প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ।
Advertisements

আমেরিকান প্রেসিডেন্টদের ক্ষমতার আয়ু রাখা হয়েছে (আমাদের মত পাঁচ বছর না) চার বছরের। তাই বাইডেনের আয়ুকাল (২০২১-২৪), মানে ২০ জানুয়ারি ২০২১ থেকে ২০ জানুয়ারি ২০২৫। যে কোন আমেরিকান প্রেসিডেন্টের প্রশাসনের বাংলাদেশের উপর প্রভাব এর বিচারে বাইডেন প্রশাসন এক ব্যতিক্রম হবেন। ইতিহাসে বাইডেনই সম্ভবত বাংলাদেশে সবচেয়ে বড় আর দীর্ঘ প্রভাব ফেলা প্রেসিডেন্ট হবেন। ফেলে ছড়িয়ে একটা ঢিলেঢালা হিসাব করলেও বাংলাদেশের উপর বাইডেনের প্রভাবের ব্যাপারটা ইতোমধ্যেই প্রায় দুবছরের। আর সেই সময়কাল বলা যায় গত ২০২১ সালের ১০ ডিসেম্বর থেকে ২০২৩ সালের বছর শেষ – এভাবে মোটামুটি এই দুবছরের কথা বলছি। আর বাংলাদেশের রাজনীতিতে বাইডেনের সম্ভবত চরমতম প্রভাবিত করার আয়ুকাল ছিল এই দুই বছর। যদিও এদুই বছর চরমতম প্রভাব বিস্তারের ফলাফল কী হয়েছিল বলে আগামিদিনের ইতিহাসে কী লেখা হবে?

বাংলাদেশের আগামিদিনের ইতিহাসে বাইডেনের আমেরিকাকে নিয়ে কী লেখা হবেঃ
প্রথমত লেখা হবে, বাংলাদেশের রাজনীতি ও রাজনৈতিক দলের মধ্যে ব্যাপক ওলটপালট ঘটিয়ে দিবার কান্ডটা করেছেন এই বাইডেন প্রশাসন। কিন্তু তাতে বাংলাদেশের কপালে যাই হোক প্রেসিডেন্ট বাইডেন নিজের দেশের জন্য বাংলাদেশ থেকে কিছু গালাগালি আর হতাশা ছড়ানোর দায় ভিন্ন খুব কিছুই ফেরত নিতে পারেন নাই। তিনি এদুই বছর বিরাট খাটাখাটনি করেছেন, কিন্তু সবই ব্যর্থ আর পন্ডশ্রম! মানে প্রচুর দামি এই শ্রম তা হলেও এটা কারোরই ভোগে লাগে নাই! বেকার গেছে। এজন্য দায়ী বাইডেন প্রশাসনের কিছু হামবড়া কর্তা যেমন আজরা জেয়া বা ডোনাল্ড ল্যু ইত্যাদি।

আমেরিকা গ্লোবাল নেতা হিসাবে সেই ১৯৪৫ সাল থেকে ছড়ি ঘুরিয়ে বেড়াচ্ছে, আমাদের মত দেশে অপছন্দের সরকার হলে তাকে ফেলে দেয়া এই ছিল আমেরিকার স্টাইল। এরপর নয়া সরকারকে দিয়ে আমেরিকা যা চায় তাই আদায় করে নিত। কিন্তু লক্ষ্য করা গেছে এই হামবড়া কর্তারা তাতেও এবার পরিবর্তন আনতে গেছেন। এরা যে স্টাইল ফলো করতে গেছেন তা হল ঠিক সরকার ফেলানো না বরং সরকার রেখেই অর উপর চাপ দিয়ে আমেরিকার পছন্দমত কাজ বা সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করা। অনেকটা এই কর্তারা যেন বলতে চান যে সরকার বদলে আমরা কি করব ওর চেয়ে বরং একে আমার স্বার্থের পক্ষে চুক্তি করা বা অবস্থান নিতে বাধ্য করলেই তো বেশী লাভ! আর এতে ফলাফল হয়েছে এমন যে না আমেরিকানেরা কিছু পেয়েছে না বাংলাদেশের বিরোধীদলের ভাগ্যে কিছু জুটেছে! অথচ বাইডেন প্রশাসন এই নয়া এক্সপেরিমেন্ট করতেই সবটা সময় ব্যয় করে ফেলেছে – যার আলটিমেট ফলাফল শুন্য থেকেছে!

ওদিকে বরং ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে, বাংলাদেশের। এখনকার অবস্থা হয়েছে সব রাজনৈতিক দলের (মানে সরকার ও বিরোধী সব দলের) কথা বলছি – সকলেই প্রচন্ড ভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে; একেবারেই দিশাহীন ওল্টপাল্ট অবস্থা হয়েছে সবার।
শব্দটা সবার বলেছি, মানে হাসিনা সরকারেরও। যদিও কেউ কেউ বা হাসিনা নিজেও এটাকে মনে করতে পারেন কথিত নির্বাচন তিনি সম্পন্ন করেছেন ও নিজেকে আবার বিজয়ী ঘোষণা করতে পেরেছেন; সুতরাং এটাই বাইডেনের উপর দিয়ে তার ক্রেডিট! বিশাল বিজয় হয়েছে। কিন্তু – তাই কী?

না, তা একেবারেই নয়। কেন? ৭ জানুয়ারি নির্বাচন শেষ হয়েছে এখন থেকে কম করে হলেও সাতদিন আগে। কিন্তু খেয়াল করেন পুরা আওয়ামী লীগের কথাও না ধরে যদি ৩০০ এমপির (২২৩ জন খোদ লীগের নিজের আর বাকিরা ব-কলমে তো লীগেরই নয়ত লীগের অনুগ্রহপ্রাপ্ত) কথাই ধরে কথা বলি এই এমপিরা কেউ জানে না যে এখন কী? কী বলতে হবে? মানে তারা কী অর্জন করেছে বলে এখন বলতে হবে তারা কেউ জানে না! মুল কারণ, এনিয়ে হাসিনার কোন নির্দেশ আসে নাই।

যদিও এটা ঠিক এবারের কথিত নির্বাচিতেরা সকলেই এই নির্বাচনের পরে কঠোরভাবে হাসিনার হাতের মুঠোতে সংহত বা কেন্দ্রীভুত! কিন্তু সবাই কাঠের পুতুল হয়ে আছে! কে কে জিতবে সেটা নির্ধারণ থেকে শুরু করে পরে কাকে কাকে ও কেমন মন্ত্রী করে নেয়া হবে বা কে কে বাদ পড়বে বা কেন ইত্যাদি সবই এককভাবে হাসিনার মুঠোয়! তাঁর বাইরের কেউই জানেন না ঠিক কোন লজিক বা বিবেচনায় কে বাদ পড়ছেন বা উপরে উঠছেন! অথচ সকলেই তটস্ত যে না জানি কি করার কারণে এমপি হতে বা পরে মন্ত্রী হতে বাদ পড়ে যাবেন বা গৃহিত হবেন! এমনকি নৌকা মার্কা পেলেও বাদ পড়তে পারেন!পরে এখন তিনি যাবেন কোনদিকে কোথায় সেটাও কেবল হাসিনাই জানেন! আমাদের এই বক্তব্যগুলোর ভিত্তি গত সপ্তাহ-দশদিন ধরে বাংলাদেশের টিভিতে প্রকাশিত রাজনৈতিক ঘটনাবলীর ছবি ও বর্ণনা নিয়ে রিপোর্ট সেগুলো! নির্বাচনের পরে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকা যেকোন মন্ত্রী – ধরেন জুনাইদ আহ্‌মেদ পলক; টিভিতে তার চোখের ভাষা দেখে মনে হয় সেখানে যেন লেখা আছে যে তিনি কিভাবে জিতলেন, কেন জিতলেন এমনকি প্রতিমন্ত্রী পদটাও টিকে গেল কেমনে – তিনি জানেন না। সেজন্য কেবল শুকরিয়া আদায় – এটাই কেবল তার নিজের করা বাকি সবই তাঁর!! অথচ এলাকা হিসাবে পলকের পড়শি সদ্য প্রাক্তন প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার তার কেন এমন হল তা কেউ জানে না! কেবল এটা সেটা কিছু অনিশ্চিত অনুমান করতে পারেন মাত্র!

তাতপর্যপুর্ণ ১১ জানুয়ারিঃ
কেন তাতপর্যপুর্ণ বলছি? নির্বাচনের তারিখ ছিল ৭ জানুয়ারি। এর ফলাফল কি ঘোষণা দিবে তা আন্দাজ থাকলেও এই তিনশ আসনের ফল সাজিয়ে গুছিয়ে প্রকাশ করতে ৮ জানুয়ারি দুপুর গড়িয়ে যায়। আর এরপরের ৯-১১ জানুয়ারি এই তিনদিনে সরকার যেসব মেজর কাজ দ্রুততার সাথে হাসিনার লোকেরা শেষ করেছেন তা হল বিজয়ী তালিকা গেজেট করা মানে, নয়া সংসদ সদস্যদের তালিকা আনুষ্ঠানিক করে বানানো এরপর তাদের আনুষ্ঠানিক শপথ গ্রহণ সম্পন্ন করা আর এরচেয়েও আরেক কঠিন কাজ মন্ত্রী বাছাই করা। মানে নেয়া বা বাদ দেয়া। বলা হয়েছে “সর্বশেষ গত (১১তম সংসদে) মন্ত্রিসভার সদস্য সংখ্যা ছিল ৪৮ জন। সেখানে প্রধানমন্ত্রী ছাড়াও ছিলেন ২৫ জন মন্ত্রী, ১৯ জন প্রতিমন্ত্রী এবং ৩ জন উপমন্ত্রী। এদের মধ্যে ৩০ জনকেই বাদ দেয়া হয়েছে ” । মানে এক বিশাল ঢেলে সাজানো আর তাতে পুরান মন্ত্রীদের দুই-তৃতীয়াংশ বাদের খাতায় চলে গেছেন। আর এমন বাদ দিবার পরে শেষে নতুন মন্ত্রীসভা হয়েছে ৩৭ জনের। আর তাদের মন্ত্রণালয় নয়া বন্টনো সম্পন্ন করা হয়েছে। আর এটা বাংলাদেশের ইতিহাসে বোধহয় সবচেয়ে কম সময়ে ঘটা এমন ঘটনা। মাত্র তিনদিনে এটা সম্পন্ন।
তাই বলা যায় ১১ জানুয়ারি সন্ধ্যারাতের মধ্যেই সব কাজ শেষ; এটা তাতপর্যপুর্ণ। কিন্তু তর্ক এখান থেকেই! যে এত তাড়াতাড়ির পিছনের কারণ কি?

একদিকে সরকারবিরোধীরা এর সমালোচনা করে কর্মীদের মনোবল বাড়াতে চেয়েছে। প্রশ্ন তুলেছে বা নিজ মনোমত ব্যাখ্যা খাড়া করেছে যে সরকার ভীত সেকারণেই এই তাড়াহুড়ো করে নয়া মন্ত্রীসভা গঠন শেষ করেছে। রাজনীতিতে ঠেস মেরে বা খোটা দিয়ে সরকার আর বিরোধীদের মধ্যে বাকযুদ্ধ চলা খুবই কমন জিনিষ, যা আমাদের মত প্রায় সবদেশেই চলে। কিন্তু বাংলাদেশের বিরোধীদলের অযোগ্যতাটা অন্য খানে!

হাসিনা এর পালটা জবাব দিয়েছেন যার সারকথা হল, আমাদের মুরোদ আছে তাই করেছি। বলেছেন, “আরে তাড়াতাড়ি, আমাদের তো সব তৈরি আছে। করব না কেন? আমরা সিদ্ধান্ত নিতে পিছপা হই না। জানি নির্বাচন হবে। নির্বাচনে জিতলে কী করব, হারলে কী করব—এগুলো সব আগে থেকেই তৈরি করা থাকবেই। তাই আমাদের সময় লাগবে কেন? সময় নষ্ট করব কেন? আমাদের একটা দিনেরও মূল্য আছে। উন্নয়নের ধারাটা অব্যাহত রাখতে হবে।’” – এইসব কথা।

আসলে বিরোধীদের লক্ষ্য ছিল কথিত নির্বাচনে হাসিনা দলকে বিজয়ী বলে পেশ করাতে নিজ কর্মি-সমর্থকদের ভাঙ্গা মনোবল চাঙ্গা করা। ভাঙ্গা কারণ তারা নির্বাচন ঠেকায় দিতে বা হাসিনারে বাধ্য করতে ব্যর্থ হয়েছে। এই অর্থে বিরোধীদের পরাজয় হয়েছে এটা তো দিনের আলোর মত পরিস্কার, তা অস্বীকারের জো নাই। তবু তারা চেষ্টা করেছে এটা বুঝাতে যে এখনও যেন হাসিনা সরকারকে চাপ দিয়ে আমেরিকা অনেক কিছুই বাধ্য করতে পারে! আর এর প্রমাণ হল, হাসিনা সরকার গঠনে তাড়াহুড়ো করছে। কিন্তু আসলে কি এটা সত্যি? কতটা সত্যি?

নয়া সরকার গঠনে হাসিনা তাড়াহুড়ো করেছে সত্য। কিন্তু কেন, এটাই প্রশ্নঃ
কথা সত্য দেখলাম আমরা হাসিনা তিনদিনের মধ্যে সরকার গঠনের সব করেছে এমনকি দুদিন সাপ্তাহিক ছুটি শেষে ১৫ তারিখ সকালেই প্রথম মন্ত্রীসভার বৈঠক করে ফেলেছেন। কিন্তু এত তাড়া কেন?

কানখাড়া করে আমাদের শুনা ও বুঝা উচিত এটা কোনই আমেরিকান চাপ নয়। বরং বাস্তবত আমেরিকা এধরণের সব চাপ দেয়ার সক্ষমতা হারিয়েছে বা নিজেই নাই করে ফেলেছে। এটা হল কঠিন সত্যিটা। কিন্তু বিরোধীরা এটা নিজেরা বিশ্বাস করতে বা মানতে পারছে না। বা চাচ্ছে না – ব্যাপক হতাশা আসবে বলে। কেন? মানে কেন এমন হল?

আসলে এটা মুখে মাটি ঢুকে যাওয়ার মত অবস্থা! মাটি আমাদের খাদ্য না। তাই মুখে কোন কারণে মাটি পড়লে থু থু করে ফেলা আর বারবার মুখ ধুয়ে পরিশুদ্ধ, মন কে পরিশুদ্ধ করার চেষ্টা করা ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না। বিরোধীদের সেই মাটি খাওয়া দশাটাই হল, তাদের আত্মত্যাগ, শতকষ্টের শেষ দুবছরের আন্দোলনে প্রায় শতভাগ তারা আমেরিকা-নির্ভর করে সাজানো কৌশলের মধ্যে থেকে আগাতে চেয়েছে। এই একপেশে পশ্চিমা অতিনির্ভরতাই তাদের খেয়ে ফেলেছে, সব শ্রম-ঘাম পানি করে দিয়েছে। তাই তারা এখন বিশ্বাস করতে চায় নাই আমেরিকা ফেল করতে পারে অথবা বাইডেনের আমেরিকারই চরম অযোগ্যতাও আছে।

আর সবার আগে, বাংলাদেশের বিরোধীরা এদিকটা যেন বুঝতেই চায় নাই যে বাইডেনের আমেরিকারই কিছু গভীর নিজস্ব স্বার্থ আছে সেটাই বাইডেনের প্রায়োরিটি বা প্রথম বিবেচনাই শুধু নয়; সরাসরি বললে সেই স্বার্থই বাইডেনের কাছে তার সব ততপরতার একমাত্র নির্ধারক উপাদান। মানে বাইডেনের পররাষ্ট্রনীতিতে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের কথা ও নির্ভরতার কথা আছে মানেই এটা নয় যে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার বাইডেনের কাজকর্মের চালিকাশক্তি বা ড্রাইভিং ফোর্স। অথচ আমাদের বিরোধীরা সেটাই বিশ্বাস করেছে!

অথচ আমরা কি ভুলতে পারি হাসিনার এই দানব ক্ষমতাটা আমেরিকারই তৈরি। জঙ্গীবাদ দমনের নামে হাসিনা যে তার সকল রাজনৈতিকবিরোধীদেরকেও নির্মুল করে ফেলতেছে, বাংলাদেশ একটা গুম-খুন-অপহরণের রাষ্ট্র হয়ে উঠতেছে ইত্যাদি – সেটা কি আমেরিকাসহ পশ্চিমারা দেখে নাই? জানে না? বরং তারা সেসব দেখেও এরাই হাসিনাকেই পিঠচাপড়ে বাহবা দিয়ে যেতে আমরা দেখেছি। এর পিছনের কারণ একটাই পশ্চিমাদের চীন ঠেকানোর স্বার্থ – এটাই সুপ্রীম। আর একাজের ভেট-উপহার হিসাবে তারা বাংলাদেশকে অবলীলায় ভারতের হাতে তুলে দিয়েছে। আমেরিকার স্বার্থ এতই নির্মম ও নিষ্ঠুর একচোখা আত্মস্বার্থকামী! যার কাছে তার আপন-স্বার্থই সব! এটা তো আমেরিকা সব সময়ই!

কিন্তু অবজেকটিভিটি বা প্রকৃতির মার-প্রতিশোধ বলে কথা আছে যা কেউ এড়াতে পারে না। আর সেটাই ঘটে চলেছে বারবার। যেমন ২০০৭ সাল থেকে যখন এটা আমেরিকার কাছেই সত্য প্রমাণিত যে আফগানিস্তানে তার পা আটকে গেছে। আর এতে আমেরিকার গ্লোবাল অর্থনৈতিতে যে পিছিয়ে পড়া শুরু এটাই চীনের কাছে ‘পড়ে পাওয়া সুবিধা’ হয়ে হাজির হবে ও হয়েছেও। সেই থেকে আমেরিকা যেটাতে হাত দিয়েছে সব ক্ষেত্রেই হারতেই আছে! এখন এতে বিদেশিদের কি বিপদ হল তা ছেড়ে আমাদের দেশের ক্ষেত্রে আসি!

হাসিনাবিরোধী সকলের শর্টকামিং বা প্রধান খামতিঃ
মূল বিষয়টা ক্ষমতা ধারণা। রাষ্ট্র-ক্ষমতা কি একে বুঝতে পারা। এবারের আন্দোলনে বিরোধীদলের শ্রম-ঘাম পরিশ্রম ব্যয় সম্ভবত বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ! তবু তাদের পদক্ষেপ দেখে কখনই মনে হয় নাই যে তারা ক্ষমতা ধারণাটা বুঝে। এই সোজাকথাটা হল, বলপ্রয়োগ। হাসিনা বলপ্রয়োগে সক্ষম ও সফল। যেই সক্ষমতাটা ব্যবহার করেই সে ক্ষমতায় আছে আর বারবার নিজেকে নির্বাচিত বলে দাবি করছে। তাহলে তাকে ক্ষমতাচ্যুত কেউ করতে চাইলে তাকেও পালটা সেও বলপ্রয়োগের যোগ্য আর সেটা আরো শক্তিশালী ক্ষমতা এটাই প্রমাণ করতে হত। মানে সেভাবে হাজির হতে হত। এটাি বলপ্রয়োগ আর পালটা-বলপ্রয়োগ এর লড়াইয়ের মূল কথা। এর বাইরে বাকি সবই এর ঝালর-সাজসজ্জা (ডেকোরেটিভ ও প্রেজেন্টেশন এর অংশ)। অন্যভাষায় এটাকেই আমি প্রায়শই বলি মুরোদ। মানে পালটা বলপ্রয়োগের মুরোদ। আপনার এই মুরোদ আছে তো আপনি রাজনীতিতে আছেন। মুরোদ নাই তো রাজনীতিতে আপনি কেউ না হয়ে থাকবেন।

তাহলে নির্বাচন কি? এর কি কোন ভুমিকাই নাই?
অবশ্যই আছে। আর সেটা হল, যাদের যাদের পালটা বলপ্রয়োগের মুরোদ আছে এমন দলগুলোর মধ্যে একটা সমঝোতার নিয়ম সেটা। কিন্তু সাবধান; এখানে লক্ষ্য করবেন প্রমাণিত পালটা বলপ্রয়োগের মুরোদ আপনার আছে আপনিও সক্ষম – এভাবে সাথে আপনারও থাকলেই এরপর আপনি ঐ সমঝোতা নিয়মের সদস্য বিবেচিত হবেন, নইলে নয়। আর কি সেই সমঝোতা? সেটা হল, যাদের যাদের মুরোদ আছে কেবল তাদের মধ্যেই যে সবচেয়ে বেশী জনসমর্থন বা ভোট-কনষ্টিটুয়েন্সি আছে সেই সেবার ক্ষমতায় যাবে।

তবে সাবধান, আপনি ক্ষমতায় গেলেও অন্য আর যারা পালটা বলপ্রয়োগের মুরোদ ওয়ালা সদস্য তাদেরও কিছু কমন স্বার্থ ও সুবিধা আপনি তাদেরকেও দিতে বাধ্য থাকবেন। যেমন আপনি ক্ষমতায় আছেন বলে আমার গণ-সমাবেশ আপনি গ্রেনেড (এটা মিলিটারি গ্রেড আর্মস যা পুলিশের হাতে রাখা হয় না) হামলা করতে বা ভেঙ্গে দিতে পারবেন না। আমি রাস্তায় সমাবেশ করে আমার কথা বলতে পারব কিন্তু সেজন্য ক্ষমতাসীন আপনি মিছিলে আমাকে পায়ে-থাইয়ে গুলি করে আমাকে পঙ্গু করে দিতে বা সরাসরি বুকে গুলি করে আমাকে খামোশ বা বাধা দিতে পারবেন না। অথবা এরই আরেক বর্ধিত রূপ ক্ষমতাসীন আপনি আমাকে গুম-খুন-অপহরণ করে বাধা তৈরি করতে পারবেন না। এটাই সেই সমঝোতার নিয়ম। আরেক ভাষায় এটাই নাগরিক সকলের কনষ্টিটিউশনাল রাইট। এমনকি এই যেটাকে মুরোদওয়ালাদের সমঝোতা বলছি এটাই আমেরিকান কনষ্টিটিউশনের প্রথম সংশোধনী (১৭৯১)।

আর এটাকেই আমরা এর এই বলপ্রয়োগ আর পালটা-বলপ্রয়োগ দিকটা পর্দা দিয়ে ঢেকে দিয়ে বলি “সিভিল রাজনীতি”, বা আবেগে বলি পরিচ্ছন্ন রাজনীতি। মানে যেটাকে কমিউনিস্টেরা বলে গণ-আন্দোলন (যেটা সশস্ত্র নয়) বা মাস-লাইন এর রাজনীতি। আর আমরাও এথেকেই ভাব মারি যেন রাজনীতি মানেই ক্ষমতা নয়; মানেই বলপ্রয়োগ আর পালটা-বলপ্রয়োগ এর মুরোদ নয়। কাম্য রাজনীতি মানে হল যেন সিভিল রাজনীতি!!! আর সেকারণেই বলেছি এই মুরোদওয়ালাদের মধ্যে সমঝোতা – এই সমঝোতা কনষ্টিটিউশনাল রাইট। এই রাইট বা খেলার নিয়ম যখন ক্ষমতাসীনেরা মানবে না , অস্বীকার করবে বুঝতে হবে এই অমান্য মানেই তখন পালটা বলপ্রয়োগের মুরোদ এর দিকে রাজনীতিকে নিতেই হবে। আর এখানটাতেই আমাদের বিরোধী দলেরা নিজেদেরকে ব্যর্থ বলে তুলে ধরেছে। ভেবেছিল আমেরিকা একাজটা করে দিবে!

কিন্তু এবারের দুবছরের আন্দোলনে কি হয়েছেঃ

প্রথম অপরাধ হল, রাজনীতিতে ক্ষমতায় আসতে চাইলে তা যে বলপ্রয়োগ আর পালটা-বলপ্রয়োগ – এই মূলসুত্র বিরোধীদলেরা মান্য করি নাই। যেন ভুলে গেছি বা থাকতে চেয়েছি।এর চেয়েও বড় অপরাধ হল, ধরেই নিয়েছি সব আমেরিকা করে দিবে। যেন আমাদের কাজ হল কেবল বড় সমাবেশ করে দেখিয়ে দেয়া। কিন্তু সরকার পড়বে কি করে? অনেক বড় নেতাকে বলতে শুনেছি বা জেনেছি তারা বলেছেন – সরকার কি করে পড়বে এ’দায় নাকি তাদের নয় আমেরিকার!!! সাথে এটাও বলেছেন, এভাবে আমেরিকা তার দায় সম্পন্ন করে দিলে মানে সরকার পড়ে গেলে তারা তখন আবার নির্বাচন দিতে হবে বলে দাবি করতে থাকবে!!!! আর এটাই শুধু অতি আমেরিকা-নির্ভরতাই নয় যেন নিজ বিবেচনা জ্ঞান-বুদ্ধি খুলে পাশে ফেলে রেখে নিজেই গাধা সেজে বসে থাকার সিদ্ধান্ত নেয়া! আত্মপ্রবঞ্চনাও বোধহয় এমন ভোলেভালা হয় না!

এই আলোচনা থেকে এটা পরিস্কার যে এবারের দুবছরের আন্দোলনের প্রধান খামতি হল এরা জানে না বা ভুলে ছিল যে রাজনীতিতে ক্ষমতা মানে তা বলপ্রয়োগ আর পালটা-বলপ্রয়োগ এর মুরোদ। আর এর বাইরে কোন সত্য নাই। সেকারণে, যেখানে দরকার ছিল আভ্যন্তরীণ যত শক্তি বা যত পালটা-বলপ্রয়োগের মুরোদ সমাজের যাদের যাদের আছে যারা সরকারের উপর ক্ষুব্ধ তাদের সকলকে সবার আগে জড়ো ও যোগাড় করা; আর পরে এর উপর দিয়ে আমেরিকান সহায়তা যত যা পাওয়া যায় তা সামিল করে পালটা-বলপ্রয়োগের মুরোদ দেখানো এভাবে; সেখানে বাস্তব ঘটনাটা হয়ে দাড়িয়েছিল যে পালটা-বলপ্রয়োগ এর মুরোদ – এই অংশটাই একেবারে অনুপস্থিত। আর সাথে সব আমেরিকা করে দিবে এই মনোভাব সপ্তমে উঠানো হয়েছিল! এমনকি ২৮ অক্টোবরের সমাবেশ সেটা আহবানের পিছনেও – সব আমেরিকাই করে দিবে আর আমাদেরকে অহিংস হয়ে বসে থাকলেই হবে -এ’ছিল তাদের স্পষ্ট ভাবনা! তাই এক সাউন্ড গ্রেনেডে্র শব্দে সব অক্কা পেয়েছিল! মঞ্চে বক্তৃতারত অবস্থাতেই সব ফেলে পালানো ঘটেছে। আর এটা হঠাত নয়, এটাই আগাম সিদ্ধান্ত ছিল! যেন আমেরিকাকে বলা যে ভাইসাব আমরা কিন্তু আমাদের করণীয় পার্ট শেষ করলাম; বাকিটা দেইখেন!

অথচ উলটা করে চিন্তা করেন। ২৮ অক্টোবরের কর্মসুচি সেদিন না থাকলেই মানে কোন কর্মসুচি না থাকলেই সেটাতে বিরোধীদের পক্ষে পরিস্থতি থাকত! কারণ, হাসিনা অপেক্ষা করছিল কিভাবে সহিংসতা, জঙ্গিত্বের অভিযোগ তুলে বিরোধী আন্দোলনকে মাঠ থেকে বিদায় করবে, সাজা দিয়ে জেলে রাখবে আর তার কারচুপির নির্বাচন আয়োজনের পথে ফাইনালি রওনা দিবে।
আবার দেখেন ২৮ অক্টোবর থেকে ৭ জানিয়ারি বা এর পরেও আমেরিকা নিশ্চুপ যাকে বলে নট নড়ন-চরণ!! তার মানে বিরোধীরা – আমেরিকা ভাইজান বাকিটা দেইখেন – বলে যে মঞ্চ ছেড়ে ভেগেছিল সেটা তারা করেছিল এবিষয়ে আমেরিকান মনোভাব কি – তারা এরপরে আসলেই কি কিছু করবে বা করতে পারে – এনিয়ে কিছু না জেনেই। তাহলে কিসের ভিত্তিতে কি লক্ষ্য করে ২৮ অক্টোবরের সমাবেশ ডাকা হয়েছিল? এটাই কি আবেগে ধরে নেয়া নয় বা ছিল না যে – আমেরিকা ভাইজান বাকিটা দেইখেন????

মানে, মনে করা হয়েছিল গণ-মহাসমাবেশ সফল করা মানেই বিরোধীদলের দায়দায়িত্ব করণীয় সব শেষ ওখানে। এটাই কি হাসিনার বলপ্রয়োগের জোরে ক্ষমতা ধরে রাখার বিরুদ্ধে পালটা-বলপ্রয়োগ এর মুরোদ দেখানো??? অবশ্যই না। এটাসি তো সবচেয়ে বড় ভুল! কারণ, তাদের ভাষাতেও যদি বলি তবে গণ-মহাসমাবেশ আর গণ-অভ্যুত্থান তো এক কথা নয়। বরং দুইয়ের দুরত্ব বহুদুর! এছাড়াও একালে গণ-অভ্যুত্থান এটাও সহজ যা যথেষ্ট নয়! এটাও বহু কঠিন হয়ে গেছে, যেটা ১৯১৭ সালে পারা যেত সেটা এখন খুবই কঠিন। এখানে তা নিয়ে বিস্তারে বলার সুযোগ নাই তাই সংক্ষেপে বলব, একালে ১৯১৭ সালের রাশিয়ার মত হবু বা গণ-অভ্যুত্থানকামী দেশটা বাকি দুনিয়া থেকে আর বিচ্ছিন্ন নয়। প্রত্যেকটা রাষ্ট্র এখন বিপুল্ভাবে বিকশিত হয়ে পরা গ্লোবাল বাণিজ্যের কারণে এই গ্লোবাল বাণিজ্যে নানান স্বার্থের অংশ হয়ে গেছে। তাই এখন বাংলাদেশে কি হয় তাতে ওসব দেশের বিশেষ করে প্রভাবশালী রাষ্ট্রগুলোর সরাসরি স্বার্থের দিক এখন জ্বলজ্বলে! এমনকি ১৯৬৯ সালের আমাদের সাতদিন আয়ুর যে গণ–অভ্যুত্থান যেটা বলা হয় সেটাও ছিল অর্কেস্টেডেড বা সাজানো! তাই টিভি-তে এসে সেকালে আয়ুব খানের সারেন্ডার-বক্তৃতা ছিল যে, আসেন গোলটেবিল করি, ক্ষমতা হস্তান্তরের ব্যবস্থার করি।

তাহলে মূল পয়েন্টটা হল, সবার আগে সরকারবিরোধী এভেলেবল দেশীয় সকল শক্তি (সরকারি ইন্সটিটিউশন প্রশাসন যারা সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ) এমন সকল সরকারবিরোধী স্বার্থ – এমন সকলকে নিয়ে একটা বুঝাবুঝি তৈরি করা এরপরে আমেরিকার কথা আসতে পারে – এমন হতে হত। এর বদলে সবই পালটা-বলপ্রয়োগ এর মুরোদ এর খবর নাই তা ভুলে কেবল এক আমেরিকা ভরসা! এমনই বোকা আর এবসার্ড কাজটাই আমরা করতে গেছিলাম!

এখানে সাথে আর একটা সাবধান বাণীঃ বলপ্রয়োগ আর পালটা-বলপ্রয়োগ এর মুরোদ বিষয়টা বুঝবার সময় ভুলেও এটা ন্যায় নাকি অন্যায় – এমন বিবেচনা এর ভিতর আনবেন না। মুরোদ-ই সত্য! যো জিতা ও-হি সিকান্দার! যে নিজেকে ডিফেন্ড করতে সক্ষম তার জন্যই এই দুনিয়া! বাকি সবকিছু আসবে এরপরে। সবার আগে ক্ষমতা এরপরে আইন বা ন্যয়-অন্যায় বা অধিকার বোধ ইত্যাদি! যার সোজা মানে হল, আগে মুরোদ এর বিজয় এরপরে সেই মুরোদকে গণ-মানুষের স্বার্থ, গণস্বার্থ (পাবলিক ইন্টারেস্ট), ন্যয়-অন্যয় বোধ, অধিকার বোধের পায়ে সমর্পণ বা উতসর্গ করে দেয়া! দিতে হবে! এই হল পথ! এর কোন উল্টা-পাল্টা বা আগে-পিছে করা যাবে না! আর মুরোদ না থাকলে না বুঝলে রাজনীতি তার জন্য নয়!

এমবেসি পাড়ার ক্ষমতার করিডোরে কান পেতে ইনফরমাল যা জানা যায়ঃ
কেন আমেরিকা বা ওর প্রতিনিধি পিটার হাস ২৮ অক্টোবরের আগে থেকেই ক্রমশ নিশ্চুপ? প্রায় নো এক্টিভিটি? নো স্যাংশন-নিষেধাজ্ঞায় চলে গেছিলেন? এর অনেকগুলো ভাষ্য-ই পাওয়া যায় যার মধ্যে বেশী মুখে মুখে ফেরা ভাষ্যটা হল যে, গত দুবছরের এই শেষের দিকে এসে আমেরিকার কাছে পরিস্কার হওয়া শুরু করেছিল যে আমেরিকা যদি এরচেয়েও বেশী স্যাংশন-নিষেধাজ্ঞায় চাপ হাসিনা সরকারের উপর প্রয়োগ করে তবে সেটা আনবেয়ারেবল বা অসহ্য হয়ে যাওয়াতে এই সরকার এখনও যেভাবে একটু ব্যলেন্স রেখেছে যে কেবল চীন নয় (যদিও একটু বেশী নির্ভরতার) তবুও পশ্চিমের সাথেও পাশাপাশি যোগাযোগ ও লেনদেন সম্পর্ক একটা রেখে চলে। কিন্তু এটাই আর তখন একেবারেই থাকবেই না। একপেশে হয়ে সরকার একেবারেই সবকিছুর জন্য চীন-মুখি হয়ে বা চীনের কোলে উঠে যাবে। পশ্চিম থেকে পুরাটাই বিচ্ছিন্ন হয়েই বিকশিত হতে থাকবে! যেটা আমেরিকার একেবারেই কাম্য নয়!

অনেকে আবার একটু পাকামো করে এখানে ভারতকে টেনে তাকে ক্রেডিটটা দিতে চায় যে ভারত দীর্ঘদিন থেকে এমন ঘ্যানর ঘ্যানর করলেও বাইডেন প্রশাসন এটাকে গুরুত্ব দেয় নাই। সেটাই নাকি এখন এই ডিসেম্বরে এসে পিটার হাসের আমল পেয়েছে।
এক্ষেত্রে আমাদের পালটা বক্তব্য হবে তাহলে – এর মানে হল “কি করিলে কি হইবে” সেসব পুর্ণ হোমওয়ার্ক সবার আগে সম্পন্ন না করেই বাইডেন প্রশাসনের এসব আজরা জেয়া বা -ডোনাল্ড ল্যু রা মাঠে নেমেছিল??? আচ্ছা এসব লোকগুলো কি ফাজলামো না সিরিয়াস কাজ করতে এসেছিল?? যারা হোমওয়ার্ক শেষ না করেই সিদ্ধান্ত নেয় কাজে নেমে আসে তাদেরকে আমরা কি বলবো???

কাজেই দেখা যাচ্ছে এই বয়ানও সুবিধাজনক হল না। তাই আরেক বয়ানের হদিস পাওয়া যায়। সেটা হল প্রধানমন্ত্রীর সন্তানকে মানি লন্ডারিং মামলায় আটকে চাপ দিলে সেটা বাইডেনের আমেরিকার জন্য অব্যর্থ অস্ত্রের মত কাজে দিবে, এটাই নাকি মনে করা হয়েছিল। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর এজেন্ডা-ক্রম এর ভিতরে সন্তানকে বাঁচানো – এটাকে তিনি কোন এজেন্ডাই করেন নাই বা রাখেন নাই। তাই আজরা জেয়াদেরও কপাল ফুটা হয়ে হাজির হয়! মানে হাসিনার পরিকল্পনার কাছে তারা সবাই হেরে যায়!

এটা সত্য-মিথ্যা যাই হোক বরং আমরা দেখেছি হাসিনা সরকারের সবার আগেই প্রায়োরিটি ছিল যে – নির্বাচন-সম্পন্ন হয়েছে দাবি করে নিজেকে বিজয়ী ঘোষণা করে দেখানো। একাজকেই প্রথম ধ্যান-জ্ঞান করে নেমে পড়া। কারণ, এটাই হল তাঁর সব ক্ষমতার ভিত্তি না শুরু! কথা সত্য। কিন্তু তাহলে কি এরপরে সন্তান বাচানোর ইস্যু আসবে? না তাও নয় তিনি তা করেন নাই; আগেই বলেছি এটা এখন তাঁর এজেন্ডাতেই নাই। আর এতেই বাইডেন প্রশাসনের কুতুবেরা নাকি বোবা হয়ে যায়! মানে এই প্রশাসন হাতে -বার্গেনিংয়ের বুটি – শুন্য হয়ে সব অকেজো হয়ে যায়! আর এটাই নাকি পিটার হাসের ক্রমশ নিশ্চুপতা!!!!! এর সত্য-মিথ্যা আমরা নিশ্চিত নই। তবে সন্তান বাঁচানোকে কোন প্রায়োরিটিতে না রাখার সিদ্ধান্তই সফল ও কার্যকর!তাহলে হাসিনার এরপরের বা সেকেন্ড প্রায়োরিটি কি?

হাসিনার দুঃচিন্তা কি নিয়েঃ
বলার পেক্ষা রাখে না হাসিনা নিজের এই সেকেন্ড প্রায়োরিটি সফল হবে কিনা এনিয়ে চিন্তিত। যদিও কোনভাবেই সেটা বাইডেন আবার নয়া সরকারের ক্ষমতার উপর চাপ দিতে পারে – এটা তা নয়! এটা আন্দাজে ঢিল ছোড়া আর যার মূল লক্ষ্য হতাশ কর্মীদের মনোবল খাড়া করা। এই অ্আন্দাজি কাজ এটা আত্মঘাতিমূলক! যেখানে বিরোধীদের সকলের কাজ এখন নিজেদেরকেই সঠিকভাবে মুল্যায়ন, কি কি ভুল হয়েছে এটা খুজে দেখে স্বীকার ও কারেকশন করে নেয়া সেখানে চাতুরি উলটা নেগেটিভ ভুমিকায় হাজির হবেই!তাহলে হাসিনার সেকেন্ড প্রায়োরিটি বা দুঃশ্চন্তা কি নিয়ে?

এই পিটার হাস বা বাইডেন প্রশাসন স্যাংশন-নিষেধাজ্ঞা এটা এখন ক্রমশই অকেজো দুর্বল হয়ে যাবে। সেকথায় আরেকটু বিস্তারে আসব।
এর আগে, নিজেকে বিজয়ী ঘোষণা করতে সক্ষম হলেও এই ২০২৪ সালেই হাসিনার জন্য অন্তত দুইটা বিপদ বা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে। সবচেয়ে বড় বিপদের ইস্যু হল দেশের অর্থনীতির বেহাল – এই হাল! এটাই এক বিরাট চ্যালেঞ্জ তার সামনে। পড়িমরি অবস্থা! এটা তিনি জানতেন তাই অনেক আগেই বলেছিলেন আমেরিকা নাকি দেশে দুর্ভিক্ষ আনবে।

গত ৯ ডিসেম্বর কালের কন্ঠের এই শিরোনাম ছিল মার্চের দিকে দুর্ভিক্ষ ঘটাতে ষড়যন্ত্র হচ্ছে – গোপাল্গঞ্জে শেখ হাসিনা। কিন্তু কেন বলেছিলেন অথবা এর ঘটনা পরম্পরা কি?

এর একেবারে প্রথমে বা শীর্ষে আছে আপাদমস্তকে চোর একটা শ্রেণী। এটা ঠিক ধনী-গরীবের ধনি শ্রেণী বলতে যা বুঝাই ঠিক তা নয় যে যেকোন সরকারের বিরুদ্ধে যেমন অভিযোগ থাকে যে সরকার ধনীদের পক্ষে কাজ করে গরীরসহ বাকি দেশের সকলকে ডুবিয়েছেন। বরং এরা হোল চোর-লুটেরা আর হাসিনাকে এমন চোরদের উপর ভরসা করেই নিজ ক্ষমতা-শ্রেণী সাজাতে হয়েছিল। হাসিনার সবচেয়ে বড় দুর্বলতা বা খামতির দিক হল তাঁর অবস্থান ঠিক রাজনীতি না, প্রতিহিংসা! বাবার হত্যার প্রতিশোধ! তাই আকন্ঠ নিমজ্জিত চুরির সুবিধা খাওয়া একটা শ্রেণী যারা জিন্দাবাদ দিয়ে হাসিনার চোখবুজা সমর্থক সেজেছে। হাসিনা তাদের আনুগিত্য কিনেছে। অথচ প্রশাসনের ভুল পরামর্শে হাসিনা যখন তেলের দাম এক লাফে দেড়্গুণ বাড়িয়েছিল এই আকন্ঠ লুটেরারা সবার আগে সকলে মিলে মানে তারা প্রায় সকলেই ব্যাংক ঋণএর ডিফল্টার তারা কব্জায় থাকা সকল টাকা একসাথে ডলারে কনভার্ট করে দেশ ছাড়তে ততপর হয়েছিল। এতে সৃষ্ট যে ডলারের চাহিদা এটা একেবারেই কৃতিম, স্বাভাবিক অর্থনীতিতে যে ডলার লাগে সেই চাহিদা নয়। আর আমাদের অর্থনীতি এই সীমাহীন যোগান দিতেও সক্ষম ঠ্যাকার কোন কারণ নাই। এই ভারসাম্যহীনতাকেই এই এলোমেলো দশা আমরা বলছি দেশের অর্থনীতির বেহাল অবস্থা। অর্থাৎ হাসিনা নিজেই যে অর্থনৈতিক শ্রেণীর উপর ভর করে তার প্রতিহিংসা বা বাবার নাম প্রতিষ্ঠার কাজ হাতে নিতে চেয়েছিলেন সেটাই তার আসল শত্রু!

তাহলে এখন হাসিনার চ্যালেঞ্জটা কি? তিনি চিন্তিত কেন?
সোজা কথায় দুইটা কাজ তাকে করতেই হবে বা অর্জন করতেই হবে। এক নগদ (ক্যাশ) ডলার ঋণ যা কমপক্ষে দশ বিলিয়নের আশেপাশে। যদিও তাঁর আসল প্রায়োরিটি অর্থে প্রধান বিষয় হল, আইএমএফ এর কাছ থেকে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে একটা পজিটিভ বা ভাল রিপোর্ট। মনে রাখতে হবে বিদেশী পুঁজি বাজারের কাছে কোন দেশের অর্থনৈতিক হাল মানে এর সম্ভাবনা-সংশয় নিয়ে (সেই ১৯৪৫ সালে প্রথম আইএমএফ এর জন্মের পর থেকে এপর্যন্ত) আইএমএফ এর দেয়া রিপোর্ট বাজারের কাছে সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য, আন-বায়াসড রিপোর্ট বলেই মনে করা হয়। যদিও অনেকে ভুল্ভাবে মনে করে থাকেন এমন রিপোর্ট না, যেন আইএমএফ এর কাছ থেকে পাওয়া ঋণই আসল বিষয়। অবুঝ কমিউনিস্টেরা এই বোকা বুঝ তৈরি করেছে। দেশ অর্থনৈতিক সংকটে পড়লে আইএমএফ এর রিমেডি বা প্রতিকার বাতলে দেয়। আর এটাকেই কমিউনিস্টেরা হুদাই শর্ত দিল কেন বলে অবুঝ হৈচৈ শুরু করে থাকে। অথচ লক্ষ্য করলে দেখা যাবে কোন দেশের এমন অরররথনৈতিক দুর্দশায় যদি আইএমএফ এর হিসাবে প্রতিকার-বুদ্ধিতে ২০ বিলিয়ন ডলার দরকার হয় তবে আইএমএফ নিজে ছয় বিলিয়নের বেশী দেয় না। অর্থাৎ আইএমএফ এর লোন দেয়াটা মুখ্য না ওর রেকমেন্দেড করণীয় পরামর্শটাই মুখ্য। এটা ২০১৮ সালে পাকিস্তানের ইমরানের ক্ষেত্রে কি হয়েছিল সেই উদাহড়ণ মাথায় রেখে বলছি। চীন পুরা ২০ বিলিয়ন একাই দিতে চেয়েছিল, ইমরান নেন নাই। আইএমএফ ৬, চীন ৬ আর বাকিটা সৌদি (তেল শোধনাগার প্লান্ট) থেকে এভাবে নিয়েছিলেন। কারণ বাজার এসব পরিস্থিতিতে একমাত্র প্রফেশনাল বিশ্বাসযোগ্য আইএমএফ পাকিস্তানের অর্থনীতির অলিগলিতে ঢুকে সব দুর্বলার কথা জেনেছে কিনা।

অদিকে এখন বলাই বাহুল্য আইএমএফ এর এক নম্বর শর্ত হবে চোর শ্রেণীর ইচ্ছাকৃত খেলাপী ব্যাঙ্ক ঋণ উদ্ধার করে নিয়ে আসো। ডলারের দুধরণের বা নানান রেট বন্ধ কর। সরকারী-ব্বসরকারির মধ্যে একদুই টাকার ফারাক এমন স্থিতিশীল ডলারের মূল্য-হার ফিরিয়ে আনতেই হবে। এটাই মূল জিনিষ। অতেব নগদ ডলারের ঋণ যোগাড় আর তা নিয়ে এরপর আইএমএফ এর প্রতিকার-পরামর্শ পালন শেষ করে আইএমএফ এর কাছ থেকে ভাল অর্থনৈতিক অবস্থার একটা সার্টিফিকেট যোগাড় – এই হল হাসিনার দুই মাথা ব্যাথার নাম!
দুটাই কঠিন কাজ!

চোর শ্রেণীর ইচ্ছাকৃত খেলাপী ব্যাঙ্ক ঋণের অর্ধেক্টাও কি উদ্ধার করতে পারবেন? মনে রাখতে হবে এরাই কিন্তু হাসিনার সমর্থক ও পোষ্য শ্রেণী; মানে নিজেই নিজের বিরুদ্ধে নামার মত কাজ এটা! কাজেই ………!!!

দুই বা দ্বিতীয়টা হল চীনের কাছ থেকে নগদ ডলার ঋণ আনা! কিন্তু চীন কি হাসিনার উপর আস্থা রাখবে? হাসিনা বিনিময়ে চীনকে সবকিছু দিতে রাজী থাকলেও চীন আপত্তি করতে পারে এই বলে যে তুমি তো বারবার কথা দিয়েও ভারত-প্রেমি! তাই আস্থা নাই!

এখানে আমরা একটা কথা মনে রাখতে পারি যে এবারই প্রথম হাসিনা আমেরিকার চাপ সামলানোর জন্য ভারত-নির্ভর নয়। যেটা অন্তত ২০১২ সাল থেকেই হাসিনার ভারত-নির্ভরতার মূল কারণ! যেটা এবারই ভারতের আমেরিকার কাছে কোন সুপারিশ করেছে আর হাসিনা এর বিনিময়েই ক্ষমতায় তা নয়। কাজেই এবার ভারতের স্বার্থ নিয়ে পরে দেখব মনে করার সুযোগ হাসিনার আছে। আর সেই লিভারেজ ব্যবহার করে সে চীনকে সন্তুষ্ট করতে লেগে পড়তে পারে! চাইকি এজন্য এবার যদি হাসিনাকেই এক নম্বর ভারত-বিরোধী ভুমিকায় দেখা যায় তাতে অবাক হবার কিছু নাই! যদিও কি হয় কি দাড়ায় সেটা আমাদের বাস্তবে দেখে বুঝতে হবে।

আর এসব কিছুর শেষ কথাটা কীঃ
শেষ কথাটা হলো – দেশের অর্থনীতির বেহাল দশা, নিয়ন্ত্রণহীন মুদ্রাস্ফিতিতে গরীব মানুষ ক্রয়ক্ষমতা না হারিয়ে ফেলে; খাদ্য ক্রয় করা টিকে থাকার সক্ষমতাও হারিয়ে ফেলার আসল নাম হল দুর্ভিক্ষ – এটা যে আমরা না ভুলি! বিরোধীদলেগুলো যত দ্রুত ঐ আমেরিকা আসতেছে – এই মিথ্যা ত্যাগ করে বাস্তবে ফিরে আসে এটা প্রথম কাজ্জ। এরপর হাসিনার চ্যাক্ষমতার চ্যালেঞ্জ বা দেশের অর্থনীতির বেহাল অবস্থাটার গুরুত্ব বুঝতে পারে আর তা থেকে করণীয় নির্ধারণ করতে পারে এবং তা ইতিবাচকভাবে এটাই হতে পারে তাদের বেরিয়ে আসার পথ!

গৌতম দাস
রাজনৈতিক বিশ্লেষক
goutamdas1958@hotmail.com

Advertisements