জাতিসঙ্ঘের সাধারণ পরিষদে দুদিন আগে গত ২৪ মার্চ ইউক্রেন-বিষয়ক এক প্রস্তাবের পক্ষে-বিপক্ষে ভোটাভুটি হয়েছে। আর বাংলাদেশ তাতে পক্ষে ভোট দিয়েছে; অর্থাৎ আগের ভোটাভুটিগুলোর চেয়ে এটা ব্যতিক্রম; যদিও এনিয়ে অনেক পত্রিকার রিপোর্টিংয়ে ভুল ইঙ্গিতে খবরটা উপস্থাপন করা হয়েছে। যেমন ‘প্রথম আলো’র শিরোনাম হল – “জাতিসঙ্ঘে ইউক্রেনের পক্ষে ভোট দিলো বাংলাদেশ”। আর ফ্যাক্টস হল – এটি ঠিক ইউক্রেনের পক্ষের বা বিপক্ষের কোনো ভোটাভুটিই ছিল না। তাহলে কী ছিল? সাধারণ পরিষদে একটা প্রস্তাব তোলা হয়েছিল এই বলে যে, ইউক্রেনের ‘সিভিলিয়ান সুরক্ষা আর মানবিক সাহায্যের প্রবেশের দাবি’ [demanded civilian protection and humanitarian access ] করা হচ্ছে। আর সেখানে এই প্রস্তাবের প্রস্তাবক ছিল ফ্রান্স, মেক্সিকো, ইউক্রেনের সাথে মিলে মোট ৯০টা দেশ। আর সুনির্দিষ্ট করে যেকোনো যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের বেলায় যেমনটা হয়ে থাকে যে, সিভিলিয়ান ক্ষতিগ্রস্ত যেন না হয় আর মানবিক সাহায্য চলাচলে যেন সুযোগ করে দেয়া হয় – এটা তেমনই অধিকার দাবি করে করা এক প্রস্তাব। কাজেই বাংলাদেশ এর পক্ষে ভোট দিয়েছে। আর এমন দাবি যেকোনো যুদ্ধে সব পক্ষই মেনে চলতে বাধ্য হতে হয়, কেননা এটা জাতিসঙ্ঘেরই এক সাধারণ অবস্থান। ফলে এটা ঠিক সরাসরি ‘ইউক্রেনের পক্ষে ভোটদান’ হয়েছে বলে দেখতে হবে – নট নেসেসারিলি [not necessarily]; অর্থাৎ এটা অনিবার্য নয়। তবে পরোক্ষে এই ভোটদানের সুফল ইউক্রেনের পক্ষে যেতে পারে, অবশ্যই।
আসলে নিউজ রিপোর্টিংয়ের শিরোনাম বিতর্কিত না রাখতে চাইলে শুধু বললেই হত যে, বাংলাদেশ ‘ইউক্রেন-বিষয়ক একটি প্রস্তাবের পক্ষে’ ভোট দিয়েছে। আর বলাই বাহুল্য, ‘ইউক্রেন-বিষয়ক একটা প্রস্তাবের পক্ষে’ ভোট আর “ইউক্রেনের পক্ষে” ভোট – এদুটা কোনোভাবেই একই কথা নয়। ফলে অযথাই এখানে টুইস্ট করা হয়েছে – বাংলাদেশ ‘ইউক্রেনের পক্ষে’ ভোট দিয়েছে। তবে এখান থেকে আরেক অনুষঙ্গীয় প্রসঙ্গ – অনেকে বলছেন, বাংলাদেশ অবস্থান বদলিয়েছে। মানে আগে বিপক্ষে ভোট দিলেও এবার পক্ষে ভোট দিয়েছে। তাই কি? না, ঠিক তাও না।
যেমন – ধরা যাক কোনো সাংবাদিক আগামী কোনো সংবাদ সম্মেলনে পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে এনিয়ে প্রশ্ন করে জানতে চাইলেন, বাংলাদেশ অবস্থান বদল করল কি না বা কেন করল? সেক্ষেত্রে কি পক্ষে ভোটদানের কারণে মন্ত্রীকে স্বীকার করে নিতেই হবে যে, তার সরকার অবস্থান বদল করেছে?
সরি, ব্যাপারটা এমন হবে না, কারণ ব্যাপারটা তাই নয়। কারণ মন্ত্রী (সম্ভবত) বলবেন, ‘আসলে হয় রাশিয়া না হলে ইউক্রেনের পক্ষ-বিপক্ষে ভোট দিতেই হবে – প্রস্তাবটাই এমন ছিল না। বাংলাদেশ পক্ষে ভোট দিয়েছে মানে বাংলাদেশ “সিভিলিয়ান সুরক্ষা’ আর ‘মানবিক সাহায্য অবাধ প্রবেশের’ পক্ষে ভোট দিয়েছে। সুনির্দিষ্ট কোনো দেশের পক্ষে-বিপক্ষে নয়”। কিন্তু এরপরেও কেউ যদি জানতে চান, এই অবস্থানের জন্য বাইডেনের আমেরিকা কি একটু খুশি হবে? এর জবাব হবে – অবশ্যই খুশি হবে! তবে এটা পরোক্ষে খুশি করা, তা-ও খেয়াল রাখতে হবে।
ইউক্রেনের সর্বশেষ অবস্থা কীঃ
ইউক্রেনে যুদ্ধের সর্বশেষ অবস্থা হল, এটা ইউক্রেনের দিক থেকে বললে – এটা তাদের আরো অধৈর্য হয়ে উঠা এবং বাইডেনের হাত প্রায় ছেড়ে কালকেই রাশিয়ার সাথে বসে সব মিটমাট করে নেয়ার আকুতি তুলে ধরা এক অবস্থায় পৌছে থাকা। যদিও বাইডেন বা পশ্চিমা শক্তির সেদিকে মনোযোগ নেই। আর রাশিয়ার দিক থেকে এটা এক হঠাৎ ঝিমিয়ে পড়া অবস্থায় পড়েছে। যেটা একধরণের ‘স্ট্যাটাস কো’[status quo] মানে, যে যে অবস্থায় আছে সেখানেই আটকে থাকার একটা চেষ্টা দেখা যাচ্ছে। অর্থাৎ দু’সপ্তাহ আগের অবস্থার সাথে যদি তুলনা করি, বিশেষ করে আমেরিকার ‘এবিসি নিউজ’ টিভির সাথে ইউক্রেন প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি যেখানে নিজ দেশের ভাষায় সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন তার কথা বলছি। এনিয়ে আমার লেখা এখানে । ঐ সাক্ষাৎকারের বক্তব্যের অভিমুখ যা ছিল তাতে এতদিন ইউক্রেন পরিস্থিতিতে একেবারে রাশিয়ান সেনা প্রত্যাহার না হলেও অন্তত লম্বা যুদ্ধবিরতি আর পুতিন-জেলেনস্কি দু’পক্ষকে সরাসরি ডায়ালগে বসতে দেখতে পেতাম। কারণ ওই সাক্ষাৎকার প্রচারের পরের দিন অন্তত দু’বার রাশিয়ান সরকারের পক্ষ থেকে ইউক্রেনের অবস্থান ইতিবাচক বলে বর্ণনা করা হয়েছিল। মানে জেলেনস্কির সাক্ষাৎকার রাশিয়া ইতিবাচকভাবে নিয়েছে – এর স্বীকৃতি বলে ধরে নিতে পারি। তাহলে আবার এখন সব ঝিমিয়ে পড়া অবস্থায় বা স্ট্যাটাস কো – এমন বলছি কেন? কারণ এর পরে কোনো অগ্রগতি নেই – মানে এর কোনো ‘পরবর্তী’ নাই।
এমনকি ওই একই সময় রাশিয়ার তেল-গ্যাস না কিনে ইউরোপের কোনো বিকল্প নাই। ফলে তারা রাশিয়ান গ্যাস কিনবে বলে অন্তত তিনটি দেশ – ফ্রান্স, জর্মানি ও নেদারল্যান্ডসের প্রকাশ্য বক্তব্য দেখেছিলাম। অথচ সেসব বক্তব্যেরও আর কোনো ফলোআপ পরে আর দেখা যায়নি। বরং সর্বশেষ অবস্থান দেখা যাচ্ছে বাইডেনের এবং তা এখন সম্পূর্ণ বিপরীত। এবিসি নিউজের সাক্ষাৎকার প্রসঙ্গে বলেছিলাম এর মধ্যে জেলেনস্কির কূটনৈতিক ডায়ালগের মাধ্যমে যুদ্ধ শেষ করার আগ্রহ আছে। কিন্তু তাতে সবার আগে বাইডেন ও জেলেনস্কির, এ দুই প্রেসিডেন্টের ইমেজ বাঁচানোটাই ছিল মুখ্য ইস্যু। সেটা নিশ্চিত হলে তবেই ওই যুদ্ধ সমাপ্তি ও ডিপ্লোম্যাটিক আলোচনা শুরু হতে পারে – এই ছিল আমেরিকান পরিকল্পনা।
কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, হিসাবে এতে সব ঠিকঠাক থাকলেও বাইডেন সম্ভবত দেখছেন, এতে তার ইমেজ বাঁচানো যাচ্ছে না। কারণ এখন যদি বিনাযুদ্ধে ও কূটনৈতিক আলোচনাতেই যুদ্ধ শেষ করা যায় তাহলে যুদ্ধটা শুরু করার দরকার কী ছিল? সে প্রশ্ন কেউ না তুললেও বাতাসে তা হাজির হবেই। আরো সুনির্দিষ্ট করে বললে, জেলেনস্কি এবিসি নিউজকে ইতোমধ্যেই বলে ফেলেছেন, তার আর ন্যাটোর কোনো সদস্য হওয়ার আকাঙ্ক্ষা নেই। ব্যাপারটি অনেকটা শখ মিটে যাওয়ার মতো হয়ে গেছে। আর তিনি বলছেন, ইতোমধ্যেই তিনি ‘এই আকাঙ্ক্ষার প্রশ্নে নিজেকে কুল ডাউন করতে পেরেছেন। আর বুঝেছেন যে, ন্যাটো ইউক্রেনকে সদস্য হিসেবে গ্রহণ করতে প্রস্তুত নয়।’ আর এ পরিস্থিতিটাকেই বাইডেন নিজের জন্য পরাজয় হিসেবে দেখছেন!
বাইডেন এখন ইউরোপেঃ
অতএব, বাইডেন ইউরোপ সফরে এসেছেন। অর্থাৎ জেলেনস্কি কিভাবে কত দ্রুত রাশিয়ার সাথে আপোষ ডিল শেষ করতে চাইছেন অথবা সাদা চামড়ার ইউক্রেনীয় শরণার্থীরা কত দ্রুত ঘরে ফিরতে চাইছেন – সেগুলো নয়, বাইডেনের চাওয়া এখানে ডমিনেট করবেই, এমন দশায় এখন সংশ্লিষ্ট সকলে। তাই গত বৃহস্পতিবার সকাল থেকেই ইইউ হেড কোয়ার্টার-ব্রাসেলসে বসে বাইডেন বৈঠক করে গেছেন যার মূল বিষয় ইইউ সদস্যদের রাশিয়ান গ্যাসের বিকল্পের সন্ধান দেয়া শুধু নয়, একেবারে ব্যবস্থা করে দেয়া। বাইডেন বলতে চাইছেন রাশিয়ার তেল-গ্যাসে বিশেষত গ্যাসের উপর ইউরোপের নির্ভরতার সমাপ্তি তিনি নাকি ঘটাবেনই!
আর এতে ‘ত্রাতা’ বাইডেন যা করতে চাইছেন তা যেন উচ্ছ্বাস দেখিয়েই হাজির করতে হবে। তাতে এটা যে, আসলে প্রপাগান্ডা তা লুকিয়ে কাজটা করতে চাইলেও লুকানো থাকেনি। বিবিসি বাংলা আর আমাদের ‘প্রথম আলো’ সেই উচ্ছ্বাস তৈরি করতে তেমন করেই শিরোনাম সাজিয়েছে। “রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধঃ রাশিয়ার বদলে এখন থেকে ইউরোপের গ্যাস আসবে আমেরিকা থেকে” – এই হল বিবিসি বাংলার শিরোনাম। আর তা দেখে সব বিচার-বিবেচনা ভুলে প্রথম আলোর শিরোনাম – ‘রাশিয়াকে হটাতে ইউরোপে গ্যাস দেবে যুক্তরাষ্ট্র’। প্রপাগান্ডায় আরো সরস দেখাতেই যেন ‘হটাতে’ শব্দটার ব্যবহার। শুনলে মনে হবে – হ্যাঁ, এবার ‘ঘ্যাগের ওষুধ’ পাওয়া গেছে! বিবিসি লিখেছে, “প্রেসিডেন্ট বাইডেনের উপস্থিতিতে ব্রাসেলসে শুক্রবার হওয়া এক চুক্তির আওতায় এবছরের শেষ নাগাদ যুক্তরাষ্ট্র ইউরোপীয় ইউনিয়নকে অতিরিক্ত ১৫০০ কোটি ঘন মিটার এলএনজি বা তরলীকৃত গ্যাস সরবরাহ করবে। এ বছরের মধ্যে রুশ গ্যাসের ওপর নির্ভরতা দুই -তৃতীয়াংশ কমানোর টার্গেট নিয়েছে ইইউ”।
কিন্তু ব্যাপারটা আসলেই কি তাই?
জবাব হল – না, ঠিক তা নয়। বিবিসি বাংলার রিপোর্টের ভেতরেই তা নিয়ে খোলাসা করে কথা বলা হয়েছে। যেমন – ‘যুক্তরাষ্ট্র কি ইউরোপের চাহিদা মেটাতে পারবে? “রুশ জ্বালানির ও পর নির্ভরতা পুরোপুরি ঘোচানো কতটা সহজ হবে ইউরোপের জন্য? আমেরিকার ওপর কতটা ভরসা তারা করতে পারে? নিজেই এই প্রশ্নটা তুলে বিবিসি বাংলা নিজেই উত্তরটা দিয়ে দিয়েছে। বলেছে, “বিবিসি নিউজের অনলাইন ইউরোপ এডিটর পল কিরবি এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছেন। তিনি তুলে ধরেন, তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের সরবরাহে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যে একটি বড় চুক্তির ঘোষণা কিছু সময় আগে জানা গেছে। তবে যুক্তরাষ্ট্র ইউরোপে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের সরবরাহ ব্যাপক বাড়ালেও, ইইউভুক্ত ২৭টি রাষ্ট্রের জন্য এটি সামান্য মাত্র।’ অর্থাৎ বাইডেনের কথায় বাকচাতুরী আছে।
“বিবিসির সংবাদদাতা পল কারবি বলছেন, ইইউ-এর ২৭টি দেশকে তাদের গ্যাসের চাহিদা মেটাতে আমেরিকার বাইরে অন্যান্য উৎপাদনকারী দেশের দিকেও তাকাতে হবে।” – বিবিসি বাংলা
এদিকে বাইডেনের ইউরোপ সফর নিয়ে ইংরেজি বিবিসি আরেকটা রিপোর্ট করেছে ‘পাঁচ চ্যালেঞ্জ’ [Ukraine war: Five challenges for Biden in Europe] শিরোনামে এবং বলতে গেলে তা খুবই খারাপ রিপোর্ট না হলেও বাইডেনের জন্য কঠিন বাধাগুলোই তুলে আনা হয়েছে সেখানে। যেমন, প্রথম চ্যালেঞ্জটা বলা হয়েছে “ঐক্য দেখানো”। মানে হল – ইউরোপের সাথে আমেরিকা যে ঐক্যবদ্ধ আছে তা দেখাতে হবে। অথচ ওখানেই বলা হয়েছে “যেখানে যত দিন যাচ্ছে ততই অনৈক্যের সম্ভাবনা বাড়ছে”।
আসলে বড় অনৈক্যই প্রকাশিত হয়ে গেছে। অথচ তেল-গ্যাস নিয়ে যতই আমেরিকা বিকল্প আছে বলে এটা-সেটা দেখাক না কেন, কথার মধ্যে বড় ফাঁক আছে। আর তা সামলাতে না পেরেই তো অনেক আগেই ইইউ নেতারা বিশেষত জার্মানির সোজা কথা – “অন্তত ২০২৭ সালের আগে রাশিয়ার ওপর থেকে জ্বালানি-নির্ভরতা কমানোর সুযোগ নেই”। আর এ নিয়ে তবু বিবিসি বাংলা নিউজ প্রপাগান্ডার লাইন ধরেছে। এই প্রথমত বিবিসি বাংলার খবরে সুনির্দিষ্ট করে প্রকাশিত হয়েছে যে, ‘জার্মানি ও ইউরোপের আরো কয়েকটি দেশের আপত্তির মুখে, রুশ তেল ও গ্যাস এখনো এই নিষেধাজ্ঞার আওতার বাইরে। কারণ রুশ জ্বালানির ওপর, বিশেষ করে গ্যাসের ওপর, তাদের নির্ভরতা”। অর্থাৎ ইউরোপের রাশিয়ান তেল-গ্যাস ক্রয়কে এখনো নিষেধাজ্ঞার বাইরেই রাখা আছে এবং বিবিসি আরো জানিয়েছে, জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ শোলৎস বুধবারও বলেছেন, “রাশিয়ার তেল ও গ্যাসের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিলে ইউরোপ অর্থনৈতিক মন্দার কবলে পড়বে”। এ ছাড়া রয়টার্স আরো সোজাসাপ্টা করে কথাটা এক এক্সপার্ট অ্যানালিস্টের বরাতে বলে দিয়েছে। লিখেছে, ‘সাধারণত একটি নতুন উৎপাদন ব্যবস্থা চালু হতে দুই-তিন বছর লাগে। অতএব এই ডিলটা সম্ভবত উপস্থিত চালু সাপ্লাইকে নতুন দিকে নিয়ে যাওয়া যতটা না, এটা নতুন উৎপাদন সক্ষমতা তৈরি করার কথা বলেছে।’
ইইউ এর স্ববিরোধী অবস্থানঃ
ইইউ আমেরিকার সাথে তালে নাচতে চায় আবার রাশিয়ান গ্যাস জ্বালিয়ে ইউরোপের ঠান্ডায় নিজের ঘরগরম রাখতে চায়। এই হল মূল স্ববিরোধ বা দু-মুখো অবস্থান। রাশিয়ার উপরে আমেরিকান ডলার অবরোধের সীমা-পরিসীমা নাই। ইউক্রেনে রাশিয়ার হামিলার একদিন আগে থেকেই এর শুরু হয়েছিল। আর ইইউ-ও আমেরিকার এই অব্রোধ অনুসরণ করে তাদের ইউরো- অবরোধের ঘোষণা করেছিল। যার সোজা অর্থ রাশিয়া ইইউ-সহ কোন দেশের ক্রেতার সাথে ইউরোতে কেনাবেচা করতে পারবে না।
তাহলে এখন এই শর্ত অনুসারে ইউরোপ রাশিয়ান গ্যাসও কিনতে পারে না। কিন্তু এই ক্ষেত্রে এসে ইইউ মোচড়ামুচড়ি শুরু করেছে। তাদের দাবি ও তারা বলতে চায় গ্যাসের উপর ইউরো অবরোধ কার্যকর নয়। তারা কার্যকর করে নাই। আর এখানেই রাশিয়ার সাথে ইইউ-এর ব্যাখ্যা-বিতর্কের শুরু। রাশিয়া সম্প্রতি ঘোষণা দিয়েছে যারা অবন্ধুসুলভ-দেশ [unfriendly] তারা গ্যাস কিনতে চাইলে তাদেরকে তা রাশিয়ার মুদ্রায় রুবলে কিনতে হবে। যেমন জর্মানি যারা প্রায় ৫৫% রাশিয়ান গ্যাসের উপর নির্ভরশীল কিন্তু তারাই আবার ইইউ-এর সদস্য হিশাবে রাশিয়ার উপর ইউরো অবরোধ আরোপকারি অবশ্যই। তারা কেবল নিজেদের সুবিধার্থে গ্যাস কেনার বেলায় অবরোধ নাই (মানে বাকি সবকিছু ইউরোতে কেনাকাটাতে অবরোধ আছে) বলছে। যার মানে হল রাশিয়া গ্যাস বেচে যে ইউরো পাবে তা দিয়ে সে ইউরোপের অন্য কোন পণ্যও কিনতে পারবে না। বলাই বাহুল্য এটা তো এক অর্থহীন ও অসম খামখেয়ালি অবদার হয়ে গেল!
তাই স্বভাবতই পুতিনকে বলতে হয়েছে সেক্ষেত্রে জর্মানির মত বন্ধু-নয় দেশকে রুবলে গ্যাস কিনতে হবে। ফলে এটা বলা যায় যে পুতিনকে একন কথা বলতে ইইউ-ই বাধ্য করছে বা ডেকে এনেছে। এনিয়ে রয়টার্স এক রিপোর্ট করেছে যাতে রাশিয়ান গ্যাস কিনে ও নির্ভরশীল এমন প্রায় সব দেশের প্রতিক্রিয়া তুলে আনা হয়েছে। স্বভাবতই এতে দেখা যাচ্ছে ক্রেতারা বিপদে পড়েছে। তারা কেউ কেউ এটা গ্যাস কিনার চুক্তিতে নাই – এমন বক্তব্য দিয়েছে। এর উপর আবার আরেক বিপদ হল যে গ্লোবাল মার্কেটে গ্যাসের দাম কমপক্ষে ৩০% বেড়ে গেছে। মানে হল ভোক্তা দেশকে এখন বেশিদামে কিনতে হবে। অবস্থাটা এককথায় বললে, ভোক্তা দেশে গ্যাস সরবরাহ অনিশ্চিত হয়ে উঠার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। আবার মনে রাখতে হবে গ্যাসের সাপ্লাইয়ের বেলায় যেকোন বিকল্প উৎস যোগাড় হয়ে গেলেও অবকাঠামো নির্মাণ শেষে তা চালু করে থিতু হতে গেলে কমপক্ষে ২-৩ বছর সময় লেগে যায়। অর্থাৎ আরামে ইউরোপে বসবাস আর আরামে থাকছে না…!
ওদিকে তেলের দামের যদি তাকাই। এর আগে ৮০ ডলারে ব্যারেল দামে রাখাই দুনিয়া হিমশিম খাচ্ছিল। সেটা এখন হয়েছে ১২০ ডলার প্রায়। এর সোজা মানে হল সারা দুনিয়ায় সরকারগুলো বিপদে এক হৈচৈ অর্থনৈতিক বিশৃঙ্খলা শুরু হয়েছে। বিশেষ করে আমাদের মত দেশ ও এর গরীব পাবলিক এরা খাদ্য কিনতেও সঙ্কটে পড়বে। এর জন্য কে দায়ী হবে? বলাই বাহুল্য ডলার অবরোধ।
সারা দুনিয়াকে এভাবে অস্থির ও অনিশ্চিত রেখে বাইডেন কী কামাইতে চাইতেছেন?? কী ইমেজ রক্ষা করবেন তিনি??
ইউরোপের সরকারগুলো কিভাবে তাদের বাইডেনকে অনুসরণের পক্ষে কী সাফাই দিবেন? আর তা কেন ও কিভাবে তাদের আমজনতার কাছে গ্রহণযোগ্য হবে??
ইউরোপে বাইডেনের আরেক গন্তব্যস্থল হল পোল্যান্ডঃ
এছাড়া ইউরোপ সফরে বাইডেনের আরেক গন্তব্যস্থল হল পোল্যান্ড। হ্যাঁ, সেই পোল্যান্ড যে এখন ২০ লাখ ইউক্রেনীয় রিফিউজি নিয়ে পেরেশান। বলা হচ্ছে – ‘সেটা নাকি এখন তার ছোট অর্থনীতিকেই ভেঙে ফেলতে উদ্যত” […refugees has put a considerable financial and logistical burdens on Poland and, if not handled competently, could ultimately lead to social unrest and economic instability.]। কিন্তু এই পোল্যান্ড ও পাশেই রোমানিয়া – এরা এখন ন্যাটোর সদস্য যারা আগে ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের বাফার রাষ্ট্র। মানে কলোনিদখলদার পশ্চিম-ইউরোপ থেকে সোভিয়েত ইউনিয়নকে সুরক্ষা দেয়ার জন্য মাঝের বাফার রাষ্ট্র। যেটা নিয়ে অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন রাশিয়ার বিরুদ্ধে। বলেছেন, ২০১৪ সালের পরপরই এরা ন্যাটোর সদস্য হয়ে গেছে অথচ তখন রাশিয়া কিছু বলেনি, তাহলে এখন কেন পুতিন ইউক্রেনের বেলায় এত আপত্তি করছেন? অথচ জবাবটা খুবই সহজ। আপনি তখনই বাধা দেন যখন আপনার সামর্থ্য-মুরোদ সংগৃহীত হয়েছে বলে আপনার মনে হয়। এটা তো পানির মতই স্বচ্ছ কথা, নয় কী? যেমন – ২০১৪ সালের রাশিয়া ছিল আমেরিকার দিক থেকে কঠোর অবরোধ আরোপের বছর আর সেটাই আবার চীনের সাথে রাশিয়ার নয়া অর্থনৈতিক সম্পর্ক শুরুর বছর। যেটা চীন-ইরানের বেলায় তাদের ২৫ বছর তেল-গ্যাস সরবরাহের বিনিময়ে চীনের বিনিয়োগ পাওয়ার চুক্তি সেি চুক্টাতির মডেল রূপটা আসলে সর্বপ্রথম তৈরি হয়েছিল চীন ও রাশিয়ার মধ্যে। তাই পুতিনের রাশিয়া ডলারশূন্য হয়েও বা ডলার থেকে বের করে দিলেও রাশিয়া পরে অর্থনৈতিকভাবে টিকে গিয়েছিল চীনের সাথে ঐ অর্থনৈতিক চুক্তির কারণে। সোজা কথায়, ২০১৪ আর ২০২২ সালের পুতিনের রাশিয়া একই অর্থনৈতিক অবস্থায় নেই। এ কারণেই ২০১৪ সালে পোল্যান্ড-রোমানিয়াকে কিছু বলতে না পারলেও এখন ইউক্রেনের বেলায় পুতিন সোচ্চার। এসময় রাশিয়া চীনের সাথে অনেক ঘনিষ্ট এবং সর্বোপরি আমেরিকা এখন অনেক বেশি গ্লোবাল কনট্রোল ও প্রভাব হারিয়েছে। তাই এটাই পুতিনের জন্য ফেবারেবল সময়!
যে কথা বলছিলাম, বাইডেনের আরেক গন্তব্যস্থল পোল্যান্ড কেন? আসলে আগেই বলেছি, বাইডেন ইউক্রেন ইস্যুতে নিজে বা ন্যাটোকে রাশিয়ার বিরিদ্ধে যুদ্ধে যাবে না ফলে এমন কিছু না করেই মিথ্যা আশ্বাসে জেলেনস্কিকে যুদ্ধে নামিয়েছেন। জেলেনেস্কি বারবার এই অভিযোগ তোলাতে তা সবাই জানে। তাই বাইডেন হয়ত এই অভিযোগে নিজ দেশেই ধোলাই হয়ে যাওয়ার ভয় করছেন। আগামি নভেম্বরের মিড টার্ম এমনিতেই বাইডেন ও দলের অবস্থা খারাপ। এর উপর অনুমান করা যায় সাদা শ্রেষ্ঠত্ববাদী ও ট্রাম্প বাইডেনের এই বোকা পারফর্মেন্স নিয়ে তাকে ধোলাই করতে ছাড়ার কোণ কারণই নাই। মূলত এ জন্যই সম্ভবত রাশিয়া-ইউক্রেন আপস আলোচনা শুরু করতে মরিয়া জেলেনস্কি প্রতিদিন সকালে উদাত্ত আহ্বান জানালেও তা ঘটছে না। আর এসব অপবাদ ঘুচাতেই বাইডেন ইউক্রেনকে দূর থেকে কিছু অস্ত্র ছুড়ে দিতে চান। কিন্তু পুতিন হুঁশিয়ারি দিয়ে রেখেছেন – পড়শি কোনো রাষ্ট্র এমন অস্ত্র ‘পৌঁছে দেয়ার কাজ করলে’ সে রাশিয়ার বিরুদ্ধে সামরিক কাজ করেছে বলে তিনি গণ্য করবেন। তাই বাইডেন নিজে সফর করে হয়ত পোল্যান্ডকে সাহসী করে তুলে পোল্যান্ডকে দিয়েই কাজটা করাতে চাইছেন; এটাই মুখ্য কারণ। পুতিনও এসব ডেভেলবমেন্ট আর বাইডেনের মতিগতি বুঝার জন্যই থমকে দাড়িয়েছেন। জেলেনেস্কির আপোহ আলোচনার দাওয়াত গা করছেন না। এককথায় বাইডেনের ইমেজ রক্ষা করতে গিয়ে সবাই একটা স্টেলমেটে আটকে গেছে। কঠিন বাস্তবতাটা হল, কেউ-ই আমেরিকায় বাইডেনের ইমেজ রক্ষা করতে পারবে না। এই অবস্থা বড় সময় ধরে থাকলে বাইডেনের পক্ষের ইউরোপ-সহ দেশগুলোর তাকে ছেড়ে চলে যাওয়ার সম্ভাবনা নাকচ করা যায় না। কারণ নিজ নিজ দেশের স্বার্থ আর নিজে ক্ষমতায় থেকে যাওয়ার উপরে আর কোন স্বার্থ বলে কিছু কখনও থাকতে পারে না – এই বট্ম লাইন সবাইকে মানতেই হয়!
শেষ পেরেক, ডলারের বদলে চীনা ইউয়ানঃ
আর সবশেষে, চীন গভীর মনোযোগে ডলারের বিকল্প হিসেবে চীনা মুদ্রা ইউয়ানকে দাঁড় করাতে চাইছে। এনিয়ে ব্যাপক ততপরতা শুরু করে দিয়েছে। সম্প্রতিকালের চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ঈ-এর দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশের সফরের উদ্দেশ্য এটাই। এমনকি দুবছর পরে তিনি এবার ভারতও সফর করেছেন। আসলে এটা ২০১৫ সাল থেকেই রাশিয়াকে সাথে নিয়ে শুরু করা এক চীনা পরিকল্পনা। আর ২০১৫ সাল থেকে এ জন্য যে, ওই বছরই আইএমএফ ইউয়ানকে আন্তর্জাতিক মুদ্রা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিল। মানে দুনিয়ার যে কোন মানুষ তখন থেকে ইউয়ানে সম্পদ ধরে রাখতে পারবে ও তার আন্তর্জাতিক অর্থদায় ইউয়ানে শোধ করতে পারবে। কারণ চীনা ইউয়ান আইএমএফের সব শর্তই তখন থেকে পূরণ করেছিল। ফলে অন্য চারটি আন্তর্জাতিক মুদ্রা – ডলার, পাউন্ড, ইউরো ও ইয়েনের সাথে পঞ্চম সমতুল্য মুদ্রা হিসেবে ইউয়ান [অনেকে একে রেনবি renminbi (RMB) বলে] স্বীকৃতি পেয়েছিল। কিন্তু ইউয়ানের সেই ধীরগতি ও বিকাশকেই চীন এখন ত্বরান্বিত করতে চাইছে মাত্র। তখনই বলা হয়েছিল যে, চীন সৌদি আরব থেকে বছরে যা তেল কিনে তা ইউয়ানে পরিশোধ করতে পারলেই ইউয়ান অনেক আগেই বিশ্বাস ও আস্থাযোগ্য এক প্রধান আন্তর্জাতিক মুদ্রা হয়ে যেতে পারে। স্বভাবতই এতে এটা বাইডেনের পাগলা পুতিনকে সাঁকো না নাড়ানোর মত কথা মনে করিয়ে দেয়া হয়ে যেতে পারে। এতে এখন পর্যন্ত সবদেশের যে ঝোঁক অভিমুখ তা হল ডলারের পাশাপাশি সবাই ইউয়ানে গ্লোবাল বাণিজ্য করার সুযোগ খুলে রাখার পক্ষপাতি। তাই এটাই ইউয়ানকে স্বাগত জানিয়ে রাখার মত একটা ঘটনা হয়ে গেছে। এককথায়, কিছু হলেই “ডলার অবরোধ” আরোপ – এটা অতি বাড়াবাড়ি ও অপব্যবহার হিশাবে দেখতে শুরু করে দিয়েছে গ্লোবাল পুঁজি বাজার। কারণ সবারই দরকার সম্পদ ধরে রাখার মত এক স্থিতিশীল মুদ্রা। আগামি ইতিহাস একে বাইডেনের এক বড় ভুল বলে চিহ্নিত করবে যে তিনি গ্লোবাল বাজারে “মুদ্রা অনিশ্চয়তা” এনেছিলেন।
আর সামনের নভেম্বরের মিডটার্ম থেকে ২০২৪ সালের নির্বাচন পর্যন্ত এসব কথা তুলেই প্রতিদ্বন্দ্বী ট্রাম্প বাইডেনের পাবলিক রেটিং আরো নিচে নামানোর চেষ্টা করে যাবেন, বলাই বাহুল্য! এই ভয় বাইডেনকে তাড়া করছে – ইউরোপে দৌড়াদৌড়ি করছেন তিনি! কিন্তু এসব কিছু করে কী ইইউ-কে সাথে অবরোধের পলিসিতে ধরে রাখতে পারবেন?? নাকি ইউরোপও ডলারের সাথে ভেসে যাবে? প্রকাশিত ইঙ্গিতগুলো ভাল না!!!
লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
goutamdas1958@hotmail.com