স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে সুখেই বসবাস করছিল মাসুদ। হঠাৎ একটি ঝড় নেমে আসে তার জীবনে। সেই ঝড় কেড়ে নেয় তার জীবন। এলাকার মানুষের দেওয়া তথ্যমতে, খুবই সাদামাটা জীবনযাপন করতো মাসুদ। হিংসের লেশমাত্রও ছিলনা তার।
কারো সাথে উচ্চস্বরে ঝগড়াও কোনওদিন। মাসুদ একদিন ভোররাতে ঘর থেকে বেরিয়ে তার স্ত্রী রেহেনা বেগমকে প্রতিবেশী জুয়েলের সাথে আপত্তিকর অবস্থায় দেখে। সেই দৃশ্যটা একজন স্বামীর কাছে কতটুকু কষ্টদায়ক ছিল তা পাঠকদের কাছে আলাদাভাবে বর্ণনা সহজ ব্যাপার নয়। তখন মাসুদের হৃদয় ভাঙা কাচের টুররোর মতো শতো, হাজারো, লাখো টুকরো হয়েছিল। শুধু হৃদয়ই ভাঙেনি তার স্ত্রী, জুয়েলের সাথে যৌনসঙ্গম করার সময় বাঁধা দিলে, চিৎকার চেচামেচি করলে তাৎক্ষণিকভাবে সংসারও ভেঙে দেওয়ার ঘোষণা দেয় রেহেনা বেগম।
উচ্চস্বরে এক তালাক! দুই তালাক! তিন তালাক বলে চিল্লাতে চিল্লাতে রেহেনা তখন তার স্বামী মাসুদকে তালাকের ঘোষণা দিয়ে বলেন, “তুই মর! তুই মরস না কেন ? তুই তারাতাড়ি মর! তুই মরলেই আমি জুয়েলকে বিয়ে করতে পারবো”।
এই কথাগুলো প্রতিবেদকের কাছে বর্ণনা দেয় তাদেরই সন্তান জুই। নিহত মাসুদ গাজীপুর জেলার শ্রীপুর উপজেলার টেপিরবাড়ী গ্রামের আব্দুল মান্নানের সন্তান (৩৭)। মাসুদ পেশায় মুদি দোকানি ছিল। আরও পনেরো বছর আগে ময়মনসিংহ জেলার ভালুকা উপজেলার রাজৈ গ্রামের আব্দুল হানিফের সন্তান রেহেনা বেগমের (৩৩) সাথে পারিবারিক ভাবে তাদের বিয়ে হয়। মাসুদের দুইজন সন্তান রয়েছে। একজনের নাম জুই (১৪) এবং আরেকজনের নাম জুনায়েদ (৭)। জুই স্থানীয় এম এইচ একাডেমির ৭ম শ্রেণির শিক্ষার্থী ও জুনায়েদ স্থানীয় একটি মাদরাসার শিক্ষার্থী। এই দুইজন সন্তান ও নিজের স্বামী থাকার পরও প্রতিবেশী জুয়েলের সাথে পরকীয়ায় লিপ্ত হয় রেহেনা।
জুয়েল (৩৫) উপজেলার টেপিরবাড়ি গ্রামের আব্দুস ছামাদ মাতবরের সন্তান। পেশায় একজন রাজমিস্ত্রী কন্ট্রাক্টর। নিহত মাসুদের সন্তান জুই ও মাসুদের মা আনোয়ারা বেগমের দেওয়া তথ্যমতে, গত শনিবার দিবাগত রাত [৬ সেপ্টেম্বর ২০২০] সাড়ে তিনটায় মাসুদ ঘুম থেকে উঠে তার স্ত্রী রেহেনা বেগমকে ঘরে না পেয়ে বাইরে গিয়ে বাড়ির পূর্ব পাশে জুয়েলের সাথে আপত্তিকর অবস্থায় (যৌনসঙ্গমরত) দেখে। সাথেসাথেই মাসুদ জুয়েলকে ধরে ফেলে। পরে এলোপাতাড়ি ধস্তাধস্তি করে দ্রুত ঘটনাস্থল থেকে দৌড়ে পালিয়ে যায় জুয়েল। আপত্তিকর অবস্থায় দেখার পর বাঁধা দেওয়ায় রেহেনা তার স্বামী মাসুদকে তিনবার তালাক দেয়। তালাকের কথা শোনার সাথে সাথে নিস্তব্ধ হয়ে যায় মাসুদ। এরপর মাসুদ আর কোনও কথা বলেনি। ওইদিন সকালে পরিবারের সদস্যদের মাধ্যমে তার অপকর্মের কথা জুয়েলকে জিজ্ঞাসা করলে জুয়েল বলে, ঘটনা জানাজানি হওয়ার পরও সে (মাসুদ) বেঁচে আছে কেন ? তার জন্য আমি রেহেনাকে বিয়ে করতে পারছি না’। এরপরই মাসুদ সকাল আটটায় বাড়ি থেকে বের হওয়ার আর জীবিত ফেরেনি, ফিরেছে মাসুদের লাশ!
জয়দেবপুর রেলওয়ে পুলিশ ফাঁড়ির সদস্যরা শ্রীপুর স্টেশনের দক্ষিণে লোহাগাছ এলাকায় রেল লাইনের উপর থেকে মাসুদের লাশ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পাঠায়। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে শ্রীপুর থানায় মামলা করার কথা বলে জামাল ( স্থানীয় আ.লীগ নেতা) থানার সামনে নিয়ে অভিযোগ লিখে নিয়ে আমাকে বলছিল, আমি থানায় জমা দিছি। আপনারা চলে যান, পুলিশ তদন্তে আসবে। ওই সময় পুলিশের সাথে আমার অভিযোগের বিষয়ে কোনও কথা হয়নি।
জামালসহ এলাকার কয়েকজনকে তিন লাখ টাকার বিনিময়ে মামলা করতে নিষেধ করে। এরপর বিচার না পেয়ে এলাকার গণ্যমান্যদের শরণাপন্ন হয় মাসুদের মা আনোয়ারা বেগম। পরে এলাকার আব্দুল জলিল চেয়ারম্যানের নির্দেশে খসরু মাদবর আমাকে তখন বলেন, ‘ঘটনার মীমাংসা করে দিই, তোমরা মামলায় গেলে কি আর হবে ? আসামি জুয়েলের থেকে ৩ লাখ টাকা নিয়ে দিই। এ ব্যাপারে আর দৌড়াদৌড়ি করে লাভ নাই, এসব বলে তারা বিচার প্রাপ্তিতে নানানভাবে আমাদেরকে বাঁধাগ্রস্ত করে। জামাল ও তার সঙ্গীয়দের কারণে থানায় মামলা করতে ব্যর্থ হয়ে এলাকায় গণ্যমান্যদের কোনও সহায়তা না পেয়ে বিচারের দাবিতে গাজীপুর জেলা পুলিশ সুপার (এসপি) শামসুন্নাহার কে বিস্তারিত জানান তিনি। ঘটনা শোনার পর শ্রীপুর থানা পুলিশকে মামলা নেওয়ার নির্দেশ দেন পুলিশ সুপার।
কথা মতো আনোয়ারা বেগম শ্রীপুর থানায় গেলে মামলা নম্বর ৬৯ [১৯ নভেম্বর ২০২০] তারিখে রেকর্ড করেন ওসি। এই মামলাটির তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে এসআই আনোয়ার হোসেনকে। মামলায় আসামিরা হলেন, ময়মনসিংহ জেলার ভালুকা উপজেলার রাজৈ গ্রামের হানিফের সন্তান ও নিহত মাসুদের স্ত্রী রেহেনা আক্তার (৩৩) এবং উপজেলার টেপিরবাড়ি গ্রামের আব্দুস ছামাদ মাতবরের সন্তান জুয়েল (৩৫)। এ ব্যাপারে মীমাংসার চেষ্টাকারী খসরু মাদবর জানিয়েছেন, আমি এ বিষয়ে তেমন কিছু জানি না। সব জানে জলিল চেয়ারম্যান (সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান)। এ ব্যাপারে সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান আব্দুল জলিল বিএ এর মোবাইলে কয়েকদিন একাধিকবার ফোন করে যোগাযোগ করার চেষ্টা করলে তিনি রিসিভ করেননি। মেসেজ পাঠালেও তিনি কোনও উত্তর দেননি।
এ বিষয়ে অভিযুক্ত জুয়েলের স্ত্রী [২ ডিসেম্বর ২০২০] বিকেলে জানিয়েছেন, আরও ১০-১৫ দিন আগে মামলা হওয়ার খবর পেয়ে আমার স্বামী বাড়ি থেকে পালিয়েছে। কোথায় আছে আমার জানা নেই। আমাদের কারও সাথে কোনও যোগাযোগ নেই। মামলার বাদী আনোয়ারা বেগম আরও জানিয়েছেন, থানায় মামলা হওয়ার পর বাড়িতে এসে আসামি দুইজনের ব্যাপারেই মামলার আয়ুকে ফোন করে জানাই, তখন তিনি ব্যস্ততা দেখিয়ে বলেন, আগামীকাল আসবো। পরে ওই রাতেই আসামি জুয়েল ও রেহেনা বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যায়। এখন পর্যন্ত আসামিরা কেউ গ্রেপ্তার হয়নি, ওই রাতে ফোন করার পর পুলিশ গুরুত্ব দিলে আসামি ধরতে পারতো। আমি আমার সন্তান হত্যার সঠিক বিচার চাই। এ ব্যাপারে শ্রীপুর থানার এসআই আনোয়ার হোসেন জানিয়েছেন, মামলা হওয়ার পরই আসামি দুইজন পালিয়েছে। তাদেরকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। আশা করছি, খুব শীঘ্রই আসামিদের গ্রেপ্তার করা হবে।
শ্রীপুর প্রতিনিধি / মোঃ মোজাহিদ