হুতু, তুতসি এবং তাও এই তিন জনগোষ্ঠির দেশ রুয়ান্ডা। নাক ও কপালের পরিমাণে কিঞ্চিত পার্থক্য ছাড়া একই ভাষা, ধর্ম সংস্কৃতি লালন করে তারা। জার্মানি থেকে দখলদারিত্ব বুঝে নেওয়ার পর থেকে বেলজিয়াম বর্ণবাদি শ্রেণীকরণ কৌশল নিয়ে দেশটিতে শুরু করে শোষণবাদী শাসন। সংখ্যালঘু তুতসি সম্প্রদায়কে অধিক সুযোগসুবিধা দিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ হুতু জনগণের মাঝে তৈরি করে দেয় অসন্তোষ, ক্ষোভ, ঘৃণাচর্চা।
বেলজিয়াম পরবর্তীতে ক্ষমতা হস্তান্তর করে যায় হুতুতের হাতে। দশক দশক ধরে লালিত ঘৃণা ও ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ হয় রক্তাক্ত সহিংসতার মধ্য দিয়ে। হাজার হাজার তুতসি ও মধ্যমপন্থী হুতুকে গৃহহীন করা হয়, পাঠানো হয় বাধ্যতামূলক নির্বাসনে।
নীপিড়ন প্রতিরোধে এই শরণার্থীদের একটি দল গড়ে তোলে রুয়ান্ডা পেট্রিয়টিক ফ্রন্ট (আরপিএফ)। এই গেরিলা দল ১৯৯০ সালে হুতি শাসনের বিরুদ্ধে শুরু করে এক লড়াই। যুদ্ধের এই চক্র চলতে থাকে পরবর্তী তিনবছর।
জাতিসংঘের সহায়তায় দুপক্ষের ক্ষমতা ভাগাভাগি সমঝোতা স্মারক।
কিন্তু উগ্রপন্থী হুতিরা তাদের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার জন্য চুক্তি বাস্তবায়নে বাঁধা দেয়, পরিকল্পনা করে ইতিহাসের এক জগণ্য গণহত্যার।
রুয়ান্ডার এই প্রেক্ষাপট ও যুদ্ধের নিষ্ঠুর চিত্র নিয়ে দুটি সিনেমা- সামটাইমস ইন এপ্রিল, হোটেল রুয়ান্ডা।
সিনেমা দুটিতে ফুটে উঠছে দুটো দিক। এক. কলোনিয়াল পিরিয়ডে নৃতত্ত্বের বিকাশের ইতিকথা, দুই. দাঙ্গা, গণহত্যার কিংবা অন্য জনগোষ্ঠীর উপর নীপিড়নের প্রেক্ষাপট কিভাবে তৈরি হয়, সেই আলাপ। মূলত যেকোন যুদ্ধ বা দাঙ্গার পেছনে একটা তাত্ত্বিক ব্যাকগ্রাউন্ড থাকে।
সামটাইমস ইন এপ্রিল সিনেমায় রুয়ান্ডা জনগোষ্ঠীকে, চোখ, নাক ও চোয়ালের পরিমাপ করার দৃশ্য এবং গণহত্যা যখন সংঘটিত হচ্ছিল কোন প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ না নিয়ে পশ্চিমাদের অ্যাক্টস অব জেনোসাইড ও জেনোসাইড সংজ্ঞায়নের অহেতুক বিতর্ক আর হোটেল রুয়ান্ডায় গণহত্যা আগাম টের পেয়ে প্রতিহত করার বদলে সকল বিদেশিদের ফিরিয়ে নেওয়ার সময় পিস কিপিং মিশনের কমান্ডার ও হোটেল ম্যানেজার পলের সাথে যে কথোপকথন-
‘We think you are dirt
Who is we?
The west, all the superpowers, everything you believe in’- যেন মনে করিয়ে দেয় নৃতত্ত্বের বিকাশের কথা।
আমেরিকা,আফ্রিকা,অস্ট্রেলিয়া, এশিয়ার বিভিন্ন অংশে ইউরোপীয়দের উপনিবেশ স্থাপন শুরু হলে অভিযাত্রীরা বিশ্বের বিভিন্ন অংশের জনগোষ্ঠীর সংস্পর্শে আসে। ভিন্ন ভিন্ন জনগোষ্ঠীর সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহের কাজ শুরু হয়। এর মূলে যেমন ছিল এসব জনগোষ্ঠীকে নিয়ন্ত্রনের উদ্দেশ্য, তেমনি অনেকের মধ্যে ভিন্ন সংস্কৃতিকে জানার স্পৃহাও ছিল। অইউরোপীয়দের বর্বর এবং অপর (আদার) পরিচিত করে দেওয়ায়ই এই স্টাডির মুখ্য উদ্দেশ্য।
নৃতত্ত্বের Anthropology এর উৎসমূল (etymology) এর দিকে খেয়াল করলে এটা স্পষ্ট বুঝা যায়। ‘anthrop’ হচ্ছে গ্রীক শব্দ, যার অর্থ ‘human animal’; ‘human being’ নয়। পৃথিবীর বিভিন্ন অংশে উপনিবেশ স্থাপনের পর এর অধিবাসীদর নিয়ে ঔপনিবেশিক স্কলারগন স্টাডি শুরু করল। এর নাম দিল Anthropology। মানে পুরোপুরি মানুষ (human being) না, পশ্চিমারা তাদেরকে মানুষরূপী পশু (human animal) মনে করত।
দুটি সিনেমাতেই দেখা যায় কিভাবে অন্য জনগোষ্ঠীর মানুষদের অসভ্য ও ‘’অপর’ করে তোলার রাজনীতি দাঙ্গার মনস্তাত্ত্বিক প্রেক্ষাপট তৈরি করে দেয়।
দিল্লি ভায়োলেন্স নিয়ে আশীস নন্দী একটা ইন্টারভিউতে বলেছেন, একটা দাঙ্গা শুরু হলে দুটি পক্ষ এর অংশীদার হয়। এক লুটেরার দল, আরেক সাধারণ মানুষ।
লুটেরার দল নিজেদের স্বার্থ, অন্যের সম্পত্তি দখল ও মারামারি সহজাত প্রবৃত্তির জন্য দাঙ্গায় শরীক হয়।কিন্তু সাধারণ মানুষদের মবিলাইজ করতে হয় প্রপাগান্ডা দিয়ে, ফেইক নিউজ ছড়িয়ে ক্রোধ তৈরি। কৃত্রিম শত্রু তৈরি করে নিজেদের দুর্দশা ও করুন অবস্থার জন্য অন্যের উপর দোষ চাপানোর মধ্য দিয়ে।
তোমাদের শত শত মানুষকে তারা খুন করেছে, তাদের হাতে লেগে আছে তোমাদের পিতা-সন্তানদের রক্ত।অথচ তোমরা চুড়ি পড়ে ঘরে বসে আছো। নিজেদের শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে আমরা লড়ে যাব, আমাদের মানুষদের হত্যার প্রতিশোধ নেব- এমন উস্কে দেওয়া বক্তব্যের মধ্য দিয়ে সাধারণ জনগণকে সহিংসতায় অংশগ্রহণ করাতে হয়।
সকল খুন হত্যা,ধর্ষণ, নির্যাতন জাস্টিফাই করে নিতে হয় অপর গোষ্ঠীকে দানব আকারে হাজির করে। যেন-Give a dog a bad name and hang him। যেমনটা হোটেল রুয়ান্ডায় তুতসিদের হত্যা করার জন্য বলা হয় ‘Cut the tall trees’।
সামটাইমস ইন এপ্রিলে- So when I grow up, my ID card will say ‘Hutu’?
Augustin: Yes. But one day, I hope that it will just say : ‘Rwandan’- বাবা ও ছেলের মাঝে এই কথোপথন আর হোটেল রুয়ান্ডায় শরনার্থি শিবিরে দুই শিশু আত্মীয়কে খুঁজে পাওয়ার আনন্দ আমাদের অনুভূতি জাগিয়ে একটা নাড়া দেয়।
‘They said there wasn’t any room
-There’s always room’ আশাবাদী একটা দৃশ্য দিয়ে যেখানে হোটেল রুয়ান্ডা শেষ হয় সেখানে সামটাইমস এপ্রিল যেন অল কোয়ায়েট অন দ্য ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট। যুদ্ধ শেষ কিন্তু যুদ্ধের স্মৃতি, মানসিক বেদনা আর ক্ষত বয়ে বেড়ানো।