আসন্ন শীত মৌসুমে গ্যাসের চাহিদা বাড়ছে। তবে কমছে গ্যাস উৎপাদন। আন্তর্জাতিক বাজারে এলএনজির (তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস) দাম বৃদ্ধির কারণে আমদানি কমেছে। এ অবস্থায় শীতে কমপক্ষে ৪০ শতাংশ বাড়তি চাহিদা মেটানোর মতো বিকল্প ব্যবস্থা নেই। ফলে আসন্ন শীত মৌসুমে তীব্র গ্যাস সংকটের আশঙ্কা রয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, বাড়তি গ্যাসের জোগান দিতে আমদানি করা এলএনজি এখন একমাত্র ভরসা। কিন্তু সেই এলএনজির দামও আন্তর্জাতিক বাজারে ৫ গুণ বেড়েছে। চলতি অর্থবছরের বাজেটে দেশের জ্বালানি খাতের জন্য ভর্তুকি বাবদ বরাদ্দ রয়েছে এক হাজার কোটি টাকা।
অথচ গত ৭ মাসেই আন্তর্জাতিক বাজার থেকে এলএনজি কিনতে গিয়ে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা ক্ষতির মুখে পড়েছে সরকার। এরই মধ্যে তেলের দাম বাড়ানো হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, আন্তর্জাতিক বাজারে তেল ও গ্যাসের দামের বর্তমান পরিস্থিতি বজায় থাকলে ক্ষতির মাত্রা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা বলা কঠিন।
এমন পরিস্থিতিতে দেশের বাজারে গ্যাসের দাম বাড়তে পারে। আর গ্যাসের দাম বাড়লে বিদ্যুতের দামও বাড়বে। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে এ তথ্য জানা গেছে।
পেট্রোবাংলা সূত্র জানায়, শীতের সময়ে এমনিতেই গ্যাসের চাপ কমে যায়। তাতে সরবরাহ লাইনে গ্যাস বাড়িয়ে চাপ বাড়াতে হয়। না হলে শিল্পে গ্যাসের সরবরাহ কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। এছাড়া শীতে গ্যাসের বাড়তি চাহিদাও তৈরি হয়।
গ্রীষ্মকালে প্রতিদিন গড়ে প্রাকৃতিক গ্যাসের (এমএমসিএফডি) চাহিদা থাকে ৩ হাজার ঘনফুট। শীতকালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৩ হাজার ৫০০ থেকে ৪ হাজার ২০০ ঘনফুটে। এ হিসাবে প্রতিদিন গড়ে চাহিদা বাড়ে ১২০০ ঘনফুট। অর্থাৎ ৪০ শতাংশ চাহিদা বাড়ে শীতে।
জ্বালানি বিভাগ ও পেট্রোবাংলা সূত্র বলছে, গত ২০ বছরে দেশে মাত্র ২৮টি অনুসন্ধান কূপ খনন করা হয়েছে। এর মধ্যে নতুন গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয়েছে চারটি। নোয়াখালীর সুন্দলপুর, কুমিল্লার শ্রীকাইল ও নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের ক্ষেত্রগুলোতে মজুত তেমন বেশি ছিল না।
বেশিরভাগই তোলা হয়ে গেছে। সর্বশেষ ২০১৮ সালে ভোলায় একটি গ্যাসক্ষেত্র পাওয়া গেছে।
বর্তমানে দেশে গ্যাস উৎপাদিত হচ্ছে প্রতিদিন ২ হাজার ৯০০ ঘনফুটের মতো। ঘাটতি রয়েছে ১৩০০ ঘনফুট। ঘাটতি ৩১ শতাংশ। চাহিদার বিপরীতে গ্যাসের জোগান দিতে হলে প্রতিদিন গড়ে দেড় হাজার ঘনফুট এলএনজি আমদানির মাধ্যমে সরবরাহ করতে হবে।
কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারে এর দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ার কারণে চাহিদা অনুযায়ী গ্যাস আমদানি করতে পারছে না। এখন গড়ে ৬০০ থেকে ৭০০ মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি দেওয়া হচ্ছে জাতীয় গ্রিডে।
প্রতি মিলিয়ন ব্রিটিশ থারমাল ইউনিটের (২৭ দশমিক ৯৬ ঘনমিটার) দাম গত বছরের মার্চে ছিল ৫ ডলার। জানুয়ারিতে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১৪ ডলারে। এখন তা আরও বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩০ ডলারে।
এই বাড়তি দরে পেট্রোবাংলা আমদানি করতে চায়নি। কিন্তু এখন শীতের কারণে ঘাটতি প্রকট হওয়ায় আমদানি শুরু করেছে। এতে স্পটভিত্তিতে গ্যাস কিনছে সংস্থাটি।
শীতের শুরুতে দেশের বিদ্যুৎ কেন্দ্র, সার ও শিল্পকারখানায় গ্যাসের চাহিদা ক্রমশ বাড়ছে। কিন্তু সে অনুযায়ী সরবরাহ বাড়ানো যাচ্ছে না। এতে সক্ষমতা থাকলেও পুরোপুরি উৎপাদনে যেতে পারছে না গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো।
কোনো কোনোটি দিনের পর দিন বন্ধই রাখতে হচ্ছে। এছাড়া গ্যাস বিতরণ কোম্পানিগুলোতে নতুন সংযোগ ও লোড বৃদ্ধির আবেদনের স্তূপ পড়েছে। সরবরাহ না থাকায় এর কোনো সুরাহা হচ্ছে না।
পেট্রোবাংলার হিসাব অনুযায়ী বৃহস্পতিবার দেশের গ্যাস ক্ষেত্রগুলো থেকে ৩ হাজার ৪২ ঘনফুট এমএমসিএফডি গ্যাস উৎপাদিত হয়েছে। কিন্তু বিতরণ করা হয়েছে ২৯১৩ ঘনফুট এমএমসিএফডি।
এরমধ্যে বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোতে সরবরাহ করা হয়েছে ১০৯১ ঘনফুট। যা মোট গ্যাস বিতরণের ৩৭ শতাংশ। যদিও পাওয়ার প্ল্যান্টগুলোর দিনে চাহিদা ছিল ২২৫২ ঘনফুট গ্যাস। এছাড়া সার কোম্পানিগুলোর দিনে চাহিদা ছিল ৩১৬ ঘনফুট গ্যাস।
বিতরণ করা হয়েছে ১২৮ ঘনফুট। মোট বিতরণের ৪ শতাংশ সরবরাহ করা হয়েছে। শিল্পকারখানাসহ অন্যান্য সব খাতে বিতরণ করা হয়েছে ১৬৯৫ ঘনফুট গ্যাস। যা মোটা বিতরণের ৫৮ শতাংশ।
বর্তমানে পেট্রোবাংলার অধীনে ৬টি বিতরণ কোম্পানি সারা দেশে গ্যাস বিতরণ করছে। এরমধ্যে শুধু তিতাসের চাহিদা ১৫৯৮ ঘনফুট। এরমধ্যে বিদ্যুৎ কেন্দ্রে ৭৫০ ঘনফুটের বিপরীতে ২৯৯ ঘনফুট গ্যাস বিতরণ করা হয়েছে বৃহস্পতিবার।
এছাড়া সার কারখানায় ১০৪ ঘনফুটের বিপরীতে বিতরণ করা হয়েছে মাত্র ৮ ঘনফুট গ্যাস। আর বেসরকারি খাতে শিল্পকারখানায় বিতরণ করা হয়েছে ১২৯১ ঘনফুট। যদিও এ খাতে চাহিদা ছিল ১৬০০ থেকে ১৮০০ ঘনফুট ।
বাখরাবাদ গ্যাস বিতরণ কোম্পানি বৃহস্পতিবার বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোতে ৫০১ ঘুনফুট চাহিদার বিপরীতে বিতরণ করেছে ২০৯ ঘনফুট। সার কারখানাগুলোর চাহিদা ৫২ ঘনফুট থাকলেও এই খাতে কোনো গ্যাস দেওয়া হয়নি। বেসরকারি শিল্পকারখানায় বিতরণ করা হয়েছে মাত্র ৮৮ ঘনফুট।
জালালাবাদ গ্যাস বিতরণ কোম্পানির অধীনে বৃহস্পতিবার বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোতে চাহিদা ছিল ৩৯৫ ঘনফুট। বিতরণ করা হয়েছে ২৫২ ঘনফুট। সার কারখানায় বিতরণ করা হয়েছে ৪০ দশমিক ৫ ঘনফুট। চাহিদা ছিল ৪৫ ঘনফুট গ্যাস। আর শিল্পকারখানায় বিতরণ করা হয়েছে ১০৩ ঘনফুট গ্যাস।
পশ্চিমাঞ্চল গ্যাস বিতরণ কোম্পানিতে বৃহস্পতিবার বিতরণ করা হয়েছে ১২৯ ঘনফুট গ্যাস। যদিও এই কোম্পানির চাহিদা ছিল ৩০০ ঘনফুটের বেশি।
চট্টগ্রামের কর্ণফুলী গ্যাস কোম্পানি থেকে বিদ্যুৎ কোম্পানিগুলোর জন্য ১৮৫ ঘনফুট গ্যাসের চাহিদা থাকলেও বিতরণ করা হয়েছে মাত্র ৩৬ দশমিক ৬ ঘনফুট। সার কোম্পানিগুলোতে চাহিদা ছিল ১১৫ ঘনফুট, বিতরণ করা হয়েছে ৭৯ দশমিক ৫ ঘনফুট।
বাকি খাতগুলোতে বিতরণ করা হয়েছে ১৮২ ঘনফুট। সুন্দরবন গ্যাস কোম্পানিতে এই দিন বিতরণ করা হয়েছে মাত্র ৯৫ দশমিক ৬ ঘনফুট। চাহিদা ছিল ২০০ ঘনফুটের বেশি।
দেশে বর্তমানে ৪টি কোম্পানির অধীনে গ্যাস উৎপাদন করা হচ্ছে। এরমধ্যে বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ড থেকে বৃহস্পতিবার উৎপাদিত গ্যাসের পরিমাণ ৬৩৩ দশমিক ৪ ঘনফুট।
সিলেট গ্যাস ফিল্ডে ৮৭ ঘনফুট, বাপেক্স থেকে ৮৪৬ দশমিক ৫ ঘনফুট। আন্তর্জাতিক কোম্পানি শেভরণ ও তাল্লুর গ্যাস কূপগুলো থেকে উৎপাদিত হয়েছে ১৫৫৪ ঘনফুট এবং আরপিজিসিএল থেকে উৎপাদিত হয়েছে ৬৪১ ঘনফুট গ্যাস।
বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, দেশে গ্যাসের চাহিদা বাড়ছে। কিন্তু নতুন ক্ষেত্র আবিষ্কার হচ্ছে না। বিদ্যমান ফিল্ডগুলো থেকে গ্যাস উত্তোলন কমছে। ফলে ক্রমান্বয়ে আমদানি নির্ভর হয়ে পড়ছে দেশ।
অর্থাৎ বিদেশ থেকে লিকুইড ন্যাচারাল গ্যাস (এলএনজি) আমদানি করে চাহিদা মেটানো হচ্ছে। এতে আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বেড়ে গেলে স্থানীয় বাজারেও প্রভাব পড়ে।
চলতি অর্থবছরের বাজেটে গ্যাস খাতে ভর্তুকি বাবদ ১ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছিল। কিন্তু গত ৪ মাসেই ১ হাজার কোটি টাকার পর আরও ৯ হাজার কোটি টাকা খরচ হয়েছে। অর্থাৎ এ খাতে মোট ১০ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিতে হবে।
সম্প্রতি বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদের সভাপতিত্বে একটি বৈঠক হয়। ভবিষ্যৎ গ্যাসের চাহিদা পূরণে ওই বৈঠকে বেশ কিছু সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। তবে সংস্থানের চেয়ে গ্যাস অপচয় রোধেই বেশি জোর দেওয়া হয়।
ব্যবহারে মিতব্যয়ী হওয়ার পাশাপাশি প্রয়োজনে কম গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় গ্যাসের রেশনিং করার কথা বলা হয়। এছাড়া চাহিদার পিক-অফপিক আওয়ার বিবেচনায় নিয়ে তুলনামূলক কম গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানে গ্যাসের সরবরাহ সাময়িক বন্ধ রাখার বিষয়ও আলোচনায় আসে।
পাশাপাশি অতিরিক্ত ব্যবহার করা গ্যাসের জন্য আলাদা ট্যারিফ নির্ধারণের প্রস্তাবও দেওয়া হয়।
বৈঠক সূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) গ্যাসের চাহিদা নিরূপণ করতে জুনে এক অতিরিক্ত সচিবের নেতৃত্বে কমিটি গঠন করে দেওয়া হয়। ২০২১ থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত পিডিবির বিদ্যুৎ উৎপাদনের গ্যাসের চাহিদা ও সরবরাহ নিরূপণ করে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল কমিটিকে।
মন্ত্রণালয়ের ওই বৈঠকে তাদের প্রতিবেদন তুলে ধরা হয়। তাতে বলা হয়েছে এই চাহিদা গড়ে ১০০ থেকে ৫৫০ এমএমসিএফডি ঘনফুট। এ ঘাটতি শুধু পিডিবির বিদ্যুৎ সরবরাহের ক্ষেত্রে।
বর্তমানে দেশে যে সরবরাহ করা হয়, তার মধ্যে পিডিবির একার চাহিদাই প্রায় ১৫০০ ঘনফুট। যদিও সরবরাহ করা হয় গড়ে ১ হাজার ১০০ থেকে ১ হাজার ৩০০ এমএমসিএফডি।
জ্বালানি বিভাগের একাধিক কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেণ, দেশের মোট উৎপাদিত বিদ্যুতের সিংহভাগ আসে গ্যাসভিত্তিক কেন্দ্র থেকে। গ্যাসের দাম বাড়লে বিদ্যুতের দামও বাড়বে।
তাদের মতে, বাজারে এমনিতেই সব ধরনের নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে। সম্প্রতি বাড়ানো হয়েছে ডিজেলের দাম। তাতেই গণপরিবহণের ভাড়া বাড়াতে বাধ্য হয়েছে সরকার।
গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়ালে নিত্যপণ্যের দাম আরও বেড়ে যাবে। এর ফলে সাধারণ মানুষ আরও ভোগান্তিতে পড়বে। সরকার জরুরি অবস্থা সামাল দিতে একটি তহবিল গঠনের কথা দীর্ঘদিন ধরে বলে এলেও তা করা হয়নি।
এরকম তহবিল করা গেলে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানির দাম বাড়লেও অন্তর্বর্তীকালীন সময় পরিস্থিতি সামাল দেওয়া যেত।
সম্প্রতি বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ গণমাধ্যমকে বলেছেন, ‘সারা দুনিয়াতে তেল, গ্যাস, কয়লার দাম বেড়ে গেছে। অনেক দেশ টাকা দিয়েও এসব পণ্য কিনতে পারছে না।
বহু দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন সংকটে পড়েছে, তীব্র লোডশেডিংয়ে পড়েছে অনেক ধনী দেশও। কিন্তু এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে সংকট হয়নি। আগামীতেও আমাদের তেল ও আমদানি করা এলএনজিতে সংকট হবে না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ বদরুল ইমাম বলেন, কয়েক বছর পরপর ছোট একটি-দুটি গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার তেমন কোনো গুরুত্ব বহন করে না।
অনুসন্ধানে বাড়তি জোর না দেওয়াই সরকারের সবচেয়ে বড় ভুল। তিনি বলেন, কম সম্ভাবনা নিয়েও অনেক দেশ এর চেয়ে বেশি অনুসন্ধান চালায়।
সূত্রঃ যুগান্তর