ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে করোনা কালিন সরকারের ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজের অর্ধেকও পৌঁছেনি ক্ষতিগ্রস্তদের হাতে। বিতরণ প্রক্রিয়ায় জটিলতা, বিলম্ব, ব্যাংকের আস্থাহীনতা ও অস্বচ্ছতার কারণেই এ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। অথচ সরকার ২১টি প্যাকেজের মাধ্যমে ১ লাখ ২১ হাজার কোটি টাকার ঋণ, নগদ অর্থ ও খাদ্যসহায়তার ঘোষণা করেছে।
অর্থ মন্ত্রণালয় প্রণোদনা প্যাকেজের শতভাগ অর্থ বিতরণের জন্য অক্টোবর পর্যন্ত সময় বেঁধে দেয় সংশ্লিষ্ট ব্যাংক ও মন্ত্রণালয়কে। কিন্তু নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ৬৬ হাজার ৬৬৫ কোটি টাকা বিতরণ করতে পারেনি সংশ্লিষ্ট ব্যাংক, মন্ত্রণালয় ও সংস্থা। প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়ন নিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদন থেকে পাওয়া গেছে এসব তথ্য।
এ প্রসঙ্গে অর্থ সচিব (সিনিয়র) আবদুর রউফ তালুকদার বৃহস্পতিবার অনুষ্ঠিত প্রণোদনা সংক্রান্ত এক বৈঠকে বলেছেন, সরকার অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। এই প্যাকেজ বাস্তবায়নের বিষয় নিয়ে স্বাধীন মূল্যায়নের দিকটি ভেবে দেখা হবে। তবে এসব প্রণোদনা প্যাকেজ অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সানেম-এর নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান বলেন, গবেষণায় দেখা গেছে, প্যাকেজ ঘোষণার পর ক্ষতিগ্রস্ত ৪ শতাংশ প্রতিষ্ঠান পুনরুদ্ধার হয়েছে, ২৯ শতাংশ হতে পারেনি। তিনি বলেন, প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়নে অর্থায়ন, ব্যবস্থাপনা ও মনিটরিংয়ের দিকে নজর দিতে হবে। তাহলে প্যাকেজ কার্যকর হবে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে ২১টি প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়নের অগ্রগতি তুলে ধরা হয়। এতে বলা হয়, রফতানিমুখী তৈরি পোশাক খাতের শ্রমিকদের বেতন দেয়ার জন্য ৫ হাজার কোটি টাকার বিশেষ তহবিল দেয়া হয়েছিল। ১ হাজার ৯৯২ পোশাক শিল্পের ৩৫ লাখ শ্রমিক-কর্মচারীকে এ তহবিলের পুরো অর্থ দেয়া হয়েছে।
এ ছাড়া ক্ষতিগ্রস্ত শিল্প ও সেবা প্রতিষ্ঠানের ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল হিসেবে ৪০ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ থেকে গত অক্টোবর পর্যন্ত ২৮ হাজার ৩৩৮ কোটি টাকার ঋণ দেয়া হয়েছে। আর বিতরণ বাকি আছে ১১ হাজার ৬৬২ কোটি টাকা। এ পর্যন্ত ২ হাজার ৫৪৯টি শিল্পপ্রতিষ্ঠান এ প্যাকেজ থেকে ঋণ পেয়েছে।
পাশাপাশি কুটির, মাইক্রো, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পোদ্যোক্তাদের (সিএমএমএমই) জন্য ৩০ হাজার কোটি টাকা প্রণোদনা প্যাকেজ থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ৬ হাজার ৩৪৬ কোটি টাকা বিতরণ করা হয়। বাকি আছে ২৩ হাজার ৬৫৪ কোটি টাকা। এখান থেকে ঋণ পেয়েছে ৪১ হাজার ৬৯টি এসএমই প্রতিষ্ঠান।
প্রতিবেদনে বলা হয়, রফতানি খাতে সহায়তার জন্য এক্সপোর্ট ডেভেলপমেন্ট ফান্ডে (ইডিএফ) ১২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়। এর মধ্যে গত অক্টোবর পর্যন্ত ৩০ কোটি টাকা বিতরণ করা হয়েছে। ১২ হাজার ৭২০ কোটি টাকা এখনও ফান্ডে আছে। এ পর্যন্ত ২ হাজার ৩৭৯ উদ্যোক্তাকে এ অর্থ দেয়া হয়।
এদিকে রফতানি খাতের আরেক প্রণোদনা প্যাকেজ প্রি-শিপমেন্ট ক্রেডিট রি-ফাইন্যান্সিংয়ের ৫ হাজার কোটি টাকার স্কিম থেকে ৪ হাজার ৯৫১ কোটি টাকা বিতরণ হয়নি। অক্টোবর পর্যন্ত ৪৯ কোটি টাকা দেয়া হয়েছে ৯টি প্রতিষ্ঠানকে।
করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের সরাসরি সেবায় নিয়োজিত ডাক্তার-নার্স ও চিকিৎসাকর্মীদের দুই মাসের মূল বেতনের সমপরিমাণ সম্মানী প্রণোদনা হিসেবে ঘোষণা দেয়া হয়। এ খাতে ১শ’ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হলেও কোনো অর্থ বিতরণ করা হয়নি।
প্রতিবেদন সূত্রে আরও জানা গেছে, করোনায় কর্মহীন দরিদ্র মানুষকে খাদ্যসহায়তা করতে আড়াই হাজার কোটি টাকার প্যাকেজ ঘোষণা দেয়া হয়। গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ১ হাজার ৬৭ কোটি টাকা দেয়া হয়েছে। আরও ১ হাজার ৪৩৩ কোটি টাকা বিতরণ বাকি আছে।
এ ছাড়া নিু আয়ের মানুষের মধ্যে ১০ টাকা কেজির চাল বিতরণের জন্য ৭৭০ কোটি টাকা প্রণোদনার পুরোটাই ব্যয় হয়েছে। এতে ১৮ লাখ গরিব মানুষ উপকৃত হয়েছেন। আর সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির বাইরে করোনায় ক্ষতিগ্রস্তদের নগদ আড়াই হাজার টাকা দেয়ার জন্য ১ হাজার ২৫০ কোটি টাকার প্যাকেজ দেয়া হয়। সর্বশেষ তথ্যমতে, ৩৭০ কোটি টাকা বিতরণ করা হয়নি। মাঠ পর্যায়ে ৮৮০ কোটি টাকা ৩৫ লাখ গরিব মানুষকে দেয়া হয়েছে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, গ্রামে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে ৩ হাজার ২০০ কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ থেকে ২ হাজার কোটি টাকা বিতরণ করা হয়নি। তবে প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক, কর্মসংস্থান ব্যাংক, পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক, আনসার ভিডিপি ব্যাংক ও পল্লী কর্ম সহায়ক ফাউন্ডেশনের (পিকেএসএফ) মাধ্যমে ১ হাজার ২০০ কোটি টাকার ঋণ দেয়া হয়েছে।
করোনার নেতিবাচক প্রভাবের কারণে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। ১১২টি উপেজলায় শতভাগ বয়স্ক, বিধবা ও প্রতিবন্ধীদের এর আওতায় আনার কার্যক্রম শুরু হয়েছে। এ প্যাকেজে ৮১৫ কোটি টাকা বরাদ্দ থাকলেও বিতরণ করা হয়েছে ২৩ কোটি টাকা। বিতরণ বাকি আছে ৭৯২ কোটি টাকা।
গৃহহীন মানুষের জন্য ঘর নির্মাণ করে দেয়া কর্মসূচির আওতায় ২ হাজার ১৩০ কোটি টাকার প্যাকেজের মধ্যে ১ হাজার ১৬০ কোটি টাকা দেয়া হয়েছে আর বিতরণ সম্ভব হয়নি ৯৭০ কোটি টাকা। পাশাপাশি কৃষকের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে ৮৬০ কোটি টাকার ধান-চাল সংগ্রহের লক্ষ্যে বরাদ্দ দেয়া হয়। এটি বাস্তবায়ন চলছে। আর কৃষিকাজ যান্ত্রিকীকরণ ৩ হাজার ২২০ কোটি টাকা প্যাকেজের মধ্যে ১৬৮ কোটি টাকা বিতরণ হয়েছে। বাকি ৩ হাজার ৫২ কোটি টাকা এখন কৃষকের কাছে পৌঁছেনি।
প্রতিবেদনটি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, সার ও বীজের জন্য ৯ হাজার ৫০০ কোটি টাকার প্রণোদনা দেয়া হয়েছে। অক্টোবর পর্যন্ত ৭ হাজার ১৮৮ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। ২ হাজার ৩১২ কোটি টাকা বিতরণ করা হয়নি। শস্য ও ফসল চাষের জন্য ৫ হাজার কোটি টাকার কৃষি রিফাইন্যান্সিং স্কিম থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ৯১ হাজার ৭০১ কৃষককে ২ হাজার ২৬৯ কোটি টাকা ঋণ দেয়া হয়েছে। বিতরণ বাকি আছে ২ হাজার ৭৩১ কোটি টাকা।
এ ছাড়া ক্ষতিগ্রস্ত পেশাজীবী, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক ৩ হাজার ৩৭০ কোটি টাকার একটি স্কিম ঘোষণা দিয়েছে। এ থেকে অক্টোবর পর্যন্ত বিতরণ করা হয় ৬৪৮ কোটি টাকা, বিতরণ বাকি আছে ২ হাজার ৭২২ কোটি টাকা।
সূত্র আরও জানায়, বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর বিতরণকৃত ঋণের সুদ স্থগিত করার ঘোষণা দিয়েছে সরকার। এ জন্য ২ হাজার কোটি টাকা সুদ সরকার ভর্তুকি হিসেবে ব্যাংকগুলোকে দেবে। এ প্যাকেজের আওতায় এখনও কোনো অর্থ ব্যাংকগুলোকে দেয়া হয়নি। তবে ব্যাংকগুলো অক্টোবর পর্যন্ত ৭৩ লাখ গ্রাহকের কাছ থেকে ১ হাজার ৩৯০ কোটি টাকার সুদ মওকুফের আবেদন পেয়েছে।
পাশাপাশি তৈরি পোশাক, চামড়াজাত পণ্য ও পাদুকা শিল্পের কর্মহীন শ্রমিকদের জন্য ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জাপান ও সরকার যৌথভাবে দেড় হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ থেকে কোনো অর্থ বিতরণ হয়নি। চিহ্নিত বেকার শ্রমিকরা তিন মাস নগদ সহায়তা হিসেবে ৩ হাজার টাকা করে প্রতি মাসে পাবেন। মাইক্রো, কুটির ও ক্ষুদ্র শিল্পঋণের জন্য ক্রেডিট গ্যারান্টি স্কিমের ২ হাজার কোটি টাকা থেকে এখন পর্যন্ত এক টাকাও ছাড় হয়নি।
সূত্রঃ যুগান্তর