শিক্ষার্থীদের বাকি দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু দোকানি নিঃস্ব
Advertisements

বাংলাদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের দোকানে অনেক শিক্ষার্থী বাকিতে কেনাকাটা করে বা খেয়ে টাকা না দেয়ায় অনেকে ভয়ানক বিপদে পড়ছেন৷ পুঁজি শেষ হয়ে যাওয়ায় নিরুপায় হয়ে ব্যবসা বন্ধ করতে বাধ্য হওয়ার মতো ঘটনাও ঘটেছে৷

সম্প্রতি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অলিম উদ্দীন নামে একজন দোকানি ৩৪ বছর ব্যবসা করার পর নিঃস্ব হয়ে শূন্য হাতে গ্রামে ফিরে গেছেন৷ আলোড়ন সৃষ্টি করা এ খবরের সূত্র ধরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের দোকানগুলোর অবস্থা জানার চেষ্টা করেছে৷ তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ দোকান মালিকেরই দাবি- পণ্য বিক্রি করে টাকা না পাওয়ায় তাদের অবস্থা শোচনীয়!

করোনা মহামারির পর অনেক দোকানিই আর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ফেরেননি৷ দোকান খোলার মতো পুঁজি নেই তাদের৷ করোনার আগে শিক্ষার্থীদের কাছে যে টাকা পাওনা হয়েছিল সেই টাকাও পাচ্ছেন না৷ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আমীর আলী হলের সামনে ৪১ বছর ধরে সোহেল স্টোর নামে একটি দোকান চালাচ্ছেন সাইফুল ইসলাম৷ তিনি বলেন, ‘‘আমীর আলী, লতিফ ও শাহ মাখদুম হল চত্ত¡রে ২০টির মতো দোকান ছিল৷ করোনার পর মাত্র ৬টি দোকান তারা খুলেছেন৷ অন্যরা পুঁজির অভাবে দোকানগুলো খুলতে পারছেন না৷’’

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ৩৪ বছর ধরে ‘প্রয়াস’ নামে একটি খাবারের হোটেল চালিয়েছেন অলিম উদ্দীন৷ গত ৩১ অক্টোবর তিনি দোকান বিক্রি করে দিয়ে ক্যাম্পাস ছেড়েছেন৷ বর্তমানে গ্রামের বাড়ি বরিশালের মেহেন্দীগঞ্জে আছেন৷ তার দোকানটি যিনি কিনেছেন তিনি এখন নাম দিয়েছেন ‘শাহজালাল হোটেল’৷

৩৪ বছরের ব্যবসা বন্ধ করে বাড়ি ফেরার কারণ জানতে চাইলে টেলিফোনে অলিম উদ্দীন বলেন, ‘‘করোনার আগেই বাকি পড়েছিল ৬ লাখ টাকার মতো৷ মালিকের কাছে অগ্রিম হিসেবে দেওয়া দুই লাখ টাকা ফেরত চাইলে তিনি দুই বছরের ভাড়া হিসেবে ৬৯ হাজার টাকা কেটে ১ লাখ ৩১ হাজার টাকা ফেরত দেন৷ পরে আবার ৩১ হাজার টাকা কেটে রাখেন৷ বাকি এক লাখ টাকা দিয়ে আর দোকান চালাতে পারিনি, কারণ, আমার কাছেও মানুষ দেড় লাখ টাকার মতো পাবে৷ যাদের কাছে বাকি আছে চাইলেও তারা টাকা দিচ্ছে না৷’’

বাকি কারা বেশি খেয়েছে জানতে চাইলে অলিম উদ্দীন বলেন, ‘‘সাধারণ ছাত্রদের কাছে কিছু বাকি আছে৷ কিন্তু বেশি বাকি হল ছাত্রনেতাদের সঙ্গে যারা থাকে, জুনিয়র নেতা, তাদের কাছে৷ এখন বাড়িতে আসার পর ৩০ হাজার টাকার মতো বিকাশের মাধ্যমে পেয়েছি৷ অনেকেই ফোন করছে৷ কিন্তু টাকা তেমন আসছে না৷’’

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আলাউল হলের সাবেক ডাইনিং ম্যানেজার ইকবাল হোসেন৷ ৫ বছর তিনি ডাইনিং চালিয়েছেন৷ শিক্ষার্থীদের কাছে তার পাওনা ১ লাখ ৬০ হাজার টাকা৷ ইকবাল হোসেন বলেন, ‘‘বারবার তাগাদা দেওয়ার পরও টাকা উদ্ধার করতে না পেরে কয়েকদিন আগে ডাইনিংয়ের দায়িত্ব ছেড়ে দিয়েছি৷’’ এ এফ রহমান হলের ক্যাফেটোরিয়ার ম্যানেজার হেলাল উদ্দিন গত ২০ অক্টোবর ক্যাশ টেবিলের উপর একটি সাদা কাগজে লিখে রেখেছিলেন ‘দয়া করে সকলে নগদ খান, আমি বাজার করতে পারি না’৷ হেলাল উদ্দিন জানালেন, ‘‘দুই দিন কাগজটি রেখেছিলাম৷ সবাই অনুরোধ করলো ওটা তুলে ফেলতে, তাই পরে সরিয়ে ফেলেছি৷ আসলে বাকি এত বেশি হয়ে গেছে যে, দৈনিক বাজার করাটাই কঠিন হয়ে গেছে৷’’ গত জানুয়ারি মাসে কলা অনুষদের পাশে ‘নাজিম স্টোরে’র মালিক নাজিম উদ্দিন নিজের ফেসবুক প্রোফাইলে লিখেছিলেন, ‘‘বাকির কারণে ব্যবসা করা অসম্ভব হয়ে পড়েছে আমার৷’’

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ব্যবসায়ী বহুমুখী সমবায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. আখতার হোসেন বলেন, ‘‘আমার একটা মুদি দোকান আছে৷ আমার নিজের বাকিও ৫-৬ লাখ টাকার কম না৷ শুধু শিক্ষার্থী না, শিক্ষক-কর্মকর্তা ও কর্মচারীরাও আমার কাছ থেকে বাকি নেন৷ শিক্ষক-কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা যেহেতু এখানে থাকেন, ফলে তাদের টাকা উদ্ধার হবে৷ কিন্তু শিক্ষার্থীদের কাছে বাকির কারণে ক্যাম্পাসে দোকান চালানো দুরূহ হয়ে পড়ছে৷ বাকির ভারে অলি ভাইকে শেষ পর্যন্ত ক্যাম্পাস ছেড়েই চলে যেতে হয়েছে৷ তার মতো আরো ৫-৬ জন আমাকে জানিয়েছেন, তারাও আর চালাতে পারছেন না৷ দোকান বন্ধ করে দেবেন৷’’

গত বছরের মার্চে বাকিতে সিগারেট না দেওয়ায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিবহণ মার্কেটের ক্যাম্পাস ফুড কর্নারের মালিক শাহ আলমকে মারধর করেন ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতা-কর্মী৷ ক্যাম্পাসে বাকির অবস্থা কী জানতে চাইলে সোহেল স্টোরের মালিক সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘‘করোনার পর জিনিসপত্রের দাম অনেক বেড়েছে৷ ছাত্রদের কাছে টাকা না থাকায় বিক্রিও কমে গেছে৷ তার মধ্যে যদি ফাও চলে যায়, তাহলে তো দোকানদারি করাই মুশকিল৷ এমনিতে বাকির ভারে জর্জরিত৷ ফলে দোকান চালানো কঠিন হয়ে যাচ্ছে৷’’

রাজশাহী শ্বিবিদ্যালয়ের মাদার বখশ ও সোহরাওয়ার্দী হলের মাঝখানে ১৪ বছর ধরে হোটেল চালান মো. হাবিবুর রহমান৷ ব্যবসার অবস্থা জানাতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘‘আমার দোকানে কোনো বাকির খাতা নেই৷ আমি নগদে বিক্রি করি৷ আর যে বাকির কথা বলে সেটা আমি ফাও হিসেবে ছেড়ে দেই৷ ছাত্রনেতারা তো জিলাপি-সিঙ্গাড়া খেয়ে চলে যায়, সেটা আমি ফাও হিসেবেই ধরে নেই৷ কারণ, এসব বাকি কখনও উদ্ধার হয় না৷ ফলে আমি বাকি বলে কিছু রাখিনি৷” কেমন ফাও দিয়ে হয় জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘সেটা তো দিতেই হয়, খুব বেশি না৷ দোকানদারি করে চালানটা বাঁচে আরকি৷ সবারই এখন পুঁজির সমস্যা৷ অধিকাংশ দোকারদারই করোনার পর আর ক্যাম্পানে ফেরেনি৷’’

বাকিতে খেয়ে টাকা না দেয়ার প্রবণতা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও কি একই রকম? মধুর ক্যান্টিনের মালিক অরুন দে তার অবস্থা জানালেন এভাবে, ‘‘এই মুহূর্তে আমার বাকি ৫০ হাজার টাকার মতো৷ সবসময় এমনই থাকে৷ কিন্তু আমাদের কাছে বাকি রেখে ক্যাম্পাস ছেড়েছে বহু ছাত্র, ছাত্রনেতা৷ তাদের অনেকেই এখন বড় অবস্থানে আছে৷ অনেকে ফিরে এসেও টাকা দিয়ে গেছে৷ এভাবেই আমরা যুগ যুগ ধরে ব্যবসা করে যাচ্ছি৷ বাকি আমাদের জন্য খুব একটা সমস্যা না৷ কিছু বাকি, কিছু ফাও এসব মিলেই আমরা ব্যবসা করি৷ আমাদের মূল সমস্যা হলো, মধুর ক্যান্টিনের সংস্কার করা প্রয়োজন৷ বারবার বলার পরও প্রশাসন এটা করে দিচ্ছে না৷’’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একাত্তর হলের সাবেক ক্যান্টিন ম্যানেজার মো. সোহেল৷ ৫ বছর ক্যান্টিন চালানোর পর গত মাসে ছেড়ে দিয়েছেন৷ সোহেল বলেন, ‘‘২ লাখ ৭৬ হাজার টাকা আমার বাকি৷ ১২ লাখ টাকা পুঁজি নিয়ে ব্যবসা শুরু করেছিলাম৷ এখন শূন্য হাতে ক্যান্টিনের দায়িত্ব ছেড়ে দিলাম৷ কারণ, আর বাজার করে খাওয়াতে পারছিলাম না৷ যাদের কাছে টাকা পাবো বারবার তাদের বলেছি, কিন্তু টাকা দেয়নি৷’’ কাদের কাছে এই বাকি? সোহেল বলেন, ‘‘সাধারণ ছাত্রও আছে, ছাত্র নেতাও আছে৷ সবচেয়ে বেশি হলো যারা নেতাদের পেছনে পেছনে ঘোরে তাদের কাছে৷ ওরা নিজেদের খুব পাওয়ারফুল মনে করে৷ অনেকের কাছেই বিষয়টি বলেছি, কিন্তু কেউ সমাধান দেয়নি৷’’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জসিম উদ্দিন হলের সামনে ২০০৩ সাল থেকে দোকান চালান সোহেল মাহমুদ৷ তিনি বলেন, ‘‘আমার বাকি ৪০ হাজার টাকার মতো৷ গত ১৯ বছরে বাকি নিয়ে ক্যাম্পাস ছেড়ে গেছে বহু ছাত্র৷ সেই টাকার পরিমাণ ৪ লাখের কম হবে না৷ দোকান ভাড়া দিতে হয়, জিনিসপত্রের দামও বেশি৷ কিন্তু আমরা তো ছাত্রদের কাছ থেকে বেশি দাম নিতে পারি না৷ ফলে আমাদের পক্ষে দোকান চালানোই কঠিন হয়ে গেছে৷’’ ছাত্রনেতাদের সম্পর্কে জানতে চাইলে সোহেল বলেন, ‘‘আপনারা তো সবই বুঝতে পারেন কারা বেশি বাকি খায়৷ এসব বলে আবার কোন বিপদে পড়ি৷ তবে সবকিছু মিলিয়ে আমাদের দিন দিন দোকান চালানো কঠিন হয়ে যাচ্ছে৷’’

বাকিতে কেনাকাটা বা খাওয়া নতুন কোনো প্রবণতা নয়৷ তবে এখন বিষয়টি কেন কোনো কোনো দোকান মালিকের অস্তিত্বকেই বিপন্ন করছে? এ প্রসঙ্গে ডাকসুর সাবেক ভিপি ও বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সাবেক সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, ‘‘আমি ছাত্র রাজনীতির বিরুদ্ধে বলবো না৷ কিছু ছাত্রনেতার যদি নৈতিক অবক্ষয় হয় সেটা ভালো না৷ এখনও অনেক সংগঠনই আছে, যাদের নেতাদের বিরুদ্ধে আপনি কোনো অভিযোগ করতে পারবেন না৷ ছাত্র ইউনিয়নের কোনো নেতা কি কোনো দোকান থেকে বাকি খেয়েছে বা ফাও খেয়েছে সেটা বলতে পারবেন? পারবেন না৷ কেউ যদি এমনটা করে থাকে, সেটা ঠিক করেনি৷ আমাদের সময় এমন অভিযোগ কেউ করতে পারেনি৷’’

সূত্রঃ ডয়চে ভেলে

Advertisements