‘‘আগে বিয়ে ভাঙার কারণ হিসেবে পণ দেওয়া-নেওয়া, পারিবারিক কলহ, সম্পত্তি সংক্রান্ত বিবাদ— এগুলো বেশি শোনা যেত। সোশ্যাল মিডিয়ায় আসক্তির কারণে বিয়ে ভাঙা এখনকার নতুন ট্রেন্ড।’’ না না কথাটা আমার নয়। কথাটা একজন ম্যারেজ কাউন্সেলরের। কিছুদিন আগে একটি সংবাদপত্রে এরকমই খবর দেখে তাজ্জব হয়ে গিয়েছিলাম। এই একুশ শতকে এটাই ট্রেন্ড হয়ে উঠেছে। কারণটা কি? কারণ এটাই যে স্ত্রী সারাদিন মোবাইলে ব্যস্ত। সোশ্যাল মিডিয়ায় সময় কাটান সব থেকে বেশি। এই অভিযোগে আদালতে বিবাহ বিচ্ছেদের মামলা করেছেন তিরিশ বছরের সৌম্য। পেশায় তিনি সফটওয়্যার নির্মাতা। তার বক্তব্য মাত্র এক বছর আগে বিয়ে হয়েছিল তাদের। বিয়ের পর দিন থেকেই মোবাইলে বুঁদ হয়ে থাকতেন স্ত্রী। সংসারের দিকে কোনও খেয়ালই রাখতেন না। এমনকি স্বামীকেও সঙ্গ দিতেন না। স্ত্রীর বিরুদ্ধে একাধিক পুরুষের সঙ্গে রাত জেগে চ্যাটিংয়ের অভিযোগ এনেছেন সৌম্য। তার দাবি, এ বিষয়ে স্ত্রীকে কিছু বললেই তিনি খেপে যেতেন। উল্টে হুমকি দিতেন সৌম্যকে। তাদের দু’জনকে নিয়ে কাউন্সেলিংয়ের নির্দেশ দিয়েছে আদালত।
হ্যাঁ এরকমই আরো সহস্র ঘটনা রোজ ঘটে চলেছে। কখনও তা প্রকাশ্যে, কখনও অপ্রকাশ্যে। সবার প্রিয় সোশ্যাল মিডিয়া আজ কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে। সামাজিক স্রোতে এক প্রকার বাধা সৃষ্টিকারী হিসেবে অনেকে সোশ্যাল মিডিয়াকেই দায়ী করছেন। কিন্তু কেন এই পরিণতি? সারা বিশ্বে এই প্রবণতা সমাজকে কোথায় ঠেলে দিচ্ছে? শুধুমাত্র একাকিত্বকে তো এই প্রশ্নের সম্মুখীন করা যায় না, তাহলে কি?
সোশ্যাল মিডিয়ায় আমরা ঠিক কী করি? আমরা সবাই ব্যস্ত নিজের নিজের জীবন নিয়ে। সারা সপ্তাহ অফিস আর বাড়ি, সংসার এইসবের মধ্যে সবার সাথে দেখা-সাক্ষাৎ হয়ে ওঠে না। কিন্তু তাদের জীবনে কি ঘটছে, তা জানতে ইচ্ছে হয়। তাদের ছেলে মেয়েরা কত বড় হল, তাদের জীবন কেমন কাটছে, সেই সবের খোঁজ এর মধ্যে দিয়েই পুরনো সম্পর্ক ঝালাই করা। আবার, অনেক সমমনষ্ক মানুষ, যাদের চিনি না, পৃথিবীর অন্য প্রান্তে বসে, তাদের লেখা, ছবি, গান, বা পাণ্ডিত্য দেখে আমরা নতুনভাবে ভাবার রসদ পাই, তাদের সৃষ্টি দেখে আনন্দ পাই, প্রেরণা পাই। তাদের সাথে বন্ধুত্ব করার সহজ উপায় সোশ্যাল মিডিয়া। কখনো কখনো সেই শৈশবের হারানো বন্ধু বা বান্ধবী, যাদের সাথে নিত্যদিনের খেলা বা খুনসুটি না হলে গোটা দিনটাই ফাঁকা ফাঁকা লাগতো, তাদেরকে হঠাৎ ফেসবুকে পেয়ে আনন্দে আত্মহারা হয়ে ওঠা, সেরকম মানুষের সংখ্যাও নেহাত কম নয়।
এই অবধি ঠিকই আছে। কার না ভাল লাগে পুরনো সম্পর্ক ঝালাই করতে, নতুন বন্ধুত্ব করতে, বা বিশ্বের দরবারে নিজের উপস্থিতি জানান দিতে? নতুন নতুন অজানা জায়গার খোঁজ, প্রিয়জনদের আনন্দের ছবি, প্রেমিকটি বা প্রেমিকাটির সেজেগুজে তার প্রিয় মানুষটির জন্য ছবি দেওয়া, একটা সুস্থ সমাজের এবং সুস্থ জীবনের জন্য খুবই দরকারি। রোজকার অফিস রান্না সংসার সন্তান এই আবর্তের মধ্যে থেকে একটা একঘেয়েমির মধ্যে সোশ্যাল মিডিয়া এক ঝলক টাটকা বাতাসের মতন। কিন্তু মানুষ যত পায়, তত চায়। শুধু সময় কাটানোর জন্য একদিন যা শুরু হয়েছিল, তা কোন এক জাদুবলে যেন দিনের পুরো সময়টাই খেয়ে নিতে শুরু করলো। আরও একটা ঘটনা বলি।
ঝাঁ চকচকে রেস্তরাঁয় সুসজ্জিত স্বামী-স্ত্রী বা প্রেমিক-প্রেমিকা একটি টেবিলে মুখোমুখি বসে। স্বাভাবিক ভাবেই উচিত নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলা, মেন্যুতে খাবার পছন্দ করা। কিন্তু এখন দেখা যায়, দুজনের হাতে দুটি মোবাইল এবং তারা সেই মোবাইলের মধ্যে ডুবে আছেন, সোশ্যাল মিডিয়াতে কোন বন্ধু বিদেশে ছুটি কাটানোর ছবি দিয়েছে, কে দামি মদ কিনে পার্টি করছে, কার ছেলে কোন ক্লাস-এ ফার্স্ট হয়েছে, কোন ছেলে বা মেয়ে তার লেখা স্ট্যাটাসে লাইক বা লাভ রিয়্যাক্ট দিয়েছে, কোন এডমায়ারার তাকে নতুন করে প্রেমের প্রস্তাব দিয়েছে, সেইসব দেখতে ব্যস্ত থাকেন। ওপর দিকে যে আরেকজন মানুষ আছেন, এবং আদপে যে সময়টা তার সাথে কাটাতে এসেছেন, সে দিকে কিন্তু কারোর ভ্রুক্ষেপ নেই। প্রযুক্তি মানুষের সুবিধার জন্য উদ্ভাবন করা, সোশ্যাল মিডিয়া মানুষের সাথে যোগাযোগ করার একটি রাস্তা, কিন্তু কীভাবে যেন সেই দূরের মানুষদের কাছে টানতে গিয়ে আমরা আমাদের কাছের বা জীবনের গুরুত্বপূর্ণ মানুষগুলিকে আস্তে আস্তে দূরে সরিয়ে দিই। খানিকটা তাদেরকে টেকেন ফর গ্রান্টেড করে নিই। বদলে গিয়েছে প্রায়োরিটি। কিছু সম্পর্ক, যেমন বাবা-মায়ের সাথে ছেলে-মেয়ের সম্পর্ক, এসবে অতটা টালমাটাল হয় না। কিন্তু ভাঙতে শুরু করে সেই সব সম্পর্ক যেগুলো মানুষ নিজের থেকে তৈরি করে, যেমন বন্ধুত্বের সম্পর্ক বা প্রেমের সম্পর্ক।
এমনকি আজও শুনতে হয়, মেয়েরা চাকরি করতে গেলে সমাজে সে তার স্বামী বা সন্তানদের যথেষ্ট সময় দিচ্ছে না। যদিও আর্থিক স্বাধীনতা সবার জন্যই প্রয়োজনীয়। এবারে ভাববার বিষয় এটাই যে, সেই মহিলা যদি সারাদিন বাড়িতেই বসে থাকেন এবং সকাল থেকে রাত সোশ্যাল মিডিয়াতে কে কী খাচ্ছে, কে কী পরে ঘুমাতে যাচ্ছে, কে কোথায় বেড়াতে যাচ্ছে, এই সব দেখে খুশি দুঃখিত এবং ঈর্ষান্বিত হয় তাহলে কি তিনিও নিজের পরিবারকে যথেষ্ট সময় দিতে পারছেন? এবারে ধরুণ বাড়ির পুরুষটির কথা। তিনিও চাকরি করে অনেক রাত করে ফিরে কোনোদিকে না তাকিয়েই তাঁর মোবাইলের ভেতরে ঢুকে গেলেন, কোন নতুন মেয়ে তাকে রিকুয়েস্ট পাঠিয়েছে, বা চ্যাট এ তার সাথে বেশ মাখো মাখো কথা হচ্ছে, বা কোন বিখ্যাত লোক কী বলেছেন এবং সেই নিয়ে সবাই চুলচেরা বিশ্লেষণ করছে অতএব তাকেও তার বুদ্ধিমত্তার পরিচয় রাখতে হলে কিছু একটা ভেবে চিনতে লিখতেই হবে, এই সবে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। খেতে খেতেও মুখে মোবাইলটি ধরে থাকেন, কোনও ক্রমে খাওয়া শেষ হলেই আবার বিছানাতে চলতে থাকে টিকটক, টিকটক যতক্ষণ না ঘুম পাচ্ছে। এর মধ্যে তাঁর এতটুকু সময় নেই যে যাকে স্বেচ্ছায় জীবনসঙ্গিনী করে এনেছিলেন তার জীবনে কী ঘটলো, কেমন কাটল, বা ছেলে মেয়ের কী খবর, সেসব জানার। এরা টেকেন ফর গ্রান্টেড। খবর নিলেও তারা থাকবে, না নিলেও থাকবে। নিজের বিয়ে করা স্বামী বা স্ত্রীকে ইমপ্রেস করার মতন নতুন কিছুই নেই। কিন্তু ফেসবুকের ওপারে কম বয়সী মেয়েটি বা মুগ্ধ ছেলেটিকে ইমপ্রেস করে নিজের বাজার দর যাচাই করার মধ্যে একটা উন্মাদনা আছে, নিজের ইগো বুস্ট আছে। আমরা সবসময়ই মনোযোগ পেতে চাই, তবে সোশ্যাল মিডিয়ার দৌলতে সেটি একটি ব্যাধির পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। মানুষ এখন শুধু অন্যের ছবি তোলাতে সন্তুষ্ট নয়, দামী মোবাইলের ততোধিক উন্নত ক্যামেরাতে নিজের নিজস্বী বা সেলফি তুলে দেখাচ্ছেন, কখনো বা নতুন জামা, কখনো মেকআপ, কখনো বা শুধুই নিজে একাকীত্ব কাটাতে। নতুন সমীক্ষায় দেখা গেছে যে সেলফি তোলাটা একটি মানসিক ব্যাধি হিসেবে দেখা হচ্ছে। কিন্তু তাতে কোনও ভাবেই এর সংখ্যা কমছে না, বরং উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। কিন্তু এত সবের মাঝে আমরা নিজের অজান্তেই কাছের মানুষদের থেকে ধীরে ধীরে দূরে সরে যাচ্ছি, আর মেতে উঠছি বিশ্বের খবরে।
অন্যদিকে আর একটা ঘটনা বলি, স্বামী প্রয়াত। সন্তানরা থাকে অন্য গোলার্ধে। ছেলে পড়াশুনো করতে গিয়ে ওখানেই থিতু হয়েছেন। বিয়ের পর মেয়ে স্বামীর সঙ্গে বিদেশে। ওরা সবাই ব্যস্ত। ইদানিং শরীর ভালো নেই। হঠাৎ যদি কিছু হয়ে যায়। সারাক্ষণ মাথায় এসবই ঘোরে আজকাল। বিপদ-আপদ হলে কাজের মেয়ে বা প্রতিবেশিই একমাত্র ভরসা। কিন্তু পরিবারের সদস্যরাই যেখানে কারওর খবর রাখেন না সেখানে প্রতিবেশিরা কে কার খবর নেয়!
না, এটি কোনো কল্পকাহিনী নয়। দৃষ্টান্ত অনেক আছে। এ সময়ের অন্যতম বড় সমস্যা হলো একাকীত্ব। জীবনের গোধূলিবেলায় একাকীত্ব সঙ্গী করে দিন কাটাচ্ছেন বহু দম্পতি। কেউ একদম একা। হ্যাঁ তাদের জন্যে সোশ্যাল মিডিয়ায় বন্ধুদের নতুন করে খুঁজে পাওয়া এক যুগান্তকারী আবিষ্কার।
তরুণ প্রজন্মের কাছেও একাকীত্ব বোধের বড় কারণ সোশ্যাল মিডিয়ার আসক্তি। এতে সময় কাটে। কিন্তু একাকীত্ব ঘোচে কি আদৌ। প্রযুক্তির এই অতিরিক্ত আসক্তি দূর করে দিচ্ছে কাছের বন্ধুকেও। সারাদিন ক্লাস, কাজ বা অফিসের ফাকে, ঘুমোতে যাওয়ার আগে বা ঘুম থেকে উঠেও কখনও প্রথম কাজটা হয় নিউজফিড চেক করা। ‘Computer in Human Behavior’ এর একটি গবেষণায় দেখা গিয়েছে, ডিভোর্সের সাথে ফেসবুকের বেশ নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। এই গবেষণায় আরও উঠে এসেছে যে, যারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে বিচ্ছিন্ন, তারা তুলনামূলকভাবে অন্যান্য দম্পতির চেয়ে ১১% বেশী সুখী।
এক্ষেত্রে কবিগুরুর কবিতা খুব মনে পড়ে- ‘বহু দিন ধরে, বহু ক্রোশ দূরে/বহু ব্যয় করি, বহু দেশ ঘুরে/ দেখিতে গিয়াছি পর্বতমালা, দেখিতে গিয়াছি সিন্ধু।/দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া, ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া/একটি ধানের শিসের উপরে, একটি শিশির বিন্দু’।
আসলে আমরা প্রত্যেকেই এক একটা গ্রহের বাসিন্দা হয়ে গেছি। হয়ে উঠছি আত্মকেন্দ্রিক অর্থাৎ সেলফিস। একান্ত নিজের মানুষজনদের বাদ দিয়ে বহু ব্যয় করে দূরের পর্বতমালা বা সিন্ধুতে মজে আছি। বিন্দুতে সিন্ধু দেখার সেই যে প্রত্যাশা। যার চাপে শেষ মেষ এই কাল্পনিক জগতের বাসিন্দা হয়ে সান্নিধ্য পাওয়ার চেয়ে আমরা হয়ে পড়ছি আরো একা, একলা। কিন্তু এই ভার্চুয়াল জীবনের আকর্ষণ চুম্বকের মতন টানে, আসল জীবনের সব দায়িত্বও, কর্তব্য, প্রেম ভালবাসা ভুলিয়ে দেয়। মাঝে মাঝে ভাবি, পালটে গেছে অনেক কিছুই, কিন্তু কোথাও যেন কিছু জিনিস আজো ঠিক এক রকমের রয়ে গেছে। একটুও পাল্টায়নি। একটু খুঁজলেই পাওয়া যাবে সেই কাছের মানুষদের। আর কমে যাবে সব দূরত্ব।
বৈশাখী নার্গিস
জবান