রাষ্ট্রায়ত্ত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বিপরীতে সরকারের ব্যাংক গ্যারান্টির পরিমাণ ক্রমেই বেড়ে চলেছে। চার বছরের ব্যবধানে এই দায় বেড়েছে ৬৩ শতাংশ। টাকার অঙ্কে যার পরিমাণ ৩৭ হাজার ৯৩৮ কোটি টাকা। যেমন-২০১৯-২০ অর্থবছর শেষে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বিপরীতে সরকারের ব্যাংক গ্যারান্টির স্থিতি ছিল ৬০ হাজার ৬৫৩ কোটি টাকা। যেখানে চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের জুন শেষে এই গ্যারান্টির পরিমাণ গিয়ে ঠেকবে ৯৮ হাজার ৫৯১ কোটি টাকায়।
বরাবরের মতো এবারো যে প্রতিষ্ঠানের বিপরীতে সরকারকে সবচেয়ে বেশি পরিমাণ ব্যাংক গ্যারান্টি দিতে হয়েছে সেটি হচ্ছে বিদ্যুৎ খাত। অর্থ্যাৎ এই খাতের আওতায় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান তাদের বিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য বিপুল পরিমাণ যে ঋণ নিয়েছে তার বিপরীতে সরকারকে বেশি ব্যাংক গ্যারান্টি দিতে হয়েছে। এই ব্যাংক গ্যারান্টিকে বলা হয় সরকারের প্রচ্ছন্ন ঋণ, কারণ এই গ্যারান্টির বিপরীতে যদি কোনো প্রতিষ্ঠান ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হয়, তবে সরকারকেই সেই ঋণ পরিশোধের দায়িত্ব নিতে হবে।
জানা গেছে, বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন ও বিদ্যুৎ খাতে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন, সার আমদানি, বাংলাদেশ বিমানের জন্য বোয়িং ক্রয়, জ্বালানি তেল আমদানি, কৃষি ঋণ বিতরণ ও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানিসহ বিভিন্ন খাতে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ ও সংস্থা দেশী-বিদেশী ব্যাংক/আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও দাতাসংস্থার কাছ থেকে গত ২০০৪ সাল থেকে বিভিন্ন সময়ে এসব ঋণ নিয়েছে।
এ বিষয়ে অর্থ বিভাগের এক সূত্র উল্লেখ করেছে, বিভিন্ন সময়ে সরকারের নীতি ও কর্মসূচি বাস্তবায়নের স্বার্থে সরকারি মালিকানাধীন আর্থিক ও অ-আর্থিক প্রতিষ্ঠান কর্তৃক গৃহীত ঋণের জন্য গ্যারান্টি ও কাউন্টার গ্যারান্টি প্রদান করা হয়ে থাকে। এসব ঋণের অর্থ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো সময়মতো পরিশোধে ব্যর্থ হলে, তা পরিশোধের দায়দায়িত্ব সরকারের উপরে বর্তায়। কাজেই সরকারের ভবিষ্যৎ আর্থিক অবস্থার ওপর এর প্রভাব রয়েছে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে জুন শেষে সবচেয়ে বেশি ব্যাংক গ্যারান্টির স্থিতি দাঁড়াবে বিদ্যুৎ খাতে। যার পরিমাণ ৫১ হাজার ৪৯৬ কোটি টাকা। ২০২১-২২ অর্থবছর শেষে যা ছিল ৪৯ হাজার ৫১৫ কোটি ৬০ লাখ টাকা। বিদ্যুৎ খাতের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ব্যাংক গ্যারান্টি দেয়া হয়েছে ‘বাংলাদেশ-চায়না পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড কর্তৃক পায়রা ১৩২০ মেগাওয়াট থার্মাল পাওয়ার প্লান্ট প্রকল্প বাস্তবায়নে নেয়ার ঋণের ৫০ ভাগ রাষ্ট্রীয় গ্যারান্টি প্রদানে। এক্সিম ব্যাংক অব চায়না থেকে ঋণ নিয়ে এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এখানে সরকারের ব্যাংক গ্যারান্টির পরিমাণ ১৬ হাজার ৯০৫ কোটি ৮১ লাখ টাকা। এর পরই রয়েছে ‘ মৈত্রী সুপার থার্মাল পাওয়ার প্রজেক্ট’। এই প্রকল্পের জন্য ভারতের এক্সিম ব্যাংক থেকে ১৪ হাজার ৮২০ কোটি ৭৬ লাখ টাকা ঋণ নেয়া হয়েছে। ঋণটি ইস্যু করা হয় ২০১৭ সালের ৪ সেপ্টেম্বর। এরপরই রয়েছে ‘রুরাল পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড কর্তৃক গৃহীত পটুয়াখালী ১৩২০ মেগাওয়াট তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র। প্রকল্পের বিপরীতে এক্সিম ব্যাংক অব চায়নাকে ঋণ দিতে হয়েছে চার হাজার ৬০০ কোটি ৫৬ লাখ টাকা।
গ্যারান্টির দিক দিয়ে দ্বিতীয় শীর্ষে রয়েছে ‘বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন’ (বিএডিসি)। সার আমদানির জন্য নেয়া ঋণের বিপরীতে সরকারের গ্যারান্টির স্থিতি রয়েছে ১৩ হাজার ১৬৯ কোটি ৫৩ লাখ টাকা। জানা গেছে, বিশ্ববাজারে সারের দাম অত্যাধিক বেড়ে যাওয়ার কারণে এবার সার আমদানির জন্য বেশি করে ব্যাংক ঋণ নিতে হয়েছে বিএডিসির। ফলে এ খাতে ব্যাংক গ্যারান্টির পরিমাণও অনেক বেড়ে গেছে।
তৃতীয় স্থানে রয়েছে সার আমদানির জন্য বিসিআইসির গ্যারান্টি। যার পরিমাণ ৯ হাজার ৫৫৭ কোটি ৭৯ লাখ টাকা। সার আমদানির জন্য বিসিআইসি রাষ্ট্রীয় সোনালী ব্যাংক থেকে তিন হাজার ৬৯২ কোটি টাকা, জনতা থেকে দুই হাজার ৯৭৯ কোটি টাকা, অগ্রণী থেকে এক হাজার ৭৬৩ কোটি টাকা এবং কৃষি ব্যাংক থেকে এক হাজার ১২৪ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। বাংলাদেশ বিমানের জন্য জুন শেষে ব্যাংক গ্যারান্টির স্থিতি হবে আট হাজার ৫৪ কোটি ৪৫ লাখ টাকা। বিমান কেনার জন্য ঋণের গ্যারান্টি দেয়া হয়েছে বিদেশী তিন ব্যাংক ও রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংকের কাছে।
এ দিকে ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নের কারণে এখন গ্যারান্টির বিপরীতে ঋণ শোধ করতে বেশি অর্থ বরাদ্দ দেখানো হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট এক সূত্র জানিয়েছে।
সূত্রঃ নয়াদিগন্ত