শ্যাম সরণের বোকা নেহরুপ্রীতি
Advertisements

ভারতের শ্যাম সরণ [Shyam Saran], একজন কেরিয়ার ডিপ্লোম্যাট। গত ১৯৭০ সাল থেকে ভারতের ফরেন সার্ভিসে যোগ দিয়ে তিনি ২০০৪-০৬ সালে এই সময়কালে মন্ত্রণালয়ের সর্বোচ্চ পদ ফরেন সেক্রেটারি ছিলেন। পরে সে পদ থেকে ফরমাল অবসর নিলেও এরপর সাধারণ নাগরিক হিসেবে ভারত সরকারের বা সময়ে প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা ও নানান দায়িত্বে কাজ করে গেছেন। বহু ধরনের কাজে সরকারি প্রতিনিধিত্ব বা বেসরকারি ও বিদেশে অনেক কিছুর সাথে এখনো সক্রিয় তিনি। দেশী-বিদেশী থিংকট্যাংকের কাজের সাথেও তিনি জড়িত। একেবারে সক্রিয় এখন সেন্টার ফর পলিসি রিসার্চ [CPR] এই থিঙ্কট্যাঙ্কের সাথে। এছাড়া প্রায়ই তাঁর লেখা কলাম বিভিন্ন মিডিয়ায় দেখতে পাওয়া যায়। তিনি ভারতের ‘পদ্মভূষণ’ রাষ্ট্রীয় পদকপ্রাপ্ত।


সম্প্রতি তিনি ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জওয়াহের লাল নেহরু সম্পর্কে উঁচু মূল্যায়নমূলক এক কলাম লিখেছেন। ভারত সরকারের ফরেন সার্ভিস ক্যাডারে যারা যোগ দেন তাদের সবারই এক স্বপ্ন-খায়েশ থাকতে দেখা যায় যে, তিনি ফরেন সচিব হওয়ার পরেই অবসর নেবেন। যদিও টেকনিক্যাল ঝামেলায় সচিব পদটা খালি নেই এমন হয়ে দাড়াতে পারে কারো বেলায়; অবসরে যাওয়ার সময় এসে গেলে অনেকের ভাগ্যে তা হয় না। এমনকি আরেকটু এগিয়ে অনেকের জ্বলজ্বলে খায়েশ মনে পুষে রাখে যে, সার্ভিস লাইফে যদি ইতোমধ্যে ক্ষমতাসীন দলের সাথে লাইন-ঘাট, সম্পর্ক, পারফরম্যান্স দেখিয়ে মন পাওয়া ইত্যাদি ঘটে যায় তাহলে তো কথাই নেই। কারণ তাহলে তিনি চাকরি থেকে অবসরের পরে কপালও খুলে গেলে পররাষ্ট্রমন্ত্রীও হয়ে যেতে পারেন।

যেমন কংগ্রেসের সালমান খুরশিদ এমন এক কূটনীতিক ছিলেন যিনি এখন কংগ্রেস দলের সাবেক মন্ত্রী এবং এখন কংগ্রেস দলের এক রাজনৈতিক নেতা হিসাবেও পরিচিত। আর বিজেপির মোদির ক্ষেত্রেও তাঁর বর্তমান পররাষ্ট্রমন্ত্রী জয়শঙ্করও তেমনদের একজন। তখন মোদি কেবল প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন ২০১৪ সালে। কোন আমেরিকান সরকার-প্রশাসনকে ছুঁতে বা পৌঁছাতে গেলে সবচেয়ে ভাল উপায়টা কী? তারাই বা ভারতের বিভিন্ন বিষয়ে সম্পর্কে কী মনোভাব পোষণ করে থাকেন? বিষয়গুলো ব্যক্তিগত মত করে জানা জরুরি। মোদির সেসব প্রয়োজন মিটাবার মত করে ২০১৪ সালে মোদির ক্ষমতায় আসার পর থেকে এরই প্রধান হাতিয়ার হয়ে আছেন জয়শঙ্কর, ঘটনা চক্রে যিনি তখন আমেরিকায় ভারতের রাষ্ট্রদূত ছিলেন।  ঘটনাচক্রে  মোদির তাঁকেই পছন্দ হয়েছিল।  আবার মোদিও প্রধানমন্ত্রী হয়ে গেছেন ঠিকই কিন্তু নিশ্চিত নন যে, আমেরিকার কাছে কী চাইতে হয়, কী পাওয়া যায়; কিভাবে তা চাইতে হয় আবার কী চাওয়া ঠিক নয়, ইত্যাদি। আবার যেখানে মোদি আমেরিকার খাতায় ওসময়ের  কিছু দিন আগে পর্যন্ত গুজরাটে দাঙ্গা লাগিয়ে মুসলমান হত্যার দায়ে নিষিদ্ধ তালিকায় থাকলেও প্রধানমন্ত্রী হয়ে গেছেন। আবার আমেরিকারও মোদির সাথে বিশেষ সম্পর্ক করা দরকার। কাজেই জয়শঙ্কর হয়ে যান মোদি আর আমেরিকা এ’দু’পক্ষের মনোভাব আগাম বুঝাবার ব্যক্তি ও দু’জনা দু’জনের বিশেষ দুত।  তাই সেসময় জয়শঙ্কর অবসরে চলে যাওয়ার মাত্র কয়েক দিন আগে হঠাৎ মোদি সেসময়ের উপস্থিত ফরেন সচিব সুজাতা সিংকে  সরিয়ে দিয়ে জয়শঙ্করকেই সচিব পদে নিয়ে নেন। আর এরপরে ২০১৯ সালে মোদি দ্বিতীয়বার নির্বাচনে জিতে এলে ততদিনে জয়শঙ্করেরও  সচিব থেকেও অবসরে যাবার সময় তখন। কিন্তু আবার ভাগ্যের শিকা ছিড়েছিল।  তখন হঠাৎ মোদির আগের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ মারা যাওয়াতে মোদি এবার জয়শঙ্করকে  মন্ত্রীও করে নিয়েছিলেন।

কিন্তু সচিব হওয়ার এসব লালিত স্বপ্ন পূরণের ক্ষেত্রে একটা মূল ফ্যাক্টর থেকে যায় তা হল ‘বহনকারী’; মানে একটা রাজনৈতিক দল লাগে। কারণ তিনি তো আমলা ফলে একটা  রাজনৈতিক দলই কেবল তাকে রাজনৈতিক পদ দিতে পারে ও বসাতে পারে। শ্যাম সরণের ক্ষেত্রে এই দলটার নাম হল কংগ্রেস। অর্থাৎ ক্যারিয়ার কূটনীতিকদের পেশাজীবনের গুরুত্বপূর্ণ শেষের দিকে যত সামান্যই হোক পক্ষে একটা রাজনৈতিক দলের সমর্থন পেতেই হয়। সচিব বা বিশেষ করে মন্ত্রী পর্যায়ে পৌঁছাতে গেলে রাজনৈতিক দলের সাপোর্ট পাওয়া নির্ধারক ফ্যাক্টর হয়ে যায়।

এই বিচারে শ্যাম সরণকে দিনশেষে কেউ কংগ্রেসের লোক বলে ফেলবে অবশ্যই। তবে এর বাইরেও ভারতে আরেকটা রেওয়াজ আছে যা এখন হয়ে উঠেছে আরেকটা বিষয়ের প্রশ্ন। তা হল – জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা পদে নিয়োগ। এটাও প্রায় ফরেন মিনিস্টারের মতোই আরেক পদ। কারণ উপদেষ্টা ঠিক মন্ত্রী না হলেও মন্ত্রীর সম-মর্যাদার পদ। কোনো সাবেক ফরেন সচিব অবসর নেয়ার পরে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার নিযুক্তি পেয়েছেন এমন হতে পারে ও হয়েছে। তাই এটাকেও এসব সাবেক আমলারা জীবনের বিরাজ ক্রেডিট ও অর্জন গণ্য করে। তা করুক কিন্তু সমস্যা অন্যখানে। এই উপদেষ্টা পদে সাবেক গোয়েন্দা বিভাগের আমলারাও নিয়োগ পেতে পারেন এবং পেয়ে থাকেন। যেমন বর্তমান মোদির জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল সাবেক “ইন্টেলিজেন্স ব্যুরোর” (আইবি) সর্বোচ্চপদ ডিরেক্টর ছিলেন। কিন্তু সমস্যা হল – ফরেন সার্ভিস আর ইন্টেলিজেন্স বুরো এরা উভয় উভয়কে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা পদে বসার জন্য অনুপযুক্ত বা কম যোগ্য মনে করে রেষারেষির কারণে। তাই কনুই-গুঁতা মারামারি চলে নিরন্তর। যেমনটা এখন জয়শঙ্কর আর দোভালের মধ্যে চলে আর মোদিকে সবসময় তাদের মাঝখানে দাঁড়িয়ে তা সামাল দিতে হয়।

এখানে একটা বাড়তি তথ্য দিয়ে রাখি, আশাকরি অপ্রাসঙ্গিক মনে হবে না। জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জিনিষটা কী? আবার এটার সর্বোচ্চ উপরে কোন মন্ত্রী নয়, তবে এক উপদেষ্টা কেন? প্রশ্নদুটার জবাব একই। এটাই আসলে ‘র’ [RAW] এর আসল মন্ত্রণালয়-ঘটিত ডিপার্টমেন্ট এর নাম। অন্যভাবে বললে ‘র’ – এটা ভারতের বাইরে ভিন্নদেশে গিয়ে নাশকতার কাজ করে বেড়ানোর প্রতিষ্ঠান; এটাকে কোন মন্ত্রণালয়ের অধীনে রাখা হবে – এই প্রশ্নের সমাধান হিসাবে এটা জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার অধীনে; যেখানে আবার তিনি উপদেষ্টা, ঠিক মন্ত্রী নন। কেন?
কারণ ‘র’ এর পরিচালনার জন্য দরকার ছিল প্রধানমন্ত্রীর কাছে ডাইরেক্ট একসেস, রাত-বিরাতেও প্রধানমন্ত্রীর কাছে সরাসরি পৌছে যাওয়ার সুবিধা। বিদেশে কাউকে খুন করার সিদ্ধান্ত দেয়া ও এর দায় নেয়া কোন ছোট সিদ্ধান্ত নয়। অথচ অন্য সবের মত এই প্রতিষ্ঠানকেও আর পাঁচটা কোন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর অধীনে রাখলে ডাইরেক্ট একসেস বন্ধ হয়ে যাবে। আর ঐ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীরই আগে সবকিছু বিবেচনা করে দেখা একটা এক্তিয়ার ও তাতে সময়ব্যয় করতে দিতেই হবে। এরপরে দরকার হলে প্রধানমন্ত্রী। এই কালক্ষেপণ বন্ধ করতেই ‘র’ মূলত প্রধানমন্ত্রীর অফিসের অধীনেই একটা বিভাগ করে রাখা হয়েছে। আর ওর বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীকে নিয়মিত পরামর্শদান ও তথ্যে আপডেট রাখার কাজটা করেন ঐ জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা। বাইরে থেকে বুঝবার সুযোগ নাই যে এই জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা – উনার কাজকর্ম ‘র’ কে নিয়ে যারা, কাকে মারবে ধরবে, খুনোখুনি ধবংস বিনাশ কাকে করবে ইত্যাদি এসব নিয়ে। এবং ভারতের নিয়ম অনুযায়ী, এই পদে সাবেক ফরেন সচিব অথবা সাবেক ইন্টেলিজেন্স ব্যুরো চীফ এমন দুদিক থেকেই আসতে পারে। [এই ব্যাপারগুলো পাবলিকলি আরো জানার সুযোগ পাওয়া যেতে পারে ২০০৭ সালে ভারতে প্রকাশিত “কাও বয়েস” বা [The Kaoboys of R&AW] এই বই থেকে।] যেমন শিবশঙ্কর মেনন তিনি সাবেক ফরেন সচিব থেকে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হয়েছিলেন। আর এপর্যন্ত কেবল পাঁচজন মানে পাঁচবার নয়া জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা নিয়োগে বদল এসেছে। এ’হল, ভারতের আমলা থেকে মন্ত্রী-উপদেষ্টা হবার গল্প।

যেটা বলতে চাচ্ছি তা হল – ফরেন সার্ভিসের ব্যক্তিত্বরা সার্ভিসের শেষের দিকে পছন্দের দলের দিকে লীন হয়ে যেতে থাকেন আর অবসরের পরে তো ওই দলের লোকই হয়ে যান। সেই বিচারে শ্যাম সরণের ভাগ্যে জুটেছিল কংগ্রেস দল। সে কারণেই বা সেই থেকে কি নেহরু সম্পর্কে তার এত উচ্ছ্বাসের মূল্যায়ন? আমরা তা খেয়াল করে দেখব, বিচার করব।

নেহেরুকে নিয়ে শ্যাম সরণের লেখাঃ
গত ১৭ নভেম্বরে ভারতের দ্যা প্রিন্ট ওয়েব পত্রিকায় শ্যাম সরণের প্রায় ১২০০ অক্ষরের কলামের দ্বিতীয় প্যারাতেই তিনি এক সমালোচনামূলক মন্তব্য লিখে বলছেন, “নেহরুর নেতৃত্বে ভুলত্রুটি ছিল, যার কিছু আবার দীর্ঘস্থায়ী ও নেতিবাচক পরিণতি রেখে গেছে। তার কাশ্মির ইস্যু নাড়াচাড়ার মধ্যে ত্রুটি দেখি, ঠিক যেমন আমি তার ১৯৬২ সাল চীনের ভারতে অনুপ্রবেশকে ভুলপাঠ করার দোষ দেখি” [“There were flaws in his leadership, some of which left enduring and negative consequences. I would fault his handling of the Kashmir issue, just as I would his misreading of Chinese intentions in 1962.” ]।

সারা জীবন আমলা হিসাবে কাটানো কাউকে শেষে কোনো রাজনীতিক বা একাডেমিক ব্যক্তিত্ব বলে অনুমান করে নেয়াটা ভুল হবে। তা সত্ত্বেও নেহরুর মত ‘পরম’ নেতার ভুলত্রুটি আছে সেটা বলা – সেটা সম্ভবত এই প্রথম আমরা উচ্চারিত হতে দেখলাম। তা সু-রেওয়াজের ধারা হতে উঠতেও পারে হয়ত আগামিতে; যেটা ভারতে এখন নেই বা আমরা দেখি না। তবে শ্যাম সরণ সম্ভবত আদর্শ বা খাঁটি কোন চোখে নয়, প্র্যাকটিক্যাল চোখে দেখে বিচার করতে অনুরোধ রেখেছেন।

কিন্তু এরপরেও আবার শ্যাম সরণ ডিপ্লোম্যাটের মত এখানে এসে পাশ কাটিয়ে চলে গেছেন। এছাড়া আবার এই সুযোগে না বলার সুযোগ নিয়েছেন যে, কাশ্মির ইস্যু অথবা ১৯৬২ সালের চীনের আসাম দখল ইস্যুতে নেহরুর ত্রুটিটা ঠিক কী ও কোথায়? বরং এবার তিনি নেহরুকে প্রশংসায় ছেয়ে ফেলেছেন, আগের যে কারো চেয়ে এগিয়ে। আর তা করতে গিয়ে তিনি আর পাঁচটা ‘হিন্দু জাতিবাদীই’ হয়ে থাকার মধ্যে আটকে গেছেন। কোন ধরনের ব্যতিক্রম হতেও চেষ্টা করেননি। সবচেয়ে মজার কথা, তিনি নিজে “হিন্দু জাতিবাদী” অবস্থান নিচ্ছেন আর ‘জাতিবাদের’ পক্ষে কথা বলছেন সেদিকে খেয়াল নাই অথচ একই সাথে অভিযোগ করছেন সাতচল্লিশ সালে “ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগ” হয়েছে [The country had been partitioned on the basis of religion…… ]। নেহেরু-গান্ধি যদি এক ‘হিন্দু জাতিবাদের ভারত’ বানাতে লেগে পড়েন এই এক্টটাই তো দেশভাগের পক্ষে তাদের শুরু করা প্রথম কাজ! তাই নয় কী? এর মানে হল – নিজের অবস্থান যে, একটা ‘হিন্দু জাতিবাদের’ সেটা খেয়াল করার পরিপক্কতা তার এখনও হয়নি অথচ ‘ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগ’ কেন হল তা নিয়ে কান্নাকাটি জুড়ে দিয়েছেন। আসলে ব্যাপারটা হল – নেহরু-গান্ধী যদি ভারতকে একটা হিন্দু জাতিবাদী ভারত হিসাবেই গড়তে শুরু করে দেন (যা তারা বাস্তবে করেও ছিলেন) তাহলে এর সোজা মানে হল – তারাই তো তাহলে মুসলমানদেরও একটা মুসলমান জাতিবাদী পাকিস্তান গড়ে নিতে ঠেলে দিয়েছেন – তাই নয় কি? এটা বুঝতে কারো কষ্ট হলে বুঝতে হবে, সেটা হচ্ছে তাঁর হিন্দুত্বের প্রতি গভীর ভালোবাসার আর মুসলমান বা ইসলামের প্রতি ঘৃণা ও ফোবিয়ার কারণে। এসবই পুরা এর পেছনের কারণ।

এরপর তিনি ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশেরা চলে যাওয়ার সময় ছোট-বড় মিলিয়ে ৫৫০ করদ রাজ্যের কথা তুলেছেন। মানে যাদেরকে হবু ভারতে কেমনে জোর করে ঢুকিয়ে নিতে সেকাজে নেহরুর প্রশংসা করে নিতে চান এই সুযোগে। সরি এটা কোন প্রশংসনীয় কাজ ছিল না যে তাদেরকে নেহরু সামরিক শক্তি দেখিয়ে নেহরুর ভারতে যুক্ত হতে বাধ্য করেছিলেন। অথচ তিনি এটাকে নেহরুর সাফল্য হিসেবে দেখছেন। অথচ এটাই ছিল ব্যর্থতা; কারণ, তিনি গায়ের জোরে কাজটা করেছেন; যা না করেও হয়ত এটা করা যেত।

যেমন কোন স্বাধীন মানুষকে যদি চয়েজ দেয়া হয় যে, তিনি এক রাজার শাসনাধীনে থাকতে চাইবেন নাকি পাবলিকের প্রতিনিধিত্বের শাসনের অধীনে যেটা রিপাবলিক না জনগণের শাসনাধীন রাষ্ট্র, এমন চান? করদ রাজ্যের সমাধান আসলে ছিল এ দুই চয়েজের প্রশ্ন। কাজেই নেহরুকে ওই সব করদ রাজ্যের বাসিন্দাদের কাছে প্রশ্ন রাখতে হত যে, তারা কী চায়। কিন্তু নেহরু তা করেননি। তিনি গিয়েছেন করদ রাজ্যের রাজার কাছে। আসলে নেহরু বাসিন্দা নাগরিকদের কাছে নয়, তিনি গেছেন রাজার হুকুমের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নিতে। আর এটাকেই তিনি সহজে কাম সারা ভেবেছিলেন। এটাই তার সবচেয়ে বড় ভুল ছিল। এর মানে, তিনি তো রিপাবলিক ধারণাই বুঝেননি। তাই এর শক্তিও বুঝেননি। স্বাধীন মানুষ নিজের স্বাধীন চয়েজ প্রকাশের সুযোগ পেলে জনগণের শাসনাধীন রাষ্ট্র-এর পক্ষে থাকবে। কিন্তু নেহেরুর ভিতরে এসব বোধ কাজ করে নাই। কেবল এক হিন্দু জাতিবাদ বুঝের অন্ধকারে তিনি সব হারিয়ে ফেলিয়েছেন।

আর সবচেয়ে বড় কথা, কাশ্মির সমস্যার মূল কথা বা মূল সমস্যাটাই তো এটাই। কারণ, প্রথমত কাশ্মিরও একটা বড় করদ রাজ্য অথচ এর সমাধানে তিনি কিছুই করতে পারেননি। করতে গেছেন হিন্দু রাজাকে পক্ষে টেনে সহজ সমাধান, যেহেতু বাসিন্দারা বড় সংখ্যায় মুসলমান তাই। একারণে, বাসিন্দাদের মতামতের কাছে যাননি। তাই এতে উল্টা তা এমন জটিল করেছেন যে, আজো ভারত-পাকিস্তান সব সঙ্ঘাতের প্রধান ইস্যু এটাই। অর্থাৎ শ্যাম সরণের করদ রাজ্য ইস্যুর সমাধান নিয়ে নেহরু প্রশংসা করতে গেছেন যা হয়ে দাঁড়িয়েছে একটা ‘খামোখা’ আর স্রেফ চাটুকারিতা! এই বয়সে (৭৫) এটা তাকে মানায় নাই বলাই বাহুল্য।

শ্যাম সরণের জন্ম ১৯৪৬ সালে। পরের ২৪ বছরের মধ্যে তিনি গ্র্যাজুয়েশন শেষ করে ১৯৭০ সালে ফরেন সার্ভিসে যোগ দিয়ে ফেলেছেন। মানে, মোটামুটি ১৯৬৬ সাল থেকেই ধরা যায় তিনি যথেষ্ট ‘ডাগর’ হয়ে গিয়েছিলেন। লক্ষণীয় ওটাই ছিল সেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরের নির্ধারক ও গুরুত্বপূর্ণ সময়কালের দুনিয়া। অথচ আর পাঁচজন সেকালের গ্র্যাজুয়েট বা রাজনীতিকের মত তিনিও খবর রাখেননি যে, দুনিয়ার জন্য “দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের” মুখ্য অর্থ ও তাৎপর্যটা কী? আর ১৯৪৫ সাল মানে, বিশ্বযুদ্ধ শেষের আগের আর পরের দুনিয়ার মধ্যে প্রধান ফারাকটা কী ও কেন?

কিন্তু সে কথা আমরা কী দেখে বুঝলাম? কারণ, তিনি লিখছেন, “যুদ্ধ পরবর্তী দুনিয়া প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল শান্তি স্থাপনের কিন্তু তা না হয়ে দুনিয়া দুই ইডিওলজির দুই সামরিক ব্লকে ভাগ হয়ে গিয়েছিল [The post-war world was already moving from the promise of enduring peace to a prolonged confrontation between two powerful ideological and military blocs, with the constant threat of a nuclear holocaust.]। তিনি আসলে সোভিয়েত ও আমেরিকা এভাবে দুই ব্লকে ভাগের কথা বলছেন। কিন্তু তিনি কি জানেন বা কখনো খোঁজ নিয়ে দেখেছেন ব্লকে ভাগাভাগি এসেছিল একমাত্র ১৯৫৩ সালের পরের ঘটনা হিসেবে। এমনকি তাও ইমিডিয়েট পরে নয়। মার্কিন প্রেসিডেন্ট আইসেনহওয়ার শপথ নিয়েছিলেন ২০ জানুয়ারি ১৯৫৩। আর এরপর প্রেসিডেন্ট তাঁর নীতি বিশেষ করে সামরিকনীতি যেখানে আসলে প্রথম পারমাণবিক অস্ত্রের বিষয়াদি এসেছিল; আর তা বাইরে প্রকাশ্যে আসতে আসতে দুই বছর লেগেছিল। য়ার সবচেয়ে বড় কথা এগুলো তো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের তাৎপর্য নয় বরং যুদ্ধ শেষের দশবছর পরের ঘটনা। যা প্রেসিডেন্ট আইসেনহওয়ার (১৯৫৩-৬১)-এর দুনিয়াকে একেবারেই উলটা এক নতুন গতিপথ যার সাথে বিশ্বযুদ্ধের নেতা রুজভেল্টের (১৯৩৩-৪৫) কাজ ও তৎপরতার কোনোই সম্পর্ক নেই বরং উলটা ততপরতা এগুলা। যার মানে শ্যাম সরণও নেহরুর মতই রুজভেল্ট বা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকেই স্টাডি অথবা ন্যূনপক্ষে আমেরিকান ইতিহাস পাঠ ইত্যাদি ঘটনার দিকে যানই-নি। কাজেই তিনি নেহরুর মূল্যায়নকারী হবেন কিভাবে? আর ১৯৪৫ সালের আগের আর পরের দুনিয়ার মধ্যে ফারাকটা কী ও কেন তা কিভাবে বুঝবেন?

অতএব তিনিও যে মুখস্থ কথার এক গতানুগতিক চাপাবাজ তাও প্রমাণ করছেন এখানে। আবার যেমন লেখার শেষের দিকে তিনি “সেকুলারিজমে” নিষ্ঠাবান এক মহাভক্ত হিসেবে নিজেকে হাজির করেছেন।

ভারত সম্পর্কে লিখছেন, “একটা বহু ধর্মীয়, বহু কালচারের রাষ্ট্র ভারত সেকুলার রাষ্ট্র না হলে আর কী হতে পারে [A multi-cultural and multi-religious country could not be anything but a secular State ……]? অথচ ঘটনা হল, শ্যাম সরণ সেকুলার শব্দটা জানছেন, শিখেছেন কবে থেকে? তিনি কি জানেন ১৯৭৬ সালের আগে সেকুলার শব্দটা ভারতের কনস্টিটিউশনে কখনো ছিল না! আসলে ১৯৭৬ সালেই প্রথম সেকুলারিজম ভারতের কনস্টিটিউশনের আরেকটা নীতি হিসেবে নয়া সংশোধনী জারি করে তা ঢুকানো হয়েছে এবং তা খামোখাই এবং নিজেদের হিন্দুজাতি চিন্তা লুকাবার জন্য। আর তাতে তাই কেবল একটাই লাভ হয়েছিল যে, এটা দিয়ে নিজেদের হিন্দুত্ব প্রীতি ও হিন্দু-জাতিবাদ প্রীতিকে লুকিয়ে এর উপরে সেকুলার জামা টাঙানো গিয়েছিল তখন থেকেই। এই আর কী! আর সেকুলারিজমকে যারা নীতি হিসেবে দেখতে ও বুঝতে চায় তারা অবশ্যই ভণ্ড ও মুসলমানবিদ্বেষী। আমার রাষ্ট্রনীতি সেকুলারিজম এমন কথা লিখে কনুষ্ষ্টিউশনে সেটে দিয়ে বাস্তবায়ন করার বিষয়ই নয়। এমনকি কোথাও না লিখে রেখেও সৎভাবে তা বাস্তবায়ন সম্ভব। তাই আমরা নিশ্চিত থাকতে পারি, এরা এসবের কোনো পাঠ-পড়াশোনা ও ফ্যাক্টস যাচাইসহ কোনো হোমওয়ার্কই করেননি।

করণীয় সেকুলারিজম নয়; মূল করণীয় মানুষ জাতি নয় নাগরিক এই বোধে এবার নাগরিক অধিকারে সাম্য মানে বৈষম্যহীন করা – এর বাস্তবায়ন – এটাই সব কাজের কাজ। অথচ তারা কোন একটা জাতির কথা মানে “ধর্মীয় জাতির” কথা আনবেই আর এরপর জাতি-রাষ্ট্রের গড়ার দিকে হাটা দিবে। অথচ সকলেই জানে এই জাতি-রাষ্ট্র বা নেশন-স্টেট মাত্রই তা নাগরিকের মধ্যে বৈষম্য করবেই। ফলে সে আবার কিসের সেকুলার নীতি করবে? আর নেশন স্টেট মাত্রয়ই সেখানে আর না নাগরিক ধারণা না নাগরিক অধিকার ধারণা কোনটাই থাকে না। সব আবছা করে ফেলা যায় সহজেই জাতি আর দেশপ্রেমের জোশে।
কথা আরও আছে। নেশন-স্টেট যারা আদি চর্চাকারী (১৬৫০-১৯৫০) তারা সবাই ইউরোপের কলোনি দখলদার রাষ্ট্র ছিল। সারা দুনিয়ায় কলোনি দখল করে বেড়ানো তাদের প্রধান ব্যবসা, প্রধান পেশা এবং প্রধান রাষ্ট্রনীতি ছিল, এই টানা ৫০০ বছর ধরে। ফলে তারা নাগরিক অধিকার বা মূল নাগরিক ধারণা কী বুঝবেবা বুঝেছিল? ফলে নাগরিক সাম্য বা বৈষম্যহীনতার কী আর বাস্তবায়ন করবে? অথচ আমরা তা পড়িনি, খোঁজ খেয়াল রাখিনি।

এজন্যই এসবের বিপরীতে মূল প্রশ্নটা আসলে ‘নাগরিক সাম্য’ কায়েম। মানে, সবার সমান নাগরিক অধিকার থাকতেই হবে। সেকুলার বলে দুনিয়াতে কিছু থাকলে এর একটাই ইতিবাচক অর্থ, সমান নাগরিক অধিকার নিশ্চিত করা। অথচ এটা কোনো জাতিরাষ্ট্র মানে নেশন-স্টেটে অর্জন একেবারেই সম্ভব নয়। যেমন বাঙালি জাতিবাদ পাহাড়িদের সমান নাগরিক গণ্য করবে না। করেনি। এমনকি পাহাড়িদের জুম্ম-জাতিবাদ সেটাও তাদের বাইরের কাউকে তার সমান গণ্য করবে না। হিন্দু নেশন-স্টেট মুসলমানকে সমান নাগরিক অধিকারের গণ্য করবে না, প্র্যাকটিস করবে না। একই অবস্থা হবে মুসলমান নেশন-স্টেটে হিন্দু নাগরিকের।
এসবই একেবারে গোড়ার মূল সমস্যা; এগুলোই চিন্তার গভীর ত্রুটি । হিন্দুত্ববাদ আড়াল করা যার লক্ষ্য সেই শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর বুদ্ধি দিয়ে এসব কোনো সমাধান নয় বা কিছুই আড়াল কেমন করে করবে! বরং মুসলমানবিদ্বেষের উৎস লুকানো হয়ে আছে এটাই!

শ্যাম সরণ বলছেন, একালের ভারত নাকি “ভারত রাষ্ট্রের সেকুলার থেকে দূরে চলে যাওয়ার কুৎসিত পরিণতি” [We see the ugly consequences of the State departing from the secular norm.]। মানে হল, তবু এসব লোকগুলো পড়াশুনা না করে, বাস্তবে কি হচ্ছে তা না দেখে কথা বলবে। খুব ভালো কথা। তাহলে গান্ধী-নেহরুর কংগ্রেস ও তার একালের প্রতিনিধি ও নেতা রাহুল গান্ধীর কংগ্রেস ‘সফট হিন্দুত্ব’ চাচ্ছে কেন আর মোদির সাথে হিন্দুত্বের প্রতিযোগিতায় নেমে পড়েছে কেন? তাহলে আসলে সারা ভারতজুড়ে প্রধান রাজনৈতিক ধারা এখন খোলাখুলি হিন্দুত্ববাদ। হিন্দুত্ব মানে এই হিন্দু-জাতিবাদ এটাই কি নেহরু-গান্ধীর ভারত নয়? এর আরও সবচেয়ে ভাল প্রমাণ হল – মোদি বা বিজেপি কি ঘোষণা দিয়ে খোলাখুলি হিন্দুত্ববাদ চর্চা করতে গিয়ে কোন সমস্যা হচ্ছে? কোনো সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ বা কোনো নির্বাচন কমিশনের আইনে বাধাপ্রাপ্ত হয়েছে, হচ্ছে? কোথাও হয়নি। কারণ এটাই তো নেহরু-গান্ধীর ভারত ও ভারতের কনস্টিটিউশন, তাই নয় কি? মোদি তো তাদের কনস্টিটিউশন বা ভারতকে কোনো বদল করে নেননি! কাজেই আর কী প্রমাণ লাগবে? ফলে, এনিয়ে একে তাকে দায়ী বা অভিযোগ করার সুযোগ কই?

তাহলে এভাবে নিজের সাথে প্রতারণার দরকার কী? শ্যামসরণ এভাবেই মোদির আগের কংগ্রেসের প্রতারণাপূর্ণ হিন্দু-জাতিবাদ করে যেতে চান, এটাই ফারাক দেখাতে চান, তাই কী? এতে কী ফারাক হবে? অথচ পরে অপর অংশ মানে মোদিকে তিনি বলছেন, ওরা ধর্মান্ধ বা বাইগট-ধারা [small-minded, vulgar and bigoted version]। অর্থাৎ নিজেকে আড়াল করার নখরা এরা তবু করবেই! অথচ মোদি-আরএসএস এরা বরং তুলনায় ‘ভালো’; কারণ তারা খোলাখুলি হিন্দুত্ববাদী। তারা কংগ্রেস, নেহরু বা শ্যাম সরণের মত নিজের হিন্দুত্ববাদ লুকায় না, অর্থহীন সেকুলার জামা গায়ে দেয় না! শ্যাম সরণের চোখ এই নেহরুই তাঁর সময়ের চেয়ে এগিয়ে থাকা ব্যক্তিত্ব!! এটাকে এক বোকা চাটুকারিতা ছাড়া আর কী বলা যায়?

লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
goutamdas1958@hotmail.com

Advertisements