যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট যেই হোক
Advertisements

বর্হিবিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব নিয়ে দ্যা গার্ডিয়ান পত্রিকার মতামত বিভাগে পাকিস্তানি উপন্যাসিক মুহাম্মদ হানিফের লেখাটি প্রকাশিত হয়। ভাওয়াল বার্তার পাঠকদের জন্য বাংলায় অনুবাদ করেছেন ভাওয়াল বার্তার সহ সম্পাদক, জাহাংগীর আলম ।

হোয়াইট হাউজের সকল প্রতিনিধির অভিন্ন কাজ হলো, বর্হিবিশ্বে সন্ত্রাসবাদের নামে সর্বাত্মক লড়াই  জারি রাখা। আমাদের আমেরিকান বন্ধুগণ তাদের প্রেসিডেন্ট কে হবে এইটা নিয়ে খুবই উদ্বিগ্ন। মেয়াদের শেষ মাসে এসে ট্রাম্প যা কিছুই করুক না কেন, তাতে তার ফ্যাসিবাদী, পাগলাটে, উদ্ভট প্রেসিডেন্ট হিসেবে খ্যাতির কোন পরিবর্তন হওয়ার সুযোগ নেই।

যুক্তরাষ্ট্র শাসিত অঞ্চলের দীর্ঘকালের শোসিত নাগরিক হিসেবে, তাদেরকে মনে করিয়ে দিতে চাই যে, বিগত অর্ধ-শতাব্দী ধরে শোসিত গোষ্ঠীর কাছে ট্রাম্প অন্যান্যদের তুলনায় একটুও ভিন্ন ছিলেন না। আমেরিকানরা বলে থাকে, তারা ট্রাম্পের চেয়ে ভালো। তারা নিজেদেরকেও ট্রাম্পের চেয়ে ভালো বলেই দাবী করে। কিন্তু যে কেউ বিনা বাক্যে স্বীকার করে নেবেন যে, ট্রাম্পের পূর্বসুরীগণ কথা-বার্তা, চাল-চলন, পোশাক-আশাকে ট্রাম্পের চেয়ে অনেকটা এগিয়েই ছিলেন বটে। ট্যাক্স ফাঁকিতে তারা ট্রাম্পের মতো চতুর ছিলেন না।

আমেরিকানগণ প্রেসিডেন্ট হিসেবে সর্বদাই একজন মাস্তানকে পছন্দের শীর্ষে রেখেছে। সেসব মাস্তানকে যত্নকরে গড়ে তুলেছে বাকী বিশ্বের উপর অত্যাচারের স্ট্রীম-রোলার চালানোর জন্য। তারা মনে করতো, তাদেরকে ছাড়া বাকী বিশ্বই সন্ত্রাসবাদে ভরপুর। তাদের মধ্য থেকে সবচেয়ে মাস্তান লোকটিকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিয়োগ দিয়ে সারা বিশ্বে শোষণের কাজে নিয়োজিত করতো। একই সময়ে তারা চাইতো তাদের প্রেসিডেন্ট নিজেদের দেশে একজন, নম্র, ভদ্র, সদালাপি, স্যুটেড-বুটেড হয়ে থাকুন।
আমেরিকান প্রেসিডেন্টগণ বিশ্বব্যাপী ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ, লুট-পাট এমনচকি ধ্বংস করেছে বহু দেশ ও জনপথ যাদের নাম তারা আজও মুখে আনেনা। সারাবিশ্বের সকল মাফিয়াদেরকে “ক্যাম্প ডেভিড” – এ পুনর্বাসন করেছে। আর ট্রাম্প তাদেরকে ঘরে তুলেছেন।

নিক্সন ছিলেন আমার শৈশবের ১ম আমেরিকান প্রেসিডেন্ট। যিনি ওয়াটারগেট ঘটনার কারণে পদচ্যুত হন।

নিক্সন, যিনি বাংলাদেশী মানুষের উপর চালানো হত্যাযজ্ঞের উপর কড়া নজর রেখেছিলেন। উসকে দিচ্ছিলেন হানাদারদের কিন্তু শেষ করতে পারেননি। অপরজন চিলেন জিমি কার্টার। যার বদৌলতে তৎকালীন সময়ে মানবাধিকার টার্মটির ব্যাপক পরিচিতি ঘটে। জিমি কার্টার প্রেসিডেন্ট থাকা কালে আমার বাসস্থান পাকিস্তানে, একজন নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্রোকে একজন সেনা স্বৈরশাসক ফাঁসিতে ঝুলান। বিনিময়ে কার্টার জেনারেল জিয়াউল হককে নির্বাচিত করানোর জন্য বিলিয়ন ডলার প্রস্তাব করেন; যা ঐ স্বৈরশাসক প্রত্যাখ্যান করেন এবং চিনাবাদাম চাষী ছিলেন বলে কার্টারকে নিয়ে কৌতুক করেন।

তার পরই আসে বিচক্ষণ রোনাল্ড রেগানের যুগ। যিনি নিজেকে তথাকথিত মুক্ত বিশ্বের নেতা হিসেবে প্রমাণে প্রচুর অর্থ ব্যয় করেন। আর বিশ্বকে আরও মুক্ত করতে চিলির অগাস্টো পিনোচেট এবং পাকিস্তানের জিয়ার মতো স্বৈরশাসকদের পিছনে প্রচুর অর্থ ব্যয় করেন।

রেগান যখন আফগানিস্তানে মুজাহিদীনকে পৃষ্ঠপোষকতা দিতে শুরু করেন, তখন আমি ১১ বছরের কিশোর। আমার ছেলে এখন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্রাজুয়েশন সমাপ্ত করেছে। আর দুর্ভাগা আমেরিকান ৩য় প্রজন্মের শিশুরা এখনো একই দেশের বিরুদ্ধে লড়াই করছে এবং আপসের জন্য আলোচনা করছে।  যেখানে আফগানিস্তানের ৪র্থ প্রজন্ম অভিবাসন কেন্দ্রে দিনাতিপাত করছে আর মহিলারা এই বুঝি আমেরিকা শান্তি আলোচনায় সফল হলো বলে দিন গুনছে; স্বাধীন দেশের স্বপ্নে।

জর্জ বুশ সিনিয়র বাগদাদের আকাশকে তার আঁতশবাজিতে সজ্জিত  করে তুলেছিলেন। তিনি এক শাসক থেকে অর্থ নিয়েছিলেন আরেক শাসককে মুক্ত করতে এবং এর মধ্যে ইরাকী বিদ্রোহীদেরকে তৃতীয় স্বৈরশাসক সাদ্দাম হুসেনের দয়ায় রাখার আগে তাদেরকে তহবিল দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন।

আমরা কি বিল ক্লিনটনকে পছন্দ করতাম না? যিনি ছিলেন ট্রাম্পের ঠিক উল্টো, নম্র-ভদ্র, যাদুকরী, মিষ্টবাসী, যার সাথে মদের পেয়ালা ভাগাভাগীতে স্বাদ জাগতো যে কারোর। মি. ক্লিন্টন যখন মনিকা লুশাংকির সাথে সম্পর্কের কারণে অভিশংসনের শিকার হলেন, তখন ক্ষোভে তিনি আফগানিস্তান এবং সুদানের উপর ক্ষেপনাস্ত্র নিক্ষেপ করলেন।

আমেরিকানরা অবশ্যই জর্জ ডব্লিউ বুশকে বেশি ভালোবেসে থাকবে। সে মনে করতে বাকী বিশ্বের সাথে যুদ্ধ লাগিয়ে রাখাই আমেরিকান প্রেসিডেন্টের প্রদান কাজ। ঝাঁপিয়ে পড়লেন আফগানিস্তানে। ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর পর তিনি বুজতে পারলেন, তার পূর্বসুরীগণ এখানে তার জন্য তেমন কিছু রেখে যান নি। তিনি মনোযোগ দিলেন ইরাকে। যুদ্ধের এক আদর্শ ক্ষেত্র প্রস্তুত করলেন। স্থাপন করলেন গুয়ান্তানামো আর আবু গোয়াব নামক নরকীয় কারাগার। হাজার হাজার নিরীহ মানুষকে হত্যা করে নিজেকে বিজয়ী গোষণা করে ফিরে গেলেন নিজ দেশে। আমেরিকান একজন মধ্যমমণা প্রেসিডেন্ট ও একজন চরম গণহত্যাকারী। তারা মনে করতো, এটাই তাদের প্রধান কাজ।

বারাক ওবামা ছিলেন সাম্প্রতিককালের সবচেয়ে পছন্দের প্রেসিডেন্ট। এমন মানুষ যার সাথে মদের পেয়ালা শেযার করা যায়। যিনি ড্রোনটাকে বেশি পছন্দ করতেন। যার বিদেশনীতি লিবিয়াকে বিলুপ্ত করে দেয়। তার মেয়াদ শেষ কালে আমেরিকা প্রতিদিন ঘন্টায় গড়়ে প্রায় তিনটি করে বোমা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ফেলতো। যিনি ২০০৯ সালে শান্তিতে নোবেল পুরষ্কার লাভ করেন।
আমেরিকানরা হলো বিশ্বসেরা এন্টারটেইনার। কিন্তু খুব সহজেই অনীহা অনুভব করে বলে মনে হয়। আর উপন্যাসে প্রশান্তি খোঁজে পেতে চলে যান ধ্বংসযজ্ঞে প্রাণের সন্ধানে। ঘরে তারা পরিবর্তনের কথা বললেও আদৌ তাদের পরিবর্তনের কোন সুযোগ আছে কি?

ধরুণ, ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রকে খারাপ চিত্র দিয়েছেন, এটাকে একটু বেশিই সাদা বানিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্রের ভাষা খারাপ করেছেন, আচরণে বাজে উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন।
কিন্তু বিশ্বব্যাপী আমরা যারা সচেতন তাদের বিশ্বাস, ট্রাম্পের হেরে যাওয়াতেও আমেরিকার পরিবর্তন সহসা হচ্ছেনা। এটা কেবলই একটি মুখরোচক ভাষা।

মূলতঃ যুক্তরাষ্ট্রের প্রয়োজন একজন স্যুটেড-বুটেড প্রেসিডেন্ট যিনি হবেননা বর্ণবাদী। য়ুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট এমন এক নেতা যিনি তার কর্মীদের সন্ত্রাসবাদে লিপ্ত করে নিজ ঘরে ভালোবাসার শ্লোগাম তুলেন। আমেরিকাবাসী ট্রাম্পকে সড়াতে যা প্রয়োজন তাই করুন। দরজা বন্ধ করে চাবি ফেলে দিন মহাসমুদ্রে। আপনাদের বিশ্বাসমতো আমেরিকান অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে বদ্ধ পরিকর ব্যক্তিটিকেই প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচন করুন। কিন্তু তাকে আমাদেরকে বাঁচানোর জন্য পাঠাবেন না দয়া করে।

Advertisements