আলী রীয়াজ আমেরিকার এক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং এক আমেরিকান থিংকট্যাংকের সিনিয়র ফেলো। ঢাকার আরেক প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের সাথে যৌথভাবে তিনি এক রচনা লিখেছেন প্রথম আলো পত্রিকায়। তারই তৃতীয় পর্বে যে লেখাটা ছাপা হয়েছে, এর শিরোনাম “রাজনীতিতে ধর্মের ফিরে আসা”।
রাজনীতিতে ধর্ম আসতে পারবে না বা ফিরে আসতে পারবে না ইত্যাদি এসব খুবই একঘেঁয়ে ধারণা, অতি ব্যবহারে জীর্ণ ফলে ক্লিশে [cliché] আর ভুল; এছাড়া সর্বোপরি বহু আগেই চ্যালেঞ্জ হয়ে যাওয়া এই ধারণা। এএসব কথা ন্যাগিং-এর পর্যায়ে পৌছানোয় তা আর নুন্যতম আগ্রহ তৈরি করে না। সিরিয়াস কোন আলোচনা এখান থেকে শুরু করা যায় না। এছাড়া কেন এই তর্ক কেউ তুলছে এর উদ্দেশ্য বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সৎ বা পরিস্কার রাখা হয় না। এছাড়া পলিটিক্যাল বায়াসনেস তো আছেই। যেমন যেই ভারতকে “সেকুলারিজমের পিতৃভুমি” হিসাবে তুলে ধরা হয়েছে এতদিন একে তুলনা করা হয়েছে এক বিশাল তুচ্ছতার চোখে যে কথিত ধর্মের ভিত্তিতে ভাগ হওয়া পাকিস্তান বা মুসলমানের বাংলাদেশ বলে – যেসব গর্বের ঠেলায় আমাদের প্রাণ যায় অবস্থা। অথচ “সেকুলারিজমের” নামে হাজির এই শক্তি মোদী বা আরএসএসের উত্থানে নির্বিকার। আবার মোদী তাদের ঘরের লোক এবং গ্লোবাল লিডারদের ক্ষমতার গুরুত্বপুর্ণ পার্টনার হয়ে উঠেছে। অথচ গুজরাট, দিল্লি কী উত্তরপ্রদেশের মুসলমানের রক্তে তার হাত রঞ্জিত হয়ে উঠেছে; এমন রাজ্যের সংখ্যা বাড়ছে তবু মোদীর রাজনীতি তাদের চোখে তেমন ‘ধর্মের রাজনীতি” নয়। এদের অনেকেই, “রাজনীতিতে ধর্ম না আনার” নীতিগত অবস্থানের লোক – এই বলে সাইনবোর্ড টাঙিয়ে ঘুরে বেড়ায়। সারকথায়, রাজনীতিতে ধর্ম না আনার” কথা যারাই তুলে তাদের উদ্দেশ্য এমনই গভীরভাবে অস্বচ্ছ থাকতে দেখা যায়। ফলে এদের কারণেই কোন সিরিয়াস আলোচনা সম্ভব হয় না। আর উদ্দেশ্য প্রশ্নবিদ্ধ থাকলে কোনদিকেই আগানো সম্ভব হবার কোন কারণ নাই। তবে সব জায়গায় দেখা যায় যে ইসলামি ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে যারা আসছে বা ইসলামিস্টরা খারাপ আর কথিত সেকুলারিস্টরা ভাল – এটাই একমাত্র এপ্রোচই।
এদিকে রাজনীতি আর ধর্মের সম্পর্ক নিয়ে যদি শুধু নাইন-ইলেভেনের পরই ধরি, তাতেও গত ২০ বছরে প্রচুর আলোচনা হয়েছে। একেবারে উল্টে-পাল্টে অনেক দিক থেকে দেখে আলোচনা সমালোচনা-পর্যালোচনা হয়েছে। কিন্তু এর কোনো প্রভাব এমন লেখকদের উপর পড়েছে তেমন মনে হয়নি। যেমন এখানে দেখে যাচ্ছে তিনি সত্তর দশকের মধ্যে থেকেই কথা শুরু করতে চেয়েছেন।
যেমন আলী রিয়াজ শুরুতেই লিখেছেন, “১৯৭২ সালে রচিত বাংলাদেশের সংবিধানে সেকুলারিজমকে একটা রাষ্ট্রীয় নীতি হিসেবে গ্রহণ করা হয়। বাংলায় একে বলা হয় ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ “। এর মানে, কথিত সেকুলারিজম একটা রাষ্ট্রীয় নীতি হিসাবে নেওয়ার বিষয়। কিন্তু এই অনুমানটাই ভিত্তিহীন। এছাড়া কেন এটাকে নীতি হিসাবে নিতেই হবে? আর কী উদ্দেশ্যে? ধর্মকে রাষ্ট্র থেকে কথিত আলাদা রাখতে হবে তাই? আবার পরিস্কার হয়ে কী তারা কথা বলছেন? যেমন, ব্যাপারটা কী সাধারণভাবে ধর্ম নাকি নির্দিষ্ট করে ইসলাম? মানে ধর্মটা ইসলাম হলে এটাকে রাষ্ট্র থেকে কথিত আলাদা রাখার প্রশ্ন তুলতে হবে? ব্যাপারটা কী এমন? এর জবাব সব সময় কথিত সেকুলারিস্টদেরকে অস্বচ্ছ রাখতে দেখেছি। কখনও রিভিজিট করে নিজেকেই প্রশ্ন করেছেন জানা যায় না!
মূলত প্রশ্নটা রাষ্ট্রকে ধর্ম থেকে আলাদা করারই নয়। একেবারেই না। প্রশ্নটা নাগরিকদের মধ্যে কোন ধরণের বৈষম্য না করার। এটা নিশ্চিত করা, এটাই রিপাবলিক রাষ্ট্রগঠনের প্রধান শর্ত ও উদ্দেশ্য। তথাকথিত সেকুলারিজম যেখানে কোন ইস্যুই নয়। কারণ বৈষম্যহীন না থাকলে পরিচয় নির্বিশেষে নাগরিকেরা নাগরিক অধিকারের দিক থেকে সকলে সমান এমন সাম্যে থাকবে না। ধর্মীয়সহ সব পরিচয় নির্বিশেষে নাগরিক সকলে সমান অধিকারের এটা চর্চায় নিশ্চিত করতে গেলে ব্যবহারিক দিক থেকে সেই রিপাবলিক রাষ্ট্র আর ঠিক আর কোন একটা ধর্মের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান হবে না আবার কোন এক ধর্মবিরোধী তাও হবে না। এই অর্থে এটা ব্যবহারিকভাবে যতটুকু যা আলাদা। এর বাইরে যারাই নাগরিক-বৈষম্যহীনতা নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে নয়, রাষ্ট্রকে ধর্ম থেকে আলাদা করতে হবে – এমন উদ্দেশ্যের কথা বলবে এরাই ইসলামবিদ্বেষী উদ্দেশ্যে কথা বলছে বুঝতে হবে। ইসলাম-কোপানি এদের উদ্দেশ্য।
১৯৭২ সালে কথিত সেকুলারিজম নীতি এসেছিল ইন্দিরার আত্ম-সংকটেঃ
আসলে ১৯৭২ সালে কথিত সেকুলারিজমের প্রসঙ্গ তুলেছিলেন ইন্ধিরা গান্ধী নিজেই, আত্মসঙ্কটে। এছাড়া সেটা ছিল তাঁর বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়ার শর্ত হিসেবে। অর্থাৎ অরিজিনালি সমস্যাটা তাঁর নিজের। কী সমস্যা? তা হল, সাতচল্লিশের দেশভাগ হয়েছিল নেহরুর স্বাধীন অখণ্ড ভারতের স্বপ্ন ভেঙে দিয়ে; আর তা ভারতের মুসলমান-সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলগুলোকে নিয়ে আলাদা পাকিস্তান রাষ্ট্র বানানোর মধ্য দিয়ে। ফলে নেহেরুর চোখে পাকিস্তান ভারতের স্বার্থের শত্রু, তা মেনেই এর জন্ম। তা হলে এই ভাষ্য অনুযায়ী ইন্দিরার চোখে ১৯৭১ সালেও শেখ মুজিব বা তাজউদ্দীন তো মূলত সেই মুসলমানই যারা স্বাধীন অখণ্ড ভারতের স্বপ্ন ভেঙ্গেছিল। তা হলে একাত্তর সালে এসে ইন্দিরা গান্ধী ঐ মুসলমানদেরই সহায়তা করবেন কেন? তাই আমাদের নয়, ইন্দিরার মন ভাল করতে পারে এ প্রশ্নের এমন একটা যুৎসই সাফাই জবাব দরকার ছিল ইন্দিরার। সেই প্রশ্নটা যেন ইন্দিরার মনে উঠেছিল ১৯৭১ সালের আগস্ট-সেপ্টেম্বরের দিকে; যখন ভারত বাংলাদেশের পক্ষে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামবে কি না সেটা আর বাস্তবে অমীমাংসিত ছিল না। তবে ‘কী পরিচয়ের’ বাংলাদেশক্ব স্বীকৃতি ঘোষণা দিবেন, ইন্দিরা নামবেন তাই তিনি খুঁজে ফিরছিলেন।
যেমন, আমেরিকা আর সোভিয়েত ইউনিয়ন, কোল্ডওয়্যারের ঝগড়ায় দুই ব্লক-রাষ্ট্রজোটে বিভক্তির সেই যুগে যখন পাকিস্তান-আমেরিকা-চীন এই ব্লক-গ্রুপের বিপরীতে বাংলাদেশ-ভারত-সোভিয়েত ইউনিয়ন এই অ্যালাইনমেন্ট তৈরি সম্পন্ন হয়ে গেছিল ও এভাবে যুদ্ধ হতে যাচ্ছে তা মুখ্যত নির্ধারিত হয়ে গেছিল, এটা ছিল সেই সময়। কিন্তু তখনই ইন্দিরার মাথায় যেন উদিত হয়েছিল, কেন এই মুসলমানের বাংলাদেশকেই তিনি সমর্থন করতে যাচ্ছেন এর এক সাফাই-জবাব তাঁর হাতে থাকতেই হবে। তাকে সুরাহা দিতে মুজিব বা তাজউদ্দীন যদি বলতেন যে তারা আর মুসলমান নয় তাহলে হয়ত ইন্দিরার মনষ্কামনা পুর্ণ হত। কিন্তু হায়! এমনটা সম্ভব নয়! অবাস্তব স্বপ্ন বলে, এর বিকল্প হিসেবে যেন ইন্দিরার মাথায় আসে ‘সেকুলারিজম’ শব্দটা। অর্থাৎ বাংলাদেশ যেন নিজেকে সেকুলার রাষ্ট্র বলে স্বীকার করে নেয়, এমনটা করার পরই অষ্টম চিঠি চালাচালিতে ইন্দিরা বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। মানে ইন্দিরার ইচ্ছা পূরণ হয় এতেই যে, তিনি ‘মুসলমান বাংলাদেশ’কে স্বীকৃতি দেননি, ‘সেকুলার’ বাংলাদেশকে দিয়েছিলেন। এভাবেই তাঁর অস্থির-মন কিছুটা শান্তি পায়!
কিন্তু একাজ করেও ইন্দিরার সব দ্বিধা-সন্দেহ তবু চলে যায়নি। কারণ যেমনটা আলী রীয়াজের ভাষ্য, ‘সংবিধানে সেকুলারিজমকে একটি রাষ্ট্রীয় নীতি হিসেবে গ্রহণ’ করা হয়েছিল – ব্যাপারটা ঠিক তা নয় আবার ওমনটা ফ্যাক্টসও নয়। অন্তত আমরা মানে বাংলাদেশ এটা নিজে যেচে কখনও গ্রহণ করেননি, বাধ্যবাধকতা চাপিয়ে দেওয়া ছিল – তাই এখন প্রমাণিত।
এছাড়া পাল্টা একটা বড় প্রশ্ন করা যায়, কথিত সেকুলার নীতি নেয়া ইন্দিরার চোখে যদি এতই কাম্য ও জরুরি হয়ে থাকে এমনকি ধরা যাক পবিত্র হয়ে থাকে তবে খোদ ভারতই ১৯৪৯ সালে জন্মের পর থেকে (ওর কনষ্টিটিউশন ১৯৪৯ সালে রচিত/গৃহিত) কথিত ‘সেকুলার’নীতির রাষ্ট্র ছিল না কেন? এই মহান সুযোগ ইন্দিরার বাবারা নেহরু বা গান্ধী খুঁইয়েছিলেন কেন? তাহলে তখনো ইন্দিরার ভারত নিজেই সেকুলার না হওয়া সত্বেও উলটা বাংলাদেশকে জবরদস্তিতে সেকুলার বানানো কেন? আলী রিয়াজের উচিত হবে এদিকটা খুঁজে দেখতে পারেন আগে। ইন্দিরার কাছেও এর জবাব ছিল না। বরং এনিয়ে আত্ম-অস্বস্তি ছিল, অনুমান করতে পারি। তাই এর ফায়সালা করতে ১৯৭৬ সালে (অর্থাৎ কথিত সেকুলার বাংলাদেশের জন্মেরই চার বছর পরে) ভারতের কনস্টিটিউশন বদলানোর সুযোগ পেয়ে খোদ ভারতকে কথিত সেকুলার ঘোষণা করিয়েছিলেন। এর প্রমাণ হিসাবে দেখতে পারেন, The Constitution (Forty-Second Amendment) Act, 1976.
কেন আওয়ামি লীগের পক্ষে নিজেকে কথিত সেকুলার বলা সম্ভবই ছিল নাঃ
আবার বাংলাদেশের আওয়ামি লীগের কাছে “তারা সেকুলার” এমন কথা মুখে আনাই সেকালে ক্ষতিকর ছিল – এটাই সেকালের ইতিহাস ও বাস্তবতা ছিল। এভাবেই আওয়ামী লীগ তৈরি হয়েছিল। সেটা কেমন? কারণ, অন্তত ১৯৬৬ সালের ছয় দফা দেওয়ার পরে আওয়ামী লীগের বিরোধীরা (মানে মূলত ইসলামী দলগুলো ও আর্মি সরকারের ভাষ্য যেটা) ছয় দফার বিপরীতে তারা অভিযোগ তুলে বলে চলত যে, আওয়ামী লীগ পাকিস্তান ও ইসলামকে দুর্বল করতে চায় বলে ছয় দফা বা স্বায়ত্তশাসনের কথা তুলেছে। অর্থাৎ মূলকথা তারা আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে “ইসলামকে দুর্বল ও ক্ষতি” করার অভিযোগ তুলত। এর অর্থ যেই আওয়ামী লীগের কাঁধে এমন অভিযোগ সেই দল তো যেচে বলতেই পারে না যে, সেকুলারিজম তার কোন হবু-রাষ্ট্রনীতি হবে! কারণ এতে ঐ অভিযোগকেই মেনে নেয়া বা প্রমাণ করে দেয়া হবে! এ কারণে কথিত “সেকুলারিজম” আওয়ামী লীগের দলে বা কোন নেতার মুখে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত থাকবার কোন সুযোগই ছিল না। এটাই আরেকটা খাস প্রমাণ যে “কথিত সেকুলারিজম” আওয়ামি লীগের নীতি ছিল না।
অতএব, ১৯৭১ সালে আমাদের কথিত সেকুলার হওয়ার কথা যা আলী রীয়াজ দাবি করছেন তা ভিত্তিহীন। তবে এটা পরিষ্কার যে, এটা ছিল ইন্দিরার ছুপা-মনোবাসনা! তাঁর মনের ‘খচখচি’ মিটানো! যা আমাদের উপর চাপানো হয়েছিল। অর্থাৎ উল্টো করে বলা যায়, এক অন্যায় মনোবাসনা যে, যে যে মুসলমানদের কারণে অখণ্ড ভারত হতে পারেনি, সেই মুসলমানদেরই ইন্দিরা সহায়তা করেন কিভাবে? এই খচখচানি দূর করতেই আমাদের সেকুলার হতে চাপিয়ে দেয়া হয়েছিল। দেখা যাচ্ছে ইন্দিরার মনোস্তুষ্টি রিয়াজ নিজের কর্তব্য বলে হয়ত অজান্তে গ্রহণ করে নিয়েছেন; যদিও একাদেমিকদের কাজ হওয়া উচিত কোন বক্তব্যের পক্ষ-বিপক্ষ দুই দিকেরই সাফাই পয়েন্টগুলো নির্মোহ যাচাই করা এবং তা, খুলে ও মেলে ধরা।
কোন রাষ্ট্রকে কথিত এই সেকুলার হতেই হবে কেন; আর তা হওয়ার উপায়ইবা কী ও দরকার কেনঃ
সেকুলারিজম নাকি এক ‘পবিত্র’ রাষ্ট্রীয় নীতি- এ কথাটা হল সবচেয়ে অর্থহীন এবং নিজেকেই ফাঁকি দেয়া এক বয়ান। অর্থাৎ এটা আসলে বুঝে বা না বুঝেই বলা কিন্তু মূলত অসৎ উদ্দেশ্যের এক বয়ান। আসলে এখানে মূল প্রশ্ন, কেন কোন রাষ্ট্রকে ‘সেকুলার’ হতেই হবে, দরকার কী? আবার তা হওয়ার উপায় কী? আর ‘সেকুলার’ হওয়া মানেই বা কী?
আমাদের অভিজ্ঞতা বলে, সেকুলারিজম এক পবিত্র রাষ্ট্রীয় নীতি এ কথা বলে যারা রাষ্ট্রের গায়ে সাইনবোর্ড টাঙিয়েছে আমরা দেখেছি, এরা কার্যত মুসলমানবিদ্বেষী। এই বিদ্বেষ চর্চা করতেই তারা ঐ সাইনবোর্ড ব্যবহার করেছে। কেন বারবার এই বিদ্বেষের দিকে আঙুল উঠাচ্ছি বা উদ্দেশ্যকে নিয়ে প্রশ্ন তুলছি?
কারণ, কোন কনস্টিটিউশনে যদি “আমাদের রাষ্ট্রীয়নীতি সেকুলারিজম” জাতীয় কিছু বলে উল্লেখ থাকতে দেখি, তবুও ঐ রাষ্ট্র বা কনস্টিটিউশন সেকুলার বলে গণ্য হবে না। আসলে রাষ্ট্র বা কনস্টিটিউশন সেকুলার বলে গণ্য হওয়ার কোনো পথ বা পদ্ধতিই এটা নয়। একেবারেই নয়। এমনকি আবার উল্টো করে বললে, কনস্টিটিউশনের কোথাও সেকুলারিজম শব্দটা উল্লেখ করা না থাকলেও সেই রাষ্ট্র বা কনস্টিটিউশন সেকুলার বলে গণ্য হতে পারে। এতে সমস্যা হবে না।
কোনো কনস্টিটিউশনে যদি “আমাদের রাষ্ট্রীয়নীতি সেকুলারিজম” জাতীয় কিছু বলে উল্লেখ থাকতে দেখি, তবুও ঐ রাষ্ট্র বা কনস্টিটিউশন সেকুলার বলে গণ্য হবে না। আসলে রাষ্ট্র বা কনস্টিটিউশন সেকুলার বলে গণ্য হওয়ার কোনো পথ বা পদ্ধতিই এটা নয়। একেবারেই নয়। এমনকি আবার উল্টো করে বললে, কনস্টিটিউশনের কোথাও সেকুলারিজম শব্দটা উল্লেখ করা না থাকলেও সেই রাষ্ট্র বা কনস্টিটিউশন সেকুলার বলে গণ্য হতে পারে। এতে সমস্যা হবে না।
তা হলে প্রথমত এটা কোন রাষ্ট্রীয় নীতি বলে সাইনবোর্ড টাঙানোর কাজই না যে, এটা সেকুলার রাষ্ট্র। তা হলে ‘অসততা বা উদ্দেশ্যের কথা’ তোলা হচ্ছে কেন? কারণ অনেক পুরনো ও প্রথম কথা হল, আপনি একটা একচেটিয়া ক্ষমতার আধিপত্যে থেকে এরপর অন্য ধর্মের লোককে ডিকটেট করতে পারেন না যে, তাঁর সেকুলার হওয়া উচিত। সবসময় এই ব্যাপার ঘটেছে এইভাবে। ঠিক যেমনটাকে আলী রিয়াজ এখন সমস্যা হিসেবে হাজির করছেন। যেমন, আমরা দেখেছি ১৯০ বছরের জমিদার আমলে, দুই বাংলার সেই জীবন জমিদার-হিন্দুর সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আধিপত্যে কেটেছে। আর সেই আধিপত্য টিকিয়ে রাখতে তারা মনে করত যেমন ইসলামী টুপি মাথায় দেয়া বা ইসলামী লেবাস পড়ে শহরে ঘোরা যাবে না। করলে নাকি তা সেকুলার নীতি ভঙ্গ হবে। তবে ব্রিটিশ আমলে জমিদাররা এটাকে ঠিক সেকুলার না, বলতেন “সাম্প্রদায়িকতা”। আর একালে সেটাকেই গুছিয়ে বলা হয়, কথিত “সেকুলার রাষ্ট্রীয়নীতি”। অথচ উদ্দেশ্যটাই অসৎ! একক আধিপত্য টিকিয়ে রাখা!
তাহলে সেকালের সাম্প্রদায়িকতার মানে হল, জমিদার-হিন্দুর যে আধিপত্য কায়েম ছিল সেটাকে কোনো চ্যালেঞ্জ করা যাতে না হয়ে যায়, এমন হতে না দেয়া। অর্থাৎ হিন্দুদের পাশাপাশি মুসলমানদের নিজ সম্প্রদায়েরও চিহ্ন প্রদর্শন করতে না দেয়াই সেকুলারিজম। এমন না করা যেন অ-সাম্প্রদায়িকতা ও সেকুলারিজম বলে সেকালে জমিদার-হিন্দু আর একালে ইন্দিরা বা মোদি সার্টিফিকেট দিয়ে যাচ্ছেন।
আর তাই মুসলমান বা কোনো ধরনের ইসলামিজমের কাছে সেকুলারিজম শব্দের অর্থ দাঁড়িয়েছে, এটাই ইসলামবিরোধীতার ও বিদ্বেষের এক হাতিয়ার এবং এটা তাদের সাথে বৈষম্য করার জন্য এসেছে।
তা হলে মূল কথা, আগে থেকে থাকা কোনো মুসলমান বা হিন্দু আধিপত্যকে টিকিয়ে রাখার জন্য ‘সেকুলারিজম’ শব্দের আশ্রয় নেয়া বা এটাকে রাষ্ট্রীয়নীতি বলে চালিয়ে দেয়া- এগুলোই অসততা ও খারাপ উদ্দেশ্য বলছি। তাদের হাত পরিস্কার নয় তাই।
রিপাবলিক রাষ্ট্রের মূল বৈশিষ্ট্য বৈষম্যহীনতা, নাগরিক অধিকারে সাম্যঃ
তা হলে, মূলকথাটা হলো বৈষম্যহীনতা। আধুনিক রিপাবলিক রাষ্ট্রের মূল- বৈশিষ্ট হিসেবে তার নাগরিকদের মধ্যে সাম্য, সব নাগরিকের অধিকার সমান- এই নাগরিক বৈষম্যহীন নীতির ভিত্তিতে দাঁড়ানো। যেখানে রাষ্ট্রের চোখে নাগরিকদের পরিচয় একটাই যে, সে নাগরিক এবং সবার সাথে বৈষম্যহীনভাবে সমান অধিকারের নাগরিক। তাতে নিজস্ব আইডেনটিটি (যেমন ধর্মীয় বা ভাষা বা পাহাড়ি-সমতলী, নারী-পুরুষ প্রভৃতি) আগের মতোই আছে কিন্তু রাষ্ট্রীয় আইডেনটিটি একটাই যে, সে রাষ্ট্রের নাগরিক। অর্থাৎ নাগরিকের অন্যসব আইডেনটিটি আগের মতই নানান ভিন্নতা নিয়ে আছে; কিন্তু সেসবের ভিত্তিকে কাউকে কারো উপরে অধিপতি না বানানো, কাউকে নাগরিক বৈষম্যের শিকার না বানানো – এসব কঠোরভাবে চর্চার মাধ্যমে রাষ্ট্রে নাগরিক অধিকারে সাম্য নিশ্চিত করা, এটাই মূল দরকারি কাজ। খেয়াল করেন, এই পুরো প্যারাটায় কোথাও সেকুলার শব্দটাই লিখতে হয় নাই। অথচ অর্থ পরিষ্কার। নতুন রিপাবলিক রাষ্ট্রের এটাই মূল-বৈশিষ্ট্য হতে হবে এবং তা কোনো ‘সেকুলারিজম আমার রাষ্ট্রীয় নীতি’ এমন কথার চাতুরি বা আড়াল না নিয়েও বলা যায়। এটা বাস্তবে প্রতিষ্ঠা করতে পারলে তবেই হয়ত আর কোনো মুসলমান বা যে কোন ধারার ইসলামিজমের পুঞ্জীভূত অনাস্থা ও ক্ষোভ আমরা কাটাতে পারি। বাংলাদেশের হিন্দুরাও অনাস্থা কাটিয়ে তেমন বৈষম্যহীন বাংলাদেশকেই আপন মনে করে আস্থা খুজতে পারেন।
অর্থাৎ মূল কথা, সেকুলারিজম শব্দের উচ্চারণই অপ্রয়োজনীয়। ফলে এ শব্দের আড়ালে কোনো চাতুরীও চলবে না। নাগরিক সাম্য-নীতি অনুসরণ করবেন এবং কোন সাইনবোর্ডে না – চর্চায় তা প্রতিষ্ঠা করবেন, এটাই এর মূল ফোকাস হতে হবে।
রাজনীতি ও ধর্মের বিভাজন – বৃটিশ অসততাঃ
আলী রিয়াজ লিখেছেন, ‘জনপরিসরে রাজনীতি ও ধর্মের বিভাজন থাকার কথা ছিল, রাষ্ট্রের একধরনের নিরপেক্ষ অবস্থানে থাকার প্রতিশ্রুতি’ ছিল। এই শব্দ ও বাক্যগুলোই আড়ালেই প্রবল অপ-ব্যবহার ঘটানো হয়েছে। ইসলাম কোপানোর পারফেক্ট সুযোগ করে নেয়া হয়ে গেছে। বলা বাহুল্য, এতে এক বিরাট অনাস্থা তৈরি হয়ে গেছে বিশেষ করে মুসলমান বা কোন ধরনের ইসলামিজমের জনগোষ্ঠীর মনে। মূলত ‘জনপরিসরে রাজনীতি ও ধর্মের বিভাজন’ এর নামে অসৎ উদ্দেশ্য হাসিল করা হয়েছিল। এই অসততার ‘গুরু’ ব্রিটিশ সরকার। বিশেষত ১৯২৩ সালের নেশন স্টেট ব্রিটিশ রিপাবলিক। এর অসৎ উদ্দেশ্য ছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধে হেরে যাওয়া তুরস্ক বা অটোমান এম্পায়ার দখল করে ব্রিটেনের নিজ ইচ্ছায় একে সাজানো। ‘কামাল তুনে কামাল কিয়া’- এই কামালকে ক্ষমতায় বসিয়ে ব্রিটিশরা ‘জনপরিসরে রাজনীতি ও ধর্মের বিভাজন’ কথাগুলো সাজিয়েছিল।
আগেই বলেছি সাম্য-নীতিকে চর্চার বাস্তবায়ন, নাগরিক বৈষম্যহীনতা বাস্তব করে তোলা – এসব কাজ সম্পন্ন করতে পারলে “জনপরিসরে রাজনীতি ও ধর্মের সম্পর্ক” কী হবে, কোথায় তা ভারসাম্য আনবে সেটা আপনাতেই ঠিক হয়ে যাবে। আর সেটাই সবচেয়ে স্বাভাবিক ও বাস্তব সমাধান হবে। কিন্তু যার উদ্দেশ্য ইসলাম-কোপানি আর মনে বিদ্বেষ, ক্রুসেদে হারার পুরান রাগ তার মুখে এসব রুচবে না! যেমন, সুলতানি তুরস্ক ছিল ডমিনেটিংভাবে ইসলামী। তা এক সাম্রাজ্যরাষ্ট্র ছিল। আবার তুরস্ক মানেই, একই সাথে বারবার ক্রুসেড হেরে যাওয়ার ইউরোপীয় খ্রিশ্চীয়-মনের ক্ষোভ ও অভিজ্ঞতাও। কিন্তু যেটাকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে তুরস্কের হেরে যাওয়ার পরের ১৯২৩ সালের সেকালের মডার্ন তবে জাতিরাষ্ট্রের ব্রিটেন চায়নি যে, ১৯২৩ সালের তুরস্কের কারণে ব্রিটেনে্র নিজ আভ্যন্তরীণ খ্রিশ্চীয় থিওলজি আবার রাজনীতির চেয়ে প্রবল হয়ে উঠুক বা রাজনীতিকদের পাশাপাশি ক্ষমতার ভাগীদার হয়ে উঠুক। তাই ব্রিটিশ শাসকেরা ব্যাপারটাকে ‘রাজনীতি ও ধর্মের বিভাজন” থাকা জরুরি এভাবে সাজিয়ে কথা তুলেছিল, ‘রাষ্ট্রের একধরনের নিরপেক্ষ অবস্থানে থাকার প্রতিশ্রুতি’ কথাগুলো এনেছিল। যাতে বৃটেনেও খ্রিশ্চীয় থিওলজির সত্ত্বা আগের মতই রাজনীতিক সত্ত্বার অধীনস্ত হয়ে নিচে চাপা থাকে। এছাড়া বাস্তবে পেয়ে যাওয়া তাদের বসিয়ে দেয়া শাসক কামাল আতাতুর্ক জবরদস্তিতে খাড়া হতে পারেন বা কোন ধরণের ইসলামিজমের হাতে আক্রান্ত না হন। কামালকে রক্ষা করতেই এই নীতি। কথিত সেকুলারিজম মানেই রাষ্ট্র আর ধর্মের বিভাজন, এমন কথা সত্য নয়। এককথায় এটা ছিল তুরস্ক বা বৃটেন স্পেসিফিক তাদের আভ্যন্তরীণ হবু কোন সংকট যে উদয় না হয় এর জন্য সাবধাণতা। রাজনীতি ও ধর্মের বিভাজন থাকতেই হবে এভাবে সেকুলারিজমকে উপস্থাপন করা একটা চিহ্ন হিসাবে একে দেখানো এমন কোন কথা কোনকালেই ছিল না।
কাজেই মোদ্দা কথা ‘রাজনীতি ও ধর্মের বিভাজন’-এর তত্ত্ব কামালের তুরস্ককে বৃটেনের নিয়ন্ত্রণে সামলানোর এক আলাপ মাত্র। এটা কোনোভাবে নাগরিক সাম্য-নীতির রিপাবলিকের আলাপই নয়। কাজেই রাষ্ট্র ও ধর্মের বিভাজনের এই আলাপ এক কথায় একেবারেই অপ্রাসঙ্গিক। ইউরোপে এটা যার যেভাবে কাজে লাগে সে সেভাবে এটা ব্যবহার করে, মানার ভান করে। এমনকি আমেরিকান রাষ্ট্রও এটা মানে না। আমেরিকা মনে করে, নাগরিকের ধর্মপালনের অধিকার ও স্বাধীনতা রক্ষাই রাষ্ট্রের কাজ। তবে মুখ্য বিষয়টি হল – তুরস্কে রাষ্ট্র ও ধর্মের বিভাজনের কথা নাগরিক সাম্য-নীতির রিপাবলিকের কথা নয় বা সেদিক থেকে তোলাই হয়নি। তাই এটি উপেক্ষাযোগ্য। এই সারকথাটা আমাদের মনে রাখতেই হবে।
সোজা কথাটা বললে, লেখক যদি বেড়ে চলা ইসলামিজমের দিকে তাকিয়ে তা ঠেকানোর উপায় খুঁজতে থাকা কেউ হন, তা হলে তিনি নাগরিক সাম্য-নীতির রিপাবলিক – এ আলাপে আমাদের কেউ নন। তার এজেন্ডা ও প্রসঙ্গও তাই আলাদা। ১৯২৩ সালে তুরস্ক থেকে ব্রিটিশদের হাতে তৈরি করা ‘সেকুলারিজম’ এই শব্দের আড়ালে আরো কত কিছু যে আমাদের দেখতে হবে সেটি তাদের ব্যাপার। এভাবে তাদের উদ্দেশ্য সাধনের চেষ্টা করতে থাকুন। কিন্তু আমরা তাদের সাথে একই নৌকায় নাই। উই আর নট ইন্টারেস্টেড! কারণ ওটা নষ্টা রাস্তা! এই সেকুলারিজম আমাদের রাস্তা নয়। এটি নাগরিক সাম্য-নীতির রিপাবলিক চিন্তারও কোন অংশ বা আত্মীয় কিছু নয়।
আবার কলোনি জমিদার আমলে, যা আগেও বলেছি, যে এমনটাই জমিদার-হিন্দুর আকাঙ্খা ও বয়ান ছিল যাকে তার অলীক বাসনাও বলতে পারি। যে মুসলমানকে ‘বাঙালি’ বলে মনে করা হতো না, বাংলা ভাষাটা কেবল বাঙালি হিন্দুর ভাষা মনে করা হত। তাই এর শ্রীবৃদ্ধি ও বিকাশে যা বলার সেটাও বাঙালি হিন্দুরই একচেটিয়া মনে করা হত। এরাই এখন ‘হিন্দুত্ববাদের “হিন্দু সংহতি“র নামে আরএসএসের ছায়াতলে অঙ্গসংগঠন হয়ে আছে।
আমেরিকার ‘ওয়্যার অন টেরর’ হল মূল আসামীঃ
বেড়ে চলা নানান ধরণের ইসলামিজম ও পশ্চিমের উপর তাদের জেনুইন অনাস্থার জন্য মূল দায়ী আমেরিকার ‘ওয়্যার অন টেরর’। আরো সুনির্দিষ্ট করে বললে, আমেরিকার ‘হোম ল্যান্ড সিকিউরিটি’ নামে ডিপার্টমেন্ট খোলা (Nov 2002) এবং তার ইসলামবিদ্বেষী নীতির চর্চা করা। সচেতনে অথবা অচেতনে এই চর্চার ফলে যে মেসেজ তারা হাজির করেছিল তা হল, আমেরিকানরা কথিত সন্দেহভাজন “মুসলমান-মুক্ত” এক দুনিয়া গড়তে চায় আর সেখানেই বসবাস করতে চায়। অথচ এটি ছিল আমেরিকা রাষ্ট্রের নিজ ভিত্তিমূলক বক্তব্য – নাগরিক বৈষম্যহীন রিপাবলিক ধারণার বিরোধী। আসলে এটাই ছিল ইভানজেলিক-খ্রীশ্চান বুশের শর্টকাট পথ।
আর এর ফলাফলে ও পরিণতিতে ঠিক এরই উল্টো প্রতিক্রিয়াই হল – এরই নাম বেড়ে চলা নানা ধরনের ইসলামিজম। ইসলামিজম তাই স্বভাবতই আমেরিকাকে পাল্টা বলছে, তারাও এমন এক দুনিয়ার কল্পনা করে যেখানে কেবল মুসলমানরা আছে। কাজেই বেড়ে চলা ইসলামিজম দেখে ভয় পাওয়ার আগে উচিত আমেরিকা খোদ নিজ-নীতির দিকে তাকানো। বাইরে বাঘ খুজার আগে নিজ মনে যে বাঘের ভয় ও সীমাহীন ঘৃণা-বিদ্বেষ তাঁরা জন্ম দিয়েছিল এর পরিণতি তো এমনই হবার কথা! সবার আগে নিজ ভুলগুলো তাদের বুঝতে হবে। বেড়ে চলা ইসলামিজম দেখে ভয় পাওয়ার চেয়ে আমরা কামনা করব, আগে আমেরিকা নিজেই আত্মসমালোচনার যোগ্য হয়ে উঠুক। তবেই হয়ত তার চরম ইসলামবিদ্বেষ ভালো হয়ে যাক: তাহলেই তো হয়। কিন্তু সে কথা বলার মুরোদ কি অনেকেরই হবে? সন্দেহ আছে!
ধর্মকে আইডিওলজি বা ভাবাদর্শের জায়গায় স্থাপনের অভিযোগঃ
৯/১১ এ আলকায়েদা আমেরিকা-রাষ্ট্রের উপর সশস্ত্র হামলা চালিয়েছে। দুনিয়ার সব ধরণের রাষ্ট্রের উপরই কোন সশস্ত্র হামলার শাস্তি মৃত্যুদন্ড বা সর্বোচ্চ শাস্তি। লিগাল পয়েন্টে এই শাস্তি নিয়ে তর্কের কিছু নাই। কিন্তু সাবধান। আপনি যদি বলেন ঠিক আক্রমণকারী এখানে অপরাধী না। ইসলাম এখানে অপরাধী? অর্থাৎ অপরাধীর ধর্মীয় পরিচয় তুলে আপনি প্রপাগান্ডা বিদ্বেষ তৈরির এক আসর চাইতেছেন। এবার আপনি তাহলে ইসলামবিদ্বেষ করলেন। অর্থাৎ আমেরিকান রাষ্ট্রের যা করা উচিত না, করণীয় ছিল না তাই করা হয়েছে এখানে।
যেমন আলী রীয়াজ আরো লিখেছেন, “ইসলাম ধর্মকে আইডিওলজি বা ভাবাদর্শের জায়গায় স্থাপন করে শাসনের হাতিয়ারে” পরিণত করেছে। সার কথায় তিনি বলতে চাচ্ছেন, “ধর্মতত্ত্বকে রাজনীতির ভাবাদর্শ” বলে ব্যবহার করা যাবে না। কেন যাবে না? কোন কথিত সেকুলারিজম এটা না করতে চায়? কিন্তু এ’ব্যাপারে আমাদের সবার পথ প্রদর্শক কি সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট খোদ বুশ (জুনিয়র) নন? তিনি কি নাইন-ইলেভেনের দিনেই হামলার কয়েকঘন্টা পরে তাঁর প্রথম টেলিভিশনে হাজির হওয়ার বক্তব্যে আমাদের ইভানজেলিক খ্রিষ্টীয় ক্রুসেডের হুমকি, আর আবার ক্রুসেড লড়ার হুমকি শোনাননি? তাহলে ধর্মতত্ত্বকে রাজনীতির ভাবাদর্শ হিসাবে ব্যবহারের দায়ে রিয়াজ ঠিক কাকে এ জন্য অভিযুক্ত করতে চান? আমরা জানি না। আগে রিয়াজের এটা আমাদেরকে জানানো উচিত!
তবে এগুলো অবশ্যই এর বাইরের দিক। ভেতরের কথা হল, ধর্মতত্ত্ব আর রাজনীতির মধ্যে কোনো সম্পর্ক থাকবে না – এটা বাস্তবত এক অলীক কল্পনা। অবশ্যই ধর্মতত্ত্ব (Theology) আর রাজনীতি আলাদা বিষয়। বিশেষ করে দুটোর ভাষাই তো আলাদা। এমনকি প্রেজেন্টেশন ও বলার স্টাইল এবং পূর্ব-অনুমানগুলোতে তারা একেবারেই আলাদা। কিন্তু আবার এমন ঘোরতর মিলও আছে যে আলাদা করাই মুশকিল। যেমন আপনি আজ বলছেন, ধরা যাক, আপনার পার্টির কোন এক রাজনৈতিক ‘রেজুলেশনের’ [resolution বা সিদ্ধান্ত প্রস্তাব] কথা। তাতে মনে হতে পারে, আপনি বিরাট জ্ঞানী রাজনীতিক রাজনীতির আলাপ করছেন। কিন্তু তলায় হাত দেন। পারবেন? মুরোদ থাকলে প্রশ্ন করেন এই ‘রেজুলেশন’ শব্দটি কই পাইলেন? এই শব্দটা শতভাগই এক ধর্মতত্ত্বীয় শব্দ ও ধারণা যার অর্থ খ্রিশ্চীয় বছর শুরুর প্রথম দিনে খ্রিশ্চীয় মানুষ নতুন বছরে কী কী করবে বলে তাঁর গডের কাছে প্রতিজ্ঞা করে, এটাই তাঁর নতুন বছরের ‘রেজুলেশন’ বলে। ঐ দিন শেষে তাঁরা একে অপরের কাছে তার তার রেজুলেশন কী, জানতে চাইবে, ‘উইশ’ করবে ইত্যাদি। তাহলে এখন বলেন রেজুলেশন কী রাজনীতির না ধর্মতত্ত্বীয় শব্দ?
সারা দুনিয়াতে মানুষের বসবাসের ইতিহাস বা এর চিহ্ন পাওয়া অনুসারে, এটা সর্বোচ্চ ছয় হাজার বছরের পুরানা মনে করা হয়। এর মধ্যে আবার সবচেয়ে বেশি চিহ্ন পাওয়া যায় এই বিচারে তা তিন হাজার বছরের পুরানা। এই তিন হাজার বছরের প্রায় পুরাটা সময় কোন না কোন বা একটা না একটা “ধর্মতত্ব” তাঁর সাথে ছিল, মানুষকে সাথে নিয়ে যে পথ হেঁটে চলছে। আর এসবের বিপরীতে মাত্র দেড় হাজার বছর আগের এক নতুন ফেনোমেনা হল – দুনিয়াতে ধর্মতত্ব বা এর প্রভাব বলে কিছুই নাই, না চাইকি ধর্মতত্ব বলেই কিছু নাই এমন ধরে নেয়া অনুমানের উপর দাঁড়িয়ে দুনিয়ার সব ফেনোমেনাকে দেখার পদ্ধতির নাম হল বিজ্ঞান বা র্যাশনালিটির এনলাইটেনমেন্ট। অর্থাৎ সোজা বললে, দুনিয়ার যেন সব ঘটনা-ফেনোমেনাই ফিজিক্যাল, এই অনুমান। মানে স্পিরিচুয়াল ফেনোমেনা বলে কিছুই নাই। আবার এর ফলাফল কিছু কিছু ক্ষেত্রে অবশ্যই খুবই ভাল। তা হওয়ারই কথা। বিশেষত যেমন নিউটনের গতিসুত্র বুঝবার ক্ষেত্রে এর উপর থিওলজির কোন প্রভাব নাই বলে এটা নাই তা ধরে নিতেই পারি। তাতে সুত্রে কোন হেরফের আসে না। কিন্তু সাবধান যেখানে রক্তমাংসের মানুষের জীবন জড়িয়ে আছে বা থাকে সেসব ক্ষেত্রে সেখানে বিজ্ঞান বা র্যাশনাল চিন্তার পদ্ধতি যথেষ্ট বলে বিবেচিত হবে না। এছাড়া থিওলজি এখনও তার মত করেই প্রভাব ফেলে থাকে।মানুষের চিন্তা বিষয়ক সব শব্দের আদিতে ধর্মতত্বের গর্ভ থেকে উতসারিত।
তাই মূলকথাটা হল, মানুষের চিন্তায় বিশেষত যেসব শব্দ সে ব্যবহার ও ধারণ করে এমন প্রতিটা শব্দের উতপত্তি ধর্মতত্বের হাতে ও ঘরে। যদিও শব্দের উতস বা রূট ধর্মতত্বের তা হলেও সেসবের অর্থ অবশ্যই বদলে যেতে পারে, বদলে নিতেই পারি। secularize বা ধর্মতত্বীয় আগ্রহের বাইরের সিভিল লাইভে ব্যবহার ধরণের এর অর্থ করে নিতেই পারি।
দুনিয়াতে শব্দের অর্থের বিবর্তন হয়, নতুন অর্থে পুরনো শব্দের ব্যবহার দেখা যায় যদিও শব্দের রুট একই থাকে। যে ডিকশনারি শব্দের রূটের হদিস দিতে পারে না সেটা ভাল ডিকশনারি নয় বলে মানা হয়। অতএব, ধর্মতত্ত্ব আর রাজনীতির বন্ধন ও সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। তা হলে ধর্মতত্ত্ব আর রাজনীতির মধ্যে কোনো পাকা দেয়াল তোলাও অসম্ভব। যদিও আবার বলছি ধর্মতত্ত্ব আর রাজনীতির ভাষ্য ও প্রেজেন্টেশন আলাদা, বলার ঢঙ, গদ্যরূপ আলাদা; উদ্দেশ্যও আলাদা। সেটাও মেনে চলা উচিত।
অতএব সাবধান। বুঝহ সুজন! আর মূলকথা, অমন সেকুলারিজমকে নদীতে ভাসিয়ে দিলেও আমাদের কোনো ক্ষতি বৃদ্ধি হবে না।
লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
goutamdas1958@hotmail.com