আধুনিক ও ধর্মীয় জ্ঞানে সমান পারদর্শী মুফতি কাজী মোহাম্মদ ইবরাহীম তার জ্ঞান ও ধর্মীয় আলোচনার মাধ্যমে ওয়াজ মাহফিল, সোশ্যাল মিডিয়া এবং গণমাধ্যমে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। তিনি গড়ে তুলেছেন হাজারো মক্তব ও আধুনিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। তবে তার এই ধর্মীয় ও সামাজিক কর্মকাণ্ডের কারণে আওয়ামী সরকারের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হন বরেণ্য এই আলেম।
মুফতি ইবরাহীমের প্রতিষ্ঠিত মক্তব ও আধুনিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়। তার স্বাভাবিক কাজে বাধা সৃষ্টি করা হয় এবং তাকে নিয়মিত গোয়েন্দা নজরদারিতে রাখা হয়।
গাড়িতে গুলি এবং চাপা দিয়ে মুফতি ইবরাহীমকে দুবার হত্যাচেষ্টা চালানো হয়। এরপরও তার ধর্মীয় তৎপরতা থামাতে না পেরে একপর্যায়ে রাতে বাসা থেকে বিনা অপরাধে তাকে আটক করা হয়। তার বিরুদ্ধে একে একে চারটি মামলা দেওয়া হয়। ডিবি অফিসে ধর্মেন্দু নামে এক হিন্দু কর্মকর্তা তাকে নির্মম নির্যাতন করেন। পাঁচ দিনের রিমান্ডসহ তিনি ১৬ মাস কারাগারের ফাঁসির সেলে বন্দি থাকেন।
ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের প্রেক্ষিতে আওয়ামী লীগ সরকার দেশত্যাগে বাধ্য হয়। মুফতি ইবরাহীম সেই সময় জুলুম-নির্যাতনের শিকার হন। তার প্রতিষ্ঠান ও পরিবারের সদস্যরা নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন। কারামুক্তির পরও তার জীবন স্বস্তিতে ছিল না। কিছুদিন আত্মগোপনে থাকার পর তিনি নীরবে দেশত্যাগে বাধ্য হন।
২০২৩ সালের রমজানে তিনি দেশত্যাগ করেন। প্রথমে সৌদি আরবে তিন মাস থাকার পর কাতারে এক বছর এবং দুবাইয়ে পাঁচ-ছয় মাস নির্বাসিত জীবনযাপন করেন। পরবর্তীতে তিনি সৌদি আরব হয়ে দেশে ফিরে আসেন। বর্তমানে তিনি লালমাটিয়ায় অ্যাভেরোজ ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের ডিরেক্টর হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
মুফতি ইবরাহীম বলেন, আওয়ামী ফ্যাসিস্ট সরকারের সময় আলেমরা নানা ভাবে নির্যাতিত হয়েছেন। তাদের রাজনৈতিক অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়। আলেমদের জঙ্গি-সন্ত্রাসী হিসেবে দোষারোপ করে আটক করা হতো। তিনি বলেন, “আইসিটি আইনে আলেমদের ধরে এনে ডিবিতে পা বেঁধে নির্যাতন করা হতো। একজন আলেমের পা ঝুলিয়ে ছয় দিন ধরে নির্যাতন করত।”
মুফতি ইবরাহীমের মতে, আওয়ামী লীগ সরকার ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় চরম বাধা সৃষ্টি করেছে। তিনি বলেন, “আমি সারা দেশে ছয় হাজার মক্তব চালাতাম। মক্তবগুলো বন্ধ করে দেওয়ায় হাজার হাজার শিশু লেখাপড়া থেকে বঞ্চিত হয়।”
গাড়িতে গুলি ও চাপা দিয়ে হত্যাচেষ্টার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে মুফতি ইবরাহীম বলেন, “একদিন কাঁচপুরে গাড়ির পাশে বিশাল আওয়াজ হয়। দেখি গুলি গাড়ির ওপরের দিকে লেগেছে। আরেক দিন টাঙ্গাইল বাইপাসে ট্রাক দিয়ে চাপা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়।”
গ্রেপ্তার হওয়ার সময় তার নামে কোনো মামলা ছিল না। আটক করার পর স্কুলের পার্টনারকে দিয়ে জোরপূর্বক একটি মামলা করানো হয়। পরে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনসহ বিভিন্ন ধারায় চারটি মামলা দেওয়া হয়। কারাগারে ফাঁসির সেলে দীর্ঘ ১৬ মাস নির্জন কেটে যায়। তিনি বলেন, “ফাঁসির সেলে আলো-রোদ কিছুই ছিল না। চুল পড়তে শুরু করেছিল।”
জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পরেও তাকে ১২/১৩টি হুমকি দেওয়া হয়। একপর্যায়ে পরিবারের নিরাপত্তার কথা ভেবে তিনি দেশত্যাগ করেন। পরিবারকেও বিষয়টি জানানো হয়নি। বিমানবন্দরে পৌঁছানোর পর তাদের জানানো হয়।
বর্তমানে তিনি দেশে ফিরে লালমাটিয়ায় অ্যাভেরোজ ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে দায়িত্ব পালন করছেন। জেলজীবনের ভয়াবহ স্মৃতি ও গণআন্দোলনের অভিজ্ঞতা তাকে আরো শক্তিশালী করেছে।
সূত্রঃ আমার দেশ