দুর্নীতিতে বেসামাল
Advertisements

গাজীপুরের শ্রীপুর পৌরসভার নাগরিকগণ নিয়মিত পৌর-কর পরিশোধ করলেও ভাগ্য বদল হয়নি স্বয়ংসম্পূর্ণ এই পৌরসভার। তবে ভাগ্য বদলেছে পৌরসভায় কর্মরত স্থানীয় ৪৫ জনসহ অস্থায়ী আরো প্রায় অর্ধশত কর্মচারীর। যাদের পিছনে মাসে খরচ হয় প্রায় দেড় কোটি টাকা। কর্মচারীদের নিজস্ব দপ্তর (খাত) না থাকায় তাদেরকে সংযুক্ত করা হয়েছে অন্যান্য বিভিন্ন দপ্তরে (খাতে), আর এই সুযোগটাকে কাজে লাগিয়ে গুছিয়ে নিয়েছে নিজেদের আখের।

সহকারী লাইসেন্স পরিদর্শক লিজা আক্তারের বেতন সর্বসাকুল্যে ১৫ হাজার ৪ শত ৫৩ টাকা হলেও তিনি সম্পদ গড়েছেন অর্ধশত কোটি টাকার উপরে।অনৈতিক টাকায় সম্পদ অর্জন করলেও রাজস্ব ফাঁকি ও দুদক থেকে বাঁচার জন্য সরাসরি নিজের নামে জমি না কিনে কয়েক ধাপে জমি কিনেছেন। ২৯ ডিসেম্বর ২০২২ সালে সম্পাদনকৃত একটি দলিল নম্বর ২২০৪১ সূত্রে দেখা যায়, তিনি প্রথমে জমি কিনেন তার নিকটাত্মীয়ের নামে, পরে সেই জমি আবার হেবা সূত্রে হস্তান্তর করা হয় তার বোনের নামে। সর্বশেষ চুড়ান্ত পর্যায়ে হেবার মাধ্যমেই সেই জমি নিজের নামে লিখে নেন লিজা আক্তার। পৌরসভার ৭ নম্বর ওয়ার্ডের ১নং সিএন্ডবি এলাকার বাড়ীসহ জমির দাম আনুমানিক তিন কোটি টাকা হলেও, কৌশল করায় সরকার রাজস্ব বঞ্চিত হয়েছে।

অন্যদিকে উপজেলার তেলিহাটি ইউনিয়নের টেংরা গ্রামের মাসুদ হাসানের নিকট হতে ২০১৮ সালে মাওনা-বরমী রোডে ২৬৮ নম্বর খতিয়ানের ৭৭৪/২৭৪১ নং দাগে ০.৫৪৮২ শতাংশ জমি ক্রয় করেন। যার বর্তমান বাজার মূল্য প্রায় তিন কোটি টাকা। স্থানীয় এনামুল হক এনাম বলেন, লিজা-জসিম দম্পতি শ্রীপুর পৌরসভায় চাকুরী করে নামে বেনামে অঢেল সম্পত্তির মালিক হয়েছেন। তিনি আরো জানান, লিজা-জসিম দম্পতির নামে সাতখামাইর মৌজায় এসএ ৮৮, আরএস ৪৭০ খতিয়ানের এসএ ১৭১৩ ও আরএস ১০১০৭ নং দাগে মোট ৩৭০ শতাংশ বা ১১ বিঘা জমি রয়েছে। আরো জানা যায়, লিজা ২০২০ সাল থেকে পৌরসভায় সরকারি চাকুরি করলেও ২০২২ সালে সম্পাদিত একটি দলিলে তিনি পেশা হিসেবে উল্লেখ করেন গৃহিনী।

লিজার মতই তার স্বামী মোহাম্মদ জসিম উদ্দিনের দুর্নীতি কাণ্ড! তিনিও চাকুরী করেন একই পৌরসভায় নকশাকার পদে। বরমী ইউনিয়নের মাইজপাড়া গ্রামের স্থানীয়রা জানান, জসিমের পিতা ওই এলাকায় ফেরী করে মালামাল বিক্রি করতেন। কিন্তু জসিমের পৌরসভায় চাকুরীর কল্যাণে রাতারাতি তাদের ভাগ্যের নকশা-ই বদলে যায়। মাত্র ২৪ হাজার ৮ শত ৫৪ টাকা বেতনের চাকুরী করে মাত্র পনের বছরে করেছেন কয়েকশো কোটি টাকার সম্পদ।

অনুসন্ধানে জানা যায়, মাওনা-বরমী সড়ক লাগোয়া ২৬৮ নম্বর খতিয়ানে ৫৪ শতাংশ একটি জমি ক্রয় করেন তার স্ত্রীর নামে। সাতখামাইর মৌজায় ৯২ বিগা জমি রয়েছে তাদের। সবই করেছেন শ্রীপুর পৌরসভায় চাকরির পর অর্জিত দুষ্প্রাপ্য আলাদিনের চেরাগের মাধ্যমে। ওই দম্পতির সম্পদের বিষয়ে জানতে চাইলে তারা সবকিছুই অস্বীকার করেন। তার সাথে আলাদাভাবে দেখা করার কথা বলে ফোন রেখে দেন।

লিজা-জসিম দম্পতির ভাগিনা ফেরদৌস আহমেদ। তিনিও খালা ও খালুর সাথে একই পৌরসভায় স্বাস্থ্য সহকারী পদে কাজ করেন জন্ম নিবন্ধন শাখায়। বেতন পান ১৫ হাজার ৫ শত ৫৪ টাকা। অথচ এই বেতনেই চৌকশ এই ব্যক্তি করেছেন অর্ধ কোটির টাকা সম্পদ। স্থানীয়রা জানান, সাতখামাইর মৌজার ৪৪৬ আরএস খতিয়ান, ১৯৮১ দাগ, ১০২১ আরএস খতিয়ান, ১৬৪০০ দাগে বিশ শতাংশ জমির উপর একটি বহুতল ভবন নির্মানাধীন রয়েছে তার। আবার গেল বছরের শেষ মাসে একই মৌজায় নিজের মায়ের নামে চৌদ্দ শতাংশ জমিও কিনেন তিনি। এনামুল হক এনাম আরো জানায়, ফেরদৌস আহমেদের মা নাজমা আক্তার ও বাবা মোঃ ফজলুল হকের নামে বিভিন্ন এলাকায় রয়েছে আরো বিপুল পরিমানে সম্পদ। এ বিষয়ে ফেরদৌসের কাছে জানতে চাইলে তিনি প্রথমে কথা বলতে না চাইলেও পরবর্তীতে তিনি বলেন, “পিতা-মাতার সম্পদের বিষয়ে আমি কিছু জানি না, তবে কর্মস্থলে আসার পরে আমার বিরুদ্ধে অনেকেই ষড়যন্ত্র করছে”।

ফেরদৌসের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের রহস্যের সন্ধান করতে গিয়ে খোঁজ মেলে বাগানবিহীন মোঃ আবু সাঈদ সরকারের কোটি টাকার সম্পদের। তিনি মালি পদে চাকুরীর সুবাদে গড়েছেন কোটি টাকার সম্পদ। জানা যায়, তিনি মাসিক ২৪ হাজার টাকা বেতনে চাকুরি করে শ্রীপুর পৌরসভার ২ নম্বর ওয়ার্ডের শ্রীপুর মৌজায় ৯২৭৮ নং জোতে তার ক্রয়কৃত সাড়ে তিন শতাংশ জমির উপর নির্মাণ করেছেন দ্বিতল ভবন। আবার তার পাশেরই আরেকটি জমিতে নির্মানাধীন রয়েছে আরেকটি বহুতল ভবন। স্থানীয় বাসিন্দা মিজান বলেন, আবু সাইদের জমিসহ বাড়ির আনুমানিক বাজার মূল্য প্রায় দের কোটি টাকা। পাশাপাশি শ্রীপুর উপজেলার গোসিংগা ইউনিয়নের পটকা গ্রামেও কৃষি জমি রয়েছে বাগান মালী আবু সাইদের মালিকানায়। এ বিষয়ে তিনি বলেন, আপনারা যদি বাড়িসহ জমির মূল্য ৩০ লক্ষ টাকাও বেচতে পারেন, তবে বিক্রি করে দেন”।

কনজারবেন্সি ইন্সপেক্টর পদে চাকুরী করেন জহির রায়হান। মাত্র ১৯ হাজার ৭ শত ৭৬ টাকার বেতনের চাকরি করে অল্প কয়েক দিনের মধ্যেই আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ বনে গেছেন তিনি। সরেজমিনে দেখা যায়, সমগ্র পৌরসভা’ই যেন ময়লার ভাগার! অভিযোগ আছে শ্রীপুর পৌরসভার যত্রতত্র ময়লা আবর্জনা বিদ্ধমান থাকলেও তা পরিস্কার না করে পৌর তহবিল পরিস্কার করেন তিনি। এভাবেই তিনি শ্রীপুর পৌরসভার হৃদয় হিসেবে খ্যাত এবং অত্যন্ত মূল্যবান ৫ নম্বর ওয়ার্ডের ই-ব্লক এর ৩০/১ নম্বর হোল্ডিং অবস্থিত মাদবর ভিলাসহ তার পৈতৃক ঠিকানা শ্রীপুর উপজেলার মাওনা ইউনিয়নের নিজ বাড়ীতে গড়েছেন আলিশান বাড়ি। এবিষয়ে তিনি বলেন, “আমরা তো উরে এসে জুরে বসি নাই। বাপের জমি সম্পত্তি বিক্রি করে আমি জমি কিনেছি”।

পৌরসভার এসব সফল সহকর্মীদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে মোঃ রুহুল আমীনও নির্মাণ করছেন একটি দ্বিতল ভবন। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মোঃ রুহুল আমীন চাকুরী করেন শ্রীপুর পৌরসভায় সুইপার পদে। মাসিক মাত্র ৬৮২০ টাকা বেতনে চুক্তিভিত্তিক চাকুরী করে শ্রীপুর উত্তর পাড়া এলাকায় ও শ্রীপুর মৌজার ১১৫৫৭ নম্বর জোত জমির উপর নির্মাণ করছেন তিন তলা বিশিষ্ট আলিশান বাড়ি। এ বিষয়ে রহুল আমীনের সাথে যোগাযোগের চেস্টা করা হলেও যোগাযোগ সম্ভব হয়নি।

দুর্নীতিগ্রস্ত সবচেয়ে ক্ষমতাধর কর্মচারীদের অন্যতম মোঃ জহিরুল হক সবুজ ওরফে সবুজ মিয়া। ব্যক্তি এক হলেও পরিচয় ভিন্ন। এ বিষয়ে সবুজের সাবেক সহকর্মী শাহিনুজ্জামান পলাশ বলেন, সবুজের সরকারী চাকুরীর বয়স অতিবাহিত হওয়ায় জালিয়াতি ও তথ্য গোপন করে নতুন জাতীয় পরিচয়পত্রের মাধ্যমে। দশ বছর বয়স কমিয়ে শ্রীপুর পৌরসভায় রোড রোলার পদে চাকুরি নেন তিনি। পাশাপাশি ভিন্ন পরিচয়ে গড়েছেন কোটি কোটি টাকার সম্পদ! এমনি দ্বৈত ভোটার হওয়ার অপরাধে ইসি (ইলেকশন কমিশন) বাদী হয়ে জাতীয় পরিচয়পত্র নিবন্ধন আইনের ২০১০ এর ১৪ ও ১৫ নং ধারায় ২০২২ সালের ৮ নভেম্বর গফরগাঁও থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। কিন্তু কালো টাকার বৌদলতে বহাল তবিয়তে রয়ে যায় ওই ধূর্ত ব্যক্তি। এমনকি কালো টাকা সাদা করতে পৌরসভার চতুর্থ শ্রেণির এই কর্মচারীর চতুর্থ স্ত্রী গেল ষষ্ঠ উপজেলা নির্বাচনের মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্দ্বীরা করেছে। সবচেয়ে চমকপ্রদ তথ্য হলো, ওই দম্পতির উভয়ের’ই রয়েছে দুটি করে জাতীয় পরিচয়পত্র! যা দ্বারা তারা নামে বেনামে বিপুল পরিমাণের সম্পদ করেছে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, শ্রীপুর উপজেলার বরমী মৌজার ২৭৫১ নম্বর জোতে জহিরুল হকের নামে সাত শতাংশ জমি রয়েছে। আবার একই মৌজার ৩২৮৯ নম্বর জোতে মোঃ সবুজ মিয়ার নামে রয়েছে আরো এগারো শতাংশ জমি। উল্লেখ্য, জাতীয় পরিচয়পত্র অনুযায়ী মোঃ জহিরুল হক ও মোঃ সবুজ মিয়া একই ব্যক্তি! অপরদিকে মোঃ জহিরুল হক বা মোঃ সবুজ মিয়ার চতুর্থ স্ত্রী হালিমা খাতুনের পূর্বে নাম মৌসুমির নামেও বিপুল সম্পত্তির মধ্যে বরমী মৌজার ৩২১৬ নম্বর জোতে পাঁচ শতাংশ জমি। শ্রীপুর পৌরসভায় ২ নম্বর ওয়ার্ডের ব্লক-ডি এর ৪৩১/১ নং হোল্ডিং বাড়ীসহ আরো আঠারো শতাংশ জমি। ভেকু (এক্সুভেটর) ড্রেজারসহ একটি প্রাইভেট মাইক্রোবাস (ঢাকা মেট্রো চ-১২-১৭২৯) আছে আরো কয়েক কোটি টাকার সম্পদ।

শ্রীপুর পৌরসভার ১ নম্বর ওয়ার্ডের মাসুদ মিয়া বলেন, রফিকুল হাসান পৌর নির্বাহী কর্মকর্তা শুধুমাত্র বাজেটে খাত উল্লেখ করেই লোপাট করেছেন কোটি কোটি টাকা। দুই অর্থবছরে ময়লা আবর্জনা বাবদ টাকা খরচ দেখানো হলেও বাস্তবে চিত্র সম্পন্ন ভিন্ন। টিআর, কাবিখার টাকাও ব্যবহৃত হয়নি যথাস্থানে। আবার ওভারল্যাপিং করে এক রাস্তার বিল উত্তোলন করা হয়েছে একাধিকবার। এসবের মাধ্যমে তিন। নিজ জেলা জামালপুরের সরিষাবাড়ি পৌর শহরে এআর জুট মিলের থেকে পৌনে পাঁচ শতাংশ জমিও ক্রয় করেছে রফিকুল ইসলাম রঞ্জু।

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে শ্রীপুর পৌরসভার প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, ব্যারিস্টার সজিব আহমেদ বলেন, এসব বিষয়ে এখনও কোনো লিখিত অভিযোগ পাইনি, সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে তদন্ত সাপেক্ষে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Advertisements