সক্রেটিসের কাছ থেকে একজন নেতা যা শিখবেন
Advertisements

সক্রেটিস এমন ব্যক্তি, যার নিজের জীবন ও তার প্রচারিত দর্শনের মধ্যে কোনো ভেদরেখা নেই। ফলে তার জীবন আলোচনা আর তার দর্শনের আলোচনা শুধু সমার্থকই নয়, বরং দর্শনের ইতিহাসে সক্রেটিসই প্রথম দর্শনকে অতি বায়বীয় বা শুধু অলৌকিক, প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের আলোচনার পরিমণ্ডল থেকে প্রতিদিনের নৈতিক জীবনের জন্য অপরিহার্য অংশ করে তুলেন। আমরা দেখতে পাচ্ছি সক্রেটিস যেই অর্থে নিজের জীবন ও দর্শনকে একাকার করে যাপন করতে সক্ষম হয়েছিলেন, যেসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে মৃত্যুর মধ্যদিয়ে অমরত্বের শিখরে পৌঁছে আজ তিনি একটি নাম শুধু নয়, একটি বৈশিষ্ট্যে পরিণত হয়েছে এবং এটা-একজন রাজনৈতিক নেতার জন্য খুবই জরুরী। বা একজন নেতার চরম সার্থকতার চূড়ান্ত পর্বে এ বাসনাই বিরাজ করে। তিনি একটি নাম থেকে হয়ে উঠতে চান একটি-গুণ, নীতি বা ইতিহাস। ফলে সক্রেটিসের জীবন/দর্শনকে এইদিক থেকে পাঠের সরাসরি কিছু উপকারিতা রয়েছে।

ক.

‘জ্ঞানের মূল কথাই হলো আত্মজ্ঞান’-সক্রেটিস।

জ্ঞানই শক্তি এ কথাটা আমরা অনেকদিন থেকে শুনে আসছি। ফলে ক্ষমতার জন্য জ্ঞান দরকার। আর যে দার্শনিক প্রকৃত অর্থে সত্যিকারের জ্ঞানের সন্ধান করেছিলেন তিনি হলেন, সক্রেটিস। জ্ঞান কী? এ প্রশ্নের সুরাহা না করেই তখনকার গ্রিসের সমাজে যেমন বহু মানুষ নিজেদের জ্ঞানী হিসাবে পরিচিত করতেন, এখনো তেমন প্রবণতার জোয়ার বেড়েছে বই কমেনি। ফলে সক্রেটিসকে জ্ঞানের প্রকৃতি কী তা সন্ধান করতে দেখা যায়। এ কাজ করতে গিয়ে তিনি যেই সিদ্ধান্তে উপনীত হন তা হলো, আত্মজ্ঞান বা নিজেকে জানা। আর নিজেকে জানার একমাত্র উপায় হলো সদগুণ অর্জন করা। এবং বেশ কিছু সদগুণকে তিনি পরীক্ষা করে দেখেন। তিনি গ্রিসের সেই সময়ের সেরা চিন্তক, সাধারণ নাগরিক, কবি, রাজনীতিবিদ সবার সঙ্গেই আলাপে শামিল হন। যেসব সদগুণকে আমরা জানি বলে ধরে নিয়ে সেগুলোর চর্চা করি, তিনি সেগুলোর প্রকৃত সত্যরূপ খতিয়ে দেখতে শুরু করেন। এবং এ বিষয়গুলো একজন নেতার জন্যও সুরাহা করা জরুরি। যেমন-তিনি প্রশ্ন করেন, সংযম কী? জ্ঞান কী? অভিমত কী? সাহস কী? বন্ধুত্ব বা প্রেম কী? ধার্মিকতা কী? রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক সম্পর্ক কী? নৈতিকতা বা ব্যক্তিগত নৈতিকতা কী ইত্যাদি বিভিন্ন প্রশ্নই আজ আমরা সক্রেটিসীয় সংলাপ আকারে পাই। যেগুলোর বেশিরভাগই তার শিষ্য বা অনুরাগী প্লেটো আমাদের জন্য লিখে রেখে গেছেন।

সক্রেটিসের জীবনের অন্যতম মিশন ছিল যে কোনো বিষয়ের ‘সত্য জ্ঞান’ অর্জন করা। এ কাজ করতে গিয়ে তিনি সেই কালের সফিস্ট বা ছদ্ম চিন্তকদের পরখ বা বিচার করতে শুরু করেন। তিনি দেখাতে চান আমরা যা জানি বলে দাবি করি, তা আসলেই কী আমরা জানি? তিনি অন্যদের চেয়ে নিজেকে এ জায়গায় আলাদা করেন যে, অন্যরা নিজের অজ্ঞতা সম্পর্কে জানেই না, আর আমি জানি যে, আমি জানি না। ফলে সে সময়ের ছদ্ম চিন্তক ও বুদ্ধিজীবীর কাছে সক্রেটিস একটি বিড়ম্বনা আকারে হাজির হয়। তাদের জ্ঞানী হিসাবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করার এই ছল তিনি উন্মোচন করে দিতে শুরু করেন। এবং এরই পরিণামে এসব সফিস্টদেরই মিথ্যা অভিযোগে তাকে মৃত্যদণ্ড দেওয়া হয়। এবং তিনি তা মেনে নিয়ে পশ্চিমা দর্শনের ইতিহাসে এক বিরাট ইভেন্ট বা নয়া সূচনা বিন্দুর আরম্ভ করেন; যা আজকের দর্শনের ইতিহাসের এক অন্যতম প্রধান পাটাতন হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

চিন্তা করলে দেখা যাবে, সক্রেটিস যেসব সমস্যার মোকাবিলা করেছিলেন, একজন প্রকৃত নেতাকেও একই সমস্যার মোকাবিলা করতে হয়। কেউ যখন বুঝতে পারেন, তিনি প্রকৃত অর্থেই নেতা। তিনি নেতা ও নেতৃত্বের সব গুণের অধিকারী এবং জনগণের কল্যাণের জন্য যথার্থ কাজের উপযোগী ব্যক্তি। কিন্তু তিনি বিপুল ছদ্ম নেতাদের দ্বারা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বেন। অন্যদিকে তিনিই যে আসলে প্রকৃত বা সত্য নেতা তা-ই বা প্রমাণ করবেন কীভাবে-এটাও একটা বড় সমস্যা। আর এ ক্ষেত্রে সক্রেটিসের পদ্ধতি এখনো বেশ কার্যকরী। আর সেই পদ্ধতি হলো তাকে সবকিছুর ওপরে স্থান দিতে হবে সত্যকে। তিনি সাময়িকভাবে পরাজিত হতে পারেন, কিন্তু তার ধারণ করা সত্য কখনো পরাজিত হবে না। ফলে নিজের ব্যক্তি যোগ্যতার নিরিখে নয়, বরং তাকে সেরা হতে হবে সত্যের মাপকাঠিতে এবং চারপাশের ছদ্ম নেতা বা নেতৃত্বকে এ সত্যের বিচারে উপনীত করতে হবে বা চ্যালেঞ্জর মুখে ফেলতে হবে। এ পরীক্ষায় ছদ্ম নেতাগুলো ছিটকে পড়লে প্রকৃত নেতার পক্ষে সহজেই নিজের জরুরতকে হাজির করা সম্ভব হবে। কেন না মানুষের জীবনে সব কিছুর চেয়ে বেশি প্রয়োজন সত্যের।

খ.

‘আমার বিশ্বাস হাতেগোনা দু-একজন অ্যাথেনীয়র মধ্যে আমি একজন সম্ভবত একমাত্র অ্যাথেনীয় যে, সত্যিকার রাজনীতি চর্চা করে এবং সমকালের লোকজনদের মধ্যে আমিই সত্যিকারের রাষ্ট্রনায়ক।’- সক্রেটিস।

(গর্জিয়াস। অনুবাদ : আমিনুল ইসলাম ভুইয়া, প্রকাশক : পাঠক সমাবেশ, ঢাকা)

সারা জীবন কঠিন দরিদ্রতার সঙ্গে লড়তে হয়েছে সক্রেটিসকে। সমৃদ্ধ অ্যাথেন্সের পথে পথে ঘুরে বেড়ানো মলিন পোশাক আর নগ্নপায়ের এ দার্শনিক নিজেকে প্রকৃত রাষ্ট্রনায়ক বলছেন! নগরীর প্রচলিত আইনও তিনি মেনেই চলতেন। তিনি অ্যাথেনীয় গণতন্ত্রের হুবহু পক্ষে ছিলেন এমন কথা যেমন বলা যায় না, আবার তার জীবদ্দশায় অ্যাথেন্সে যখন স্বৈরশাসন কায়েম হয়েছিল সেটার পক্ষে ছিলেন তাও বলা যায় না। বরং তিনি তার সময়ের অ্যাথেন্সের জ্ঞানগত উন্নতি সাধনের চেষ্টায় নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন। তিনি যে বিচারের নামে অবিচারের কবলে পড়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত হলেন তা তথাকথিত গণতান্ত্রিক আইনের মাধ্যমেই কার্যকর করা হয়েছিল। ৫০০ জন জুরির ভোটে এ রায় নির্ধারিত হয়েছিল। যার মধ্যে অনেকেই সক্রেটিসের অনুসারী ছিলেন। অনেক ছদ্ম চিন্তক তখন সক্রেটিসের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন এবং তাদের সংখ্যাই ছিল বেশি। সক্রেটিস দেখেছিলেন, প্রকৃত সদ্গুণ ও সত্যকে পাশ কাটিয়ে যে ধরনের শাসননীতি চালু করা হয়েছে তা গণতন্ত্র বা স্বৈরতন্ত্র বা অভিজাত শাসনতন্ত্র যাই হোক না কেন, তাতে নাগরিকদের কোনো কল্যাণ হবে না। আত্মার উন্নতিকে অবজ্ঞা করে নগরীর উন্নয়নের যে নীতি নেওয়া হয়েছে, তাতে কাজের কাজ কিছু হবে না। মৃত্যুর আগে তিনি জবানবন্দিতে বলেন,

‘সারাজীবন আমি চুপ থাকিনি। অধিকাংশ মানুষ যেসব জিনিস নিয়ে মাথা ঘামায়-অর্থকড়ি, সহায়-সম্পত্তি বানানো, সামরিক পদ লাভ, বক্তৃতায় নাম কামানো, রাজনৈতিক পদ দখল করা, ষড়যন্ত্র আর দলবাজিতে অংশগ্রহণ করা-এসব আমি অবহেলা করেছি। তাই আমি এমন পথে হাঁটিনি, যাতে আমার নিজের কোনো উপকার হবে না, আপনাদেরও হবে না; বরং প্রত্যেকের দুয়ারে ব্যক্তিগতভাবে উপস্থিত হয়ে আমি আপনাদের সেবা করার চেষ্টা করেছি। আমার দৃষ্টিতে যে সেবা সবার জন্য সবচেয়ে সেরা সেবা তাই-ই করার চেষ্টা করেছি। আমি আপনাদের বোঝানোর চেষ্টা করেছি, কেউ যেন কেবল নিজের বিত্তবৈভব নিয়ে মাথা না ঘামায়, নিজের প্রকৃত উৎকর্ষ ও জ্ঞানার্জনের চেষ্টা করে নিজের পরিচর্যা করে। নগরীর সম্পদের কথা চিন্তা না করেই খোদ নগরীর পরিচর্যা করে।’ (সক্রেটিসের জবানবন্দি, অনুবাদ, আমিনুল ইসলাম ভুইয়া)

এ বক্তব্য থেকে সক্রেটিসীয় রাজনীতির একটা ধারণা পাওয়া যায়। এ জন্যই তিনি নিজেকে রাষ্ট্রনায়ক বলছেন। তিনি সমাজের প্রতিটি মানুষের সবচেয়ে জরুরি যে জ্ঞানগত উন্নতি করা-সেই দিকে মনোযোগ দিয়েছেন। এবং নিজের জীবন দিয়ে সেই কাজ করে গেছেন। তার সময়ে অ্যাথেন্স গণতন্ত্র ও আইনের শাসনের এক গৌরবজনক সমৃদ্ধিতে পৌঁছেছিল। এবং এটা নিয়ে নগরের বাসিন্দাদের গর্বেরও সীমা ছিল না। কিন্তু তিনি দেখছেন এ গণতন্ত্রের মধ্যে ফাঁক রয়ে গেছে। আর সেই গলদ কাটিয়ে উঠতে হলে দরকার জ্ঞানের সাধনা। এবং যেই ধরনের ছদ্ম/নকল জ্ঞানের গর্বে অ্যাথেন্স ভাসছে তাকে চ্যালেঞ্জ করার জন্য তিনি প্রতিষ্ঠিত সব মূল্যবোধকে পরীক্ষা করার এক অভিনব পদ্ধতি গ্রহণ করলেন। এ পদ্ধতিকে এলেংকাস বা খণ্ডননীতি বলা হয়। তিনি নগরীর সেরা রাজনীতিবিদ, দার্শনিক ও সাধারণ নাগরিক, শ্রমিক এমনকি দাসদের সঙ্গেও সংলাপে বসেন। এসব সংলাপে আমরা দেখতে পাই একটি বিষয়ের প্রতিষ্ঠিত যে সংজ্ঞা, মত বা জ্ঞান জনগণ পোষণ করেন তা প্রকৃতই ‘সত্য’ জ্ঞান কিনা। এর মধ্যে কোনো সত্য আছে কিনা তা তিনি খতিয়ে দেখতে চান। এমন না যে তিনি দাবি করছেন, তিনি সেসব বিষয়ের সত্যজ্ঞান রাখেন বা জানেন। তিনি যেসব সংলাপে এসব বিষয়ের সমাধান দিয়েছেন এমনও নয়। তিনি কার্যকরভাবে, সংলাপে খণ্ডন পদ্ধতির যুক্তিশীল প্রয়োগের মাধ্যমে এসব বিষয়ের ব্যাপারে প্রশ্ন তুলেছেন। আমরা যা নিশ্চিতভাবে জানি সেই জানার, সেই নিশ্চিত জ্ঞানের সত্যতার যাচাই করে দেখতে চেয়েছেন। এবং সবাইকে সঙ্গে নিয়ে প্রকৃত ও সত্য জ্ঞানে পৌঁছানো যায় কিনা সেই চেষ্টা করেছেন। নগরীর সবাইকে তিনি প্রকৃত জ্ঞানের আলোকে নিজেকে ও সমাজকে উন্নত করার কাজে আহ্বান করেছেন। এটাই তার রাজনৈতিক প্রক্রিয়া। এ জন্যই তিনি নিজেকে প্রকৃত রাষ্ট্রনায়ক বলছেন।

গ.

‘অপরীক্ষিত জীবনযাপন যোগ্য নয়’-সেক্রেটিস।

সক্রেটিসের জবানবন্দির এ বাক্যটি আজ বহুল পরিচিত। অনেক জায়গায় কোটেশন আকারে ব্যবহার করা হয়। কিন্তু একজন নেতার সবচেয়ে বেশি এ পরীক্ষার বা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হয় বলে মনে হয়। প্রতিটি মানুষকেই জীবনের বিভিন্ন ধাপে বিভিন্ন রকম পরীক্ষার মুখোমুখি হতে হয়। নেতার জন্য পরীক্ষা যদিও একটা স্বাভাবিক বিষয়। কিন্তু সক্রেটিস এ পরীক্ষিত জীবনকেই আদর্শ জীবন মনে করেন। এবং অপরীক্ষিত জীবনযাপন কারা যাবে, সেটা যাপনযোগ্য নয় বলে মন্তব্য করেন। তার মানে নীতিগতভাবে আমাদের পরীক্ষিত জীবন বেছে নিতে হবে। চ্যালেঞ্জহীন, মসৃণ জীবনের জন্য বিভিন্ন কৌশল শেখানোর জন্য চারদিকে মোটিভেশনাল গুরুদের যে নসিহত শুনি সক্রেটিস তার বিপরীতে অবস্থান নেন। মোটিভেশনাল গুরুদের মূল কাজ হলো, কৌশল শেখানো যা কোনো না কোনোভাবে কোনো না কোনো সত্যের নকল। আর সক্রেটিসের নীতি হলো, সত্য নীতির শিক্ষা। আর এ শিক্ষার পথ কঠিন। যে সত্য কথা বলেন, তার চেয়ে অপ্রিয় আর কে? প্লেটোর এ বাক্যও বহুল পরিচিত।

এখন আমরা দেখি নেতারা সবচেয়ে বেশি সময় ব্যয় করেন কৌশলের পেছনে। কারণ কৌশল প্রয়োগ করে কঠিন পরীক্ষা এড়িয়ে যাওয়ার পদ্ধতিই যেন রাজনীতির শিল্প হয়ে উঠেছে। কিন্তু সক্রেটিসের শিক্ষা ঠিক উল্টা। কৌশল নয়, নীতির আলোকে চলতে হবে। আর এতে স্বাভাবিকভাবেই কঠিন পরীক্ষার মধ্যে পড়তে হবে। এ পরীক্ষার মধ্যে পড়াই হবে জীবনের চাওয়া, সাধনা। পরীক্ষা থেকে বেঁচে যাওয়ার নীতি নয় বরং পরীক্ষিত জীবনের নীতিই অবলম্বন করতে বলেন তিনি। কেন না অপরীক্ষিত জীবনযাপনযোগ্য নয়।

ঘ.

‘অন্যায়কারী এবং অন্যায়ের শিকার হওয়া মানুষ পরস্পরের বন্ধু হতে পারে না’-সক্রেটিস।

‘লাইসিস’ নামক প্লেটোর রচিত সংলাপটিতে সক্রেটিস এ উক্তি করেন। এখানে বন্ধুত্ব নিয়ে মূলত কথাবার্তা শুরু হয়। এবং সক্রেটিস এখানে বন্ধুত্ব বলতে কী বোঝায় সেটার কোনো চূড়ান্ত মীমাংসায় পৌঁছাননি; কিন্তু প্রতিটি মানুষের জীবনে বন্ধুত্বের প্রয়োজন এবং ক্ষমতাধর, রাষ্ট্রপরিচালকদের আরও বেশি প্রয়োজন-এমন মতামত দিয়েছেন তিনি। সক্রেটিসের বন্ধুত্বের ধারণার মূল কথা হলো, সদ্গুণের সঙ্গে সদ্গুণের বন্ধুত্ব। কোনো অবস্থাতেই অন্যায়ের সঙ্গে অন্যায়ের বন্ধুত্ব হতে পারে না। কারণ, অন্যায়কারী ও অন্যায়ের শিকার পরস্পরের বন্ধু হতে পারে না। তাদের মধ্যে প্রয়োজনের জন্য, কোনো কিছু হাসিল করার জন্য সাময়িক সখ্য বা ঐক্য হতে পারে, কিন্তু বন্ধুত্ব হতে পারে না। কারণ সক্রেটিসের বিবেচনায় বন্ধুত্ব এমন একটি সদ্গুণ, যা অর্জন করতে হয়।

সক্রেটিস ব্যবহারিক নীতি-দার্শনিক হিসাবে আরও একটি বিষয়ের দিকে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। তা হলো, প্রতিশোধ গ্রহণের নীতি। একজন নেতার জন্য বা রাষ্ট্রপরিচালনার ব্যাপারে এ প্রতিশোধ গ্রহণের প্রশ্নটি বারবারই ফিরে ফিরে আসে। এ বিষয়ে নেতাকে সিদ্ধান্ত নিতে হয়। কারণ যে কোনো নেতাকেই শত্রু-মিত্রের নীতির মীমাংসার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। প্রতিশোধ গ্রহণের বেলায় সক্রেটিসীয় নীতি তার অন্যতম শিষ্য ক্রিতোর সঙ্গে আলাপের সময় ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন, ‘বেঁচে থাকা গুরুত্বপূর্ণ নয়, সত্যিকারে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, ভালোভাবে বাঁচা। অন্যায় কাজ করা কোনো অবস্থাতেই ভালো বা সম্মানজনক হতে পারে না। অন্যায় কাজ সব সময়ই মন্দ ও অসম্মানজনক। কোনো মানুষের ওপর অন্যায় করা হলে, তাকে আঘাত করা হলে, শত প্ররোচনা সত্ত্বেও এর পাল্টাটি করা যাবে না।’

এ নীতি সেই সময়ের গ্রিসের প্রচলতি নিয়মের বিরোধী। কিন্তু এ নীতি গ্রহণের মূলে সক্রেটিসের এ ধারণা কাজ করছে, যে কোনো মানুষই মূলগত বা মৌলিকভাবে অন্যায়কারী না। অজ্ঞানতাই মানুষকে অন্যায়ের দিকে নিয়ে যায়। তাই সত্য জ্ঞানের উন্মেষ ঘটাতে পারলেই মানুষ অন্যায়ের ধারা থেকে ফিরে আসবে। এবং তিনি সেই কাজেই সারা জীবন ব্যয় করেছেন।

নেলসন ম্যান্ডেলাসহ প্রতিশোধ গ্রহণ না করার এ নীতি অনেক নেতাকে অনুপ্রাণিত করেছে। অনেকেই প্রতিশোধ গ্রহণের নীতিকে প্রকৃত পথ মনে করেন নাই। মহাত্মা গান্ধীর বিখ্যাত উক্তি -‘চোখের বদলে চোখ নেওয়ার নীতি পুরো দুনিয়াকে অন্ধ করে ফেলে’-এখানে সেক্রটিসীয় দর্শনের বলিষ্ঠ প্রয়োগ দেখতে পাওয়া যায়।

ঙ.

‘সদ্গুণই হলো জ্ঞান’-সক্রেটিস।

এটা সহজেই বুঝতে পারা যাচ্ছে সক্রেটিস দুনিয়ার যে কোনো সমস্যাকে জ্ঞানের সমস্যা মনে করতেন। ফলে প্রকৃত/সত্য জ্ঞানার্জনই সমস্যা সমাধানের কার্যকর পথ বলে মানতেন। এবার প্রশ্ন দেখা দেয় তাইলে, জ্ঞান কী?

সক্রেটিস দুই ধরনের জ্ঞানের কথা বলেছেন-দেখা যায়। এক. মানবীয় জ্ঞান, দুই. ঐশ্বরিক জ্ঞান। জ্ঞানের চূড়ান্ত হিসাবে তিনি যে ঐশ্বরিক জ্ঞানকে দেখেছেন, তা তিনি বিভিন্ন সংলাপে বলেছেন। এবং এটাও বলেছেন, মানুষের পক্ষে সেই জ্ঞান অর্জন করা সম্ভব নয়। তবে মানবীয় বা মানুষের পক্ষে অর্জনযোগ্য যে জ্ঞান তাকে তিনি সদ্গুণ বলেই চিহ্নিত করেছেন বিভিন্ন আলাপে।

তাহলে যখন প্রশ্ন দেখা দেয়, মানুষ যখন অন্যায় করেন, তখনো অনেকে মনে করে তারা সঠিক কাজটিই করছেন। এটার সমাধান কী? সক্রেটিস মনে করেন, দুটি মন্দের মধ্যে একটি বেছে নিতে পারলে কেউ বড়টিকে বেছে নেবে না-বলে মত দেন সক্রেটিস। ছোট্ট সংলাপ মেনোতে তিনি এ বিষয়ে বলেন,

‘যারা মন্দকে মন্দ বলে চিহ্নিত করে না, তারাও মন্দকে কামনা করে না। বরং যা ভালো বলে মনে করে তাই কামনা করেন-যদিও আদতে তা মন্দ; যারা অজ্ঞতার কারণে খারাপ জিনিসকে ভালো বলে ধরে নেয়, তারা অবশ্যই অন্তর থেকে ভালো জিনিসই কামনা করেন।’

সক্রেটিস মনে করেন, যেহেতু মানুষ ভালো হতে চায়, উত্তম হতে চায়, ফলে উত্তম হওয়ার প্রতিবন্ধকতা দূর করাই হলো শিক্ষা ও দর্শনের উদ্দেশ্য। এবং এই একই উদ্দেশ্য রাজনীতিরও। নেতা এ নীতিকে গ্রহণ করে উত্তম হওয়ার বাধাগুলো দূর করার জন্য কাজ করতে পারেন। সে ক্ষেত্রে একটা বড় সমস্যা এ সময়ে দেখা যায়, তা হলো, মন্দ জিনিসকে ভালো বলে প্রচার ও প্রতিষ্ঠার ফলে মানুষ মন্দ জিনিসকে সত্যি সত্যিই ভালো বলে ধরে নিয়ে সেটাই কামনা করে। এর ফলে গোটা সমাজের নীতির ভিতই দাঁড়িয়ে যায় দুর্নীতির ওপরে। এ সময়ের রাজনীতির জন্য একজন প্রকৃত নেতার জন্য এটা একটা বড় চ্যালেঞ্জ। সত্যকে মিথ্যার সঙ্গে মিশিয়ে, মন্দকে ভালোর মোড়কে জড়িয়ে উপস্থাপনের এ প্রতিযোগিতার মধ্যে একজন নেতাকে এ ধরনের সক্রেটিসীয় অবস্থান নেওয়ার জন্য কঠোর মূল্য দিতে প্রস্তুত থাকতে হবে।

আর সদ্গুণই যেহেতু জ্ঞান; তাহলে, সদ্গুণ অর্জন জ্ঞানার্জনের পরিপূরক। একজন মানুষের জন্য তো বটেই, একজন নেতার জন্যও জ্ঞানার্জনের কোনো বিকল্প নেই। এবং এটার নীতি হলো সদ্গুণ অর্জন করা।

নেতৃত্বের সক্রেটিসীয় পদ্ধতি

স্বনামধন্য মার্কিন বিমান সেনা লেফটেনেন্ট কর্নেল অ্যারন টাকার ২০০৮ সালে ‘লিডারশিপ বাই সক্রেটিক মেথড’ নামে একটি প্রবন্ধ লিখেছেন। সেই প্রবন্ধে তিনি সক্রেটিসের যেসব মেথড আলোচনা করেছেন তার যে বিষয়গুলো নেতৃত্বের জন্য সক্রেটিসীয় শিক্ষা আকারে দেখা যেতে পারে, সংক্ষেপে সেই আলাপ করেই এ লেখা শেষ করছি।

সক্রেটিস তার অনুসারীদের প্রশ্ন করতেন। তাদের জানা বিষয়কে পদ্ধতিগত প্রশ্নের মাধ্যমে সংশয়ে ফেলে দিতেন। এবং তার পরে অনুসারীদের এ বিষয়ে আরও উন্নত চিন্তা কী হতে পারে, সেই দিকগুলো নিয়ে ভাবতে বাধ্য করতেন। এবং যে কোনো সমস্যার সমাধান তাদের কাছ থেকেই বের করে আনতে চেষ্টা করতেন প্রথমতো। এভাবে তিনি অনুসারীদের চিন্তার ক্ষমতাকে প্রসারিত করতে ভূমিকা রাখতেন। একজন নেতারও অনুসারীদের এভাবে প্রশিক্ষিত করে নেওয়ার প্রক্রিয়া অনুসরণ করা উচিত বলে এ চৌকস মার্কিন বিমান সেনা মনে করেন।

আধুনিক আমেরিকার অন্যতম রূপকার, দার্শনিক, বিজ্ঞানী ও রাজনৈতিক নেতা বেঞ্জামিন ফ্রাকলিন তার অটোবায়োগ্রাফিতে স্বীকার করেছেন, তার সফলতার পেছনে সক্রেটিসের চিন্তার অবদান রয়েছে। তিনি জটিল পরিস্থিতিতে আলাপের মাধ্যমে সমাধান বের করা এবং উত্তম পন্থা অবলম্বনের সুযোগ তৈরিতে সক্রেটিসের পদ্ধতিকে কার্যকর বলে মনে করেছেন। আমেরিকার সংবিধান প্রণয়নে এ পদ্ধতি তাকে ব্যাপকভাবে সাহায্য করেছিল বলে লিখেছেন।

আইনি সমস্যার সমাধানের কাজে সক্রেটিসের পদ্ধতি খুব কাজের। এ পদ্ধতি ব্যবহার করে ব্যক্তির ভেতরের সত্যকে বের করে আনা সম্ভব হয়। অন্যদিকে একজন নেতার জন্য এটা অনুসরণীয় হতে পারে যে, সক্রেটিস কীভাবে তার অনুসারীদের ভেতর থেকে উত্তম চিন্তাভাবনা বের করে আনতেন। তিনি কখনো প্রথাগত শিক্ষক ছিলেন না। তিনি স্বাভাবিকভাবে আলাপ শুরু করতেন। আলাপ করতে করতে তিনি অনুসারীকে এমনভাবে প্রশিক্ষিত ও জ্ঞানের প্রতি আগ্রহী করে তুলতেন, অনুসারীর নিজেকে কখনো ছাত্র মনে হতো না। একজন নেতাও এ পদ্ধতিতে তার অনুসারীদের প্রশিক্ষিত করতে পারেন।

অন্যদিকে সম্মিলিত সংলাপের পাশাপাশি একজন একজন করে মুখোমুখি কথা বলার মাধ্যমে কার্যকর কর্মপরিকল্পনা প্রণয়নের সুযোগ তৈরি হয়। এবং সবার কাছ থেকে পাওয়া সেরা মতামতগুলোকে নিয়ে আবার সংলাপের মাধ্যমে আরও অগ্রসর অবস্থানে যাওয়া সম্ভব হয়-সক্রেটিসীয় পদ্ধতি ব্যবহার করে।

সক্রেটিসীয় নেতৃত্বের ধারণায় এ শিক্ষাটা মনে রাখা জরুরি যে, নেতৃত্ব হলো মানুষকে দিয়ে এমন কিছু করানো, যা আপনি চান এবং তিনিও (অনুসারীরা) সেটাই করতে চান। এবং একজন নেতা তখনই সফল-তিনি যেটা করতে চান সেটা যখন একইভাবে তার আশপাশের লোকজনও করতে চাইবেন। এবং সক্রেটিসীয় পদ্ধতি এখানে খুবই কার্যকর। সক্রেটিস যা করতে চাইতেন গোটা অ্যাথেন্সের জ্ঞানপিপাসু তরুণরা তখন তাই করতে চাইতেন। এবং সক্রেটিস তাদের সামনে হাজির হতেন একজন জ্ঞানানুরাগী হিসাবে। ফলে একজন নেতাও যদি অনুসারীদের কাছে মাস্টার বা মোড়ল হিসাবে হাজির না হয়ে সক্রেটিসীয় সংলাপের মতো সহজভাবে নিজেকে হাজির করেন, তখন অনুসারীরা সহজেই নেতাকে বুঝতে পারবেন। নেতাকে যদি জটিল মনে করেন, অনুসারীদের মনে বিশ্বাস তৈরি হওয়ার বদলে সন্দেহ তৈরি হবে। সক্রেটিসীয় পদ্ধতি অনুসারীদের সঙ্গে নেতার নৈকট্য নিবিড় করতে সাহায্য করে। আব্রাহাম লিঙ্কনকে সক্রেটিসীয় পদ্ধতির অনুসারী একজন নেতা হিসাবে গবেষকরা চিহ্নিত করে থাকেন। তিনি তার সহকর্মীদের সঙ্গে সক্রেটিসের মতো আচরণ করতেন। তাদের কাছ থেকে সরাসরি সেরাটা বের করে আনতে চাইতেন-এমনভাবে যেন কাজটা তারাই করছে। তিনি তেমন গুরুত্বপূর্ণ কিছু করছেন না। সক্রেটিসও এমনভাবেই হাজির হতেন। কখনো শিক্ষকের মতো না। যেন সামান্য সূত্রধর তিনি।

আরও একটি কার্যকরী সক্রেটিসীয় পদ্ধতি হলো, কোনো বিষয়ে অনুসারীদের চিন্তামূলক সহমত তৈরি করা। ঐকমত্যের চেয়ে শক্তিশালী সম্পর্ক খুব কমই আছে। চিন্তার ঐক্য নেতাকে দ্রুতই শক্ত অবস্থান তৈরি করতে সাহায্য করে। এবং সক্রেটিস শূন্য হাতে খালি পেটে এ ঐক্য তৈরি করতে পেরেছিলেন তার অনুসারীদের মধ্যে। যার ফলে শাসকশ্রেণিও ভড়কে গিয়েছিল।

যে কোনো নেতার জন্য বিখ্যাত দার্শনিক মেকিয়াভেলির প্রিন্স গ্রন্থটি যুগযুগ ধরে অতি জরুরি পাঠ্য। মেকিয়াভেলি সক্রেটিসীয় নীতির অনুসরণের পরামর্শ নিয়েছেন রাষ্ট্রনায়ককে। সরাসরি নেতার সঙ্গে সংলাপের মাধ্যমে কার্যক্রম পরিচালনার গুরুত্ব নিয়ে তিনি বিস্তারিত লিখেছেন।

এখন কথা হলো সক্রেটিসের শিক্ষা কি মানুষ নিয়েছেন। সক্রেটিসের সময়েই একদল সফিস্ট/ছদ্ম জ্ঞানী যাদের বিরুদ্ধে সক্রেটিসের মূল সংগ্রাম শুরু হয়েছিল তারা সক্রেটিসেরই চিন্তার তালিমে অংশগ্রহণও করত শুধু নিজেদের খ্যাতি ও বাজার তৈরি করার জন্য, তারা সক্রেটিসকে অনুসরণ করত না কেবল নকল করত। কারণ সক্রেটিসের পথ ছিল কঠিন। সত্যের পথে আসার জন্য সক্রেটিসের পরামর্শ হলো, ‘আপনি যদি সত্যের দিকে আসতে চান তা হলে, আপনার নিজেকেই আসতে হবে, নিজের জন্যই আসতে হবে।’

যদিও সক্রেটিস একটি কাজ ভালোভাবেই করে গিয়েছেন। সেটা হলো, যেনতেনভাবে জ্ঞান ফলিয়ে দার্শনিক হওয়ার পথ বন্ধ করে দিয়েছেন। তাদের তিনি সফিস্ট বা ছদ্ম চিন্তক হিসাবে চিহ্নিত করার কাজটি ভালো মতোই করেছেন। সক্রেটিস দর্শনকে যে স্তরে নিয়ে গেছেন, তাতে প্রকৃত দার্শনিক হতে হলে, সদ্গুণ, সত্য-জ্ঞান-এর ব্যবহারিক চর্চায় শামিল হতে হবে। শুধু জ্ঞানগত কচকচানির কোনো স্থান সেখানে নাই। এবং কঠিন, পরীক্ষিত জীবনযাপন করেই তা অর্জন করতে হয়। সেই দিক থেকে সক্রেটিসীয় ধারণার কাছাকাছি বা বিচারে দুনিয়াতে দার্শনিকের সংখ্যা হাতেগোনা।

যা হোক, গ্রিক দর্শনের ধারাকে পশ্চিমা দর্শন এবং এটাকে পৃথিবীর দর্শন আকারে চর্চার ফলে অন্য সংস্কৃতি ও সভ্যতা এবং চিন্তার ইতিহাসের দিকে আমরা নজর দিতে পারিনি। ফলে সক্রেটিসের জীবনাবসানের এ করুণ পরিণতিকে দর্শনের শহিদ হিসাবে আখ্যায়িত করে যেভাবে পশ্চিমা দর্শনের ইতিহাসচর্চা শুরু হয়, এটা এখন পশ্চিমা দর্শনেরই সমস্যা হয়ে উঠেছে। তার পরও এটার জন্য সক্রেটিসকে খুব একটা দায়ী করা চলে না। সক্রেটিসের কাছে ব্যক্তি নয়, সত্যই অমর। আর দর্শনের কাজ হলো এ সত্যের কাছে পৌঁছানোর পথকে পরখ করে দেখা। আপনি যাই হোন, নেতা বা কর্মী বা সাধারণ আমজনতা-এ যাত্রায় সক্রেটিস চির দিন আমাদের সঙ্গী।

Advertisements