তালেবান নেতৃত্বের মধ্যে মতবিরোধের কারণে সরকার গঠনে বিলম্ব হচ্ছে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে মুজাহিদ বলেন, এটি সম্পূর্ণ গুজব। কোনো প্রকার বিরোধ নয় বরং কৌশলগত কিছু কারণে এই বিলম্ব হচ্ছে। শিগগিরই সরকার গঠিত হবে।
আফগানিস্তানের সশস্ত্র রাজনৈতিক দল তালেবানের মুখপাত্র জবিউল্লাহ মুজাহিদ বলেছেন, আফগানিস্তানের স্থিতিশীলতা নষ্ট করতে যেই অস্ত্র হাতে তুলে নেবে, সেই এই দেশ ও দেশের মানুষের শত্রু।
তালেবানের নিয়ন্ত্রণের বাইরে থাকা একমাত্র প্রদেশ পাঞ্জশিরে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার ঘোষণার পর সোমবার কাবুলে এক সংবাদ সম্মেলনে এই মন্তব্য করেন তিনি।
এর আগে সোমবার এক টুইট বার্তায় পাঞ্জশিরের ওপর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেন জবিউল্লাহ মুজাহিদ।
সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, আফগানিস্তানের যুদ্ধ শেষ হয়েছে। যুদ্ধ শেষে তিনি আশা করছেন এক স্থিতিশীল আফগানিস্তান প্রতিষ্ঠিত হবে।
মুজাহিদ বলেন, আফগানিস্তানের স্থিতিশীলতার বিরুদ্ধে যারাই অস্ত্র হাতে নেবে, তাদেরকে দেশ ও দেশের জনগণের শত্রু হিসেবে গণ্য করা হবে।
তালেবান মুখপাত্র বলেন, ‘জনগণের জানা থাকা প্রয়োজন আগ্রাসনকারীরা আমাদের দেশ গঠন করতে পারবে না। সুতরাং আমাদের জনগণের নিজেদেরই এই দায়িত্ব পালন করতে হবে।’
পাঞ্জশিরের তালেবানবিরোধী আহমদ মাসুদ বাহিনীর সাথে যুদ্ধের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আলেম ও আফগানিস্তানে আগ্রাসন প্রতিরোধ যুদ্ধের সাবেক নেতাদের সহায়তায় তারা শুরুতে আলোচনার মাধ্যমেই বিরোধ মীমাংসার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু সমঝোতা না হওয়ার জেরে তালেবান যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে বাধ্য হয়।
মুজাহিদ বলেন, তবে তারা চাইলে তালেবানের সাথে একত্রে দেশ গঠনের কাজে অংশ নিতে পারেন। তালেবান নেতৃত্ব তাদেরকে ক্ষমা করে দেবে।
জবিউল্লাহ মুজাহিদ বলেন, শিগগিরই আফগানিস্তানে ইসলামি ও জবাবদিহিতামূলক সরকার গঠন করা হবে। অন্তর্বর্তীকালীন সময়ের জন্য গঠিত এই সরকারে সকলের অংশগ্রহণ থাকবে।
তালেবান নেতৃত্বের মধ্যে মতবিরোধের কারণে সরকার গঠনে বিলম্ব হচ্ছে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে মুজাহিদ বলেন, এটি সম্পূর্ণ গুজব। কোনো প্রকার বিরোধ নয় বরং কৌশলগত কিছু কারণে এই বিলম্ব হচ্ছে। শিগগিরই সরকার গঠিত হবে।
আফগান সামরিক বাহিনীর প্রসঙ্গে তিনি বলেন, গত ২০ বছর যারা আফগান বাহিনীতে যুক্ত হয়ে প্রশিক্ষিত হয়েছেন, তালেবান যোদ্ধাদের সাথে তাদেরকে যুক্ত করে আফগানিস্তানে নতুন নিরাপত্তা বাহিনী গঠন করা হবে।
এদিকে বিভিন্ন শহরে আফগান নারীদের বিক্ষোভের বিষয়ে তিনি বলেন, আফগান নারীদের বিক্ষোভের অধিকার রয়েছে। তবে এই মুহূর্তে সরকার গঠিত না হওয়ায় এবং নিরাপত্তা ঝুঁকি থাকায় আমরা তাদের আহ্বান জানাচ্ছি, সরকার গঠন পর্যন্ত অপেক্ষা করার।
কাবুলে রোববার নারীদের এক বিক্ষোভে তালেবান যোদ্ধাদের সহিংস আচরণের বিষয়ে মুজাহিদ জানান, অনেক তালেবান যোদ্ধাই এখনো প্রশিক্ষিত না হওয়ায় এই দুঃখজনক ঘটনা ঘটে। ঘটনার সাথে সংশ্লিষ্টদের তারা গ্রেফতার করেছেন।
পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইয়ের প্রধানের সফর সম্পর্কে তিনি বলেন, পাকিস্তান এর আগে এমন একটি সফরের জন্য বার্তা পাঠালেও তালেবান সম্প্রতি এতে সম্মতি জানায়। আফগানিস্তান ও পাকিস্তান উভয় দেশের সীমান্ত, অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তাসহ দ্বিপাক্ষিক বিষয়ে তারা আলোচনা করেন।
২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্রে নাইন-ইলেভেনের সন্ত্রাসী হামলার জেরে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ হামলার জন্য আফগানিস্তানে আশ্রয়ে থাকা আলকায়েদা প্রধান ওসামা বিন লাদেনকে দায়ী করেন। ওই সময় আফগানিস্তানের ক্ষমতাসীন তালেবান সরকারের কাছে ওসামা বিন লাদেনকে মার্কিন প্রশাসনের হাতে তুলে দেয়ার দাবি জানান বুশ।
তালেবান সরকার ওসামা বিন লাদেনকে তুলে দেয়ার পরিবর্তে যুক্তরাষ্ট্রে সন্ত্রাসী হামলার সাথে তার সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে মার্কিনিদের কাছে প্রমাণ চায়। প্রমাণ ছাড়া তারা ওসামা বিন লাদেনকে মার্কিন প্রশাসনের কাছে তুলে দিতে অস্বীকৃতি জানায়।
বুশ প্রশাসন ও তালেবানের মধ্যে বিরোধের জেরে ২০০১ সালের অক্টোবরে আফগানিস্তানে আগ্রাসন শুরু করে মার্কিন বাহিনী। অত্যাধুনিক সমরাস্ত্রসজ্জ্বিত মার্কিন সৈন্যদের হামলায় তালেবান সরকার পিছু হটতে বাধ্য হয়।
তবে একটানা দুই দশক যুদ্ধ চলতে থাকে দেশটিতে।
এরইমধ্যে আফগান যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে ন্যাটো জোটের সদস্য দেশগুলোও যুক্ত হয়। মার্কিনিদের সমর্থনে নতুন প্রশাসন ও সরকার ব্যবস্থা গড়ে উঠে দেশটিতে।
২০১১ সালের ২ মে পাকিস্তানের অ্যাবোটাবাদে মার্কিন সৈন্যদের এক ঝটিকা অভিযানে নিহত হন ওসামা বিন লাদেন। ২০১৩ সালে অজ্ঞাতবাসে তালেবানের প্রতিষ্ঠাতা মোল্লা মোহাম্মদ ওমরের মৃত্যু হয়।
তা স্বত্ত্বেও তালেবান যোদ্ধারা আফগানিস্তানে মার্কিন নেতৃত্বাধীন বহুজাতিক বাহিনীর দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে লড়াই অব্যাহত রাখে।
দীর্ঘ দুই দশক আফগানিস্তানে মার্কিন নেতৃত্বের বহুজাতিক বাহিনীর দখলের পর ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে কাতারের দোহায় এক দ্বিপাক্ষিক চুক্তিতে আফগানিস্তান থেকে মার্কিন বাহিনী প্রত্যাহার করতে সম্মত হয় যুক্তরাষ্ট্র। এর বিপরীতে আফগানিস্তানে শান্তি প্রতিষ্ঠায় অংশ নিতে তালেবান সম্মত হয়।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের ঘোষণা অনুসারে ৩১ আগস্ট আফগানিস্তান থেকে বহুজাতিক বাহিনীর সম্পূর্ণ প্রত্যাহারের ডেডলাইন থাকলেও ৩০ আগস্ট সম্পূর্ণ সৈন্য প্রত্যাহার সম্পন্ন হয়।
মার্কিনিদের সাথে চুক্তি অনুসারে ক্ষমতাসীন থাকা মার্কিন সমর্থনপুষ্ট আফগান সরকারের সমঝোতার জন্য তালেবান চেষ্টা করলেও দুই পক্ষের মধ্যে কোনো সমঝোতা হয়নি। তালেবানের অভিযোগ, আশরাফ গনির নেতৃত্বাধীন আফগান সরকার দেশে শান্তি প্রতিষ্ঠায় তাদের আহ্বানে সাড়া দেয়নি।
এর পরিপ্রেক্ষিতে মে মাসে বহুজাতিক বাহিনীর প্রত্যাহারের মধ্যেই পুরো দেশের নিয়ন্ত্রণে অভিযান চালানো শুরু করে তালেবান।
৬ আগস্ট প্রথম প্রাদেশিক রাজধানী হিসেবে দক্ষিণাঞ্চলীয় নিমরোজ প্রদেশের রাজধানী যারানজ দখল করে তারা। যারানজ নিয়ন্ত্রণে নেয়ার ১০ দিনের মাথায় কেন্দ্রীয় রাজধানী কাবুলে পৌঁছে যায় তালেবান যোদ্ধারা। তালেবানের অগ্রসরে আশরাফ গনির কাবুল ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার জেরে আফগান প্রশাসন ভেঙে পড়ার পরিপ্রেক্ষিতে ১৫ আগস্ট কাবুলে প্রবেশ করে তালেবান যোদ্ধারা।
তবে কাবুলের উত্তরের দুর্গম পাঞ্জশির প্রদেশ শুধু তাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে রয়ে গিয়েছিলো। আফগানিস্তানে রুশ আগ্রাসন প্রতিরোধ যুদ্ধের কিংবদন্তি যোদ্ধা আহমদ শাহ মাসুদের ছেলে আহমদ মাসুদের নেতৃত্বে তালেবানবিরোধী বিদ্রোহী যোদ্ধারা এই উপত্যকায় অবস্থান নিয়েছিলো।
সোমবার পাঞ্জশির নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে পুরো আফগানিস্তানের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে তালেবান। তবে আহমদ মাসুদ আত্মগোপন করে নিরাপদেই রয়েছেন বলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তার ঘনিষ্ঠরা জানিয়েছেন।
সূত্র : তোলো নিউজ, আলজাজিরা, টিআরটি ওয়ার্ল্ড ও আফগান সংবাদমাধ্যম