ইতিহাস সব ঘটনা ধরে রাখে না, ছোটখাটো অনেক কিছু সেখানে ঠাঁই পায় না। তাই বলে সেসব ঘটনা মূল্যহীন—এমন ভাবারও কোনো কারণ নেই। সাদামাটা সেসব ঘটনা বা কাহিনি বরং ইতিহাসের ঘটনাবলি বুঝতে সাহায্য করে। এমনকি বুঝিয়ে দিতে পারে ঐতিহাসিক কোনো আন্দোলনের জনভিত্তি বা শ্রেণিচরিত্র। ছোটখাটো ঘটনা তাই সব সময় হেলাফেলার নয়।
একুশের ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত এমন অনেক ঘটনা আমাদের কারো কারো অভিজ্ঞতায় রয়েছে, যা সাদামাটা হওয়া সত্ত্বেও আকর্ষণীয় এবং পাঠকের কাছে হতে পারে উপভোগ্য। এ ধরনের কোনো কোনো ঘটনা বুঝতে সাহায্য করে একুশের ভাষা আন্দোলন ছাত্রসমাজের বাইরে নানা শ্রেণির মানুষকে কিভাবে কতটা গভীরতায় স্পর্শ করেছিল। একুশে ছিল দেশের প্রথম গণতান্ত্রিক আন্দোলন, যা জনগণকে নানা মাত্রায় প্রভাবিত করেছে।
একুশে ফেব্রুয়ারির দিনকয়েক আগের কথা। ‘ব্যারাক’ নামে খ্যাত মেডিক্যাল কলেজ হোস্টেলে বসে সিদ্ধান্ত হয়, ‘বর্তমান আন্দোলনে পুরান ঢাকার সমর্থন আদায় করতে হবে। আটচল্লিশের ভাষা আন্দোলনে ওরা প্রতিপক্ষ হিসেবে কাজ করেছে। কিন্তু গত চার বছরে অবস্থা অনেক পাল্টেছে। কোনো মহল্লা সর্দারকে ধরে কাজটা সারতে হবে।’ কলেজ ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক শরফুদ্দিন আহমদ ঢাকাইয়া। কাজেই দায়িত্ব তাঁর ওপরই পড়ে। আর শরফুদ্দিনের বক্তব্য : ‘যেতেই যদি হয়, তাহলে সর্দারদের প্রধান কাদের সর্দারের কাছেই যাওয়া ভালো।’
সাক্ষাৎকারের ঘটনাটা ছিল বেশ মজার। ‘মেডিক্যালের ছাত্রনেতারা এসেছেন সর্দার সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে’ শুনে সর্দার সাহেব অর্থাৎ মীর্জা আবদুল কাদের বেশ আদব-তমিজের সঙ্গে ছাত্রনেতাদের বসিয়ে, ধৈর্য ধরে তাঁদের সব কথা শোনার পর একসময় বলে ফেলেন, ‘ক্যান, উর্দুটাই তো ভালো লাগে, অক্ষরগুলান আরবির লাহান দ্যাখা যায়। দোষটা কী উর্দুর?’ শুনে শরফুদ্দিন বিপদ গোনেন। এত কথার পর কি না ‘উর্দুই ভালা!’
আসলে এর কারণ অন্যত্র। পুরান ঢাকার আদি মহল্লাবাসীদের (ঢাকাইয়া) জবানিভাষা উর্দু-বাংলার এক অদ্ভুত মিশ্রণ—এককথায় দোআঁশলা। তা ছাড়া উর্দু ধর্মীয় ভাষা আরবির কাছাকাছি। তাই ওদের ধারণা পাকভূমির রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার চেয়ে উর্দুর হক বেশি। এমনটাই বুঝিয়ে ছিলেন তাঁদের বড় হুজুর নবাববাড়ির খাজা সাহেবরা। তাঁদের রক্ষণশীলতাও এ জন্য কম দায়ী ছিল না।
কথাবার্তার ফাঁকে কেক-নিমকি-শিঙাড়া-মিষ্টি ও চা এসে পড়ে। ছাত্র-অতিথিদের আপ্যায়নে খুঁত নেই। এগুলো দেখে শরফুদ্দিনের মাথায় বুদ্ধি খেলে। তিন বন্ধু বিদায় নেওয়ার জন্য উঠে দাঁড়াতেই সর্দার সাহেব হা হা করে ওঠেন : ‘কিছু মুখে না দিয়া যান কই?’ বন্ধু শরফুদ্দিন বিনয়ের সঙ্গে বলেন : ‘২২ পঞ্চায়েতের সর্দারদের সর্দার বলেই না সেই মেডিক্যাল ব্যারাক থনে আপনার কাছে আসা। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবি আমেগা দ্যাশের মাইনসের জন্য বাঁচন-মরণ ব্যাপার। সেই দাবি আদায়ের জন্য হরতাল। এ ব্যাপারে যখন কথা পাওয়া গ্যালো না তখন আর বইসা কী অইব?’
এবার সর্দার সাহেব সত্যিই সংকটে। ‘একে তো অতিথি, তায় মেডিক্যালের ছাত্র। ওরা না খাইয়া যাইব গা? সর্দারের ইজ্জত থাকে কোথায়?’ মত পালটে ফেলেন কাদের সর্দার। ‘ঠিক আছে, আগে বহেন্ত, তারপর না কথা।’ এই নাটকের মধ্যে চা ঠাণ্ডা, আরেক প্রস্থ চা এলো। খাওয়াদাওয়ার ফাঁকে সর্দার সাহেব জানিয়ে দেন : ‘কথা দিলাম এবার ঢাকাই মহল্লার মুসলমানরা ছাত্রগো বিরুদ্ধে যাইব না, হরতাল করা না-করা তাগো মর্জি।’ শুনে শরফুদ্দিন মহাখুশি।
কারণ কাদের সর্দারের ওইটুকু আশ্বাসই সেদিন যথেষ্ট ছিল। তাই দেখা গেছে একুশে ফেব্রুয়ারি সকালে মহল্লাবাসী সবাই হরতালে যোগ না দিলেও সমর্থনটা ছিল স্পষ্ট। দুপুর হতে না হতে হাওয়া পালটে যেতে থাকে। আর পুলিশের গুলিতে ছাত্র-অছাত্র মৃত্যুর পর প্রায় পুরো মহল্লাই যেন মেডিক্যাল ব্যারাক ও হাসপাতাল প্রাঙ্গণে উঠে আসে। আহত-নিহতদের তারা একনজর দেখতে চায়। সে অভাবনীয় দৃশ্য না দেখলে বোঝা যাবে না। কাদের সর্দারের সঙ্গে সাক্ষাতের ঘটনা খুবই ছোট, কিন্তু আন্দোলনের পক্ষে এর গুরুত্ব ছিল অসামান্য।
পরদিন শুক্রবার ছাত্র-আন্দোলন যে গণ-আন্দোলনে পরিণত হয়েছিল তার পেছনে তো মহল্লাবাসী কিশোর, তরুণ, যুবক ও কিছু শ্রমজীবী মানুষ—যারা রিকশা চালায়, ঠেলা টানে বা ছোটখাটো দোকানদারিতে ব্যস্ত। একুশের গণমিছিলে যোগদানের কারণ অবশ্য পুলিশের গুলিবর্ষণ—‘ছাত্র মাইরা অ্যালাইছে’, কথাটা মুখে মুখে ছড়িয়ে যায়। পর্দানশিন, রক্ষণশীল ঢাকাই মহিলারা পর্যন্ত এ ঘটনায় অস্থির। মহল্লা সর্দারদের মধ্যে বিশেষভাবে মাওলা সর্দার, ইলিয়াস সর্দার, পিয়ারু সর্দার, এমনকি মেজাজি মতি সর্দার পর্যন্ত একুশের আন্দোলনের সহযোগিতায় হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। সেসব ঘটনা ইতিহাসের নেপথ্য কাহিনি।
ইতিহাসের এসব নেপথ্য কাহিনীর মধ্যে হোসেনি দালান এলাকার পিয়ারু সর্দারের দাক্ষিণ্য ছিল ভাষা আন্দোলনের জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। ২৩ ফেব্রুয়ারি রাতে তাঁর সহায়তা না পেলে মেডিক্যাল ছাত্রদের পক্ষে প্রথম শহীদ মিনার তৈরি সম্ভব হতো কি না বলা কঠিন। মেডিক্যাল ছাত্রদের হাতে ২৩ ফেব্রুয়ারি এক রাতের শ্রমে তৈরি শহীদ মিনার তাত্ক্ষণিকভাবে হয়ে ওঠে প্রতিবাদ ও সংগ্রামের প্রতীক এবং পরবর্তীকালে পূর্ণাঙ্গ শহীদ মিনার নির্মাণের প্রেরণা, যে শহীদ মিনার জাতীয় জীবনে সব গণতান্ত্রিক সংগ্রামের প্রেরণা।
শহীদ মিনার তৈরির পরিকল্পনা ছিল একান্তভাবেই মেডিক্যাল ছাত্রদের। ‘শহীদ স্মৃতি অমর হোক’—এ স্লোগানের টানেই ওই পরিকল্পনা। ২২-২৩ ফেব্রুয়ারি পথে পথে পুলিশ-সেনাবাহিনীর টহল ও সন্ধ্যার পর থেকে জারি করা কারফিউর মধ্যে শহীদ মিনার তৈরির পরিকল্পনা কাজে পরিণত করতে গিয়ে সমস্যা তৈরি হয় সিমেন্ট নিয়ে। কলেজ ভবন সম্প্রসারণের জন্য কলেজ প্রাঙ্গণে বিস্তর ইট-বালু মজুদ ছিল। ছিল সিমেন্টও, কিন্তু গুদামের চাবি সাব-কন্ট্রাক্টর পিয়ারু সর্দারের কাছে। নিরুপায় হয়ে যেতে হয় তাঁর বাড়িতে।
সব শুনে সর্দার সাহেব কিছুক্ষণ গম্ভীর, চুপচাপ থাকেন। হয়তোবা গত দুই দিনে ছাত্র-অছাত্র হত্যার ঘটনা তাঁর মনে ছায়া ফেলে থাকবে। তাই শেষ পর্যন্ত ঢাকাইয়া ভাষায় যা বললেন তার মূল কথা হলো : ‘এমন কাজে সিমেন্ট দিতে তাঁর আপত্তি নেই, যে কয় ব্যাগ দরকার ছাত্ররা তা নিতে পারে। তবে সিমেন্ট বের করে গুদাম যেন ঠিকঠাকমতো তালা বন্ধ করা হয় এবং কাজ শেষে গুদামের চাবিও যেন তাঁর কাছে ফেরত পাঠানো হয়।’
ছাত্রদের আশ্বাস পেয়ে সর্দার সাহেব ভেতরে চলে যান, ফিরে এসে গুদামের চাবি ছাত্রবন্ধু আছগরের হাতে তুলে দেন। অবিশ্বাস্য ঘটনা! সর্দার সাহেবের এমন উদারতা ও সহযোগিতা সবার কাছেই অভাবনীয় মনে হয়েছে। আমরা তাঁর বিশ্বাসের অমর্যাদা করিনি, প্রয়োজনের অতিরিক্ত সিমেন্ট ব্যবহার করিনি। এবং পরদিন ২৪ ফেব্রুয়ারি রবিবার গুদামের চাবি ঠিকই পিয়ারু সর্দারের হাতে পৌঁছে দেওয়া হয়।
এমন আরো কিছু বিচিত্র ঘটনা একুশের কারিগরদের স্মৃতিতে এখনো সজীব। মাত্র দিন দশের আন্দোলন। এর মধ্যে অনেক ছোটখাটো ঘটনা একুশের আন্দোলনকে বৈচিত্র্যে ভরে তুলেছে। তার কিছু যেমন মজার, তেমনি কিছু অবিশ্বাস্য। আন্দোলন উপলক্ষে ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে আবদ্ধ রাজবন্দিরা কি কখনো ভাবতে পেরেছেন যে জেলে বসে তাঁরা ঢাকাই আতিথ্য পাবেন? কেক-পাউরুটি-বিরিয়ানির আস্বাদ নিতে পারবেন? পারবেন পুরনো কমিউনিস্ট রাজবন্দিরাও? দেখেশুনে শেষোক্তরা ছিলেন অভিভূত।
ছাত্রবন্ধু আলী আছগর কি কখনো ভাবতে পেরেছিল যে খবর হরকরার দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে পুরান ঢাকার তস্যগলিপথের ভুলে ঢাকাইয়া অন্দরমহলে ঢুকে পড়ে অক্ষত শরীরে বেরিয়ে আসতে পারবে? পারবে ঢাকাই গৃহবধূর দরদি সহযোগিতায়? সে কাহিনি রীতিমতো রোমাঞ্চকর। তেমনি আমরা কি ভাবতে পেরেছি যে মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের সুইপার, পাকিস্তান মেডিক্যাল কোরের পাঠান কর্নেল আফ্রিদির মতো অবাঙালি আন্দোলনরত মেডিক্যাল ছাত্রদের সস্নেহ সহানুভূতিতে দেখবেন। গুলিবর্ষণের ঘটনায় উদ্বিগ্ন কর্নেল আফ্রিদি সরজমিনে অবস্থা দেখতে ব্যারাকে এসে ‘তাজ্জব কা বাত’ বলে স্বগতোক্তি করবেন কিংবা এমন মন্তব্য করবেন যে ছাত্রদের উচ্ছৃঙ্খলতার জন্য গুলি চালানো হয়েছে বলে যে রিপোর্ট তা তাঁর কাছে বিশ্বাসযোগ্য মনে হচ্ছে না। হোস্টেলের ভেতরে গুলির ঘটনায় অবাক হয়েছিলেন কর্নেল আফ্রিদি।
শুধু তা-ই নয়, মেডিক্যাল হোস্টেলের কন্ট্রোল রুম থেকে ২২ ফেব্রুয়ারি পুলিশ ও সেনা-জওয়ানদের মাইক ছিনিয়ে নিয়ে যাওয়ার পর ছাত্ররা কর্নেল আফ্রিদির কাছে ওই অন্যায়ের প্রতিকারের জন্য আবেদন জানানোর পর তিনি মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিন ও প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের সঙ্গে যোগাযোগ করে কয়েক দিনের মধ্যেই মাইক ফেরত আনার ব্যবস্থা করেন। এ মাইক ছিল আমাদের কলেজ ছাত্র সংসদের। সত্যি বলতে কি, আমাদের ছাত্রবন্ধুরা অবাক হয়েছিল হাসপাতাল সুপার কর্নেল আফ্রিদির এমন হৃদয়তায়।
একুশের ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত এমন বহু ঘটনা—সাদামাটা বা চমকপ্রদ, আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী অনেকেরই ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার ফসল, যা আন্দোলনের ইতিহাসে স্থান পায়নি, পাওয়ার কথাও নয়। কিন্তু এসব ঘটনা বা কাহিনি পাঠকের জন্য চিত্তাকর্ষক হতে পারে বলে এগুলো সংগ্রহ করে গ্রন্থাগারে প্রকাশের ব্যবস্থা নেওয়া হলে অন্তত আন্দোলনের কিছু পার্শ্বচিত্রের দেখা মিলত এবং তা পাঠকের জন্য উপভোগ্যও হতে পারত। একুশের ইতিহাসও তাতে সমৃদ্ধ হতো। কিন্তু সময় চলে যাচ্ছে, তা সত্ত্বেও এ পর্যন্ত কেউ এ কাজে হাল ধরেননি। ধরবেন বলেও মনে হচ্ছে না।
প্রসঙ্গত বলি, মুক্তিযুদ্ধের দলিলপত্র যেমন বহু খণ্ডে লেখা হয়েছে, ততটা না হলেও ভাষা আন্দোলনের ঐতিহাসিক দলিলপত্রও তেমনি বেশ কয়েক খণ্ডে সংবলিত হওয়ার দাবি রাখে। এবং সেই সঙ্গে এর বহুমাত্রিক ইতিহাস, যা বর্তমান প্রজন্মের জন্য খুবই জরুরি। এ প্রয়োজনীয়তা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে।
কারণ তারা ভাষা আন্দোলন, বিশেষ করে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসই জানবে না, বরং সে ইতিহাসের সামাজিক-রাষ্ট্রনৈতিক বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। তা ছাড়া এ ধরনের ইতিহাস জাতির জন্য ঐতিহ্য সৃষ্টির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে।
আমরা চাই, ইতিহাসবিদরা ভাষা আন্দোলনের বিস্তারিত দলিলপত্র ও ইতিহাস সংকলন ও রচনার ক্ষেত্রে যথাযথ ভূমিকা পালন করে জাতির কৃতজ্ঞতাভাজন হবেন।
কবি, গবেষক ও ভাষাসংগ্রামী