মসলা চাষ শিখতে তুরস্কে যাচ্ছেন ২০ কর্মকর্তা
Advertisements

পাঁচ বছরের প্রকল্প মেয়াদ শেষ হতে আর বাকি প্রায় সাড়ে চার মাস। আগামী জুন মাসেই শেষ হচ্ছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের (ডিএই) অধীনস্থ কৃষক পর্যায়ে উন্নতমানের ডাল, তেল ও মসলা বীজ উৎপাদন, সংরক্ষণ ও বিতরণ প্রকল্পের (তৃতীয় পর্যায়) কাজ। কিন্তু শেষ বেলায় এসেও ডাল, তেল ও মসলা চাষ শিখতে তুরস্কে যাচ্ছেন ২০ কর্মকর্তা। তাদের বিদেশ যাত্রায় অনুমতিপত্র (জিও) জারি করেছে কৃষি মন্ত্রণালয়।

আগামীকাল বুধবার তাদের তুরস্কের উদ্দেশে যাত্রা করার কথা। সাত দিন থাকবেন সেখানে। এবার ২০ কর্মকর্তার তুরস্কে সফরে ঠিক কত টাকা খরচ হবে তা সুনির্দিষ্ট করে জানা যায়নি। তবে তাদের প্রত্যেকের পেছনে কমপক্ষে তিন লাখ টাকা করে ব্যয় হবে বলে মনে করা হচ্ছে।

এর আগে ২০১৭-১৮ ও ২০১৮-১৯ এই দুই অর্থবছরে ২০ জন করে মোট ৪০ জন বিদেশ ভ্রমণ করেছেন। তারা চীন ও ভিয়েতনাম গিয়েছিলেন। তাদের জনপ্রতি ৪ লাখ ৩৮ হাজার টাকা খরচ ধরা হয়। আইএমইডির প্রতিবেদন অনুযায়ী, এই প্রকল্পের আওতায় পাঁচ দফায় মোট ১০০ জন কর্মকর্তার বিদেশ প্রশিক্ষণ নেয়ার কথা। এ জন্য বরাদ্দ রাখা হয় ৪ কোটি ৩৮ লাখ ৮ হাজার টাকা। তৃতীয় দফায় ২০ জন কর্মকর্তা তুরস্ক যাচ্ছেন। আরো ৪০ জন কর্মকর্তার বিদেশ ভ্রমণ বাকি থাকল।

প্রকল্প প্রস্তাবনা সূত্রে জানা যায়, মানসম্পন্ন বীজ উৎপাদন ও সরবরাহ বাড়াতে তৃতীয় পর্যায়ে ১৬৫ কোটি ২৫ লাখ ৯২ হাজার টাকা ব্যয়ে ২০১৭ সালের জুলাইতে কৃষক পর্যায়ে উন্নত মানের ডাল, তেল ও মসলা বীজ উৎপাদন, সংরক্ষণ ও বিতরণ প্রকল্পের অনুমোদন দেয় জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক)। প্রকল্পের তিন বছরের মাথায় খরচ বাড়িয়ে ১৮৩ কোটি ৪৪ লাখ টাকা করা হয়। চলতি বছরের জুন মাসে পাঁচ বছর মেয়াদি এই প্রকল্পটি শেষ হবে।

করোনাকালে সরকারি কর্মকর্তাদের ভ্রমণ ও প্রশিক্ষণে নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়। মাঝখানে করোনা পরিস্থিতি কিছুটা উন্নতি হলেও গত মাস থেকে ফের প্রাদুর্ভাব বেড়েছে। সরকার যেখানে বিদেশ সফরে কর্মকর্তাদের নিরুৎসাহিত করছে এবং বাজেট কমিয়ে দিয়েছে সেখানে কৃষি সম্প্রসারণের ওই প্রকল্পের আওতায় ২০ জন কর্মকর্তাকে বিদেশে পাঠানোর অনুমতি দেয়া হলো। যেখানে প্রকল্প মেয়াদ ও কাজই সাড়ে চার মাসের মধ্যে শেষ হচ্ছে সেখানে কর্মকর্তাদের এই বিদেশ ভ্রমণ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

কৃষক পর্যায়ে উন্নতমানের ডাল, তেল ও মসলা বীজ উৎপাদন, সংরক্ষণ ও বিতরণ প্রকল্পের পরিচালক (পিডি) মো: খায়রুল আলম প্রিন্স নয়া দিগন্তকে বলেন, ডিপিপিতে আছে ডাল, তেল, মসলা ও মৌচাষ- এসব বিষয়ে আধুনিক জ্ঞান নিতে ১০০ জন কর্মকর্তাকে বিদেশে প্রশিক্ষণ দেয়া হবে। প্রতি বছর ২০ জন করে বিদেশে প্রশিক্ষণে যাওয়ার কথা ছিল। দুই দফা ৪০ জন বিদেশে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। কিন্তু করোনার কারণে শেষের দুই বছর কেউ যেতে পারেননি। এবার যাচ্ছেন।

আগামী জুনে প্রকল্পটি শেষ হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, এখন পর্যন্ত সব মিলিয়ে ৮০ শতাংশ প্রকল্প কাজ সম্পন্ন হয়েছে। প্রকল্প মেয়াদেই বাকি কাজ সম্পন্ন হবে। অন্য প্রসঙ্গ তোলার আগেই তিনি বলেন, আমি ব্যক্তিগতভাবে অসুস্থ। সার্জারি হয়েছে। ডাক্তার কথা বলতে নিষেধ করেছেন। আরো কিছু জানার থাকলে অফিসে আসেন।

জানা যায়, বেশ কিছুদিন আগে কর্মকর্তাদের তুরস্ক ভ্রমণের জন্য কৃষি মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট উইংয়ে আবেদন দেন প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা। গত রোববার এই কর্মকর্তাদের বিদেশ যাত্রায় জিও দেয় কৃষি মন্ত্রণালয়ের প্রশাসন শাখা। ২০ জন কর্মকর্তার মধ্যে উপ প্রকল্প পরিচালক ড. ফ ম মাহবুবুর রহমানসহ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের ১৫ জন কর্মকর্তা, পরিকল্পনা কমিশনের তিনজন এবং কৃষি মন্ত্রণালয়ের দুইজন কর্মকর্তা রয়েছেন। এর মধ্যে এমন পাঁচ-ছয়জন রয়েছেন, যাদের ডাল, তেল ও মসলা চাষ শিখতে বিদেশ সফরের প্রয়োজনীয়তা নেই।

এ বিষয়ে উপ প্রকল্প পরিচালক ড. ফ ম মাহবুবুর রহমান কথা বলতে রাজি হননি। তিনি ডিএইর প্রশিক্ষণ উইংয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকে জিজ্ঞাসা করতে বলেন।

ডিএইর উপপরিচালক (বিদেশ প্রশিক্ষণ) এস এম বোরহান উদ্দিন বলেন, ২০ কর্মকর্তার বিদেশে প্রশিক্ষণের অনুমোদন হয়েছে জানি। কিন্তু তারা ঠিক কী শিখতে যাচ্ছেন তা এই মুহূর্তে বলতে পারব না।

প্রকল্প সূত্রে জানা যায়, এই প্রকল্পের উদ্দেশ্য হলো-ইউনিয়ন ভিত্তিক ‘বীজ এসএমই’ স্থাপনের মাধ্যমে কৃষক পর্যায়ে উন্নত বীজ নিশ্চিতকরণ, উন্নত বীজ ব্যবস্থাপনা ও আধুনিক প্রযুক্তি প্রয়োগে ডাল, তেল ও মসলা ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি করা, ডাল, তেল ও মসলা আমদানি হ্রাসের মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয়, মৌ চাষের মাধ্যমে ফসলের ফলন বৃদ্ধি এবং গ্রামীণ কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা, সুষম মাত্রায় ডাল, তেল ও মসলা সরবরাহ করে মানব স্বাস্থ্যের পুষ্টি নিশ্চিত করা, উন্নত মানের বীজ ব্যবস্থাপনা ও মৌ চাষে মহিলাদের অংশগ্রহণে গ্রামীণ দারিদ্র্য হ্রাস করা এবং শস্য বিন্যাসে ডাল, তেল ও মসলা ফসল অন্তর্ভুক্ত করে পানি সাশ্রয় ও মাটির স্বাস্থ্য সুরক্ষা।

প্রকল্পের মূল কাজগুলো হলো, ৩৬ হাজার ১৭১টি ব্লক প্রদর্শনী, কৃষক প্রশিক্ষণ ৬০০ ব্যাচ, কৃষকদের রিফ্রেসার্স কোর্স ১৫০ ব্যাচ, এএএও প্রশিক্ষণ ১৫০ ব্যাচ, রিফ্রেসার্স এএএও প্রশিক্ষণ ১৫০ ব্যাচ, ডিএইর অফিসার প্রশিক্ষণ ও তাদের রিফ্রেসার্স কোর্স, মৌ পালনে সার্টিফিকেট কোর্স, ১০০ জনের বৈদেশিক প্রশিক্ষণ, ১৬ হাজার ৫৫০টি মাঠ দিবস, ২৫৬টি কৃষক পুরস্কার, ১৬ হাজার ৪৭০টি এসসিএ বীজ প্রত্যয়ন, ১২৮টি কৃষকদের উদ্বুদ্ধকরণ ভ্রমণ, জাতীয়, আঞ্চলিক মিলে ৭৬টি কর্মশালা, মৌবক্স ও মধু এক্সটাক্টর দুই হাজারটি, ময়েশ্চার মিটার দুই হাজার ৭৩৯টি, উন্নত বীজ সংরক্ষণ পাত্র ও শুকানোর উপকরণ মোট ১৮ হাজারটি ও ৫০ সেট এবং বীজ প্যাকেজিং ব্যাগ ৭১.৮৩ লাখ।

বর্তমানে তৃতীয় পর্যায়ে প্রকল্পটি চলমান। এর আগে এই প্রকল্প দু’টি পর্যায়ে শেষ হয়েছে। চলমান প্রকল্পের জন্য দুই ধরনের (বীজ বিশেষজ্ঞ এবং ব্যবস্থাপনা ও দক্ষতা) কনসালট্যান্স নিয়োগের কথা বলা হয়েছে। পিডি খায়রুল আলম প্রিন্স জানিয়েছেন, প্রকল্পে দু’জনকে কনসালট্যান্ট নিয়ো দেয়া হয়েছে। জানা যায়, দু’জনের প্রত্যেকে ৪৮ মাসের বেতন ধরা হয়েছে। প্রতিজনের জন্য দুই লাখ ৫০ হাজার টাকা মাসে এক কোটি ২০ লাখ টাকা পাবেন। অর্থাৎ দুইজন কনসালট্যান্টের পেছনে খরচ হচ্ছে মোট দুই কোটি ৪০ লাখ টাকা। জানা যায়, এর আগেও একই প্রকল্প দু’টি পর্যায়ে শেষ হয়েছে। তখনো বিদেশ থেকে কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা ছিল।

এ বিষয়ে কৃষি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (সম্প্রসারণ) মো: হাসানুজ্জামান কল্লোল বলেন, কর্মকর্তাদের বিদেশ ভ্রমণের বিষয়টির ফাইল আমার দফতরে আসেনি। এটা প্রশাসন শাখা দেখে থাকে।

এ বিষয়ে প্রশাসন উইংয়ের অতিরিক্ত সচিব ওয়াহিদা আক্তার বলেন, প্রকল্পে যেহেতু এটা ধরা আছে (বিদেশ ভ্রমণ) তাই যেতেই পারে। করোনার জন্য হয়তো শিডিউলগুলো (বিদেশ যাওয়া) মিস হয়েছে। চার মাস বড় কথা নয়, প্রকল্প মেয়াদে তারা বিদেশে যেতেই পারেন।

কৃষি সচিব মো: সায়েদুল ইসলাম ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের মহাপরিচালক মো: বেনজীর আলমকে ফোন দিলেও তারা রিসিভ করেননি।

সূত্রঃ নয়া দিগন্ত

Advertisements