ইসলামে আশুরা অর্থাৎ ১০ই মুহররমের যে মর্যাদা তার সাথে কারবালায় হুসাইন (রা.) এর শাহাদাত কিম্বা অপরাপর কোনও ঘটনার দূরতম কোনও সম্পর্ক নেই। দু’টি ব্যাপার সম্পূর্ণ আলাদা। তবে এ কথা সত্য যে, এই উম্মতের উপর নানাবিধ কারণে কারবালার একটা সুদূরপ্রসারী প্রভাব লক্ষ্য করা যায়।
এর কারণ হুসাইন (রা.) রাসুলের নাতি হবার সুবাদে উম্মতের তাঁর প্রতি বিদ্যমান ভালোবাসা। এর বাইরে ইসলামের দৃষ্টিতে হুসাইন (রা.) অন্যায় হত্যার শিকার হওয়া কিম্বা আপনার বা আমার অন্যায় হত্যার শিকার হওয়ায় কোনও তফাৎ নাই। কোরআনে সূরা মায়িদায় আল্লাহ্ যে কোনো অন্যায় হত্যাকে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ হিসেবে সাব্যস্ত করেছেন।
আদতে মৌলিকভাবে কারবালার ঘটনায় দু’টি বড়ো প্রশ্নের মুখোমুখি আমরা সকলেই হই। প্রথমত হুসাইন (রা.) এঁর ইয়াজিদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের প্রসঙ্গ এবং দ্বিতীয়ত ইয়াজিদের ব্যাপারে আমাদের মনোভাব কি হবে।
ইসলামী রাষ্ট্রনীতি অনুযায়ী, একজন খলিফা মৃত্যুর পূর্বে কাউকে নিজের পদের উত্তরসূরী হিসেবে মনোনয়ন দান করার অধিকার রাখেন- কিন্তু এই মনোয়ন তাঁর মৃত্যুর পর সেই ব্যাক্তিকে খেলাফতের জন্য কেবলমাত্র করা একটা প্রস্তাব এবং পরামর্শ হিসেবে বিবেচিত হয়।
যতক্ষণ না পর্যন্ত উম্মতের বেশিরভাগ অগ্রগণ্য, মান্য, প্রভাবশালী ও জ্ঞানী দায়িত্বশীল ব্যাক্তিবর্গ তাঁর আনুগত্য মেনে নিচ্ছেন ততক্ষণ পর্যন্ত সেই ব্যক্তি খলিফা নন।১
ইসলামী রাষ্ট্রনীতিতে আপনাপনি (By Default) কারো রাষ্ট্র নেতা হবার সুযোগ নাই। কেবলমাত্র তখনই তিনি রাষ্ট্রনেতা হবার অধিকার রাখেন, যখন অধিকাংশ দায়িত্বশীল তাঁর নেতৃত্বের প্রতি আনুগত্য পোষণ করে। ইয়াজিদের নেতৃত্ব সিরিয়াবাসী মেনে নিয়েছিলেন।
কিন্তু হিজাজবাসীরা (মক্কা, মদিনা, তাবুকসহ তৎসংলগ্ন অঞ্চল) ইয়াজিদের নেতৃত্ব মেনে নেয় নি। অপরদিকে ইরাকবাসীরা পত্র ও প্রতিনিধির বরাতে বার বার ঘোষণা করছিল তাঁরা হুসাইন (রা.) ব্যতীত অন্য কারো নেতৃত্ব মেনে নেবে না।২
আর হুসাইন (রা.) নিজেও ইয়াজিদের নেতৃত্বের প্রতি অনাস্থা জানিয়েছিলেন। কারণ ইয়াজিদ ছিল কঠোর চরিত্রের এবং দমনপ্রবণ। তাই হুসাইন (রা.) আশঙ্কা করছিলেন, যদি ইয়াজিদ তামাম উম্মতের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় সক্ষম হয়, তখন তিনিও তাঁর অনুগত থাকতে বাধ্য হবেন আর ইয়াজিদের কঠোরতার দরুণ উম্মত জুলুমের শিকার হতে পারে।ফলে তিনি চেয়েছিলেন, ইয়াজিদ উম্মতের অধিকাংশের আনুগত্য আদায়ের পূর্বেই ইয়াজিদকে নিরস্ত্র করতে। ফলত ইরাকবাসীর আহ্বানে সাড়া দিয়ে তিনি কুফার পথে রওয়ানা করেন। কিন্তু কুফার কাছাকাছি পৌঁছে তিনি বুঝতে পারেন, ইরাকবাসীরা তাঁর সঙ্গে প্রতারণা করেছে।
তিনি এও বুঝতে পারেন ইরাকবাসীরা ইয়াজিদের আনুগত্য মেনে নিয়েছে। ফলে তিনি সন্ধির প্রস্তাব রাখেন। সে সব প্রস্তাবের মাঝে এও ছিল যে, তিনি ইয়াজিদের আনুগত্য মেনে নিতে সম্মত আছেন।৩
কিন্তু ইরাকের প্রাদেশিক সরকারের প্রধান উবায়দুল্লাহ বিন জিয়াদ হুসাইন (রা.) এঁর কোনও প্রকার বক্তব্য শুনতে সম্মত ছিলেন না। তিনি ছিলেন রূঢ় স্বভাবের। তিনি নির্দেশ দিয়েছিলেন, বিনাশর্তে হুসাইন (রা.)কে তার সামনে উপস্থিত করতে।
কিন্তু সন্ধিবিহীন ও শর্তহীনভাবে সাক্ষাত নিজেকে মৃত্যুর কাছে সমর্পণেরই নামান্তর ছিল। সুতরাং তার কাছে উবায়দুল্লাহ বিন জিয়াদের সৈন্য দলের সাথে লড়াইবিহীন কোনও বিকল্প ছিল না। আর এভাবেই কারবালার সেই দুর্ভাগ্যজনক ঘটনার জন্ম হয়েছে।৪
হুসাইন (রা.) এঁর শাহাদাতের ঘটনায় ইয়াজিদের সম্পৃক্ততা বিষয়ে এবার আসা যাক। এ ব্যাপারে বহুধা বিভক্ত বর্ণনা পাওয়া যায়। আর ইতিহাস তার স্বভাবসুলভ রীতিতেই ত্রুটিপূর্ণ ও ভুল বর্ণনা থেকে মুক্ত নয়।
তবে যাই হোক, ইয়াজিদ ইবনে মোয়াবিয়ার ব্যাপারে এই উম্মত প্রধানত ৩টি ভাগে বিভক্ত :
১. যারা ইয়াজিদকে সত্য ও ন্যায়ের মাপকাঠিতে চূড়ান্ত উত্তীর্ণ মনে করেন। তারা ইয়াজিদের প্রতি ভালোবাসা পোষণ করেন। এরা নাওয়াসিবি হিসেবে চিহ্নিত। এরা সিরিয়ার একটা অংশের।
২. যারা ইয়াজিদকে মুরতাদ মনে করে। অভিসম্পাত করে। প্রবলভাবে ঘৃণা করে। এরা শিয়া সম্প্রদায়। তারা ইয়াজিদকে হুসাইন (রা.) এঁর হত্যা এবং নবী বংশধারা ধ্বংসের ষড়যন্ত্রকারী হিসেবে মনে করে।
৩. এরা হচ্ছে আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামা’আত। উম্মতের সেই হক্বপন্থীদল যারা মধ্যমপন্থার উপর প্রতিষ্ঠিত। তারা না ইয়াজিদের ব্যাপারে ভালোবাসা পোষণ করেন না শত্রুতা। বরং তারা এ ব্যাপারে চুপ থাকেন।
যেমন আবু আব্দুল্লাহ ইবনে তাইমিয়া বলেন, আমরা ইয়াজিদের ভালোগুণ অস্বীকার করি না আবার তা অতিরঞ্জিতও করি না।৫
আর ইমাম গাজ্জালি (র.) বলেন, ‘যেহেতু কোনও মুসলমানের পক্ষে যথাযথ প্রমাণবিহীন কাউকে হত্যাকারী বলা হারাম, তাই ইয়াজিদকে হুসাইন (রা.) এঁর হত্যাকারী কিম্বা হত্যার নির্দেশ প্রদানকারী হিসেবে বলা জায়েজ নয়।’৬
যেহেতু ইয়াজিদের হুসাইন (রা.) এঁর হত্যা প্রসঙ্গে সম্পৃক্ততার অকাট্য প্রমাণ পাওয়া যায় না, সুতরাং আমাদের উচিত হবে এ ব্যাপারে নীরব থাকা।
ইয়াজিদের ব্যাপারে যত মিথ্যে গল্প প্রচলিত আছে, সম্ভবত আর কারো ব্যাপারে এত মিথ্যে আরোপ করা হয় নি। তার ব্যাপারে মদ্যপান, সমকামিতার যে অপবাদ আছে তা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন ও মিথ্যা। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, তিনি যাবতীয় অন্যায় থেকে মুক্ত ছিলেন।
এ কথা ঠিক, তার দ্বারা ঘটিত জুলুমের ইতিহাসও বিদ্যমান আছে। সুতরাং সে যা মন্দ করেছে তার ফায়সালা আল্লাহ্র। তবে এ কথা অনস্বীকার্য যে, উমাইয়া এবং আব্বাসীয় এই দুই আমলেই তার মত স্বভাবের বহু খলিফা ছিলেন এবং তারচে মন্দও অনেকে ছিলেন। অন্যদিকে হুসাইন (রা.) এঁর আদর্শ ছিল উম্মতের কল্যাণকামীতা এবং উম্মতকে জুলুমের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য ত্যাগের শিক্ষা। সেই শিক্ষাটুকু ধারণ করলেই এই উম্মত এখনও বদলে যেতে পারে।
আমাদের মনে রাখা উচিত, ইতিহাসের বইয়ে যা লেখা থাকে তার সব সত্য নয়। আর তাছাড়া, একটা বিশেষ গোষ্ঠী কারবালার ইতিহাস বিকৃত করে উপস্থাপন করছে। অতীতের বহু বিজ্ঞ আলেমগণ কারবালা কিম্বা তৎসংক্রান্ত ঘটনা নিয়ে বিতর্কে না জড়াতে পরামর্শ দিয়েছেন। আমাদের বাড়াবাড়ির পথ পরিহার করা উচিত।
সহায়ক তথ্যসূত্র :
১. আহকাম আল-সুলতানিয়্যা, আবু ইয়ালা আল ফাররা
২. আল-কামিল ফিত-তারিখ, ইবনে আসীর
৩. তারিখ আল তাবারি, ৪র্থ খণ্ড, আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ইবনে কাসীর
৪. প্রাগুক্ত
৫. মাজমা’উল ফাতোয়া, ইবনে তাইমিয়া
৬. শরহে বাদ-আল-আমালি, মোল্লা আলী ক্বারী