চার লেনে উন্নীত করতে প্রতি কিলোমিটারে ব্যয় হয়েছে প্রায় ১৮ কোটি টাকা। তার পরও এক বছরের মধ্যে ভঙ্গুর দশায় চলে যায় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক। কোথাও পিচ (পেভমেন্ট) দেবে যায়। আবার কোথাও ফুলেফেঁপে ওঠে দেশের অন্যতম ব্যয়বহুল এ সড়ক। ভেঙে যায় সড়ক বিভাজক। জয়দেবপুর-ময়মনসিংহ মহাসড়কটি চার লেনে উন্নীত করতে ব্যয় হয়েছে এর চেয়েও বেশি। প্রতি কিলোমিটারে প্রায় ২১ কোটি টাকা। একই সমস্যা দেখা দিয়েছে এ সড়কেও।
অথচ দুটি মহাসড়কই সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে নির্মাণ করেছে সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তর। নির্মাণকাজ তত্ত্বাবধান করেছেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পর্যবেক্ষকরা। প্রকল্প পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন অধিদপ্তরের অভিজ্ঞ ও জ্যেষ্ঠ প্রকৌশলীরা। এর পরও সড়কগুলো টেকসই হচ্ছে না।
দেশের মহাসড়কগুলো নির্মাণে ব্যয় হচ্ছে অতিরিক্ত। যদিও তা টেকসই হচ্ছে না। এ নিয়ে পর্যবেক্ষণ রয়েছে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগেরও (আইএমইডি)। বিভাগটি বলছে, কয়েকটি ব্যতিক্রম ছাড়া বেশির ভাগ প্রকল্পেই নির্মাণের কিছুদিনের মধ্যেই সড়ক-মহাসড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
জাতীয় সংসদের পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সাম্প্রতিক এক বৈঠকে এ মূল্যায়নসংবলিত প্রতিবেদন উপস্থাপন করে আইএমইডি। প্রতিবেদনে ২০১৬ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার আওতায় সমাপ্ত ৯৬টি সড়ক নির্মাণ বা উন্নয়ন প্রকল্প নিয়ে পর্যবেক্ষণ দেয়া হয়।
শুধু চার লেনের মহাসড়ক নয়, বিভিন্ন জাতীয়, আঞ্চলিক ও জেলা সড়ক নির্মাণ কিংবা সংস্কার বা উন্নয়নকাজেও মোটা অংকের অর্থ ব্যয় করছে সওজ অধিদপ্তর। এ বিষয়েও আইএমইডির পর্যবেক্ষণ হলো উন্নয়ন বা সংস্কারকাজ শেষ হওয়ার এক থেকে দেড় বছর, কখনো কখনো তারও আগেই নষ্ট হতে শুরু করছে সড়ক-মহাসড়ক।
ব্যয়বহুল এসব সড়কের টেকসই না হওয়া নিয়ে অভিযোগ রয়েছে নীতিনির্ধারক ও আইনপ্রণেতাদের মধ্যেও। সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি একাব্বর হোসেন মনে করছেন, বিভিন্ন কারিগরি ত্রুটি ছাড়াও ঠিকাদারদের নিম্নমানের কাজের কারণেই সড়ক টেকসই হচ্ছে না। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, মাঠপর্যায়ে যেসব কর্মকর্তা বা ঠিকাদার রয়েছে, তারা নিজের লাভ খোঁজেন। দেশের ক্ষতি হচ্ছে কিনা, সে বিষয়টি বিবেচনায় রাখেন না। নির্মাণ পর্যায়ে যেসব মানের উপকরণ ব্যবহার করার কথা সেসব করা হচ্ছে না। ফলে সড়ক-মহাসড়ক যতদিন স্থায়ী হওয়ার কথা ততদিন হচ্ছে না।
টাঙ্গাইল থেকে রংপুর পর্যন্ত মহাসড়ক চার লেনে উন্নীত করতে প্রতি কিলোমিটারে খরচ হচ্ছে সাড়ে ৬২ কোটি টাকার বেশি। একইভাবে চলমান জয়দেবপুর-এলেঙ্গা চার লেন মহাসড়কটিতেও কিলোমিটারপ্রতি নির্মাণ ব্যয় বেড়ে ঠেকেছে ৮৮ কোটি ৭৭ লাখ টাকায়। নির্মাণকালেই ঢাকার সঙ্গে দেশের উত্তর ও উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে যোগাযোগের জন্য গুরুত্বপূর্ণ মহাসড়কটিতে রাটিং (দেবে বা ফুলেফেঁপে যাওয়া) দেখা দিয়েছে।
দেশে ব্যয়বহুল সড়ক হচ্ছে, কিন্তু সেগুলো টেকসই হচ্ছে না। এর পেছনে মোটাদাগে চারটি কারণ চিহ্নিত করেছেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মো. হাদিউজ্জামান। এগুলো হলো যানবাহনের ওভারলোডিং, প্রথাগত বিটুমিন ব্যবহার, হাট-বাজার এলাকায় অপর্যাপ্ত ড্রেনেজ ব্যবস্থা ও সড়ক নির্মাণকালে গাড়ি চলাচল করতে দেয়া। এর মধ্যে বিটুমিনের বিষয়টিতে গুরুত্ব দিয়ে তিনি বলেন, আমাদের দেশে সড়ক টেকসই না হওয়ার অন্যতম কারণ বিটুমিন। এ বিটুমিনে পরিবর্তন আনা এখন সময়ের দাবি। এক্ষেত্রে পলিমার মডিফায়েড বিটুমিন বা পিএমবি সবচেয়ে ভালো বিকল্প হতে পারে।
আইএমইডির প্রতিবেদনে এসব মহাসড়ক নির্মাণের ক্ষেত্রে আরো কিছু সমস্যার কথা উঠে আসে। এগুলো হলো প্রকল্পের ব্যয় বৃদ্ধি, মেয়াদ বেড়ে যাওয়া, ঘন ঘন প্রকল্প পরিচালক পরিবর্তন, প্রকল্প পরিচালকদের প্রকল্প এলাকায় অবস্থান না করা, ত্রুটিপূর্ণ উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি), সম্ভাব্যতা সমীক্ষা ছাড়াই প্রকল্পের কাজ শুরু করা, মাটি পরীক্ষা না করা ইত্যাদি।
বিভাগটির অভিযোগ, এসব প্রকল্প পর্যবেক্ষণের পর সেগুলোর ত্রুটি দূর করতে বিভিন্ন সময়ে নানা সুপারিশ দিয়েছে সংস্থাটি। অনেক ক্ষেত্রে সেগুলোও আমলে নেয়া হয়নি।
ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের চার লেনের প্রকল্পটি নিয়ে আইএমইডির পর্যবেক্ষণ বলছে, অত্যধিক সংখ্যক ও অননুমোদিত ভারবাহী যানবাহন চলাচলের কারণে মহাসড়কটি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ক্রমবর্ধমান পণ্য ও যাত্রীবাহী যানবাহনের জন্য মহাসড়কটির পূর্ণ উপযোগিতা ও স্থায়িত্ব নিশ্চিত করতে দ্রুত নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচর্যা করা প্রয়োজন। তা না হলে দেশের অর্থনীতির প্রধান মহাসড়ক হিসেবে বিবেচিত সড়কটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যানবাহন চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
এ বিষয়ে আইএমইডি সচিব প্রদীপ রঞ্জন চক্রবর্তী বণিক বার্তাকে বলেন, সড়ক ও মহাসড়ক নির্মাণে অর্থ ব্যয়ের যৌক্তিকতা ও প্রয়োজনীয়তার বিষয় পর্যালোচনা করছে আইএমইডি। কারিগরি ও প্রায়োগিক নানান বিষয় এরই মধ্যে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটিকে অবহিত করা হয়েছে। চেষ্টা করছি জনগণের টাকার সর্বোচ্চ ব্যবহার ও দক্ষতার মাধ্যমে মানসম্পন্ন প্রকল্প সম্পন্ন করার। তবে সড়কের গুণগত মান বজায় রাখতে হলে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোর আরো দায়িত্বশীলতার প্রয়োজন রয়েছে। বিশেষ করে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের মাসিক পর্যালোচনা সভাটি আরো দক্ষ ও সঠিকভাবে হওয়া প্রয়োজন। তাহলে সেখানেই অনেক ত্রুটি-বিচ্যুতির সমাধান চলে আসতে পারে। পাশাপাশি পিএসসি ও পিআইসি কমিটিগুলোকে আরো সক্রিয় হওয়া প্রয়োজন। যে পর্যায়ে যতটুকু করা প্রয়োজন আইএমইডি সেগুলো দক্ষতার সঙ্গে দেখার চেষ্টা করছে। সেজন্য মাঠপর্যায়ে তদারকি আরো বেগবান করা হয়েছে।
অন্যদিকে সওজ অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী মো. আবদুস সবুর মনে করছেন, দেশের সড়ক-মহাসড়ককে যতটা খারাপ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়, বাস্তবে আসলে এগুলো ততটা খারাপ নয়। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, সব সড়ক একদিনে ভালো করা সম্ভব হবে না। ধীরে ধীরে সব সড়কই একসময় ভালো মানের হবে। আমরা সে লক্ষ্যেই কাজ করছি। এখন সবার প্রত্যাশা অনেক বেশি বেড়ে গেছে, আমরাও সেই প্রত্যাশা পূরণের জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি। আশা করছি দ্রুতই দেশের সব সড়ক মানসম্পন্ন হবে। তিনি আরো বলেন, সড়কের ওপর ওভারলোড যানবাহন নিয়ন্ত্রণ করাই এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমরা চেষ্টা করছি একটি নিরাপদ সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য ওভারলোডেড যানবাহন নিয়ন্ত্রণ করার উপায় বের করতে। আবার আমাদের দেশের সড়ক নির্মাণে যে মানের বিটুমিন ব্যবহূত হয়ে আসছে তাতে সড়কের স্থায়িত্ব ধরে রাখা যাচ্ছে না। আমরা বিটুমিনের গ্রেড কোয়ালিটি পরিবর্তন করে উচ্চমানের বিটুমিন ব্যবহার করছি। ঢাকা-সিলেট মহাসড়কসহ নতুন বেশকিছু সড়কে আমরা উচ্চ মানের বিটুমিন ব্যবহার করছি, সেগুলোতে ভালো ফলাফল মিলেছে। আমরা ধীরে ধীরে সব সড়কেই উন্নত গ্রেডের বিটুমিন ব্যবহার করব। সড়ক টেকসই করার পরিকল্পনা সব সময়ই ছিল, ভবিষ্যতেও থাকবে।
সূত্রঃ বণিক বার্তা