অনন্য বাফুফে, অবহেলায় দর্শকরা
Advertisements

বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন তথা বাফুফের প্রতি আমার মুগ্ধতা বেশ পুরোনো। যখনই জীবন বেহুদা ঠেকে তখনই আমি পত্রিকা খুজে বাফুফে কর্তাদের বিভিন্ন সময়ে দেয়া বিচিত্র সব বয়ানের সাগরে ডুব দেই। ইয়াকিন মানুন, সেই সাগর এতই বর্ণিল এবং বিচিত্র যে সকল হতাশা ভুলে আপনি নতুন উদ্যোমে জীবন শুরুর তাগিদ অনুভব করবেন! একপাল কৌতুক অভিনেতা যদি দেশের ফুটবলের হর্তা কর্তা হয়ে বসে আত্মশ্লাঘায় ভুগতে পারেন, মিডিয়া কভারেজ পেতে পারেন, ফিফার অন্দরে গিয়ে গুরগম্ভির আলোচনায় শরিক হতে পারেন; একবার ভেবে দেখুন ত আপনি আমি কি নিয়ে হতাশায় ভুগছি?

নেপাল বাংলাদেশ দুই ম্যাচের সিরিজ হয়ে গেলো। যখনই শুনলাম যে দর্শক সমেত এই আয়োজনের পরিকল্পনা চলছে তখনই বিষম খেয়েছিলাম। দীর্ঘ দিনে অভিজ্ঞতা থেকে জানি, বাফুফে যা বলে তা করে না এবং যা করে তা বলে না। তাই যখন করোনাকালিন স্বাস্থ্যবিধি মেনে হাজার সাতেক দর্শক নিয়ে ম্যাচ আয়োজনের ঘোষনা শুনলাম বেশ কৌতুক অনুভব করেছি। সে কৌতুকে শামিল হতেই ছুটে গিয়েছিলাম মাঠে। ইয়াকিন মানুন, আমাকে সঠিক সাবুদে বাফুফে সামান্য কসুর করেনি। স্বাস্থ্যবিধিকে বৃদ্ধাঙুলি দেখিয়ে সংখ্যা গণনার নয়া পদ্ধতি শিখিয়েই আয়োজনের ইতি টেনেছে তারা।

নিজ তাগিদেই মাস্ক মুখে প্রবেশ পথে পা রেখেই বুঝেছি স্বাস্থ্যবিধির বেইজ্জতি আসন্ন। খেলা শুরুর সময় পার হয়ে যাবার পরেও গেট আগলে বসে আছেন বাফুফের প্রতিনিধি। ঐদিকে বাড়ছে দর্শকের ভিড়। শেষে যা রুপ নিলো ঠেলা ধাক্কায়। মাস্ক মুখে একে অপরের উপর যে ভাবে হুমড়ি খেয়ে পরছিলো তাতে করোনা শরমে মুখ লুকিয়েছে কি না অধমের জানা নাই। রীতিমত যুদ্ধ করে শেষ পর্যন্ত যখন মাঠে ঢুকতে পারলাম ততক্ষণে ১০-১৫ মিনিট শেষ! বাফুফের আয়োজন আর তাতে ঠিক সময়ে মাঠে ঢুকতে পারার ভাবনাও যে পাপ তা জানা থাকায় সে অর্থে কষ্ট পাইনি।

এবার মজার দ্বীতিয় পর্ব। স্বাস্থ্যবিধি মোতাবেক নিরাপদ দুরত্ব রক্ষায় নাকি চক কেটে জায়গা নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছিলো! বাফুফের কর্তারা প্রায়শই বাস্তব আর খোয়াব মিলিয়ে ফেলে এক বিদঘুটে খিচুড়ি পাকান। এখানেও তাই। দাগের কোনো অস্তিত্বও নেই। নেই কোনো বিধি নিষেধ। যার ফলে সবাই গায়ে গা লাগিয়ে, মাস্ক থুতনিতে দিয়ে করোনা ঠেকিয়েই খেলা দেখেছেন! খেলা দেখেছেন বলাটা বোধয় ঠিক হলো না। কেননা যতটা না খেলা দেখা গিয়েছে তারচেয়ে বেশি দেখতে হয়েছে হকারের মুখ!

আপনি যদি বাফুফেকে জেনে থাকেন তবে বিস্মিত হবার কোনো কারণ নেই। ৯০ মিনিটের খেলায় দর্শকদের পানাহারের বন্দোবস্তের জন্য মাঠে ছিলো শ খানেক হকার। চিপস, বাদাম, পানি ত ছিলোই বাফুফে কসুর করেনি সুখটানের বন্দোবস্ত করতেও। প্রকাশ্য মাঠেই অবলীলায় চলেছে বিড়ি সিগারেট বিক্রি! এরুপ আপ্যায়ন বাফুফে বৈ কারোর পক্ষেই সম্ভব না। হকার সব মাঠে সব খেলাতেই থাকে। তবে বাফুফীয় হকাররা কর্তার ন্যায় কর্মে অনন্য। প্রতি মিনিটে দর্শকদের সামনে গিয়ে যে রুপ প্রতিবন্ধকতা তারা তৈয়ার করছিলো তাতে মুগ্ধ হয়ে একজন শেষ পর্যন্ত বিষই চেয়ে বসলেন!

এসব সহ্য করে হাসিমুখেই খেলা দেখে গিয়েছেন দর্শকরা। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছিলো মাঠে ঢুকে যেন বড় পাপ করে ফেলেছেন। স্কোর বোর্ড নাকি ছিলো একটা। কোথায় ছিলো খোদা মালুম। অধমের দু চোখ বহু কসরতের পরেও তার হদিস পায়নি। ফুটবল খেলায় সময় একটি বড় বিষয়। সেটিও এমন জায়গায় সেটা হয়েছে যা আগে থেকে জানা না থাকলে খুজে পাবার কোনো সম্ভাবনা নাই। আধুনিক জামানায় জায়ান্ট স্ক্রিন সকল মাঠেই অন্যতম অনুসঙ। সেটি বাফুফের একটি আছে বটে। তাতেও অনন্যতা রয়েছে। অন্যসকল দেশের জায়ান্ট স্ক্রিনে যেখানে খেলা দেখা যায় বাফুফে সেটিতে নেপাল বাংলাদেশ ম্যাচের বয়ান লিখে রেখেছে!

গ্যালারিতে যাবার পথে স্তুপ করে রাখা ময়লা কি বাফুফের অন্দরের প্রতীকি রূপ কি না তা অবশ্য আমার জানা নাই। তবে এটুকু নিশ্চিত করে বলতে পারি, আন্তর্জাতিক ম্যাচ হচ্ছে এমন কোনো মাঠে আপনি আর যাই হোক ময়লার স্তুপ দেখতে পাবেন না যদি না এর আয়োজক হয় এক এবং অদ্বীতিয় বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন। এত সবের ভীড়ে সাউন্ড সিস্টেমের কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। বেশ কবার কিছু শব্দ কানে এসেছে বটে তবে তা এতই পরিষ্কার ছিলো যে কয়েজনকে জিজ্ঞাস করেও মর্ম উদ্ধার করতে পারি নাই!

শুরুতে গণনা পদ্ধতির বাফুফীয় আবিষ্কারের জিকর করেছিলাম, সেটিও একটু ব্যাখ্যা করি। ম্যাচের পূর্বে আনুষ্ঠানিক ভাবে জানানো হয়েছিলো করোনা মাথায় রেখে হাজার সাতেক টিকেট ছাড়া হবে দর্শকদের জন্য। যার মধ্যে পাচ হাজারের মত হবে সৌজন্য এবং বাকি দুই হাজার সাধারণ দর্শকদের জন্য। আপনি যদি এ দুটি ম্যাচ টিভিতে দেখে থাকেন তবে নিশ্চিত ভাবেই কবুল করবেন যে আর যাই হোক মাঠে সাত হাজার দর্শক ছিলো না। খোলা চোখেই বোঝা গিয়েছে কমপক্ষে হাজার দশেক মাঠে হাজির ছিলো প্রিয় দলকে সমর্থন জানাতে। বাফুফের ঘোষিত সাতের সাথে আরো তিন কোত্থেকে কি করে উদয় হলো তা আমাদের সাধারণ গণনা যারা জানেন তাদের জন্য চিন্তার বিষয় হতে পারে। কিন্তু আপনি যখন বাফুফের অংশ তখন চিন্তা বদলে যেতে বাধ্য। বাফুফে যেহেতু বলেছে সাত হাজার দর্শক থাকবে তাই সেটা বাস্তবে দশ হলেও বাফুফের কাছে সাতই ছিলো। যদি না থাকত তবে আমরা এ বিষয়ে বাফুফের একটি হলেও বয়ান পেতাম। সেটি না পাওয়াই ত বলে দেয় তারা সাতের বেশি দেখেনি!

মাঠে ঢুকার আগে শুনেছিলাম দর্শকদের শরীরের তাপমাত্রা মাপার বন্দোবস্তও নাকি বাফুফের তরফ থেকে করা হয়েছে। যদি কারো তাপমাত্রা ৯৯° এর বেশি হয় তবে তাকে মাঠে ঢুকতে দেয়া হবে না। দুটি ম্যাচেই আতিপাতি করে খুজেও এমন কিছু দেখিনি। না যন্ত্র না যন্ত্র হাতে কাউকে! কে যে কাকে মেপেছে আর কিই বা মেপেছে খোদা মালুম! এত সবের পরেও যদি আপনি বাফুফেকে অনন্য না মানেন তাহলে আপনি বড় বিপদে রয়েছেন।

কষ্টের কথাটা বলি। নব্বই দশকের পর থেকেই বাংলাদেশের ফুটবলে দর্শকদের জন্য হাহাকার দেখি এসেছি আমরা। সুলতান আমল শেষ হয়ে সালাউদ্দিনের দুই মেয়াদেও সে হালত বদলায়নি। এবার সম্পুর্ণ বিপরীত একটি দৃশ্য কিন্তু দেখা গিয়েছে। মাঠে দর্শক ছিলো। বহু বছরের মধ্যে কোনো নির্দিষ্ট খেলোয়াড়ের নামে স্লোগান দিয়েছেন দর্শকরা। এ সবই হয়েছে ফেসবুকের কিছু ফুটবল গ্রুপের উদ্যোগে এবং বাকিটা ফুটবল প্রেমী দর্শকদের নিজ উদ্যোগে। এমন একটি সময়ে বাফুফের আশ্চর্য নির্লিপ্ততা আমাদের আহত করে। দর্শকদের ত চাওয়া পাওয়ার কিছু নেই, তারা গিয়েছেন গাটের পয়সা খরচ করে, স্বেচ্ছায়। যেখানে সব জায়গায় দর্শকদের সর্বোচ্চ কদর করা হয় সেখানে বাফুফে যেন অদ্ভুত ব্যতিক্রম।

আমি বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের কঠোর সমালোচক। কিন্তু আর যাই হোক ক্রিকেট বোর্ড দর্শকদের সাথে এমন বিমাতা সূলভ আচরণ কিন্তু করে না। দর্শক প্রবেশ করানো থেকে বসার আসন, জায়ান্ট স্ক্রিন সবখানেই পেশাদারিত্বের ছাপ দেখেছি আমরা। দর্শক শুণ্যতায় ভোগার পরেও বাফুফের এই ব্যবহার ব্যাখ্যার দাবী রাখে। বাফুফের অনন্য স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণের খেসারত হিসাবে আমার পরিচিত একজন ম্যাচ শেষে করোনা পরীক্ষা করিয়ে পজেটিভ হয়ে শয্যাশায়ী! এর দায়টা কে নিবে? দুরত্ব নিশ্চিত করার বদলে যখন দর্শকদের মাঠে ঢোকার জন্য যুদ্ধ করতে বাধ্য করা হয় তখন ত এটি স্বাভাবিকই।

বড় জানতে ইচ্ছে করে, বাফুফে কি সত্যই মাঠে দর্শক চায়? নাকি বাকি সব কিছুর মত এটিও একটি ফাকাবুলি? যদি চাইতই তবে করোনার মাঝেও দলকে সমর্থন জানাতে যারা স্বেচ্ছায় মাঠে ছুটে গিয়েছিলো তাদের প্রতি এমন ব্যবহার ত সম্ভব না। সে জন্যই বাফুফের প্রতি আমার মুগ্ধতা কমে না। স্বীয় কর্ম দ্বারা বাফুফেও তা কখনো কমতে দেয় না!

লেখকঃ কবি; ক্রীড়া সম্পাদক, জবান।

Advertisements