বিএনপি ও জামায়েতে ইসলামীর ডাকা টানা তিন দিনের অবরোধের প্রথম দিন মঙ্গলবার সকালে ঢাকার রাস্তায় প্রায় সব ধরনের গাড়ির সংখ্যা কম লক্ষ্য করা গেছে। দূরপাল্লার কোনো বাস ছেড়ে যায়নি গাবতলী থেকে।
মঙ্গলবার সকাল থেকে ঢাকায় যানবাহনের সংখ্যা খুব একটা দেখা যায়নি, ছিল না চিরচেনা যানজটও।
সকাল সাড়ে ৯টা পর্যন্ত ঢাকার মহাখালী, বনানী, গুলশান, মিরপুর, আদাবর, শ্যামলী, মোহাম্মদপুর, গ্রিন রোড, তেজগাঁও, বিজয় সরণী, ফার্মগেট, নাবিস্কো, পান্থপথ, কলাবাগান, লালমাটিয়া, ধানমন্ডি, সংসদভবনসহ বিভিন্ন এলাকা ঘুরে সীমিত সংখ্যক যাত্রীবাহী বাস, মালবাহী ট্রাক, পিকআপ ভ্যান চলাচল করতে দেখা গেছে।
তুলনামূলকভাবে মিরপুরসহ যেসব এলাকায় তৈরি পোশাক কারখানা রয়েছে, সেসব এলাকায় রাস্তায় মানুষজন এবং যানবাহনের সংখ্যা বেশি দেখা গেছে।
যদিও পুরো শহরেই ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা ছিল কম।
রাস্তায় রিকশা ও সিএনজিচালিত অটোরিকশার সংখ্যা ছিল স্বাভাবিক দিনের মতোই।
তবে বেলা বাড়ার সাথে সাথে রাস্তায় যানবাহনের সংখ্যা বাড়তে দেখা যাচ্ছে।
এছাড়া অবরোধের মধ্যে ঢাকার কমলাপুর রেল স্টেশনে স্বাভাবিক দিনের মতোই ট্রেন চলাচল করতে দেখা গেছে।
যদিও স্টেশনে যাত্রীদের সংখ্যা স্বাভাবিক দিনের চেয়ে কম লক্ষ্য করা গেছে।
দূরপাল্লার যান চলাচল বন্ধ
মঙ্গলবার সকাল থেকে ঢাকার গাবতলী এবং সায়েদাবাদ বাস টার্মিনাল থেকে দূরপাল্লার কোনো বাস ছাড়তে দেখা যায়নি। তবে টার্মিনালে বাসের টিকেট কাউন্টারগুলো খোলা ছিল।
গাবতলী থেকে উত্তরবঙ্গের ২৬টি জেলা এবং দক্ষিণবঙ্গের ২২টি জেলায় প্রতিদিন কমপক্ষে ১২০০ বাস চলাচল করে বলে জানিয়েছে টার্মিনাল কর্তৃপক্ষ।
কিন্তু অবরোধের কারণে পর্যাপ্ত সংখ্যক যাত্রী না পাওয়ায় দূরপাল্লার বাসগুলো ছাড়া যাচ্ছে না বলে জানিয়েছেন বাসের টিকেট বিক্রেতারা।
সায়েদাবাদের অবস্থাও একই রকম বলে জানিয়েছেন পরিবহন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী এবং কর্মীরা।
সদরঘাটে অধিকাংশই লঞ্চই নোঙর করা
নৌ-পরিবহনের ক্ষেত্রেও কিছুটা স্থবিরতা লক্ষ্য করা গেছে। মঙ্গলবার সকালে সদরঘাটে অধিকাংশই লঞ্চই ছিল নোঙর করা।
কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, অবরোধের প্রথমদিন সকালে ঢাকার সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালের অধিকাংশ লঞ্চই ঢাকা ছেড়ে যায়নি।
যাত্রী না থাকায় লঞ্চ ছাড়া হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন তারা।
তবে ভোরের দিকে অল্প কয়েকটি লঞ্চ বিভিন্ন গন্তব্যের উদ্দেশ্যে সদরঘাট ছেড়েছে বলে জানানো হয়েছে।
র্যাব-পুলিশের সতর্ক অবস্থান
ঢাকার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মোড় এবং প্রবেশপথগুলোতে পুলিশের সতর্ক অবস্থান লক্ষ্য করা গেছে।
এর মধ্যে গুলশান চেকপোস্টে মোটর সাইকেল, গাড়ি এবং সাধারণ মানুষের ব্যাগে তল্লাশি চালাতে দেখা গেছে।
এছাড়া প্রধান সড়কগুলোর পাশাপাশি বিভিন্ন এলাকায় র্যাব ও পুলিশের বেশ কয়েকটি দলের টহল চোখে পড়েছে।
আওয়ামী লীগের শান্তি মিছিল, বিএনপির অনুপস্থিতি
ঢাকার বিভিন্ন পয়েন্টে সরকারি দল আওয়ামী লীগ শান্তি মিছিল করেছে। মিছিলে নেতাকর্মীদের বিএনপি এবং হরতাল-অবরোধ বিরোধী স্লোগান দিতে দেখা গেছে।
এর মধ্যে সকাল সাড়ে ১০টার দিকে ঢাকার গাবতলীতে শান্তি মিছিল করেছে সরকারি দলের নেতাকর্মীরা।
সকাল ১০টার দিকে আশপাশের বিভিন্ন এলাকা থেকে ছোট ছোট মিছিল নিয়ে গাবতলী মোড়ে আসতে থাকে দলটির নেতাকর্মীরা।
তবে এখনো পর্যন্ত বিএনপির কোনো ঝটিকা মিছিল বা এ ধরণের কোনো তৎপরতা দেখা যায়নি।
এদিকে বিএনপির সাথে অবরোধ ডাকা জামায়াত ঢাকার মহাখালি এবং উত্তরায় ঝটিকা মিছিল করেছে এমন দাবি করে নিজেদের সামাজিক মাধ্যমে পোস্ট দিয়েছে।
গাজীপুর এবং চট্টগ্রামে বাসে আগুন
অবরোধের আগের রাতে অর্থাৎ সোমবার গাজীপুর সিটি করপোরেশন এবং শ্রীপুর উপজেলায় দু’টি বাসে আগুন দেয়ার খবর পাওয়া গেছে।
তবে এসব ঘটনায় এখন পর্যন্ত কারো হতাহত হওয়ার খবর পাওয়া যায়নি।
এছাড়া মঙ্গলবার ভোরে চট্টগ্রাম নগরীর ইপিজেড থানার সল্টগুলা ক্রসিং এলাকায় একটি বাসে আগুন দেয়া হয় বলে নিশ্চিত করেছে ফায়ার সার্ভিস।
এর আগে সোমবার রাতে নগরীর দামপাড়া ও বালুচরা ট্যানারি বটতলা এলাকায় আরো দু’টি বাসে আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটে।
অবরোধ কেন ডাকা হলো?
শনিবার বিএনপির সমাবেশে ‘হামলা, হত্যা, গ্রেফতারের প্রতিবাদে’ এবং সরকার পতনের একদফা দাবি আদায়ে ৩১ অক্টোবর, ১ ও ২ নভেম্বর তিন দিনের এই অবরোধ কর্মসূচি দেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে বিএনপি।
গত রোববার দলটির সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবীর রিজভী আহমেদ টানা তিন দিনের এই অবরোধ কর্মসূচি ঘোষণা করেন।
বিএনপি বলছে, গত পাঁচ দিনে সারাদেশে বিএনপির দুই হাজার ছয় শ’ নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। মামলা হয়েছে ৪৫টি।
আর গত ২৮ জুলাই থেকে এখন পর্যন্ত সারাদেশে দলটির নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে ৪৪২টি। যেখানে গ্রেফতারের সংখ্যা পাঁচ হাজার ছাড়িয়েছে।
বিএনপি বলছে, তাদের ভাষায় এসব গ্রেফতার, নির্যাতনের অবসান এবং সরকার পতনের দাবি আদায়ের জন্যই তাদের অবরোধের নতুন কর্মসূচি।
অবরোধের অতীত অভিজ্ঞতা যা বলছে
বিএনপির জন্য অবরোধ কর্মসূচি নতুন নয়। এর আগেও দলটি একটানা অবরোধ কর্মসূচি পালন করেছে। তবে সেটি এখন থেকে আট বছরেরও বেশি আগে।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জন করার পর ২০১৫ সালে ওই নির্বাচনের প্রথম বর্ষপূর্তিতে টানা তিন মাস হরতাল-অবরোধ পালন করে দলটি৷
সে সময় মূলত অবরোধের ঘোষণা দেয়ার পর এক পর্যায়ে এর সাথে হরতালকেও যুক্ত করে দলটি।
ওই হরতাল-অবরোধ এক পর্যায়ে সহিংস রূপ নেয়। একের পর এক বাসে আগুন ও পেট্রোল বোমা নিক্ষেপের মতো ঘটনায় বহু মানুষ হতাহত হলে ব্যাপক সমালোচনার সৃষ্টি হয়।
সরকার এসব ঘটনার জন্য বিএনপি-জামায়াত জোটকে দায়ী করলেও তারা অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে উল্টো সরকারকেই এর জন্য দায়ী করে আসছে।
তখন একটানা হরতাল অবরোধ চলতে থাকলে এক পর্যায়ে এটি তার কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলে। রাজপথেও অবরোধের সমর্থনে বিএনপি কিংবা ২০ দলীয় জোটের নেতাকর্মীদের আর দেখা যায়নি।
এক পর্যায়ে বিএনপি সেই কর্মসূচি স্থগিত করে। ২০১৫ সালের এপ্রিলে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া হরতাল-অবরোধ যুগপৎ কর্মসূচির অবসান ঘটান।
এর মাধ্যমেই বিএনপির অবরোধ কর্মসূচি শেষ হয়। এরপর দলটি আর অবরোধের কর্মসূচিতে যায়নি।
তবে এরপরও বিভিন্ন সময় বিএনপি হরতাল করেছে। সমাবেশ, লং মার্চও করেছে। যদিও দলটির পক্ষ থেকে বিভাগীয় সমাবেশ, অবস্থান কর্মসূচি এবং লং মার্চের দিকে বেশি আগ্রহ দেখা যায় সাম্প্রতিক দিনগুলোতে। অবরোধ এমন কি হরতাল থেকেই সরে এসেছিল দলটি।
রোববার বিএনপি ও সমমনা দলগুলো যে হরতাল পালন করেছে, সেটি ছিল তিন বছর আট মাস পর হরতালের মতো কোনো কর্মসূচি।
২০২০ সালের ২ ফেব্রুয়ারি যেটা দেয়া হয়েছিল। তখন ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ফলাফল প্রত্যাখ্যান করে ওই হরতাল ডেকেছিল বিএনপি।
সেই হরতাল নিয়েও অনেক আলোচনা হয়েছিল রাজনৈতিক অঙ্গনে। কারণ দলটি সেইবারও দীর্ঘ সময় পর হরতাল কর্মসূচির ডাক দিয়েছিল।
সূত্র : বিবিসি