রাজনীতিশূন্য বুয়েট মানে আপনারা আসলে ছাত্রলীগশূন্য বুয়েট পাবেন এটাই মন্দের ভালো মনে করেছিলেন। কিন্তু না তা হয় না। রাজনীতিশূন্য কোনোকিছু থাকে না। বা রাজনীতি শূন্যস্থান পছন্দ করে না। আপনারা সেইদিন রাজনীতি নিষিদ্ধ না করে যারা হত্যাকারী, যারা অপরাজনীতি ও সন্ত্রাসের কারিগর তাদের প্রতিহত করার রাজনীতি শুরু করলে আজকে এই সংকট দেখতে হতো না। বুয়েটে রাজনীতির নামে ক্ষমতাসীনদের ফেরানোর বা তাদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত হুট করে হয় নাই। বা এটা শুধুই সাধারণ ক্ষমতাসীন ছাত্রনেতাদের সিদ্ধান্ত এটাও মনে করার সুযোগ নাই। ক্ষমতার রাজনীতি কোনো প্রতিষ্ঠানকেই নিজেদের আওতার বাইরে রাখতে চান না। রাখা নিরাপদ মনে করেন না। কাজেই, পথটা যত কঠিনই হোক।
রাজনীতিকে রাজনীতি দিয়েই মোকাবিলা করতে হবে। এটা করতে না পারলে বুঝতে হবে আমরা স্বাধীনতা অর্জনের পথে নিজেদের পরিচালিত করতে ভয় পাই। এই ভয় পাওয়া একই সঙ্গে আমাদের পূর্বপুরুষদের সঙ্গে বেঈমানী করার শামিল। কারণ তারা স্বাধীনতার জন্য নিজের জীবনকে কোরবানি করতে দ্বিধা করেন নাই। আর আজ স্বাধীনতাকে ভয় পেলে আামদের ভাগ্যে যা পরিণতি হওয়ার তাই হবে।
সারা দেশের মানুষের মতো বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরাও রাজনীতির কাছে অসহায় এখন। এই অসহায়ত্ব থেকে বাঁচতে সাধারণ আমজনতা যতটা সম্ভব রাজনীতি ও রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিষয় এড়িয়ে চলেন। রেস্টুরেন্ট বা অনেক চায়ের দোকানে বড় করে লেখা থাকে, ‘রাজনৈতিক আলাপ থেকে বিরত থাকুন’। রাজনীতি মানেই যেন একটা হাঙ্গামার বিষয়। তাই যতটা পারা যায় এই বিষয় থেকে দূরে থাকতে পারলেই ঝামেলা এড়ানো যাবে- এমনটা মনে করে জনপরিসরে রাজনীতিকে দূরে ঠেলে রাখার চেষ্টা হচ্ছে অনেক দিন থেকেই।
দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ক্ষমতাসীন দলের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ ও আধিপত্য প্রতিষ্ঠার কথা আমরা সবাই জানি। তাদের অন্যয়ের প্রতিবাদ করতে গিয়ে অনেক মানুষকে জীবন দিতে হয়েছে। অনেকেই পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন। প্রকাশ্যে বিশ্বজিৎকে কুপিয়ে হত্যার ভিডিও বাংলাদেশের মানুষ দেখেছে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসকে অনেকটা কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প করা হয়েছে অনেক আগেই। নিজেরাই নিজেদের ইচ্ছেমতো অপরাধ ও অপরাধী চিহ্নিত করে, নিজেরাই রায় দেয়, নিজেরাই বিচার করে। নিজেদের বিচারে কাউকে অপরাধী মনে হলে পিটিয়ে মেরেও ফেলে। এক কথায় এক সময়ের ঐতিহ্যবাহী ছাত্র সংগঠন, ছাত্রলীগ তাদের কিছু নেতা-কর্মীর অপকর্মের কারণে এখন একটা ত্রাসের নাম সাধারণ শিক্ষার্থীদের কাছে।
এমনই এক নিষ্ঠুরতার শিকার হয়ে ২০১৯ সালে বুয়েট শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ নিহত হওয়ার পর ছাত্রদের আন্দোলনের মুখে প্রতিষ্ঠানটিতে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ হয়। সেই ঘটনার ৪ বছর পর বুয়েটে আবারো ছাত্র রাজনীতি চালুর জন্য তৎপর হয়ে উঠেছে ছাত্রলীগ। বুয়েটের উপাচার্যও বলছেন, শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা চাইলে ক্যাম্পাসে ফের ছাত্র রাজনীতি চালু করা যেতে পারে।
এরই মধ্যে গতকাল উচ্চ আদালত বুয়েটে রাজনৈতিক সংগঠন ও এর কার্যক্রম এর কার্যক্রম নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত স্থগিত করেছেন। এক রিট আবেদনের শুনানি নিয়ে হাইকোর্ট এ আদেশ দিয়েছেন। সাম্প্রতিক সময়ে ২৭শে মার্চ মধ্যরাতের পর ছাত্রলীগের কিছু নেতাকর্মী বুয়েট ক্যাম্পাসে প্রবেশ করে এবং রাজনৈতিক কার্যক্রম চালান, এমনটি উল্লেখ করে ২৯শে মার্চ আন্দোলন শুরু করে শিক্ষার্থীরা। আন্দোলনের অংশ হিসেবে তারা টার্ম ফাইনাল পরীক্ষাসহ সব ধরনের একাডেমিক কার্যক্রম বর্জন করছে। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ভাষ্য, ২৭শে মার্চ মধ্যরাতের পর ক্যাম্পাসে ‘বহিরাগতদের’ প্রবেশ ও রাজনৈতিক সমাগমের মূল সংগঠক ইমতিয়াজ। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের দাবির মুখে বুয়েটের হল থেকে ইমতিয়াজের সিট বাতিল করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
গতকাল হাইকোর্টের আদেশের বুয়েটের উপাচার্য সত্য প্রসাদ মজুমদার বলেছেন, আদালত যেটা বলবেন আমাকে সেটা মানতে হবে। আদালতের আদেশ শিরোধার্য। ২০১৯ সালের ১১ই অক্টোবর বুয়েট কর্তৃপক্ষের দেয়া ‘জরুরি বিজ্ঞপ্তি’র বৈধতা নিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির শিক্ষার্থী ইমতিয়াজ হোসেন রিট করেন। ইমতিয়াজ বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের ছাত্র। সে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য।
ছাত্রলীগ বলছে রাজনীতি করা গণতান্তিক অধিকার। আবরার ফাহাদের ঘটনার বিষয়ে তাদের মন্তব্য হলো- মাথাব্যথার জন্য মাথা কেটেই ফেলে দিতে হবে এমন কোনো কথা নাই। এটা হতে পারে না। ওদিকে হাইকোর্টের রায়ের পর সংবাদ সম্মেলন করেন বুয়েটের আন্দোলনরত সাধারণ শিক্ষার্থীরা। ক্যাম্পাসের ছাত্ররাজনীতি মুক্ত রাখতে শিক্ষকদের পাশে থাকার আর্জি জানান তারা।
সাধারণ শিক্ষার্থীরা মূলত রাজনীতি নিষিদ্ধ করে অত্যাচার থেকে নিজেরা রেহাই পেতে চেয়েছিল। কিন্তু ক্ষমতাসীন দল থেকে আবারো সেই পুরানা ট্যাগ চালু করা হয়েছে। এই রাজনীতি নিষিদ্ধের পিছনে জামায়াত বা জঙ্গিদের খোঁজা হচ্ছে। এর আগেও আমরা দেখেছি- ক্ষমতার ঠিক করে দেয়া নীতির বাইরে থাকলে প্রথমে তাকে ভিলেন বানানো হয়, এবং তারপরে তাদের উপর চলে অত্যাচার। এটা জানে সাধারণ শিক্ষার্থীরা। এই অবস্থায় মন্দের ভালো হিসেবে যে নীতি বুয়েটের সাধারণ শিক্ষার্থীরা নিয়েছে এবং আবরার ফাহাদের রক্তের প্রতি তাদের দরদ থেকে তারা যে রাজনীতিমুক্ত বুয়েট প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম করেছে তা যে তাদেরকে শেষ পর্যন্ত নিরাপদ রাখতে কাজে আসছে না তা খোলাসা হয়েছে নিজের ভালো চাকরি, ভবিষ্যৎ বা সফলতা রাজনীতিকে এড়িয়ে অর্জন করার এই আত্মগত, নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকার প্রক্রিয়া কাজে আসে না। আসার কথাও না। রাজনীতিকে এড়িয়ে, পালিয়ে, স্কেপ করে আপনি রাজনীতি থেকে বাঁচতে পারবেন না। এটা কোনোকালেই, কোনো দেশেই, কোনো সমাজেই হয় না।
এই বিষয়ে প্লেটোর বিখ্যাত কথাটা প্রিয় বুয়টের শিক্ষার্থীদের মনে করিয়ে দিতে চাই-“রাজনীতি না করার পরিণতি হলো, আপনি আপনার চেয়ে অযোগ্যদের দ্বারা শাসিত হবেন”।
রাজনীতিশূন্য বুয়েট মানে আপনারা আসলে ছাত্রলীগশূন্য বুয়েট পাবেন এটাই মন্দের ভালো মনে করেছিলেন। কিন্তু না তা হয় না। রাজনীতিশূন্য কোনোকিছু থাকে না। বা রাজনীতি শূন্যস্থান পছন্দ করে না। আপনারা সেইদিন রাজনীতি নিষিদ্ধ না করে যারা হত্যাকারী, যারা অপরাজনীতি ও সন্ত্রাসের কারিগর তাদের প্রতিহত করার রাজনীতি শুরু করলে আজকে এই সংকট দেখতে হতো না। বুয়েটে রাজনীতির নামে ক্ষমতাসীনদের ফেরানোর বা তাদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত হুট করে হয় নাই। বা এটা শুধুই সাধারণ ক্ষমতাসীন ছাত্রনেতাদের সিদ্ধান্ত এটাও মনে করার সুযোগ নাই। ক্ষমতার রাজনীতি কোনো প্রতিষ্ঠানকেই নিজেদের আওতার বাইরে রাখতে চান না। রাখা নিরাপদ মনে করেন না। কাজেই, পথটা যত কঠিনই হোক। রাজনীতিকে রাজনীতি দিয়েই মোকাবিলা করতে হবে। এটা করতে না পারলে বুঝতে হবে আমরা স্বাধীনতা অর্জনের পথে নিজেদের পরিচালিত করতে ভয় পাই। এই ভয় পাওয়া একই সঙ্গে আমাদের পূর্বপুরুষদের সঙ্গে বেঈমানী করার শামিল। কারণ তারা স্বাধীনতার জন্য নিজের জীবনকে কোরবানি করতে দ্বিধা করেন নাই। আর আজ স্বাধীনতাকে ভয় পেলে আামদের ভাগ্যে যা পরিণতি হওয়ার তাই হবে।
এই বিষয়ে বিখ্যাত লেখক, তাত্ত্বিক এরিক ফর্ম তার ফিয়ার অব ফ্রিডম বইতে লিখেছেন। জার্মানি বা ইতালিতে ফ্যাসিবাদ কায়েম হতে পেরেছে এই কারণে না যে, সেখানকার শাসকরা অস্ত্র ও সেনাকে বেপরোয়াভাবে ব্যবহার করেছেন। বরং সেইসব দেশের বিপুল জনগোষ্ঠী নিজেদের স্বাধীনতা ক্রমে সংকোচিত হচ্ছিল দেখেও শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তুলতে আগ্রহী ছিলেন না। যা তাদের পূর্বপুরুষরা করেছিল। সেইসব দেশের জনগণ অনায়াসেই নিজেদের স্বাধীনতা তাদের দেশের ক্ষমতাসীনদের কাছে বিলিয়ে দিয়েছিল। তারা ফাইট করার বদলে স্কেপ বা পলায়নপর নীতিকে সুবিধার মনে করেছিল। বেশির ভাগ ক্ষমতার সঙ্গে ভিড়ে গিয়েছিল আর বাকিরা নিজের কাঁধে বিপদ আসার আগ পর্যন্ত রাষ্ট্র-রাজনীতি কোনোকিছু নিয়ে তেমন আগ্রহী ছিল না। তিনি মনে করেন, আমাদের গণতন্ত্রের জন্য বাইরের ফ্যাসিস্ট শক্তিধর দেশগুলো বড় হুমকি না। এই হুমকিটা তৈরি হয়েছে আমাদের নিজেদের অবস্থানের দ্বারাই। আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বাধীন অবস্থান আমরা বিসর্জন দিয়ে দিয়েছি। আমাদের নিজেদের জীবন ও প্রতিষ্ঠানের মর্যাদা বিসর্জন দেয়ার মাধ্যমেই স্বৈরাচারী শাসনকে আমরা সহজ করে দিয়েছি আমাদের সমাজে। ফলে সমস্যা বাইরের থেকে আসে না, সমস্যা আমাদের মধ্যে ও আমাদের প্রতিষ্ঠানের মধ্যেই নিহিত।