্যমে এ সম্পত্তি কেনা হয়েছে। এছাড়া অবজারভার
এলাকাটিতে পরিদর্শনে গিয়ে আহমেদ আকবর সোবহানের এক ছেলের মালিকানাধীন একটি অট্টালিকারও সন্ধান পেয়েছে।

বাংলাদেশ সরকার গত ২১ অক্টোবর আহমেদ আকবর সোবহানসহ তার পরিবারের ছয় সদস্যের ওপর দেশত্যাগের নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। এছাড়া তাদের ব্যাংক হিসাবও জব্দ করেছে বিএফআইইউ। এ বিষয়ে গার্ডিয়ানের সাথে কথা বলেছেন বসুন্ধরা গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান ও আহমেদ আকবর সোবহানের ছেলে সাফওয়ান সোবহান। তিনি বলেন, তার পরিবার তাদের বিরুদ্ধে তোলা সব অভিযোগ দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করছে।

এদিকে সিআইডি নাসা গ্রুপের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদারের বিরুদ্ধে অর্থ পাচারের অভিযোগ তদন্ত করছে। তার সম্পত্তিও জব্দ করা হয়েছে। লন্ডনের কেনসিংটনে তিনি ও তার পরিবারের সদস্যরা কিভাবে তিন কোটি ৮০ লাখ পাউন্ডের পাঁচটি সম্পত্তি কিনেছেন, তা খতিয়ে দেখছে বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।

তবে নজরুল ইসলাম মজুমদারের ঘনিষ্ঠ সূত্র জানায়, তিনি এসব সম্পত্তি অবৈধ উপায়ে কেনার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।

সূত্র : বাসস

Advertisements