দ্য গার্ডিয়ানের মতামত বিভাগে প্রকাশিত কেনান মালিকের লেখাটি ভাওয়াল বার্তার পাঠকদের জন্য তরজমা করা হয়েছে।
প্রায় তিন হপ্তা ধরে মিয়ানমারের রাস্তায় ব্যাপক বিক্ষোভ চলছে। গত ১ ফেব্রুয়ারি সেনা বাহিনী অং সান সু চির সরকারের বিরুদ্ধে নির্বাচনে কারচুপিসহ বেশ কয়েকটি অভিযোগ দায়ের করে ক্ষমতা থেকে হটিয়ে দেয়। যদিও তার দল ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি) ব্যাপকভাবে জিতেছিল।
তারপর থেকে,সরকারী কর্মচারী এবং শিক্ষক, বাস চালক এবং গার্মেন্টস শ্রমিকরা রাস্তায় নেমে এসেছে। ‘রোড ব্লকিং ডে’ ঘোষণা করে প্রধান শহর ইয়াঙ্গুনকে পুরো অচল করে দেওয়া হয়। চালকরা বনেট ও বুট খুলে সড়কগুলোতে গাড়ি পার্ক করে রেখে যায়। এমনকি পুলিশের কিছু সদস্যও আন্দোলনে যোগ দিয়েছে বলে খবর পাওয়া গেছে।
দেশব্যাপী জান্তা বিরোধি বিক্ষোভ সাহসী ও প্রশংসনীয় কাজ। এধরনের বিক্ষোভ রাশিয়া, বেলারুশসহ বিভিন্ন দেশে হয়েছে। মিয়ানমারের বিক্ষোভ স্বাগত জানানোর মতো এবং গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এ গণবিক্ষোভ অস্বস্তিকর একটি প্রশ্নেরও জন্ম দেয়। তখন বিক্ষোভ,অবরোধ এবং এই চিৎকার কোথায় ছিল? যখন সামরিক জান্তা সংঘবদ্ধভাবে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে গোষ্ঠী নির্মূলে নৃশংস হত্যাযজ্ঞ চালায়, তাদের গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়া হয়, হত্যা করা হয় হাজার হাজার রোহিঙ্গাকে, লাখ লাখ রোহিঙ্গাকে জোর করে প্রতিবেশী বাংলাদেশে জীবন বাঁচাতে আশ্রয় নিতে বাধ্য করা হয়।
বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী মিয়ানমারের উত্তর পশ্চিমাঞ্চলীয় রাজ্য রাখাইনে সংখ্যালঘু মুসলিম রোহিঙ্গাদের অধিকাংশের বাস ছিল। দেশটির সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বর্বরতার শিকার হয়েছে রোহিঙ্গারা। যদিও রোহিঙ্গারা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে রাখাইনে বসবাস করতো। তাদেরকে অফিসিয়ালি এবং আনঅফিসিয়ালি বিদেশি হিসেবে গণ্য করা হয়। মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ তাদের বাঙালি বলে আখ্যা দেয়। ২০১৪ সালের জনগণনায় তাদের মিয়ানমারের সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করতে অস্বীকার করে কর্তৃপক্ষ।
১৯৬২ সালে মিয়ানমারের ক্ষমতায় আসে সামরিক জান্তা। তখন দেশটির নাম ছিল বার্মা। ক্ষমতায় এসেই জনসমর্থন শক্তিশালী করার জন্য রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়ানো শুরু করে। ২০১৭ সালে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে দেশটির সেনাবাহিনীর সবচেয়ে ভয়াবহ নৃশংসতা দেখা যায়। সাজানো সন্ত্রাসবিরোধী অভিযানের নামে রোহিঙ্গা জাতিগোষ্ঠী নির্মূল শুরু করে তারা। যাতে গণহত্যার আলামত পেয়েছেন অনেকে। যার সঙ্গে সাদৃশ্য রয়েছে জিনজিয়াংয়ে উইঘুরদের বিরুদ্ধে চীনের নৃশংসতার।
প্রথম দিকে রোহিঙ্গা নৃশংসতা নিয়ে চুপ ছিলেন অং সান সূ চি। পরবর্তীতে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে নৃশংসতাকে ভূয়া খবর বলে প্রত্যাখ্যান করেন তিনি। মিয়ানমারের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ এবং তাদের গণতন্ত্রকামীরা রোহিঙ্গা নৃশংসতা নিয়ে খুবই উদাসীন। কোনো উচ্চবাচ্য তারা করেননি। বরং রোহিঙ্গাবিরোধী বিক্ষোভে অংশ নিতে দেখা গেছে তাদের অনেককে।
২০১১ সাল থেকে ক্ষমতা হারাতে শুরু করে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী। এ প্রক্রিয়া ধীরে ধীরে ২০১৫ সালে সাধারণ নির্বাচনের পথকে সুগম করে। অং সান সূ চি’র নেতৃত্ব ভূমিধস জয় পায় এনএলডি। যা গেল বছরের নভেম্বরের নির্বাচনেও ধরে রাখে তার দল। দেশটিতে নির্বাচন হলেও সামরিক বাহিনী গণতন্ত্রের জন্য কখনোই ক্ষমতা ত্যাগ করেনি। মিয়ানমারের সংবিধান রচিত করে সামরিক বাহিনী। পার্লামেন্টে তাদের জন্য ২৫ শতাংশ আসন বরাদ্দ। প্রতিরক্ষা, স্বরাষ্ট্র এবং সীমান্ত বিয়ষক মন্ত্রণালয়ের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ সেনাবাহিনীর হাতে। এছাড়াও সংবিধান পরিবর্তনে তাদের ভেটো ক্ষমতাও রয়েছে।
অং সান সূ চি মিয়ানমারের সামরিক শাসনের ওপর গণতান্ত্রিক একটি আবরণ পরিয়েছেন। একইভাবে ধামাচাপা দিতে চেয়েছেন রোহিঙ্গাবিরোধী নৃশংসতাকে। সূ চি’র দলের অনেক নেতাকর্মী সরাসরি রোহিঙ্গাবিরোধী উগ্রবাদী সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত। সূ চি শুরুতে রোহিঙ্গা ইস্যুতে চুপ থাকলেও পরে ভূয়া তথ্য বলে উড়িয়ে দিয়েছেন। সন্ত্রাসবিরোধী অভিযানের নামে সমর্থন জানিয়েছেন সামরিক বাহিনীর নৃশংতাকে। ২০১৯ সালে হেগের আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে ব্যক্তিগতভাবে সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে আনা গণহত্যার অভিযোগের বিরুদ্ধে সাফাই গেয়েছেন তিনি।
সূ চি’র সমর্থকরা বলছেন, সেনাবাহিনীর কর্মকাণ্ডকে চ্যালেঞ্জ করা তার পক্ষে সম্ভব ছিল না। তার হাতে কোনো সুযোগ ছিল না। তিনি বিরোধিতা করলে তার ফলাফল ভুগতে হতো। তাই তাকে ওই পদক্ষেপ নিতে হয়েছে। এখন অভ্যুত্থানবিরোধী যে বিক্ষোভ হচ্ছে তা কিন্তু সামরিক শাসকের পক্ষে হচ্ছে না। এখন সূ চি তাদের হাতে গৃহবন্দি। সামরিক বাহিনী তাদের যা ইচ্ছে তাই করছে।
এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্নটি হলো-ক্ষমতা পাওয়ার জন্য গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে কতটা মূল্য দিতে হচ্ছে? মিয়ানমারের মতো পরিস্থিতিতে আপোষ করা অনিবার্য। দেশটিতে হয় সামরিক বাহিনীর সঙ্গে কাজ করো, না হয় সামরিক শাসন চালু। অনেকে মনে করেন, বিশেষ করে রোহিঙ্গাদের জন্য দেশটির গণতন্ত্র এবং সামরিক শাসনের মধ্যকার পার্থক্যটা বোঝা খুব জটিল।
রোহিঙ্গাদের রক্ষায় ব্যর্থতা দেশটিতে গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রাকে কেবল দুর্বলই করেছে। সমাজের দুর্বল এবং অতি সাধারণ মানুষের জন্য এ গণতন্ত্র কোনো সুফলই বয়ে আনতে পারেনি। মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের ক্ষেত্রেই কেবল নয়, ভারতে মুসলিম, সৌদি আরবে নারীদের ক্ষেত্রে, দক্ষিণ আফ্রিকায় অভিবাসী এবং ইউরোপে কাগজপত্রহীন অভিবাসীরা একই বাস্তবতার শিকার।
এখন গণতন্ত্র আন্দোলন এবং রোহিঙ্গা একটিভিস্টদের মধ্যে নতুন যোগসূত্র গড়ে উঠেছে। অনেক রোহিঙ্গা অভ্যুত্থান বিরোধী বিক্ষোভে যোগ দিয়েছে, অন্যদিকে মনে হচ্ছে রোহিঙ্গাদের প্রতি ডেমোক্র্যাটদের শত্রুতা কমে গেছে। ট্রেড ইউনিয়নগুলোও গণতন্ত্র এবং রোহিঙ্গা অধিকার উভয়ের জন্য সংগ্রামের সাথে নতুন সম্পর্ক গড়ে তুলতে শুরু করেছে।
তাদের এ যোগসুত্র বা আন্দোলন সঠিক কোনো গন্তব্যে নিয়ে যায় কিনা তা এখনো দেখার বাকি। তবে সবার জন্য সমান অধিকার নিশ্চিত করা ছাড়া অবধারিতভাবে বলা যায় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা অসম্ভব।