ইসলামোফোবিয়া নিয়ন্ত্রণে বিল - ইসলামোফোবিয়া নিয়ন্ত্রণ বিল কতটা কার্যকর হবে ? - সত্য ও নিরপেক্ষ সংবাদ
Advertisements

মিডল ইস্ট মনিটর এর মতামত পাতায়  প্রকাশিত  নাসিম আহমেদের লেখাটি  ভাওয়াল বার্তার পাঠকদের জন্য তরজমা করা হয়েছে ।


মার্কিন সিনেটে ইসলামোফোবিয়া মোকাবেলায় গত সপ্তাহের ক্লোজ ভোট ও মার্কিন বৃহত্তর একটি মুসলিম দলের প্রতিক্রিয়া দেখে মনে হচ্ছে, বাইডেন নাইন ইলেভেনের যুগ থেকে বেরিয়ে এসে আমেরিকাকে নতুনভাবে হাজির করেতে চাচ্ছে। কিন্তু সেখান থেকে বেরিয়ে আসা আমরিকার জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হবে।”সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ” প্রকল্পের মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া মুসলিম বিরোধী বর্ণবাদের জেনোফোবিক স্রোতকে সংস্কার করা এবং বিশ্বব্যাপী ইসলামোফোবিয়া ইন্ডাসট্রির সাথে ইসরায়েলের সহযোগিতার যোগসূত্রের তদন্ত ততটা সহজ হবে না।

একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় ‘চিরকালের যুদ্ধ’ শেষ করা ও দুই দশক ধরে জারি থাকা সন্ত্রাসবাদের নামে যুদ্ধ নীতি থেকে বেরিয়ে এসে মার্কিন পররাষ্ট্র নীতিকে পুনর্নির্মাণের অঙ্গীকার নিয়ে বাইডেন ক্ষমতায় এসেছেন। মানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াই, গণতন্ত্রকে পুনরুজ্জীবিত করা এবং চীন ও রাশিয়ার সাথে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে মার্কিন ও তার মিত্রদের প্রস্তুত করা।

যদিও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের পুরনো নীতি পুনর্নির্মাণ করে ভবিষ্যতে আগাতে চাচ্ছে। কিন্তু দুই দশক ধরে মধ্যপ্রাচ্যে যে কাঠামো ও বর্ণবাদী ডিসকোর্স জারি রেখেছে তা শেষ হবার নয়। ‘সামরিক–শিল্প কমপ্লেক্স’ পুনর্নির্মাণ করা বাইডের পক্ষে সহজ হবে না, কেননা যুদ্ধ নীতি তৈরিতে তারাই মূল ভুমিকায় থাকে। বেশি মুনাফা কামাই করতে অস্ত্র ব্যবসায়ীরা সবসময় নতুন শত্রু চায়।

নাইন ইলেভেনের পর সন্ত্রাসবাদের নামে যে বয়ান জারি করেছে তার সমাধান আমরিকার অনেক কঠিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে। কেননা বিশ্বজুড়ে কর্তৃত্ববাদী শাসকরা ‘মুসলিম সন্ত্রাসবাদ’র দুহাই দিয়ে চরম মানবাধিকার লঙ্ঘন ও অগণতন্ত্রকে জায়েজ করে নিচ্ছে। সন্ত্রাসবাদের নামে ভয় তৈরি এবং শরীয়া বিকৃতি করা ষড়যন্ত্রের তত্ত্বের সংস্কৃতি সমাজের গভীরে শিখড় গেড়ে আছে। যা শুধুমাত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নয়,বিশ্বজুড়েও এর প্রভাব আছে।

চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং এবং মধ্যপ্রাচ্যের অনেক শাসনব্যবস্থা ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ এর বয়ানকে আত্তীকরণ করে নিয়েছে। ওবামা ক্ষমতা গ্রহনের শুরুতে “গুয়ানতানামো বে” বন্ধ করার চেষ্টা করেছিলেন। কিছু উইঘুর বন্দিকে মুক্তি দেওয়ার পরিকল্পনা করেছিলেন। তবে তার এ আদেশ নানা কারণে, বিশেষ করে কংগ্রেসের বিরোধিতার মুখে বাস্তবায়িত হয় নি। এ নিয়ে রিপাবলিকানরা একটি যৌথ বিবৃতি প্রকাশ করে, যেখানে দাবি করা হয় উইঘুরদের উগ্র ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে যা আমাদের জনসংখ্যার জন্য হুমকি স্বরূপ।’ চীনা কমিউনিস্ট পার্টিও এরূপ প্রপাগান্ডা চালিয়ে তাদেরকে আলাদা করে রাখে।

“সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ” নামে যে বয়ান দশকব্যাপী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জারি রেখেছে তার পরিবর্তনে সবচে বড় বাধা রিপাবলিকানরা।দুই দশক ধরে চলে আসা মুসলিম বিরোধী বর্ণবাদের জেনোফোবিক স্রোতকে মোকাবেলায় যে নতুন বিল মার্কিন সিনেটে পাস হয়েছে, তার সবচেয়ে শক্তিশালী বিরোধী হলো এই রিপাবলিকানরা।

গত সাপ্তাহে মার্কিন সিনেটে ভোটের মাধ্যামে “কমবেটিং ইন্টারন্যাশনাল ইসলামোফোবিয়া অ্যাক্ট” শিরোনামে একটি বিল পাস হয়েছে। বিলটি মুসলিম বিরোধী বর্ণবাদ মোকাবেলায় কাজ করবে । বিলে বলা হয়েছে, একজন বিশেষ দূতের পরিচালায় একটি দপ্তর প্রতিষ্ঠা করা হবে। যার কাজ হবে ইসলামোফোবিয়ার তথ্য সংগ্রহ করে একটি বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ করা। মুসলমানদের বিরুদ্ধে সহিংসতা, হয়রানি ,বিশ্বব্যাপী তাদের মসজিদ, স্কুল এবং কবরস্থান ভাংচুর ইত্যাদি বিষয় নিয়ে এই প্রতিবেদন তৈরি হবে।

মুসলিম বিদ্বেষের ঘটনা প্রকাশের পাশাপাশি, প্রতিষ্ঠানটি সরকারি ও বেসরকারি মিডিয়াতে মুসলিম বিদ্বেষ ও সহিংসতা উস্কে দেওয়ায় তাদের ভূমিকা কি ছিল তাও প্রতিবেদনে উল্লেখ থাকবে। ভারতের তো প্রেমকে জড়িয়ে লাভ জিহাদ এমনকি করোনার বিস্তারকে করোনা জিহাদ আখ্যা দিয়ে মুসলিম জনগোষ্ঠীর ওপর আক্রমণ উস্কে দেওয়া হয়েছিল। মিয়ানমার, ভারত, চীন প্রভৃতি রাষ্ট্রে জাতিগত উচ্ছেদ ও গণনিধনের পরিপ্রেক্ষিত তৈরিতে ইসলামোফোবিয়া বারুদের কাজ করে। জোর পূর্বক শ্রম, পুনরায় শিক্ষা বা কনসেনট্রেশন নামে চীন জিনজিয়াং অঞ্চলে উইঘুরদের উপর নির্যাত নিয়েও কাজ করবে এই দপ্তর।

সিনেটের আইন প্রণেতাদের ভোটে বিলটি পাস হয়েছে। বিলটির পক্ষে ভোট পড়ে ২১৯টি। আর বিপক্ষে ভোট পড়ে ১১২টি। ভোটে প্রমাণ হয় ইসলাম এবং মুসলমানদের প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ঘৃণা কতটা গভীর। ইসলামোফোবিক মন্তব্য করার জন্য রিপাবলিকান লরেন বোয়েবার্টকে দায়িত্ব থেকে অপসারণের পদক্ষেপ নিলে, বিল পাস নাও হতে পারত। কলোরাডোর এই প্রতিনিধি কংগ্রেসে নির্বাচিত প্রথম মুসলিম নারী ইলহান ওমরকে একজন সন্ত্রাসী হিসাবে অখ্যা দিয়েছিল।

ফ্লোর বিতর্কেও রিপাবলিকানরা বিলটির তীব্র বিরোধিতা করেছিল। ভোটে হেরে, কেউ কেউ সোশ্যাল মিডিয়াতে হতাশা প্রকাশ করেছে। জর্জিয়ার রিপাবলিকান প্রতিনিধি মার্জোরি টেলর গ্রিনসহ কয়েকজন টুইটারে হতাশা প্রকাশ করে বলেছে, ওমরকে ‘জিহাদ স্কোয়াড’এর সদস্য হিসেবে উল্লেখ করেছেন।

বাইডেনের বৈদেশিক নীতির পুনঃনির্ধারণ বাস্তবায়ন হবে, যদি আন্তর্জাতিক ইসলামোফোবিয়া মোকাবেলায় স্থাপিত দপ্তরকে নিরপেক্ষভাবে কাজ করার অনুমতি দেওয়া হয়। দপ্তর নিরপেক্ষভাবে কাজ করছে কিনা তা বুঝা যাবে, চীনা কমিউনিস্ট পার্টি ও তার মিত্র দেশের বর্ণবাদ এবং মানবাধিকার লঙ্ঘন প্রকাশের ধরণ দেখে।

দপ্তরকে শুধু চীন,ইন্ডিয়া ও মিয়ানমারের রিপোর্ট প্রকাশ করলেই হবেনা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ মিত্রদেরও রিপোর্ট প্রকাশ করতে হবে। প্রমান থাকা সত্ত্বেও মার্কিন মিত্র জায়নবাদী ইসরায়ের ইসলামোফোবিক কাজকে ঢেকে রাখা হচ্ছে। মুসলিমদের সন্ত্রাসবাদী তকমা লাগিয়ে, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিভাজন তৈরি করা হয়েছে। যা থেকে ইসরায়েল ব্যাপক ফায়দা নিচ্ছে।

এই সাপ্তাহে ভোটের সময় মার্কিন মুসলিম অধিকার গোষ্ঠী (সিএআইআর) একটি ঘৃণা গোষ্ঠীর গোপন তথ্য উন্মোচন করে। যারা দীর্ঘদিন মুসলিম সংগঠন ও মসজিদে গুপ্তচরবৃত্তি করে তথ্য সংগ্রহ করত।

তারা (সিএআইআর) বলেন, গতবছর তারা জানতে পারে মুসলিম সংগঠনের ভিতর এমন একাধিক ব্যাক্তি রয়েছে, যারা স্টিভেন এমারসনের নেতৃত্বে মুসলিম বিদ্বেষী গোষ্ঠী  ইনভেস্টিগেটিভ প্রজেক্ট অন টেররিজম (আইপিটি) এর গুপ্তচর হিসাবে কাজ করছে। সাউদার্ন “পভার্টি ল সেন্টার” এমারসনকে মুসলিম বিরোধী একটিভিস্ট হিসেবে চিহ্নিত করেছে।

মার্কিন মুসলিম সংগঠন প্রমণ করেছে যে আইপিটির (ইসলামোফোবিক ইন্ডাস্ট্রি) সাথে ইসরায়ের সংযোগ রয়েছে। তারা প্রায় ১০০ টি ফাইল, ইমেল এবং নথি প্রকাশ করেছে। যা ইঙ্গিত করে এমারসন ইজরায়েলি সরকারের সহযোগিতায় এই ইন্ডাস্ট্রি নিয়ে কাজ করছেন।

ইসরায়েলের সাথে এমারসনের সরাসরি যোগাযোগ রয়েছে এমন একটি প্রমান মুসলিম সংগঠনটি প্রকাশ করেছে। ইসরায়েলি সরকার এমারসনকে আমেরিকান একটি কলেজ ছাত্রদের গ্রুপ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে এবং হামাসের সাথে তাদের কোনো সংযোগ আছে কিনা তা জানতে চান। সে এই ব্যাপারে দ্রুত জানাতে তার স্টাফকে ইমেইল করে। এ ইমেইল সে প্রাক্তন ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর তেল-আবিবে অফিস থেকে পাঠিয়েছি। আইপিটি (ইসলামোফোবিক ইন্ডাস্ট্রি) ইসরায়ের পক্ষে করা গবেষণায় হামাসকে সন্ত্রাসী সংগঠন বোকো হারামের সাথে সংযুক্ত করার চেষ্টা করেছে।

এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে সিএআইআর(মার্কিন মুসলিম সংগঠন) কয়েকটি প্রশ্ন তুলেছে:’মুসলিম বিরোধী দলটি মুসলিম সংগঠনগুলির উপর গুপ্তচরবৃত্তি থেকে সংগৃহীত সমস্ত তথ্য নিয়ে কি করছিল? এটা কি বিদেশী সরকারকে সরবরাহ করছিল এবং যদি তাই হয়, তাহলে বিদেশী সরকার সেই তথ্য নিয়ে কি করছিল?’

নিঃসন্দেহে প্রশ্নগুলি গুরুতর, বিশ্বব্যাপী ইসলামোফোবিয়ার বিস্তারের তদন্তের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক স্থাপিত দপ্তরকে অবশ্যই তদন্ত করতে হবে। তবে প্রশ্নটি থেকে যায়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কি তার মিত্রদের স্বার্তের থেকে মুসলিম নাগরিকদের অধিকার ও স্বাধীনতাকে অগ্রাধিকার দিবে? যে নাকি বিশ্বব্যাপী ইসলামোফোবিয়া শিল্পের বড় খেলোয়াড়ের সাথে সহযোগিতা করতে গিয়ে ধরা পড়েছেন?

Advertisements