অভাবে অসহায় মানুষ তীব্র হচ্ছে ঋণের ফাঁদ
Advertisements

বাংলাদেশে ঋণগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। আর এই ঋণের টাকা পরিশোধ না করতে পেরে আত্মহত্যার সংখ্যাও উদ্বেগজনক। বিশ্লেষকেরা বলছেন, করোনার অভিঘাতের পর এখন সংসার চালাতে মানুষকে এখন ঋণ করতে হচ্ছে। ফলে তারা ঋণের ফাঁদে পড়ছেন। তারই দুঃখজন প্রতিক্রিয়া এখন দেখা যাচ্ছে।

এই ঋণের ফাঁদে শুধু নিম্নবিত্ত নয়, নিম্ন মধ্যবিত্ত এবং মধ্যবিত্তরাও আটকা পড়ে যাচ্ছে। প্রচলিত ব্যাংকের সুদ হার কম হলেও সেখান থেকে ঋণ পাওয়া সহজ নয়। ফলে তার উচ্চ সূদ হারে অপ্রচলিত, ব্যক্তিখাত এবং এনজিও থেকে ঋণ নিচ্ছেন। ওই ঋণের সুদ আর কিস্তি পরিশোধ করতে গিয়ে এখন তারা দিশেহারা।

ঋণ শোধ করতে না পেরে আত্মহত্যা

গত রোববার ঋণের টাকা শোধ করতে না পেরে নাটোরের লালপুরে আল আমিন নামে একজন আত্মহত্যা করেন। স্থানীয়রা জানিয়েছেন, অর্থাভাবে সংসার চালাতে তিনি কয়েকজনের কাছ থেকে চড়া সুদে ঋণ নিয়েছিলেন। কিস্তি ও সুদ পরিশোধে ব্যর্থ হয়ে চাপের মুখে তিনি আত্মহত্যা করেন। একই দিনে নওগাঁর মহাদেবপুরে আত্মহত্যা করেন নিমাই পাহান নামে এক আদিবাসী যুবক। তিনি স্থানীয় এক সুদের কারবারির কাছ থেকে সংসার চালাতে ১২ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছিলেন প্রতি সপ্তাহে এক হাজার ২০০ টাকা সুদ দেয়ার শর্তে। ওই টাকা শোধ করতে গিয়ে তিনি আবার স্থানীয় একটি এনজিও থেকে ঋণ নেন। এভাবে তিনি ঋণের চক্রে পড়ে আত্মহত্যা করতে বাধ্য হন বলে জানা গেছে।

এর আগে ২৬ আগস্ট রাতে নাটোরেরই বনপাড়ায় ঋণের টাকা শোধ করতে না পেরে আত্মহত্যা করেন ফারুক হোসেন। তার স্ত্রী আমেনা খাতুনও একদিন আগে একই কারণে বিষপানে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। হাসপাতালে নেয়ার পর তিনি মারা যান। তারা ১০ লাখ টাকার ঋণের ফাঁদে জড়িয়ে পড়েছিলেন।

গত ৬ আগস্ট নাটোরের বড়াইগ্রামের শরীফুল ইসলাম সোহেল আত্মহত্যা করেন। তিনি ব্যবসা করার জন্য বিভিন্ন ব্যক্তি এবং এনজিওর কাছ থেকে মোট ৩৮ লাখ টাকা ঋণ নিয়েছিলেন। মোবাইল ফোন ব্যবসায় এই অর্থ বিনিয়োগ করেছিলেন। কিন্তু যা ব্যবসা হতো তার চেয়ে সুদের হার অনেক বেশি। শেষ পর্যন্ত সুদ ও কিস্তির টাকা পরিশোধে ব্যর্থ হন। সংসার চালানোও অসম্ভব হয়ে পড়েছিলো তার।

গত ৭ জুলাই সাভারের আশুলিয়ায় আত্মহত্যা করেন ভাতের হোটেল ব্যবসায়ী হারুন মিয়া। করোনার সময় তার হোটেল ব্যবসায় ধ্বস নামলে তিনি ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েন। কিন্তু সেই ঋণ ও সুদের টাকা তিনি আর শোধ করতে না পেরে অপমানের শিকার হচ্ছিলেন।

বাংলাদেশে এখন ঋণ শোধ করতে না পেরে এভাবে আত্মহত্যার ঘটনা প্রায়ই ঘটছে। আর প্রতিটি ঘটনার পিছনেই আছে উচ্চ সুদ হারের ঋণ। এর সঙ্গে আগের মত কাজ না পাওয়া। করোনার সময় অর্থনৈতিক সংকট আর এখন নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের দামের ঊর্ধ্বগতিতে নিম্ন এবং সীমিত আয়ের মানুষ দিশেহারা হয়ে পড়ছেন। তারা ঋণ করে পরিস্থিতি সামাল দেয়ার চেষ্টা করছেন। কিন্তু ঋণের উচ্চ সুদ হার তাদের ঋণের ফাঁদে জড়িয়ে ফেলছে।

ঋণের জাল

ঢাকার রিকশা চালক হাসিবুর রহমান তিনটি এনজিও থেকে ঋণ নিয়েছেন এক লাখ ৯ হাজার টাকা। চারজনের সংসার। রিকশা চালিয়ে তার মাসে আয় হয় ১৫-২০ হাজার টাকা। কিন্তু প্রতি সপ্তাহে কিস্তি শোধ করতে হয় তিন হাজার টাকা। তিনি বলেন,” আমার আয়ের টাকা কিস্তি শোধ করতেই চলে যায়। সংসার চালানো কঠিন হওয়া হয়ে পড়েছে।”

তিনি বলেন,ওই ঋণের টাকায় তিনি একটি রিকশা কিনেছেন, বাকি টাকা সংসারে খরচ করেছেন। তার কথায়,”করোনার সময় ঋণের টাকায় চলেছি। এখন আবার বিকাল তিনটার পর রিকশা যাত্রী পাওয়া যায় না। আয় কমে গেছে। জিনিসপত্রের দাম অনেক বেশি। আরো ঋণ দরকার। কিন্তু এখন বন্ধু বান্ধবের কাছ থেকে যে ধার করব তারও সাহস পাচ্ছি না। শোধ করব কীভাবে?”

আশুলিয়ার পোশাক কর্মী আব্দুল খালেক করোনার সময় চাকরি হারান। তার স্ত্রীও পোশাক কারখানায় কাজ করতেন, তারও চাকরি চলে গেছে। খালেক এখন আশুলিয়া বাজারে রাস্তার পাশে কলা বিক্রি করেন। আর তার স্ত্রী একটি হোটেলে ধোয়া মোছার কাজ করেন। তারা দুই জন মিলে দিনে ৫০০ টাকা আয় করেন। খালেক বলেন,”এখন যে আয় তা দিয়ে আমাদের সংসার কোনো মতে চলে যাচ্ছে। কিন্তু কাজ হারানোর পর বিভিন্ন লোকজনের কাছ থেকে কমপক্ষে এক লাখ টাকা ধার করেছি। তা এখনো শোধ করতে পারিনি। পাওনাদাররা প্রতিদিনই লজ্জা দেয়। কী করব ভেবে পাই না। জিনিসপত্রের দাম যা বাড়ছে তাতে আর মাস শেষে টাকা থাকে না।”

দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের সাধারন মানুষ ঋণ চক্রে জড়িয়ে পড়ছেন। তারা ঋণ তো শোধ করতে পারছেনই না, উল্টো ঋণের বোঝা বাড়ছে।

কুড়িগ্রামের সাংবাদিক আরিফুল ইসলাম জানান,”এনজিও এবং সুদি মহাজন দুই পক্ষেরই সুদের ফাঁদে পড়ছে সাধারণ মানুষ। তারা এই ফাঁদ থেকে বের হতে পারছেন না। ঋণের টাকা না দিতে পারায় অনেকে জেলেও যাচ্ছেন। মানুষ মূলত সংসার চালাতেই এই ঋণ নিচ্ছেন। প্রচলিত ব্যাংক থেকে নানা শর্তের কারণে তারা ঋণ পান না। এনজিও এবং সুদের কারবারিরা ব্যাংক চেক রেখে বিপরীতে ঋণ দেয়। ফলে সাধারণ মানুষ সেদিকেই ঝুঁকছে।”

তার কথা,”এনজিওগুলো বছরে শতকরা ১৪ ভাগ সুদ নেয়। কিন্তু সুদ আসল হিসেব করে প্রতি সপ্তাহে কিস্তি দিতে হয়। ফলে ওই টাকার ওপরে চক্রবৃদ্ধি হারে সুদ আসে। তারা ওই টাকা তেমন কাজে লাগাতে পারেন না। উল্টো ওই টাকা শোধ করতে আরেকটি এনজিও থেকে ঋণ নিতে বাধ্য হন। আর সুদের কারবারিরা অবিশ্বাস্য হারে সুদ নেন। কেউ কেউ ১০০ টাকায় মাসে ১০ টাকা সুদ নেন। ফলে একবার ঋণ নিলে আর বের হতে পারেন না। ভিটেমাটিও বিক্রি করতে হয়।”

মোংলা উপজেলার সাংবাদিক আবুল হাসান জানান,” করোনায় সময় সাধারণ মানুষ আগের নেয়া ঋণ শোধ করতে পারেননি। এখন আবার নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বেড়ে গেছে। যারা ক্ষুদ্র ব্যবসা করতেন তারা ব্যবসা হারিয়েছেন। আয় বাড়ছে না। ফলে নতুন করে ঋণ নিতে হচ্ছে। আগের ঋণ আর নতুন ঋণ মিলিয়ে মানুষ অসহায় অবস্থার মধ্যে পড়েছে।”

তিনি জানান,”এই অবস্থায় সুদের কারবারিরা সুযোগ বুঝে সুদের হারও বাড়িয়ে দিচ্ছে। আর ওই কারবারিরা প্রয়োজনে টাকা আদায়ে পেশি শক্তি ব্যবহার করছে। জমিজমা লিখে নিচ্ছে।”

পিরোজপুরের মিজানুর রহমান মিজু জানান,” সুদের কারবারিরা কৌশলে আসল আর সুদ এক সঙ্গে মিলিয়ে টাকা ধার হিসেবে স্ট্যাম্পে লিখে নেন। সেখানে সুদের কথা থাকে না। আর সেটা শোধ করতে না পারলে একইভাবে নতুন স্ট্যাম্পে লিখে নেন। ফলে প্রভাবশালী সুদের কারবারিদের বিরুদ্ধে কিছু করার থাকে না।”


পরিস্থিতি কোন দিকে যাচ্ছে?

ইউএনডিপির বাংলাদেশের কান্ট্রি ইকোনমিস্ট ড. নাজনীন আহমেদ মনে করেন,” যারা ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন তারা করোনার অভিঘাত সামলে উঠতে পারেননি। নতুন করে দ্রব্যমূল্যের চাপ তাদের আরো বিপর্যন্ত করে তুলেছে। যার ফলে এর নানা প্রতিক্রিয়া হচ্ছে। এরা দারিদ্র্য সীমার ঠিক উপরে ছিলেন। ফলে করোনার সময় সহায়তাও পাননি, মানুষের কাছে হাতও পাততে পারেননি। কিন্তু তাদের জন্য যদি এখন সহায়তা কর্মসূচি না নেয়া হয় তাহলে তারা টিকে থাকতে পারবেন না। দারিদ্র্য সীমার নিচে চলে যাবেন।”

তার মতে,”মূল্যস্ফীতির চাপ আরো একটি আশঙ্কা তৈরি করেছে। যারা নিম্ন মধ্যবিত্ত তারা কিন্তু চাপে আছেন। তারাও ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ছেন। তাদের জন্যও যদি সহায়তামূলক কর্মসূচি না নেয়া হয় তাহলে তারাও দারিদ্র্য সীমার নিচে চলে যাবেন।”

সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের(সানেম) নির্বাহী পরিচালক এবং ঢাকা বিশ্বিবিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. সেলিম রায়হান বলেন,” সাধারণ মানুষের ঋণগ্রস্ততা নিয়ে আমরা উদ্বেগজনক খবর পাচ্ছি। করোনার সময় দারিদ্র্যের উল্লম্ফন হয়েছে। মানুষ ব্যক্তিগত পর্যায় ছাড়াও বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক এবং অপ্রাতিষ্ঠানিক উৎস থেকে ঋণ নিয়েছে। কিন্তু করোনা থেকে রিকভারি স্টেজে আবার এখন দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি তাদের বিপর্যস্ত করে তুলেছে। আগের ঋণ শোধ করতে পারছেনা। নতুন করে ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ছে।”

তার কথা,”মানুষকে এই ঋণ থেকে বের করে আনতে সরকারের উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন। সরকারের সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিতে তাদের অন্তর্ভূক্ত করতে হবে। নয়তো তারা দরিদ্র সীমার নিচে চলে যেতে পারেন। দুঃখজনক পরিস্থিতি আরো বাড়তে পারে।”

প্রসঙ্গত, বাংলাদেশে করোনার কারনে তিন কোটি মানুষ নতুন করে দরিদ্র হয়েছেন। আর গত জুন মাসে পিপিআরসি এবং ব্র্যাক এক যৌথ গবেষণায় বলা হয়েছে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারনে নতুন করে আরো ২১ লাথ মানুষ দরিদ্র হয়েছেন।

সূত্রঃ ডিডব্লিউ

Advertisements