কথিত মার্কিন উদারতানৈতিকতাবাদের ধোঁকা ও এর পতন এবং ইহুদিবাদীদের হাতে মার্কিন রাজনীতি, যুক্তি বা বিবেক ও দেশ-পরিচালনার বন্দিত্ব-এ দুটি মহাসত্য আজ স্পষ্ট ও উন্মোচিত।
সম্প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ফিলিস্তিনপন্থী ছাত্রদের ওপর পুলিশি হামলা ও সশস্ত্র বাহিনীর বর্বর আচরণের প্রেক্ষাপটে তেহরানে অবস্থিত ‘নানা ধর্ম ও মাজহাব সংক্রান্ত’ গবেষণা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা ও এর ট্রাস্টি বোর্ড-এর প্রধান হুজ্জাতুল ইসলাম সাইয়্যেদ আবুল হাসান নাভ্ভাব এক বিবৃতিতে পাশ্চাত্যের কথিত উদারনৈতিকতাবাদের সমালোচনা করতে গিয়ে এই মন্তব্য করেছেন।
তিনি বিবৃতিতে বলেছেন: পরম করুণাময় ও অসীম দয়ালু আল্লাহর নামে, পশ্চিমা আধুনিকতার অন্যতম তাত্ত্বিক ভিত্তি হচ্ছে কথিত উদারনৈতিকতাবাদ বা উদারতাবাদ (লিবারেলিজম)। পশ্চিমারা কথিত আলোকিত যুগের মিরাস হিসেবে এই মতবাদকে নিয়ে গর্ব করে খুব অদ্ভুত পদ্ধতিতে!
বর্তমানে পশ্চিমারা বিশেষ করে মার্কিন চিন্তাবিদরা এই লিবারেলিজম নিয়ে এমনভাবে কথা বলেন যে এটা যেন আধুনিক এক ধর্ম! তাদের বাড়াবাড়ি এমন পর্যায়ে চলে গেছে যে একবার একদল বিখ্যাত মার্কিন দার্শনিক ও চিন্তাবিদ মার্কিন লিবারেলিজমের বিরোধীদের ওপর যে কোনো ধরনের সহিংস আচরণকে বৈধ বলে ঘোষণা দেন!
পশ্চিমাদের এই উদারতাবাদের সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত মূলনীতি ও কেন্দ্রীয় ধারণাটি হল বাক-স্বাধীনতা ও চিন্তার স্বাধীনতা। বহু দশক ধরে পাশ্চাত্য প্রাচ্যের জোট ও তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর নিন্দা করে আসছে এবং যখনই কোনো সুযোগ আসে তখনই এই অঞ্চলগুলোর বিরুদ্ধে তাদের প্রচারণা জোরদার হয়, কোনো কোনো অঞ্চলে সেনা অভিযানও চালানো হয়েছে।
মার্কিন তাত্ত্বিক ফুকোইয়ামা মানবজাতির বিশ্বব্যবস্থার সর্বশেষ সংস্করণ ও ইতিহাস হিসেবে লিবারেলিজমের রাজনীতি তথা লিবারেল গণতন্ত্রের চেহারাকেই ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন খুব জোর গলায়। মানবজাতির চূড়ান্ত পরিণতি এই ব্যবস্থার মধ্যেই রয়েছে বলে তিনি যে দাবি করেছিলেন সে দাবির বাস্তবায়ন সম্পর্কে পরে তিনি নিজেই নানা সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। কিন্তু মার্কিন ক্ষমতার ধারক-বাহকরা মনে করেন তাদের লিবারেল সংস্কৃতিই বিশ্বের সেরা ব্যবস্থা ও লিবারেলিজমের মার্কিন সংস্করণ দেশটির রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ব্যবস্থাকে বৈধতা দেয় এবং বিশ্বের অন্যান্য রাজনৈতিক ব্যবস্থার সঙ্গে সংঘাতে জড়িত হওয়ারও অনুমতি দেয় এই মার্কিন লিবারেলিজম!
লিবারেলিজম কতটা ভালো বা মন্দ সে বিচারে না গিয়েই ও এর ভবিষ্যত সম্পর্কে কোনো মন্তব্য না করেই যে প্রশ্নটিকে এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বলা যায় তা হল পশ্চিমা রাজনীতিবিদরা নিজেরাই কতটা এই লিবারেলিজম মেনে চলেন এবং এর বিকাশে তারা কতটা আন্তরিক? এ প্রশ্ন করছেন খোদ অনেক মার্কিন ও পশ্চিমা চিন্তাবিদরাই।
বিশ্ববাসীর কাছে এখন এটা দিবালোকের মত স্পষ্ট যে পশ্চিমারা ও বিশেষ করে মার্কিন কুশিলবরা অন্যদের অঞ্চল, তাদের দেশ ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা মোকাবেলা করতে গিয়ে মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের মত লিবারেলিজমের নীতিগুলোকেই মেনে চলছেন না। এমন অনেক দেশ রয়েছে যেখানে রয়েছে গণতন্ত্র এবং অবাধ ও মুক্ত নির্বাচন, কিন্তু এইসব দেশের সরকার পশ্চিমাদের স্বার্থের সহযোগী নয় বলে পশ্চিমা সমর্থন পাচ্ছে না, অন্যদিকে এমন অনেক সরকার রয়েছে যারা পশ্চিমাদের জুলুম ও শোষণের ব্যাপারে নীরব রয়েছে কিংবা অন্তত তাদের জুলুমের সহযোগী। পশ্চিম এশিয়া অঞ্চলেই এ ধরনের অনেক নন-লিবারেল ও অগণতান্ত্রিক সরকার রয়েছে। অথচ এরা মার্কিন সরকার ও ইউরোপের অকুণ্ঠ সমর্হন পাচ্ছে।
আসলে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থেই পশ্চিমা কুশিলবরা দেশে দেশে হস্তক্ষেপ করছেন এবং লিবারেল শ্লোগানগুলো এক্ষেত্রে তাদের হাতিয়ার বা মিথ্যা অজুহাত মাত্র যাতে বিশ্ববাসীর দৃষ্টিকে বিভ্রান্ত রাখা যায়। লিবারেলিজম নিয়ে তাদের এই প্রতারণা অন্যদের কাছে বহু আগেই স্পষ্ট হয়েছে। যা নতুন তা হল খোদ ইউরোপ ও মার্কিন ভূমিতেই তাদের লিবারেল থাকার ধোঁকা স্পষ্ট হওয়া। পশ্চিমারা অন্তত পাশ্চাত্যের ভেতরেই লিবারেল নীতি লঙ্ঘন করে না এবং এসব নীতি রক্ষার জন্য প্রয়োজনে ধর্ম ও ন্যায়বিচারকেও কুরবানি করা যেতে পারে বলে মনে করা হত অতীতে। কিন্তু এখন এটা স্পষ্ট হয়ে গেছে যে পশ্চিমাদের কাছে অন্য এমন কিছু ট্যাবু ও কথিত পবিত্রতা আছে যেসবের জন্য তারা মুক্তিকামিতাকেও এর জন্য উৎসর্গ করতে প্রস্তুত।
ইসরাইল ও ইহুদিবাদের প্রতি পাশ্চাত্যের অন্ধ সমর্থন কোনো নতুন বিষয় নয়। এক সময় ভাবা হত ইহুদিদের প্রতি ঐতিহাসিক নির্যাতনের কারণে পাশ্চাত্য তাদের প্রতি লজ্জা ও অপরাধবোধের শিকার এবং এ কারণেই তারা ইহুদি রাষ্ট্র ও ভূমিকে সমর্থন দেয়ার কথা ভাবে। কিন্তু ইহুদিবাদের অশুভ অনিষ্টতাকে পশ্চিম এশিয়ায় রপ্তানি করা এবং জার্মানি ও পাশ্চাত্যের অন্যান্য দেশের অপরাধযজ্ঞের জন্য মুসলিম দেশগুলোকে ক্ষতিগ্রস্ত করা একটি বিভৎস বিষয়। অনেকেই ভেবেছিল যে পাশ্চাত্য হয়ত হলোকাস্টের ক্ষতিপূরণ করতে চেয়েছিল মানবিক লক্ষ্যে। ইসরাইলকে সমর্থন দেয়ার মাধ্যমে তারা পশ্চিম এশিয়াকে এটাও কখনও কখনও বোঝাতে চেয়েছে যে তারা আসলে এ অঞ্চলের একমাত্র আসল গণতন্ত্রকে সমর্থন দিচ্ছে যাতে এ অঞ্চলে লিবারেল গণতন্ত্র প্রচার করা যায়। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় এটা স্পষ্ট হয়েছে যে ইসরাইলিদের প্রতি বদান্যতা নয় বরং তাদের রাজনৈতিক ভিন্ন মতলব রয়েছে। আর তা হল ইসরাইল নামক অবৈধ ও কৃত্রিম সরকারের মাধ্যমে এ অঞ্চলের জাতি ও শক্তিগুলোকে দমিয়ে রাখা। অন্য কথায় ইসরাইলই এ অঞ্চলে পাশ্চাত্যের চোখ, কান ও বাহু। আসলে মার্কিন সরকারসহ পশ্চিমা সরকারগুলো তাদের রাজনৈতিক লক্ষ্যগুলো ছাড়াও শক্তিশালী ইহুদিবাদী লবি, তাদের অর্থ ও মিডিয়ার হাতে বন্দি হয়ে আছে। আর এ কারণেই তারা ইসরাইলকে সর্বাত্মক
সমর্থন যোগাতে গিয়ে অনেক বড় রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক স্বার্থ ও সুনাম হারানোর মূল্যও পরিশোধ করছে।
মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ফিলিস্তিনপন্থী ছাত্রদের বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ আন্দোলনের সঙ্গে যে আচরণ করেছে সেখানকার সরকার তা থেকে লিবারেলিজমের প্রতি মাকিন সরকারের অন্তরিকতার অভাবই ফুটে উঠেছে। এটাও সুস্পষ্ট হয়েছে যে মার্কিন সরকারের বুদ্ধিমত্তা ও কঠিন ইচ্ছাশক্তি পুরোপুরি ইহুদিবাদী লবিগুলোর হাতে বন্দি যেসব লবি সবচেয়ে শক্তিশালী লবি হিসেবে বিবেচিত।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষস্থানীয় দশটি বিশ্ববিদ্যালয় যেগুলোকে কখনও কখনও বিশ্বের সেরা দশ বিশ্ববিদ্যালয় বলেও প্রচার করা হয় সেসবের ওপর রয়েছে ইসরাইলপন্থী ইহুদিদের পরিপূর্ণ নিয়ন্ত্রণ। ফিলিস্তিনের পক্ষে মার্কিন ছাত্রদের আন্দোলন কথিত মার্কিন উদারতানৈতিকতাবাদের ধোঁকা ও এর পতন এবং ইহুদিবাদীদের হাতে মার্কিন রাজনীতি, যুক্তি বা বিবেক ও দেশ-পরিচালনার বন্দিত্ব-এ দুটি মহাসত্যকে আজ সুস্পষ্ট করেছে।