বাংলা চলচ্চিত্রের কিংবদন্তি অভিনেতা প্রবীর মিত্র আর আমাদের মাঝে নেই। সোমবার, ৬ জানুয়ারি ২০২৫, ঢাকায় ৮৩ বছর বয়সে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। অভিনেতা মিশা সওদাগর তার মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এক পোস্টে মিশা সওদাগর লিখেছেন, ‘প্রবীর মিত্র দাদা আর নেই। কিছুক্ষণ আগে তিনি ইন্তেকাল করেছেন। স্রষ্টা তাকে ক্ষমা করুন।’
প্রবীর মিত্রের জানাজা সোমবার বাদ জোহর বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন কর্পোরেশন (বিএফডিসি)-এ অনুষ্ঠিত হবে। পরে আজিমপুর কবরস্থানে তাকে দাফন করা হবে। দীর্ঘদিন ধরে শারীরিক নানা জটিলতায় ভুগছিলেন এই অভিনেতা। অক্সিজেন স্বল্পতা, ব্লাড লস, এবং প্লাটিলেট কমে যাওয়ার সমস্যাসহ অন্যান্য শারীরিক অসুস্থতার কারণে তাকে গত ২২ ডিসেম্বর রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। দিন যত গড়ায়, তার শারীরিক অবস্থা আরও অবনতি হতে থাকে।
১৯৪১ সালে চাঁদপুরে জন্মগ্রহণ করা প্রবীর মিত্রের শৈশব কেটেছে ঢাকায়। তার পৈতৃক বাড়ি ঢাকার কেরানীগঞ্জের শাক্তায় অবস্থিত। ঢাকার কোতোয়ালি থানার হরিপ্রসন্ন মিত্র রাস্তাটি তার দাদার নামানুসারে নামকরণ করা হয়। বিএসসি পাস করার পর তিনি লেখাপড়ার যবনিকা টানেন।
প্রবীর মিত্রের অভিনয় জীবন শুরু হয় স্কুলে পড়াকালীন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ডাকঘর’ নাটকে অভিনয়ের মাধ্যমে। প্রহরী চরিত্রে অভিনয় করে তিনি প্রথমবারের মতো সবার নজর কাড়েন। পরে পুরনো ঢাকার লালকুঠিতে নাট্যচর্চার মাধ্যমে তার অভিনয় দক্ষতা আরও বিকশিত হয়। ১৯৬৮ সালে পরিচালক এইচ আকবরের হাত ধরে ‘জলছবি’ চলচ্চিত্রে তার প্রথম অভিনয়ের সুযোগ আসে। ছবিটির গল্প এবং সংলাপ লিখেছিলেন তার স্কুলজীবনের বন্ধু, আরেক কিংবদন্তি অভিনেতা এটিএম শামসুজ্জামান।
প্রবীর মিত্র তার ক্যারিয়ারে অসংখ্য জনপ্রিয় চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন। নায়ক হিসেবে অভিনয়ের সুযোগ কম পেলেও তার চরিত্রাভিনয়ের গভীরতা দর্শকদের মন জয় করে নিয়েছে। ১৯৬৭ সালে নির্মিত সাদাকালো ‘নবাব সিরাজউদ্দৌলা’ চলচ্চিত্রে আনোয়ার হোসেনের অসাধারণ অভিনয়ের পর, রঙিন সংস্করণে নবাব সিরাজউদ্দৌলার চরিত্রে অভিনয় করে দেশজুড়ে প্রশংসা কুড়িয়েছিলেন প্রবীর মিত্র।
১৯৭০ থেকে ১৯৭৯ সালের মধ্যে তার অভিনীত উল্লেখযোগ্য ছবির তালিকায় রয়েছে ‘জীবন তৃষ্ণা’, ‘জলছবি’, ‘তিতাস একটি নদীর নাম’, ‘সেয়ানা’, ‘জালিয়াত’, ‘রক্তের ডাক’, ‘ফরিয়াদ’, ‘রক্ত শপথ’, ‘চরিত্রহীন’, ‘জয়পরাজয়’, ‘অঙ্গার’, ‘মিন্টু আমার নাম’, ‘ফকির মজনু শাহ’, ‘মধুমিতা’, ‘অশান্ত ঢেউ’, ‘অলঙ্কার’, ‘অনুরাগ’, ‘প্রতিজ্ঞা’, ‘তরুলতা’, ‘গায়ের ছেলে’, ‘পুত্রবধূ’ প্রভৃতি।
১৯৮০ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত প্রবীর মিত্র অভিনীত উল্লেখযোগ্য ছবির তালিকায় রয়েছে ‘নৌ চোর’, ‘সুখে থাকো’, ‘ঝুমকা’, ‘সোনারতরী’, ‘সুখের সংসার’, ‘প্রতিহিংসা’, ‘আরশীনগর’, ‘মানসম্মান’, ‘চেনামুখ’, ‘অপমান’, ‘চ্যালেঞ্জ’, ‘ফেরারী বসন্ত’, ‘আঁখি মিলন’, ‘রসের বাইদানী’, ‘নয়নের আলো’, ‘মন পাগলা’, ‘জিপসি সর্দার’, ‘দহন’, ‘মায়ের দাবি’, ‘ঘর ভাঙা ঘর’, ‘রানী কেন ডাকাত’, ‘বেদেনীর প্রেম’ প্রভৃতি।
প্রবীর মিত্র ১৯৮৩ সালে প্রথমবারের মতো জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেন। তার অসামান্য অভিনয় দক্ষতার জন্য তিনি বাংলা চলচ্চিত্রে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন।
বাংলাদেশ চলচ্চিত্র অঙ্গনের জন্য প্রবীর মিত্রের মৃত্যু এক অপূরণীয় ক্ষতি। সৃষ্টিকর্তা তাকে পরকালীন শান্তি দান করুন এবং তার পরিবারকে এই শোক সইবার শক্তি দিন।