ফ্যাসিবাদ-মুক্ত হবার শর্ত কী আমেরিকার বার্মা দখলে সামিল হওয়া
Advertisements

সারা বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ পর্যন্ত খুঁজছে বার্মা থেকে বাংলাদেশে গোলা এসে পড়ার পিছনের ঘটনা কী? সাধারণ মানুষের উদ্বেগের প্রধান দিকটা হল, এমনিতেই ডলার সংকট আর চরম মুদ্রাস্ফীতিতে ডুবে থাকা আমাদের অর্থনীতিতে তাদের নাভিশ্বাস উঠা জীবনে, বাংলাদেশ কী কোন যুদ্ধে জড়িয়ে যাচ্ছে? আমরা কী এবার অন্যের যুদ্ধস্বার্থে বলি হতে যাচ্ছি? কারণ সাধারণভাবে বাংলাদেশের নুন্যতম অবস্থান হল যুদ্ধের বাইরে থাকা অর্থে যুদ্ধবিরোধিতা, শামিল না হওয়া। সেখানে বলাই বাহুল্য এসময়ের যেকোন যুদ্ধ যাতে জবরদস্তিতে বাংলাদেশকে সামিল করা হবে আত্মঘাতি বিশেষত তাতে যেখানে এখন অন্তত মারাত্মক খাদ্য সংকট বা দুর্ভিক্ষাবস্তা তৈরি করবে বলে আশঙ্কা আছে!

ঘটনাটা প্রথম প্রকাশ ছিল একটা পুরানা ঘটনা যার শুরু এক আমেরিকান উদ্যোগ থেকে। গত ২০১৯ সালের হাসিনা যেটাকে বলেছিলেন দুর্বৃত্বপনা; বা দুর্বৃত্বের প্রস্তাব [flagitious proposition]। আমেরিকান বেনার নিউজের ভাষায়, আমেরিকার এক “গর্হিত কাজ”।

সেই প্রস্তাবটা কী আর তা কোথা থেকে উদয় হয়েছিল?
এটা উদয় হয়েছিল আকাবাকাঁ ভাবে; মানে প্রথম যুগে আমেরিকার বার্মার জেনারেলদের পক্ষ নিয়ে কথা বলা যেটা পরে জেনারেলদের নির্মুলের পক্ষে অবস্থান নিয়ে।একালের বার্মার দিকে আমরা প্রথম খোঁজ নিতে আকৃষ্ট হই ২০১৭ সালে, রোহিঙ্গা উচ্ছেদ আর বাংলাদেশে তাদের আশ্রয়প্রার্থিতা থেকে। কিন্তু একালের বার্মার পরিবর্তনের শুরু ২০০৭ সাল থেকে। ভারত সরকার যেন বার্মার জেনারেলদেরকে খুব সুবুদ্ধি দিচ্ছে এমন ভাব ধরে দেয়া উস্কানিতে জেনারেলেরা মুসলমান বলে বার্মার রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠিকে ২০১৭ সালে নিশৃংসভাবে হত্যা আর ভয়ের খেলা দেখিয়ে বাংলাদেশ পাঠিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু মজার কথা হল রোহিঙ্গা খেদানোর পক্ষে জেনারেলেরা যে সাফাই ব্যাখ্যা দিয়েছিল তা আমেরিকা, ভারত, ও চীন কেউ বাদ যায় নাই, সকলের মেনে নিয়েছিল ও তাদেরও অবস্থানও সেটাই হয়ে দাড়িয়েছিল। সারকথায় সেই ভাষ্যটা হল, আরসা (ARSA, Arakan Rohingya Salvation Army) বলে এক ‘কল্পিত বাহিনীর’ কথা তুলেছিল। আরসা নাকি বার্মিজ নিরাপত্তা বাহিনীর উপরে ৭০টা স্থানে হামলা করেছিল। আর তা প্রতিরোধ করতে ধাওয়া করতে গেলে রোহিঙ্গাদের আবাসস্থলের বাসিন্দারা ভয়ে ডিসপ্লেসেড বা ঘর ছেড়ে আশ্রয়ে ভাগতে যাওয়াতেই নাকি বাংলাদেশ সীমান্তে রোগিঙ্গা ঢল উঠার কারণ। সারকথায়, দেখা যায় জেনারেলেরা তাদের যে সব দানবীয় আচরণের দায়স্বীকার করতে পারবে না তা এই “কল্পিত আরসার নামে” তারা হাজির করে থাকেন। পরিণতিতে এখন সংশ্লিষ্ট সবদেশেরই একটা করে আরসা আছে। আমেরিকান পাসপোর্টধারী আরসাও আছে বলে শুনতে পাই!!

এককথায়, ২০০৭ সালের পর থেকে বার্মা গ্লোবাল লাইম লাইটের ইস্যু হয়ে আসার পিছনের মূল কারণ হল এর আগে মোটামুটি ১৯৮৯ সাল থেকেই ক্রমান্বয়ে বার্মা জাতিসংঘের অবরোধ আর পরে আমেরিকান বা পশ্চিমা অবরোধে পর্যদুস্ত হয়েছিল। বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের মত চীন-বার্মা সীমান্ত এটাও শতছিদ্র [perforated] সীমান্ত বলা হয়। সেই সুযোগ এর ভিতর দিয়ে এটাই বার্মার বাহিরের দুনিয়ার সাথে যোগাযোগের একমাত্র সীমান্ত বা উপায় হয়ে উঠে; কিন্তু এর সবটাই ইনফরমালি ফরমাল ধরণের বাণিজ্যের লেনদেন। ফলে অন্যভাবে দেখলে বার্মার উপর সব স্যাংশন বা অবরোধের ফলে পরিণতিতে এর মাখন গিয়ে উঠছিল একা চীনের ঘরে।

এটা ভাঙতেই নেপথ্যে ভারত উদ্যোগ আহবানে সারা দিয়ে পশ্চিম সামিল হওয়াতে বার্মা গ্লোবাল লাইম লাইটটে আস্সেতে শুরু করেছিল। এরই প্রকাশ্য চিহ্ন হল বা এক রফার দলিল হল ২০০৮ সালের বার্মার কথিত নয়া কনষ্টিটিউশন ২০০৮। কিন্তু “কথিত” কারণ, বার্মা এরপরেও আসলে কোন রাষ্ট্র নয় – একটা আর্মি ক্লাবের মালিকানায় একটা ভুখন্ড মাত্র। এনিয়ে বিস্তারে দেখতে এখানে। যা হোক এনিয়ে কথা আর বাড়াবো না কারণ, ২০২০ সালের নির্বাচনের পরে জেনারেলেরা বুঝে যায় ও সিদ্ধান্ত নেয় যে এই পশ্চিমা-ফর্মুলায় বাইরের দুনিয়ায় আসাটা ভুল ও তা অকার্যকর,তাতে ব্যাপারটা ক্ষমতা জেনারেলদের হাতে রাখার দিক থেকে।

কিন্তু ঘটনা এর আগেই দুনিয়ার অন্যান্য ঘটনায় অন্যদিকে রওনা দিয়েছে। আমেরিকা-চীনের গ্লোবাল পালাবদলের গোপন-প্রকাশ্যের লড়াইয়ে আমেরিকা আবিস্কার করেছিল যে বার্মার অবস্থান আসলে চীন-ভারতের দিকে ভারি ফলে বড় মাখন সব তাদের দিকে চলে যাচ্ছে। এমনকি সেটার মধ্যে আবার বার্মা না চাইলেও তার অতি চীন-নির্ভরতা যা সীমাহীন বলে আর লম্বা সময় ধরে তা চীনমুখি করে শুরু থেকেই দীর্ঘদিন সাজানো বলে সব মাখন এমনিতেই চীনের ঘরে উঠেই চলছে।

তাই ২০১৯ সাল থেকেই এনিয়ে আমেরিকার বিকল্প ভিন্ন পরিকল্পনা উন্মোচিত হতে শুরু হয়েছিল। এই আমেরিকান পরিকল্পনাটা সংক্ষিপ্ততম ভাষায় বললে তা হল, ‘বার্মা দখল’। এটা হল, আমেরিকার ‘বার্মা দখল’ পরিকল্পনা। কিন্তু এই ভাষায় নয়; বরং ভিন্নভাবে। তাহলে দখলের সেই সাফাই-ভাষ্যটা কী? সাফাইটা হল, আমেরিকা রোহিঙ্গা সমস্যা্র সমাধান করতে চায়, এই ছলে। সোজাসাপ্টা বললে, রোহিঙ্গা ইস্যুর সমাধানের উছিলায় বাংলাদেশকে ব্যবহার করে ( মোটা দাগে সম্ভাব্য আমেরিকান এয়ার কাভারে বাংলাদেশের পদাতিক বাহিনী মুভ করিয়ে ধরণের কিছু করে) বার্মা দখল।

কিন্তু এসব কথাগুলো আমাদের সামনে হাজির করা হয়েছিল ভিন্নভাবে, ভিন্ন ভাষায়। কীভাবে এবং কোথায়?

বলা হল এটা যেন রুটিন আমেরিকান কংগ্রেসের (সংসদ) এক ততপরতা। যেখানে সংসদীয় কমিটি তো থাকবেই। তেমনই ওর পররাষ্ট্র উপকমিটির এশিয়া অংশের নেতা বা কংগ্রেসম্যান হলেন ব্রাড শেরম্যান। একথা সর্বজন বিদিত যে রোহিঙ্গারা মুসলমান বলে বার্মিজ জেনারেলদের এথনিক ক্লিনজিং ঘটে চলছে। আর তারা কখনই বাধ্য না হলে রোহিঙ্গাদের আগামিতে ফেরত নিতেই চান না। তাই এই পরিস্থিতিকে উছিলা করে এইবার শেরম্যান সামনে এসে তিনি নিজ উপকমিটির এশিয়ার বাজেট প্রসঙ্গে আলোচনার সময় বলছেন, বার্মার রাখাইন প্রদেশকে কেটে এনে বাংলাদেশের সাথে যুক্ত করে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান করতে হবে।

এশিয়ায় আমেরিকান রণকৌশলগত স্বার্থ রক্ষার্থে ও প্রভাবিত করতে দুইটা মিডিয়া ও ওয়েব সাইট খুলেছে। এর একটা হল বেনার নিউজ [BENAR News] আরেকটা ডিজিটাল লাইব্রেরি ধরণের যার নাম ‘রোর বাংলা’ [roar.media]। এগুলো ২০১৭ সালের শেষের দিকে চোখে পড়তে শুরু করেছিল। ব্যানার নিউজের ক্যারেকটার হল অনেকটা সোভিয়েত-আমেরিকা রেষারেষির যুগের মত তখন আমেরিকা সোভিয়েতের বিরুদ্ধে কোন প্রতিষ্ঠান খাড়া করলেই সেখানে একটা শব্দ কমন থাকতে দেখা যেত – ফ্রি [Free] এই শব্দটা; যেমন ফ্রি নিউজ বা ফ্রি মিডিয়া। বুঝাতে চাইত যে রাশিয়া ফ্রি স্পিচ বা ফ্রি মিডিয়া বলে কিছু নাই। এর উল্টাটা তাই আমেরিকায় যেটা আছে। তাই অনেক সময় বেনার নিউজেও ফ্রি শব্দটা দেখা যায়। [কিন্তু দুঃখের বিষয় এই ওয়েব এখন বিআরটিএ আটকে রেখেছে। ফলে ভিপিএন দিয়ে ঢুকতে হবে।]

সেই ব্যানার নিউজে ব্রাড শেরম্যান এর ‘রাখাইন প্রদেশকে কেটে আনা” এই খবরটা কিভাবে উপস্থাপন করা হয়েছিল? গত ৮ জুলাই ২০১৯ প্রকাশিত এর হুবহু সে রিপোর্টের প্রথম বাক্যটা তুলে আনছি … “রোহিঙ্গাদের রক্ষা করতে ব্যর্থ হওয়ার কারণে মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশকে বাংলাদেশের সাথে যুক্ত করার যে প্রস্তাব মার্কিন কংগ্রেসম্যান ব্রাড শেরম্যান দিয়েছেন তা প্রত্যাখ্যান করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, এ ধরনের প্রস্তাবনা একটি ‘গর্হিত কাজ’ ”। পরেরদিন ৯ জুলাই ২০১৯ একই খবর আমেরিকান ভোয়াবাংলার [VOA] নিউজও ছিল এরকমঃ ……“রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে মিয়ানমারের অস্থিতিশীল রাখাইন রাজ্যকে বাংলাদেশের সঙ্গে সংযুক্ত করতে মার্কিন কংগ্রেসম্যান ব্রাড শেরম্যানের দেয়া প্রস্তাবের কড়া সমালোচনা করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা”।

রাখাইন প্রদেশকে বাংলাদেশের সাথে যুক্ত করার যে প্রস্তাবঃ
তাহলে এবার আমরা ২০১৭ সালের জেনারেলদের কোলে বসে থাকা তিনদেশের আমেরিকা, ভারত ও চীন – এখানে একটা বদল হতে দেখছি। এদের মধ্যে আমেরিকা সরে এসে যেন পল্টি মারতে চাইছে। বলছে বার্মাকে ভাগ করে “রাখাইন প্রদেশকে কেটে আনতে হবে”। এখানে আরো একটু আলো ফেলব। পটভুমিটা হল, এটা বার্মিজ জেনারেলদের বৈশিষ্ট যে তারা গ্রহিতা দেশকে অনুগ্রহ লাভের ভুমিকায় রেখে দিয়ে তাদের উপর নিজ কমান্ড বজায় রাখার ক্ষমতা রাখে, নিজ দাতা অবস্থান তারা সহসা হারায় না; যেভাবেই হোক তা ধরে রাখতেই সক্ষম হতে দেখি আমরা। তাহলে, আমেরিকা কী এই জেনারেলদের কমান্ড থেকেই বের হতে চাচ্ছে? না, ঠিক একদম তা নয়। সে প্রসঙ্গে পরে আসছি।

কখন ও কোথায় এবং কোন ভাষায় আমেরিকা এটা প্রথম প্রকাশ্যে এনেছিল? এটাই ২০১৯ সালের জুনের শেষে-আগষ্টের প্রথম সপ্তাহের দিকে, আমেরিকান কংগ্রেসে (আমেরিকান সংসদে) তা আমরা দেখলাম। আর এর চেয়েও বড় কথাটা হল, আজকের বার্মিজ গোলা এসে বাংলাদেশে কেন এসে পড়ছে এর পিছনের পোলারাইজেশনে মানে আমেরিকা, চীন ও ভারত এবং একালে যুক্ত হওয়া রাশিয়ার মধ্যে এখন কোনদেশ কে কোন দিকে এখন আছে তা আসলে সেকালে ২০১৯ সালেই স্পষ্ট ছিল। সেটা কীভাবে??

২০১৯ সালের রোহিঙ্গা বা বার্মা ইস্যুতে ভারত-চীন একসাথে আমেরিকার বিরুদ্ধে অবস্থানেঃ
ঐ ২০১৯ সালেই ব্রাড শেরম্যান এর কথিত আমেরিকান প্রস্তাবের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল ভারত ও চীন একসাথে। এরই একটা ঝলক দেখেছিলাম তখন। যদিও তা তখন যথেষ্ট খোলাখুলি ছিল না বলে তত আমল হয় নাই। সেটার প্রমাণ পাওয়া যায় কীভাবে এই খবর আমাদের কাছে তখন এসেছিল তা ফিরে অনুসরণ করলেই।

যেমন ব্রাড শেরম্যান প্রথমবারের মত আমেরিকান কংগ্রেসে রাখাইন প্রদেশ কেটে আনার কথা বলেছেন ১৩ জুন ২০১৯। আর তা আমরা প্রথম জানতে পারি একমাত্র ভারতীয় টাইমস অব ইন্ডিয়ায় (TOI-ET) প্রকাশিত এক রিপোর্টের কল্যাণ্যে; তাও আবার সেই রিপোর্ট শেরম্যানের বক্তব্যের প্রায় ১৭ দিন পরে, ১ জুলাইয়ে। এবং দ্বিতীয় আর কোন মিডিয়ায় এই খবর ছাপা হয়েছে জানা যায় না।

This proposal was made on June 13 during a hearing on the State Department’s budget for the South Asia, according to a US media report.

এমনকি TOI-ET নিজের খবরের সোর্স হিসাবে জানাচ্ছে সেটা আমেরিকার স্থানীয় রিপোর্ট (according to a US media report)। অর্থাৎ খুব অস্পষ্ট; সুনির্দিষ্ট করে কোন সোর্স এর কথা বলা নাই। কিন্তু তাই বলে খবরটা কী দুর্বল বা ভুয়া? না; অবশ্যই তা একেবারেই নয়। কেন, কী প্রমাণ আছে এর?

প্রথম প্রমাণ হল, এই খবরের প্রতিক্রিয়ায় যেসব খবর তৈরি হয়েছে, আমেরিকান দুই মিডিয়া বেনার নিউজ আর ভোয়া, তা অবলীলায় নিজেরাই ছেপেছে। এভাবে এরা পরোক্ষে TOI-ET এর খবরের সত্যতার সাক্ষ্য দিয়ে ফেলেছে। মানে আমেরিকান কংগ্রেসে এমন আলোচনা হয়েছে তা স্বীকার করে নিচ্ছে।

আর দ্বিতীয় প্রমাণ আরও অনেক বেশি সাক্ষ্য -প্রমাণ। এর সবচেয়ে বড় প্রভাবটা হল, TOI-ET তে ছাপা হওয়া ঐ রিপোর্টের প্রেক্ষিতে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হাসিনা খুবই কড়াভাবে আমেরিকাকে ধোলাই করে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিল। আর তা বাংলাদেশে তো বটেই, ভারতে ব্যাপকভাবে এবং এশিয়ায় অনেকদেশের মিডিয়ায় গুরুত্ব পেয়েছিল। ফলে TOI-ET তে ছাপা হওয়া খবরের সত্যতা নিয়ে আর কোন প্রশ্ন থাকে নাই। তবে এসব সত্বেও ভারত-চীন যে এক অবস্থান নিয়ে আমেরিকার বিরোধিতা করেছিল সে অংশটা ভারত কোন প্রত্যক্ষ প্রমাণে হাজির রাখতে চায় নাই; তাই যাকিছু প্রমাণ তা পরোক্ষে প্রমাণ, এখানে তা লুকায় নাই।

এমনকি আরেকটা তথ্য খুব গুরুত্বপুর্ণ ছিল সে সময়ে। ১ জুলাই ২০১৯ TOI-ET প্রথম খবরটা চাউর করেছিল। আর এর প্রায় এক সপ্তাহ পরে ৯ জুলাই হাসিনা এক সাংবাদিক সম্মেলনে হাসিনা আমেরিকা ও কংগ্রেসম্যান ব্রাড শেরম্যানকে খুবই কড়া ্সমালোচনা করেছিলেন। তবে, সবচেয়ে বড় কথা হল ঐ সাংবাদিক সম্মেলন ছিল আসলে হাসিনার ২০১৯ সালের ৩-৮ জুলাই এই পাঁচদিনের চীন সফর শেষে দেশে ফিরার পরের দিনের রেগুলার প্রেস ব্রিফিং। আমরা জানি সাধারণত হাসিনার চীন সফরের সময়কালে ভারত টেনশনে থাকে যে কোন কোন নয়া চীনা প্রকল্পে না হাসিনা একমত হয়ে এলেন!!! যা হোক, সেবার ঘটেছিল উলটা। ভারত-চীন মিলে একসাথে হাসিনার মাধ্যমে আমেরিকার বিরুদ্ধে তাদের জবাব দিয়েছিল। যেমন বেনার নিউজের এর শিরোনাম করে ছিল, “রাখাইনকে বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্ত করতে বলা অন্যায়ঃ শেখ হাসিনা”। ভোয়ার শিরোনাম ছিল, “কংগ্রেসম্যান ব্রাড শেরম্যানের কড়া সমালোচনা করলেন হাসিনা”।

এখন ২০১৯ সালের ঠিক এই পুরান জিনিষটাই আবার নতুন করে এখন উঠে আসছে। যদিও আগে কংগ্রেসম্যানের প্রস্তাবটা এসেছিল ট্রাম্পের আমলে। কিন্তু এবার (২০২২) সেটাই আরো সংগঠিতভাবে বাইডেনের প্রোগ্রাম হয়ে এসেছে। আর এতে বাংলাদেশের নিজ রাষ্ট্র-রাজনীতি ও সাধারণ মানুষের দিক থেকে যদি বলি, তবে এটা এখন আমাদের ১৪ বছরের ফ্যাসিবাদি-কর্তৃত্ববাদী সরকার উতখাতেই বিষয়, যেটার স্বপক্ষে আমাদের মানুষেরা আশা করে যে আমেরিকা এতে সমর্থন দিবে। আন্তর্জাতিক হিউম্যান রাইট ফোরামগুলোতে আমাদের পাশে নিঃশর্তে দাঁড়াবে এটাই আশা করে। কিন্তু ক্রমশ যে ইঙ্গিত আমরা দেখছি সেটা হল, ব্রডম্যানের “রাখাইন প্রদেশ কেটে আনা” – সেই ব্যাগেজ এটাই যেন বাইডেনের শর্ত হিসাবে আমাদের কাধেঁ লটকে বসে যেতে চাইছে।

একদম খাড়াভাবে বললে, বার্মা একটা স্বাধীন সার্বভৌম জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্র তাতে সে আমাদের জন্য যতই রোহিঙ্গা সমস্যা তৈরি বা মুসলমান ক্লিনজিং এর নায়ক হোক না কেন! তাই, “রাখাইন প্রদেশকে বাংলাদেশের সাথে যুক্ত করার আমেরিকার প্রস্তাব – এটা একটা ক্রিমিনাল প্রস্তাব। এটা কোনদিনই কোনভাবেই জাতিসংঘ টপকিয়ে পাশ হতে পারবে না। যেমন, ইরাকের সাদ্দামের স্বাধীন কুয়েত রাষ্ট্রকে দখলের পরিণতিতে জাতিসংঘ নিন্দা প্রস্তাব যেমন প্রবল সংখ্যাগরিষ্ঠতায় পাশ হয়েছিল, সবকিছু সাদ্দামের বিরুদ্ধে গেছিল। এটাই সাদ্দামের প্রথমত বিশাল নৈতিক পরাজয় ঘটিয়েছিল আর এর সুযোগ নিয়ে বুশের ইরাক দখল সহজকেই ঘটে গিয়েছিল।

আসলে বাইডেন বার্মা দখল করতে চান যাতে আমেরিকা-চীন এদের যে গ্লোবাল নেতৃত্বের ঝগড়া আছে তাতে আমেরিকার নিজের বিজয় ও স্বার্থ তাতে মিটে। মূলত এশিয়ায় বার্মা, যতই জেনারেলদের ক্লাব সেটা হোক, সেই জেনারেলেরা পরাজিত হয়ে সেটা “বাইডেনের বার্মা” হয়ে যাবে এটা পড়শি ভারত ও চীনের পক্ষে মেনে নেওয়া কঠিন। বলা যেতে পারে পরিস্থিতি এখন ভারত-আমেরিকার গত ২০ বছরের ঘনিষ্ট সম্পর্কের সবচেয়ে ভাটার সময়, দূরে সরে যাবার সময়!! আমেরিকা ইতোমধ্যেই পাকিস্তানকে ভারতের বিরুদ্ধে দাড় করিয়েছে!!

আমরা সবাই জানি যে, গত কমপক্ষে প্রায় ২০ বছর ধরে ভারত আমেরিকার হয়ে এশিয়ায় চীন ঠেকানোর দাড়োয়ান হতে চেয়ে ভুমিকা রেখে গেছে। তবুও ভারতের নিজ কোরস্বার্থ হল বঙ্গোপসাগরে আমেরিকান সেভেনফ্লিট নোঙর করার বিরুদ্ধে দাঁড়ানো অথবা ভারতের যেকোন পড়শিদেশে আমেরিকার গেড়ে বসার বিরোধিতা করা যেটাতে সে আপোষ করে নাই। চীন হল ভারতের ন্যাচারাল পড়শি (যা বদলানো যাবে না) যার তুলনায় আমেরিকার নতুন করে এশিয়ার কোথাও কোন পড়শি দেশে গেড়ে বসতে দেয়া ভারতের জন্য আপত্তির। এই হল ভারতের কোরস্বার্থের সারকথা।

কাজেই বার্মা প্রশ্নে ভারতের অবস্থান এটা চীনা অবস্থানের পক্ষে সমর্থন হয়ে উঠবে; ন্যাচারাল কারণে।

ওদিকে রাশিয়া, ইউক্রেনের যুদ্ধ সাত মাস শেষ করেছে যা আগামি নভেম্বরের আগে কোন মোড় বদল বা মোচড় নিবার সম্ভাবনা নাই বলেই মনে হয়। এঅবস্থায় রাশিয়া না চাইতেই আমেরিকা বিরোধী জোট বা ফ্রন্টের সামনের স্থানের রাষ্ট্র। তাই ভারত ও চীনের সমর্থনে রাশিয়া বাইডনের বার্মার দখলের স্বপ্নের বিপরিতে তবে এই উসিলায় সরাসরি এশিয়ায় পা-রাখতে চাওয়া আমেরিকার বিরোধিদের প্রধান ভুমিকায় হাজির হচ্ছে।

কিন্তু বাংলাদেশের দিক থেকে দেখলে এসবই তো গ্লোবাল নানা দেশেরস্বার্থ ও পরিস্থিতি। আর বাংলাদেশের নিজস্ব চাওয়া যেখানে হাসিনার পতনে একটা প্রতিনিধিত্বমূলক সরকার ও রাজনীতি কায়েম; এভাবে কর্তৃত্ববাদ-ফ্যাসিবাদ হটানো। এই কাজে আমরা আমেরিকাসহ দুনিয়া সকল রাষ্ট্রের সমর্থন চাই; সকল ফোরামে সমর্থন চাই। কিন্তু তাই বলে আমরা না আমেরিকা না চীন বা ভারতের স্বার্থের কোন যুদ্ধে সামিল হতে পারব না। আমরা কারো ব্যাগেজ বইতে পারব না, কোন সামরিক সংশ্লিষ্ঠতায় সামিল হতে চাই না, পারব না। এটা বাংলাদেশের কোরস্বার্থের বিরোধি!

আমরা হাসিনার ক্ষমতা আকড়ে থাকার প্রবল বিরোধী; সরকারের কাঠামো, জবাবদিহিতা ভেঙ্গে ফেলা এর চরমবিরোধী; বিচার বিভাগ তো বটেই খোদ কনষ্টিটিউশনই এখন নির্বাহি ক্ষমতার অধীনে। এসবই অগ্রহণযোগ্য যার আমুল পরিবর্তন এখন আমাদের নুন্যতম কাম্য। তাতে হাসিনা ২০১৯ সালে যতই সঠিকভাবে আমেরিকা ও কংগ্রেসম্যান শেরম্যানের সমালোচনা করে থাকেন না কেন!

আমরা কী শেষে আমেরিকা না চীনের পক্ষ নিবঃ
এখন বাংলাদেশ বলতে দুটা প্রতিনিধিত্ব হতে দেখা যাচ্ছে। একটা হাসিনা-মোমেনের। যেমন হাসিনার পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেন, বার্মার বাংলাদেশে বোমার গোলা ফেলা প্রসঙ্গে বলছেন এটা নাকি বার্মার ‘অনিচ্ছাকৃত’। অর্থাৎ একদিকে বার্মার গোলা পড়তেছে এটা বাস্তবতা। কিন্তু সেটাকে কৌশলে নরম করে দেখিয়ে কসরত করে মোমেন অস্বীকারের চেষ্টা করছেন; এটাকে প্রলেপ দিয়ে হাজির করতে চেষ্টা করছেন। এটা হল আসলে হাসিনার বাইডেনবিরোধি রাশিয়া-চীন-ভারতের জোট বা মেরুতে বাংলাদেশকে ঢুকাতে, অবস্থান নিতে চাইছেন। আর এজায়গায় বাংলাদেশের কমন স্বার্থ ও আকাঙ্খাকে হাসিনা প্রতিনিধিত্ব করেন না। মানে তিনি সেই আকাঙ্খাকে নিজের সাথে রাখতে পারেন নাই বলেই আমার ধারণা। আসলে হাসিনার স্বার্থ আর আমাদের কমন স্বার্থ এক নয়। এককথায় বাংলাদেশের স্বার্থ হল, কোন দেশ বা ব্লকে না সামিল হওয়া। সেটা বাইডেনের বার্মা দখলের পক্ষে বা বিপক্ষে কোন যুদ্ধেই সামিল না হওয়া।

বাংলাদেশ শেষে বাস্তবে কোন সিদ্ধান্তের দিকে যায় সেটা আগামি বাংলাদেশের জন্য খুবই নির্ধারক!!

রাজনৈতিক বিশ্লেষক
goutamdas1958@hotmail.com

Advertisements