ভালবাসার আদ্যোপান্ত
Advertisements

শীতের সকালে একফালি রোদ গাছের ফাঁক দিয়ে উকি দিচ্ছিলো। প্রকৃতপক্ষে শীতের সকালে কোন উদ্যানের মনোরম পরিবেশ অনেকখানি উপভোগ্য একটি ব্যাপার। রাতুল উদ্যানের ঠিক পশ্চিম পাশে অবস্থিত একটি হ্রদের পাড়ে দাড়িয়ে আছে। কিছুক্ষণ দাড়িয়ে থেকে রাতুল ওর কাধে ঝোলানা ব্যাগটি হাতে নিয়ে পাশেই বিদ্যমান একটি কাঠের বেঞ্চিতে রাখল। ওকে খুবই অস্থির দেখাচ্ছিল, যা ওর অবয়বে পরিষ্কারভাবে ফুটে উঠেছে। বারবার রাতুল এদিক ওদিক উজ্জ্বল দৃষ্টিপাত করছিল। অবশেষে রঙচটা জিনসের পকেট থেকে মোবাইল ফোন বের করল এবং ফোন করল। কিছুক্ষণ পর ওপাশ থেকে এক মেয়েলি কন্ঠ ভেসে উঠল।
‘হ্যালো?’
‘রাতুল বলছিলাম, কি রে তোর কোন খোঁজ-খবর নাই যে, আমি আর কতক্ষণ ওয়েট করব, ওয়েট করতে করতে আমি রীতিমত বোর হয়ে গিয়েছি, তুই কি আসবি না নাকি? না আসলে বল, আমি চলে যাই’- বলে রাতুল এক দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
‘ দোস্ত, প্লিজ রাগ করিস না, জাস্ট ফাইভ মিনিটস ওয়েট কর, আমি এক্ষুণি চলে আসছি।’
‘ ওকে তাড়াতাড়ি আয়।’
‘ওকে, বাই দ্য ওয়ে, তোর এই নাম্বার তো আমার কাছে সেইভ করা নেই।’
‘ নতুন নিয়েছি, আয় তাড়াতাড়ি।’
এতক্ষণ যার সাথে রাতুলের ফোনে কথোপকথন হল সেই মেয়েটির নাম উপমা। রাতুলের সাথে একই ক্লাসে পড়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ের গন্ডিতে উপমাই ওর একমাত্র ঘনিষ্ঠ মেয়েবন্ধু। উচ্চ- মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে উপমা। ছোটবেলা থেকেই জাকজমক পোশাক-পরিচ্ছদ আর বিলাসিতাই ওর নিকট খুবই পছন্দনীয় বিষয়। বাবা- মায়ের একমাত্র মেয়ে বলে কথা। কিন্তু রাতুলের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা একটু ভিন্ন রকমের। উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তান হলেও সাদামাটা জীবন-যাপন আর উচ্চ আদর্শই ওকে বেশি কাছে টানে। প্রায় আধা ঘন্টা পর উপমা যথাস্থানে এসে উপস্থিত হয়ে দেখল, রাতুল বেঞ্চিতে বসে বসে ঝিমুচ্ছে। উপমা পা টিপে টিপে রাতুলের ঠিক পেছনে এসে ভারি গলায় বলল, ‘ হ্যান্ডস আপ! ডোন্ট মুভ।’
রাতুলের মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। চোখ ডলতে ডলতে কোনরকমে দু’হাত শূণ্যে তুলে দাড়াল। ঠিক সেই মুহূর্তেই রাতুল অবাক করে দিয়ে খিল খিল করে হেসে উঠল উপমা।
রাতুল প্রচন্ড পরিমাণে রেগেমেগে বলল, ‘ এইভাবে কেউ ফান করে নাকি উপমা! ছি! তোকে আমার মারতে ইচ্ছে করছে এখন।’
উপমা ঠোঁট বাকিয়ে বলল, ‘ ইস! তোর সাহস কেমন আমার জানা হয়ে গেছে, আবার আসবে আমাকে মারতে, হুম!’
‘ হইছে, এখন পাকনামি বাদ দে, বল কিজন্য আসতে বলেছিস এখানে?’
‘ কেন? কারণ ছাড়া আসা যাবে না বুঝি, তুই না আমার গুলু গুলু দোস্ত।’ – বলে উপমা রাতুলের গালে আলতো টিপ্পনি কাটল।
রাতুল মৃদু হেসে বলল, ‘ ভণিতা বাদ দে, আসল কথা বল।’
উপমা মিনমিন করে বলল, ‘ আমাকে কয়েকটা পোট্রেইট পিক তুলে দিবি? কয়েকদিন ধরে ফেসবুকে পিক আপ করি না। আর তাছাড়া তুই তো জানিস আমার মডেলিং করার ইচ্ছা।’
‘ আচ্ছা, রেডি হ এন্ড কি পোজ দিবি সেটা ভাব।’ – বলে রাতুল ওর ব্যাগ থেকে একটি ডিএসএলআর ক্যামেরা বের করল এবং ক্যামেরার সাথে লেন্স সংযুক্ত করল। ওরা প্রায় এক ঘন্টা যাবত জায়গা পরিবর্তন করে ফটোশুট করল। এরপর ওরা একসঙ্গে উদ্যানের রাস্তা ধরে মৃদু পায়ে হাটতে শুরু করল। হঠাৎ করে নীরবতা ভেঙে উপমা বলে উঠল, ‘ দোস্ত, পিকগুলা কেমন হইছে সেটাই তো দেখলাম না, দেখি একটু?’- বলে রাতুলের হাত থেকে ক্যামেরা নিয়ে ছবিগুলো দেখতে শুরু করল। আচমকা জোরে একটা চিৎকারl করে উপমা রাতুলকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘ ইয়েহ….! দোস্ত, দেখ, দেখ, এই ছবিটা কত জোস হইছে, তাই না?’
‘ হুম, অনেক জোস হইছে, আমি জোস করে তুলছি বলেই জোস হইছে, এখন আমাকে ছাড়।’ – রাতুল অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে উপমাকে বলল। সাথে সাথে উপমাও নিজেকে দুরত্বে নিয়ে গেল।
উপমা ক্লান্ত স্বরে বলল, ‘ দোস্ত, আমার ভীষণ খিদে পেয়েছে।’
‘ চল, ওই যে সামনে ফুচকা মামার কাছে থেকে কিছু খেয়ে নেই।’
‘ দ্যাটস নট ব্যাড, চল।’
তখন ক্লান্ত দুপুর। রাতুল রিক্সায় করে বাসার দিকে যাচ্ছে। পথে শুধু ওর উপমার কথাই মনে পড়ছে। মনে পড়ছে ওর নরম হাতের আলতো ছোঁয়া, মনে পড়ছে সেই আলিঙ্গনের মুহুর্তটি। রাতুল ওর হৃদয়ে এক অদ্ভুত রকমের শিহরণ অনুভব করল। উপমার অবয়ব যেন ওর সামনে রূপকথার রাজকুমারীরূপে মত ভেসে উঠছিল। তবে কি রাতুল উপমাকে ভালবেসে ফেলছে? এই সবকিছু ভাবতে ভাবতে কখন যে রাতুল ওর বাসার সামনে পৌছে গিয়েছে, তা ওর অবগতই ছিল না। আপনমনে মৃদু হাসি দিয়ে রিক্সা ভাড়া চুকিয়ে ও বাসায় চলে গেল। পরদিন বিকেলবেলা রাতুলের সাথে উপমার দেখা হল। উপমাকে ক্লাসের অ্যাসাইনমেন্ট পেপার দিতে এসেছে রাতুল। গতকাল যে উদ্যানে ওদের দেখা হয়েছিল সেই উদ্যানে গিয়েই ওরা ঘাসের ওপর বসল। রাতুল উপমাকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠল, ‘ কি রে, অ্যাসাইনমেন্ট পেপারটা কি তোর এতই জরুরী ছিল যে আজকেই নিতে হবে?’
উপমা বলে উঠল, ‘ দোস্ত, আমি কিছুই লিখি নাই, তাই ভাবছি তোরটা দেখেই কপি করব।’
‘ কপি ছাড়া আর পারিস টা কি?’
উপমা রাতুলের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, ‘ ভালবাসতে পারি।’
রাতুলের চোখমুখ মুহুর্তেই লাল হয়ে গেল এবং ওর হৃদস্পন্দন বাড়তে লাগল। জড়সড় গলায় সে উপমাকে বলল, ‘ কাউকে লাভ করিস?’
‘ হ্যা, একজনকে অনেক লাভ করি, বাট তাকে এখনও বলি নি, তবে খুব শীঘ্রই বলে দেব।’
‘ কাকে লাভ করিস, বল না প্লিজ।’- রাতুল অনুনয় করে বলল।
উপমা দুষ্টুমির চোখে বলল, ‘ না এখন বলব না, যখন রিলেশন হবে তখন জানতে পারবি, আমি এখন গেলাম।’
রাতুল উপমা বিদায় জানিয়ে আনন্দে নাচতে লাগল৷ রাতুল এখন পুরোপুরি নিশ্চিত যে, উপমা ওকেই ভালবাসে। তাই সে মনস্থির করল, উপমাকে ওর মনের কথা বলে দেবে।
দুইদিন পর রাতুলের সাথে উপমার দেখা হল।রাতুল আজ বেশ পরিপাটি আর গোছানো মনে হচ্ছে। উপমাও একটি নীল রঙা শাড়ি পড়ে বেশ সেজে-গুজে এসেছে। ওরা কিছুদূর হেটে গিয়ে রাস্তার মোড়ে ফুটপাতের কোণে গিয়ে দাড়াল। এরপর ওদের মধ্যে কথোপকথনের এক পর্যায়ে রাতুল বলে উঠল, ‘ উপমা, তোকে একটা কথা বলতে চাই।’
উপমা বলল, ‘ আমিও তোকে একটা কথা বলতে চাই।’
‘ তাহলে তুই আগে বল।’
উপমা মৃদু হেসে বলল, ‘ তুই চেয়েছিস আগে বলতে, ডোন্ট ব্রেক দ্য রুল।’
রাতুল ওর প্যান্টের পিছন পকেট থেকে একটি গোলাপ বের করে উপমার হাত আলতো করে ধরে বলল, ‘ আই লাভ ইউ উপমা, উইল ইউ বি মাই লাইফ পার্টনার।’
মুহুর্তেই যেন উপমার মুখমন্ডলে পরিবর্তনের ছোঁয়া লাগল। রাতুলের দিকে রক্তচক্ষু করে রেগেমেগে উপমা বলল, ‘ ইমপসিবল। আমি অন্য একজনকে লাভ করি। ওর নাম নেহাল। আর এই কথাটাই আমি তোকে বলতে চেয়েছিলাম।’
রাতুল মুহুর্তের জন্য যেন জমে গেল। পরক্ষণেই আবার নিজেকে সামলে নিয়ে কম্পিত গলায় বলল, ‘ তাহলে আমাকে জড়িয়ে ধরা, আমার গালে আলতো করে ছুঁয়ে দেয়া, আমাদের খুনসুটিগুলো, সবই কি মিথ্যা ছিল?’
উপমা ঝাঝালো কন্ঠে বলল, ‘ তুই কি করে ভাবলি আমি তোকে হাগ করেছি বলেই আমি তোকে লাভ করি? হাহ! তোর মত একটা ক্ষ্যাতের সাথে আমি রিলেশন করব? আমি? আর আমি নেহালের সাথে অনেক কম্ফোর্টেবল।’
রাতুল কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, ‘ তাহলে তুই কি শুধু বন্ধুত্বের নামে আমার কাছে থেকে বেনিফিট নিয়েছিস?’
উপমা ক্রুদ্ধ গলায় বলল, ‘ হ্যা, নিয়েছি, তো?’
রাতুলের হাত থেকে গোলাপটি পড়ে গেল। ওর মনে হল, পৃথিবীতে ওর থেকে অসহায় বোধ হয় আর কেউ নেই। মানুষের জীবনে কিছু মুহুর্ত আসে, যে সময় নিজেকে খুবই শূণ্য মনে হয়, রাতুলের সেই মুহুর্তে তাই মনে হল। উপমা ইতিমধ্যে সেখান থেকে প্রস্থান করেছে। রাতুল কোনরকমে নিজেকে সামলে নিয়ে গন্তব্যহীন পথে হাটতে শুরু করল।
তিন বছর কেটে গিয়েছে।
রাতুলকে প্রায়ই এখন ক্লাসশেষে উদ্যানের ভেতরে পথশিশুদের সাথে সময় কাটাতে দেখা যায়। ওদেরকে নিয়ে রাতুল প্রায়ই মধ্যাহ্নভোজটা সেরে নেয়। মাঝেমধ্যে ওদের জন্য নতুন জামা কাপড় নিয়ে আসে। আর এতেই ওরা অনেক খুশি হয়। রাতুলের হৃদয়েও প্রশান্তি নেমে আসে। অন্যান্য দিনের মত তেমনি একদিন ক্লাসশেষে রাতুল পথশিশুদের সাথে সময় কাটাচ্ছিল এবং ক্যামেরা দিয়ে ওদের ছবি তুলছিল। ঠিক কিছুক্ষণ পর সেখানে উপমা এসে উপস্থিত হল। রাতুল উপমাকে দেখে কিছু বলতে যাবে তার আগেই উপমা আবেগাপ্লুত কন্ঠে বলে উঠল, ‘ আমি তোকে অনেক কষ্ট দিয়েছি, তাই না? আমিও কষ্ট পেয়েছি জানিস, অনেক কষ্ট পেয়েছি! নেহাল আমাকে ফেলে চলে গিয়েছে অন্য একজনের সাথে। ‘
রাতুল মাথা নিচু করে রইল। কোন কথা বলল না।
উপমা আবার কাঁদো কাঁদো গলায় বলে উঠল, ‘ আমি আমার জীবনের বাকি প্রতিটি মুহূর্ত তোর সাথেই কাটিয়ে দিতে চাই।’
রাতুল নরম গলায় উত্তর দিল, ‘ এটা পসিবল না উপমা। আমার জীবনের বাকি মুহুর্তগুলো আমি ওদের সাথেই কাটাতে চাই। এখন থেকে ওরাই আমার ভালবাসার আদ্যোপান্ত।’

Advertisements