সবার জন্য শিক্ষা নিশ্চিত করার জন্য সরকার বছরের প্রথম দিন বিনামূল্যে ছাত্র-ছাত্রীদের হাতে নতুন বই তুলে দেন। এ লক্ষ্যে বছরের মাঝামাঝি সময়ে প্রতিষ্ঠান প্রধানদের নিকট আগামী বছরের বইয়ের চাহিদা চাওয়া হয় উপজেলা শিক্ষা অফিস থেকে। কিছুকিছু প্রতিষ্ঠান প্রয়োজনের চেয়েও অতিরিক্ত চাহিদা দিয়ে থাকেন। এভাবে প্রতি বছর প্রায় প্রত্যেক প্রতিষ্ঠানে অনেক বই অতিরিক্ত থেকে যায়। অতিরিক্ত বইগুলো শিক্ষা অফিসে ফেরত পাঠানোর বিধান থাকলেও বরামা ইসলামিয়া ফাজিল মাদরাসা সে আইন লঙ্ঘন করেছে।
বইয়ের হিসেব মেলাতে অভিভাবকদের জাল স্বাক্ষর দিলেন শিক্ষকরা
গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার বরামা ইসলামিয়া ফাজিল মাদরাসায় এক অফিস সহকারীর বিরুদ্ধে সরকারি বই চুরি করে বিক্রির অভিযোগ উঠেছে। এই চুরিকে বৈধতা দিতে উঠেপড়ে লেগেছেন মাদরাসাটির বার্তমান ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষসহ কয়েকজন শিক্ষক। বিষয়টি উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তার নজরে আসলে তিনি তদন্তপূর্বক ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন বলে আশ্বাস দেন। তদন্তের দায়িত্ব দেন উপজেলা একাডেমিক সুপারভাইজারকে। এরপর-ই তড়িঘড়ি করে বই বিতরণের তালিকায় অভিভাবকদের স্বাক্ষরের জায়গায় জাল স্বাক্ষর দেন কয়েকজন শিক্ষক। অভিভাবকদের জাল স্বাক্ষর দেয়ার ভিডিওচিত্র ইতিমধ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চাউড় হয়েছে। এরপরই তড়িঘড়ি করে বই বিক্রি ১৬ হাজার টাকা অফিসে জমা দেন অফিস সহকারী। এরইমধ্যে কয়েকজন সংবাদকর্মী অভিযুক্ত অফিস সহকারী আমিনুল হকের নিকট এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বই বিক্রির বিষয়টি অস্বীকার করেন। পরে সাংবাদিকদের ঘুষ দেয়ার অপচেষ্টাও করেন তিনি। তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন বলে জানিয়েছেন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মোঃ ওয়াহিদ হোসেন।
চুরি করে বই বিক্রির বিষয়টি গত ১২ সেপ্টেম্বর এলাকায় জানাজানি হয়৷ এরপর-ই অনুসন্ধানে নামে কয়েকজন সংবাদকর্মী। বিষয়টি প্রসঙ্গে মাদরাসায় কথা হয় ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ ফারজানা বেগমের সঙ্গে। শুরুতে তিনি কিছুই জানেন না বলে জানান। পরবর্তীতে বিষয়টি তিনি জানেন বললেও বই বিক্রির বিষয়টি অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, ‘আমার অনুমতিক্রমে শুধুমাত্র খাতা বিক্রি করা হয়েছে প্রতিষ্ঠানের নামে সাইট খোলার জন্য। প্রতিষ্ঠানে কোনো টাকা না থাকায় আমি সে অনুমতি দিই। তবে বিগত বছরগুলো ২০২০, ২১ ও ২৩ সালের বইয়ের চাহিদা ও বিতরণের তথ্য জানতে চাইলে তিনি কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি’।
গত ১৯ সেপ্টেম্বর বই বিক্রির বিষয়ে তদন্তে গিয়েছিলেন উপজেলা একাডেমিক সুপারভাইজার পারভিন ইসলাম। দূর্নীতি তদন্তে গিয়ে ঘটে মহাদূর্নীতি। চুরি করে বই বিক্রি করায় বিগত বছরগুলোর কোন বই অতিরিক্ত নাই। সকল বই বিতরণ হয়ে গেছে এটা প্রমাণ করানোর জন্য শিক্ষকদের বসিয়ে দেওয়া হয় বিগত ৫ বছরের চাহিদা পত্র ও বই বিতরণ রেজিস্ট্রার দিয়ে। তারা নিজেরাই শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকের নামের স্থলে জাল স্বাক্ষর করছেন। এরকম একটি ভিডিও ইতিমধ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চাউড় হয়েছে।
২০২৩ সালের পুরোনো বই থাকলেও ২০, ২১ ও ২২ সালের বই নেই
এসব বিষয়ে মাদ্রাসাটির সহকারী অধ্যাপক আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘আমি প্রায় দেড় বছর ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্বে ছিলাম। ২০২৩ সালের নতুন বই উত্তরের নতুন বিল্ডিংয়ের সিঁড়ির নিচে গ্রীল ও তালা লাগিয়ে বিতরণ ও সংরক্ষণের ব্যবস্থা করি। সেইসাথে পুরাতন বই ও খাতা পশ্চিমের বিল্ডিং এর সিড়ির নিচে রাখার ব্যবস্থা করি। ওখানে প্রায় ১৫-২০ বস্তা বই ও খাতা ছিল। হঠাৎ একদিন মাদরাসায় এসে শুনতে পাই ওগুলো নাই। ২০২৩ সালের অতিরিক্ত পুরোনো বই থাকলেও পুরোনো সালের বইগুলো নেই। ২৩ সালের এতো বই অতিরিক্ত হলে ২০,২১ ও ২২ সালেও সমপরিমাণ থাকার কথা। সমপরিমাণ না হলেও কিছুকিছু হলেও থাকার কথা। তাহলে সেগুলো কোথায় ? আমরা জানতে পেরেছি সেগুলো বিক্রি করে দিয়েছে অফিস সহকারী আমিনুল হক। ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মহোদয়ের কাছে জানতে চাইলে তিনি কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি। এ ঘটনায় দোষীদের শাস্তির দাবি জানাচ্ছি’।
এসব বিষয়ে কথা হয় মাদ্রাসাটির ইংরেজি প্রভাষক মোহাম্মদ শরীফ রায়হানের সাথে। তিনি বলেন, ‘মাদরাসাটিতে অফিস সহকারী আমিনুল ইসলামের ভাবটা এমন যেন, তিনিই ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষসহ সকল শিক্ষকদের পরিচালনা করেন। গত কয়েক মাস যাবত অনেক অনিয়ম হচ্ছে মাদ্রাসায়। মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার পর থেকে এভাবেই অনিয়ম হচ্ছে। গত কয়েক বছরের বই বিক্রি করেছে, এই টাকা প্রতিষ্ঠানের ক্যাশে জমা করছে ধরা খাওয়ার পর। তাহলে আগের হিসেবগুলো কোথায় ? সরকারি বই প্রতিষ্ঠান বিক্রি করা রাস্ট্র বিরোধী কাজ। এটা কোনোভাবেই বিক্রি করার সুযোগ নেই প্রতিষ্ঠানের’।
ঘটনার সত্যতা যাচাই করতে সংবাদ কর্মীরা মাদরাসায় গেলে ওই অফিস সহকারী মাদরাসা থেকে সটকে পড়েন। পরবর্তীতে তার বাড়িতে গিয়ে অভিযুক্ত অফিস সহকারী আমিনুল হকের সঙ্গে কথা হয়, তিনি বলেন, ‘অফিসের সাইট খোলার টাকার সংকট ছিল। তাই ১৬ হাজার ৩৩৪ টাকার খাতা বিক্রি করা হয়েছে, বই বিক্রি করিনি। পরে বিদায়ের সময় তিনি সাংবাদিকদের ঘুষ দেয়ার অপচেষ্টা করেন’।
সরকারি বই প্রতিষ্ঠানের বিক্রির কোনো সুযোগ নেই: এডিসি সার্বিক ওয়াহিদ হোসেন
শ্রীপুর উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা নুরুল আমীন বলেন, ‘বই অতিরিক্ত হলে প্রতিষ্ঠানের সে বই বিধি মোতাবেক বিক্রির কোনো সুযোগ নেই। প্রতিষ্ঠানকে আগেই বলা আছে, বই অতিরিক্ত হলে শিক্ষা অফিসে জমা দিবে, পরবর্তীতে বিক্রির প্রয়োজন হলে বিজ্ঞাপন দিয়ে টেন্ডারের মাধ্যমে বিক্রি করা যাবে। ওই মাদ্রাসা সরকারি বই বিক্রি করে দিয়েছে, এমন একটি অভিযোগ পেয়েছি। তদন্তে দোষী প্রমাণিত হলে দোষীদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে’।
এসব বিষয়ে মাদ্রাসা কমিটির সভাপতি ও অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মোঃ ওয়াহিদ হোসেন বলেন, এ বিষয়টি খোঁজ নিয়ে দেখি। বই দিয়েছে সরকার। সে বই কারো বিক্রি করে দেয়ার কোনো সুযোগ নেই। জেলা শিক্ষা কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলবো। যদি বিক্রির বিষয়টি প্রমাণ হয় তাহলে দোষীরা কোনো ছাড় পাবে না।