ভারত নাই, আমেরিকার নয়া সামরিক জোট
Advertisements

আমেরিকা এশিয়ায় এবার এক নতুন জোট খুলেছে। এটা সামরিক জোট নাম AUKUS। অস্ট্রেলিয়া, ইউনাইটেড কিংডম আর ইউনাইটেড স্টেটস –এই তিন দেশের ইংরাজি নামের আদ্যক্ষর দিয়ে, ত্রিদেশীয় এই নয়াজোটের নাম ঠিক করা হয়েছে। এটা যতটা না সামরিক জোট তার চেয়ে বেশি অষ্ট্রেলিয়াকে চীনের মুখে ফেলে দিয়ে আমেরিকা-বৃটেনের ওর ঘাড়ে চড়ে পিছনে দুরে বসে থেকে পরমাণূ অস্ত্রের ব্যবসা করে নেয়া। এছাড়া আবার এটা এমনই অষ্ট্রেলিয়া যার ভৌগলিক অবস্থান চীনের হাতের নাগালেই আর তার চেয়েও বেশি বিপদের হল অষ্ট্রেলিয়ার ইকনমি দাঁড়িয়ে আছে চীনে রপ্তানি করতে পারার উপরে। তবে গত ২০১১ সাল থেকে আমেরিকার এটা চীনের প্রভাবের বিরুদ্ধে খামোখা লড়বার তৃতীয় উদ্যোগ। আগের ‘পিভোট এশিয়া’ আর ‘কোভিড’ এর ব্যর্থতার পরে এটা আরেক নয়া উদ্যোগ। এটাও ব্যর্থ হবে, কারণ এশিয়ার চীনের সাথে সীমান্তবিরোধ যাদের আছে তারাই যুদ্ধ চায় না, সমাধান মনে করে না। কাজেই চীনের সাথে সীমান্তবিরোধের কথা তুলে এর আড়ালে আমেরিকান যেকোন স্বার্থ আদায় করা অসম্ভব। এর উপর তা যদি যুদ্ধ-কেন্দ্রিক আমেরিকান বুদ্ধি হয় তবে এর কোনই ভবিষ্যত নাই।

এবার সরাসরি যদি প্রশ্নটা করা হয় এই জোট মানে অর্থনৈতিকভাবে, এটা ৫০-৯০ বিলিয়ন ডলারের এক ঋণশোধের দায় যা একা অষ্ট্রেলিয়ার উপর চাপিয়ে দেওয়া হল। তাহলে এই অর্থনৈতিক দায়ের রিটার্ণটা কোথা থেকে আসবে? সেপ্রশ্ন এখনও উহ্য থেকে গেছে। এছাড়াও উলটা এই জোট নুন্যতম ফাংশনাল হলেই চীনে যতটুকু রপ্তানি বাজার অষ্ট্রেলিয়ার এখনও যা আছে সেটাও বন্ধ হয়ে যাবে বা অন্য কেউ তা দখলে নিবে। এতে অষ্ট্রেলিয়ার অর্থনীতি আরো দ্বিগুণ চাপে পড়বে। তখন অষ্টেলিয়াকে উদ্ধার করবে কে? কেউ জানে না। অর্থাৎ মাটিতে পা রেখে এসব দায় অষ্ট্রেলিয়া প্রধানমন্ত্রী মাথায় নিয়েছে মনে হয় না।

অর্থনৈতিক সক্ষমতার বিরোধ বা প্রভাব সামরিক সক্ষমতা দিয়ে জিতে যাওয়া বা টপকে গিয়ে সমাধান করা যায় না। এছাড়া পারমাণবিক টেকনোলজি মানবজগত থেকে প্রত্যাহার করে ফেলার যুগে নতুন করে এশিয়ায় পারমাণবিক সাবমেরিন দিয়ে যুদ্ধ সাজানোর প্রচেষ্টা একেবারেই চরম দায়িত্বজ্ঞানহীন। একদিন এজন্য বাইডেন আর বরিস কাঠগড়ায় উঠবেন, অবশ্যই!



মূল লেখা শুরু এখান থেকেঃ

ইংরেজি ওভারল্যাপ [overlap] মানে একজনের কোলে আরেকজন। মানে যেমন একটা জোটে থাকা অবস্থায় সেখানেই আরেকটা আরো কিছু অন্যদের সাথে জোট খুলে বসাটা হবে ওভারল্যাপিং জোট। হ্যাঁ, ঠিক তাই ঘটিয়েছেন প্রেসিডেন্ট বাইডেন। এশিয়ায় আগের কোয়াড জোটের বাইরে আরেকটা ত্রিদেশীয় জোট খুলেছেন। আর এই ঘটনাটা আমাদের দিক থেকে দেখলে, এতদিনে এনিয়ে আগ্রহীরা যখন জানল, কোয়াড জোট মানে কী ও কারা এরা। এ ছাড়া সবাই যখন ভাবছিল তারা এশিয়ার গ্লোবাল মেরুকরণ বুঝতে শুরু করেছে। ওদিকে আমেরিকা যখন আমাদের বাংলাদেশকে কোয়াডে ঢুকানোর জন্য চাপাচাপি করছিল এরই মাঝে ঠিক এমন সময় আরেক ফ্যাসাদ হাজির হয়েছে। বাইডেন নতুন আরেক জোটের ঘোষণা দিয়েছেন গত বুধবার ১৫ সেপ্টেম্বর যার বিস্তারিত ঘোষণা এবং তা নিয়ে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর প্রতিক্রিয়া দেয়া এখনো শেষ হয়নি। এরপর বিস্তারিত তথ্য আর বুঝাবুঝি শেষে তাৎপর্য বর্ণনা পশ্চিমেই এখনো তেমন শুরুই হয়নি। এমনই প্রাথমিক অবস্থায় এখন আমরা।

AUKUS বা এইউকেইউএসঃ
AUKUS এই হলো নয়া জোটের নাম। যে নামটা ভেঙে ভেঙে লিখলে হয় A-UK-US; মানে হল অস্ট্রেলিয়া, ইউনাইটেড কিংডম আর ইউনাইটেড স্টেটস – হল সেই ত্রিদেশীয় এক নয়াজোট। সবচেয়ে বড় কথা, জন্ম-ঘোষণার শুরু থেকেই এরা পরিষ্কার যে, এটা সামরিক জোট। মানে যেমন অস্ট্রেলিয়া, জাপান, ইন্ডিয়া আর আমেরিকা – এই চার দেশীয় ‘কোয়াড’ নামের জোটের মত – এবার নতুনটা সামরিক নাকি বাণিজ্যিক জোট এ নিয়ে কোনো তর্কই নেই। কোয়াড নাকি কোনো সামরিক বা বাণিজ্যিক কোনোটাই নয়, এমন না না করতে করতে এখন বলে এটা এক স্ট্র্যাটেজিক জোট। এসব ধানাই-পানাইয়ে এই নয়া জোটের বেলায় নাই। আরো সুনির্দিষ্ট করে বললে এটা অস্ট্রেলিয়াকে সাবমেরিনে সমৃদ্ধ করতে নয়াজোটের বাকি দু’দেশ বৃটেন-আমেরিকা ভুমিকা নিবে; এমন করে যাত্রা শুরু করার এক জোট হবে এটা; এমনটাই তাদের আপাতত বলতে শোনা যাচ্ছে। তবে তাও আবার ডিজেলে চলা ও ধোঁয়া ছাড়া সাবমেরিন নয়, এটা নাকি একেবারে পরমাণু অস্ত্র ও জ্বালানিতে চালানো এমন সমৃদ্ধ সাবমেরিন বহর হবে। অর্থাৎ এটা নিউক্লিয়ার সাবমেরিন (n-sub) হতে যাচ্ছে যেটা আবার SSBN বা নিউক্লিয়ার ব্যালেস্টিক অস্ত্র বহণকারি গোত্রের।

ইতোমধ্যেই পশ্চিমা এক্সপার্টেরা অল্প ক’জন যারা এই জোট নিয়ে মুখ খুলেছেন তারা বলা শুরু করেছেন যে এতে এশিয়াতে এখন আগের অন্যান্য জোট উদ্যোগগুলো মিলিয়ে যাবে আর এই নয়া জোটকে কেন্দ্র করে এশিয়ামুখী পশ্চিমা দেশেরও ব্যাপক মেরুকরণ শুরু হবে; যদিও যারাই ইতোমধ্যে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন তাতে লক্ষণ তেমন নয়।

এর প্রথম তাৎপর্য হল, যে ওভারল্যাপিং-এর কথা বলছিলাম, আগের কোয়াড যা এখনো বেঁচে আছে বলে জানি, তা থাকা সত্বেও পুরান কোয়াডের দুই সদস্য অস্ট্রেলিয়া আর আমেরিকা এই নয়া সামরিক জোট খুলেছে দেখা যাচ্ছে তবে সাথে ব্রিটেনকে নিয়ে। তাতে এখন বাকি দু’জন কোয়াড সদস্যের কী হবে?

কৌতুকের কথা হলো, কোয়াড এমন এক জোট যার সদস্য দেশের চার প্রধান কখনো একসাথে মুখোমুখি মিটিংয়ে বসেননি। কেবল এই গত মার্চ ২০২১ তে একবারই বসেছিলেন অন-লাইনে, মানে ভার্চুয়ালি। তবে এবার আগামী ২৪ সেপ্টেম্বর মানে এ’মাসেই আমেরিকায় হোয়াইট হাউজে প্রথম মুখোমুখি কোয়াড রাষ্ট্রপ্রধানরা বসতে যাচ্ছেন। এই মিটিংয়ের সেই অভাব সম্ভবত পূরণ হতে যাচ্ছে। তবে সেটা কারো কারো জন্য শেষ মিটিংও হতে পারে। অনুমান করা হচ্ছে বাইডেন সেখানে বৃটেনসহ তাদের গড়া নয়া জোটে যোগ দিতে কোয়াডের বাকি দু’দেশকে আনুষ্ঠানিক দাওয়াত দেবেন। তবে জাপানের কনস্টিটিউশনে ও ১৯৬০ সালের আমেরিকার সাথে করা এক সিকিউরিটি চুক্তি অনুসারে জাপানের পারমাণবিক তৎপরতায় যুক্ত হতে স্থায়ী নিষেধাজ্ঞা দেয়া আছে বলে সম্ভবত জাপান এমন জোটের সদস্য হতে বাধা পাবে। তাহলে আর ভারতের বেলায় কী হবে?

ভারত কী করবে?

কিন্তু আগেই এ নিয়ে আমাদের বোঝাবুঝির কাজ কয়েক ধাপ এগিয়ে রেখেছে এক রাশিয়ান মিডিয়া স্পুটনিক [SPUTNIK] । স্পুটনিকের সে নিউজের শিরোনামটাই অনেক সাংঘাতিক। শিরোনাম হল – “ভারতের জন্য বার্তা? নয়া জোটের ঘোষণায় কোয়াডের অস্তিত্ব আর আমেরিকার নির্ভরযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন ও বিতর্ক উঠেছে” [Message for India? AUKUS Announcement Sparks Debate About Relevance of Quad, Reliability of US]। কিন্তু স্পুটনিক কেন এমন শিরোনাম করল? কারণ, স্পুটনিক লিখেছে এই নয়া জোটের খবর ভারতের বিশ্লেষকদের মধ্যে আলোড়ন ও তর্ক তুলেছে। তারা ভালোভাবে নেননি। কিন্তু এত তর্ক উঠছে কেন?

কারণ তাঁরা সবাই ভারতের মনের আসল ইচ্ছাটা আগে থেকেই জানেন। আর তা হল, যতই মুচড়ামুচড়ি করুক, শেষে ভারত কারো সামরিক জোটে কখনো যাবে না। তাই তারা বলছেন, এই “অনিচ্ছুক” [New Delhi’s “reluctance”] ভারতের খবর তো বাইডেনের আমেরিকার অজানা নয়। তাহলে বাইডেনের এই নয়া জোটের ঘোষণার অর্থ তাঁরা করছেন এভাবে যে, বাইডেন তাহলে ভারতকে ছেড়ে অন্যান্য সম্ভাব্যদের নিয়ে এশিয়ায় অন্য কিছু খুঁজতে নেমে গেলেন। তবে, স্পুটনিক এখানেই না থেমে আরেক ধাপ এগিয়েছে। ভারতের এক সাবেক নেভি অফিসার শেষাদ্রি ভাসান [Seshadri Vasan] যিনি এখন চেন্নাইভিত্তিক এক থিংকট্যাংক [Chennai Centre for China Studies (C3S)] পরিচালনা করেন, তার সাথে এ নিয়ে কথা বলে তাঁর বয়ান সংগ্রহ করেছে। শেষাদ্রি স্পুটনিককে বলছেন, “ভারত বারবার জানিয়েছে, সে কোয়াডকে কোনো সামরিক জোট হিসাবে দেখে না, বড় জোর এক নিরাপত্তা স্বার্থবিষয়ক গ্রুপ হিসাবে ভারত দেখতে চায়”। এছাড়া তিনি বর্ণনা করে বলেছেন যে যেমন “তাইওয়ান প্রণালী বা দক্ষিণ চীন সাগর নিয়ে কোনো সামরিক সঙ্ঘাত দেখা দিলে ভারত সেক্ষেত্রে আমেরিকার সাথে কোনোরকম সামরিকভাবে জড়িত হতে অনিচ্ছুক” […also shown its reluctance to get militarily involved on the side of the US in case there is any conflict in the Taiwan Strait or the South China Sea for that matter]। তাই তাঁর ধারণা আমেরিকা নিশ্চয় (ভারতকে ছাড়া) অন্য আগ্রহী পার্টনার খুঁজছিল।

আসলে সত্যিকারভাবে বললে, ‘ভারতের অবস্থান সবসময়ই ছিল এমন যে “মাংসের ঝোল খাবো কিন্তু মাংস খাবো না” ধরণের। অর্থাৎ নিরাপত্তাবিষয়ক গ্রুপ- জোটে থাকব কিন্তু ‘সামরিক অ্যালায়েন্স’ এমন জোটে থাকব না। তাহলে নিরাপত্তাবিষয়ক কোনো গ্রুপের জোটেই বা ভারতের থাকার দরকারটা কী? আবার বাস্তবে তাহলে কোয়াডের অধীনে সদস্য রাষ্ট্রের যৌথ সামরিক মহড়ায় ভারতের অংশ নেয়ারইবা দরকার কী? এর অর্থই বা কী? এটা কি সামরিক তৎপরতায় যোগ দেয়া হয়ে যায়নি?

এমনকি সাউথ চায়না সি-কেন্দ্রিক কোয়াড জোট যে এলাকার সমুদ্রসীমা বিতর্ককে উসিলা করে গড়ে তোলা হয়েছে সেটা ভারতের কোনো সীমান্ত বা ভুমির কাছাকাছিও নয়, কোনো স্বার্থও নাই সেখানে। সেই কোয়াড জোটে তাহলে ভারত যোগ দিতে দৌড়াল কেন? আসলে কোয়াডকে একটা চীনবিরোধী জোট দেখেই ভারত ছুটে গিয়েছিল। কিন্তু ওদিকে এবার ‘শুধু ঝোল খাবার পণ’ করে রাখাতে এখন ভারতের মনে যা ছিল-আছে তা বাইরে উদাম হয়ে বের হয়ে আসছে।

তবে শেষাদ্রি আরেক মন্তব্য করেছেন, যা থেকে তিনি ইঙ্গিত দিয়েছেন যে, ভারত কোয়াডে থাকবে না। তাই তিনি ইঙ্গিত দিচ্ছেন কোয়াড ত্রিদেশীয় নয়া জোটে বিলীন হচ্ছে তাহলে ভারত সেখানে থাকতে পারছেই না। তবে তিনি কথাটা ঘুরিয়ে বলেছেন, “কোয়াড আগামীতেও হয়তো নিজেকে দরকারি করে বাঁচিয়ে রাখতে পারবে। কারণ নতুন ত্রিদেশীয় জোট তো প্রতিরক্ষাভিত্তিক”। অর্থাৎ তিনি ইঙ্গিত দিচ্ছেন কোয়াডই ত্রিদেশীয় জোটে রূপ নিতে যাচ্ছে।

তবে ঐ একই স্পুটনিক রিপোর্টে আরেক প্রাক্তন ভারতীয় রাষ্ট্রদূতের বয়ান এসেছে যার নাম অনিল ত্রিগুণায়াত [Anil Trigunayat]। এছাড়া এমনকি বর্তমান ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জয়শঙ্করসহ আরো অনেকের উদ্ধৃতি তুলে এনেছে স্পুটনিক। তবে তাদের সবার মূল কথাটা হল আসলে ভারতের কোয়াড জোটে থাকতে পারছে না বলে তা নিয়ে নিজেদেরকে দেয়া “সান্ত্বনা”। ভারতের ‘মন খারাপের কিছু নেই’ ধরনের বা ‘হতাশ হবার কিছু নেই’ এরকম [I don’t think New Delhi needs to feel threatened or disenchanted…… ]। যেমন একজন বলছেন, এখন থেকে ভারতের আলাদা আলাদা করে রাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করা উচিত।

ওই সাবেক রাষ্ট্রদূত কথা বলতে গিয়ে তিনি যেসব সংগঠনে ভারতের কদর আছে বলে গৌরব করে তা জানিয়েছেন যেমন ব্রিকস [BRICS] এই অর্থনৈতিক ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠান আর এসসিও [SCO] (সাংহাই করপোরেশন অর্গানাইজেশন) এর কথা। কিন্তু এখানে ব্যাপার হল ভারত যে এক অকর্মণ্য “বেচারা” তাই প্রমাণ হল। কারণ, এদুটো প্রতিষ্ঠানই আসলে চীনা উদ্যোগের জোট যেখানে চীনের মূলত প্রধান পার্টনার হলো রাশিয়া। আর ভারতকে চীন দয়া করে রেখেছে, নিজের উদারতায়; প্রতিদ্বন্দ্বি বা শত্রু হিসাবে দেখলে জোটে নিত না। একটা ফেয়ার এপ্রোচ বা ন্যায্যতাবোধে নেয়া চীনের এই সিদ্ধান্ত, যে লম্বাদুর পর্যন্ত চিন্তা করতে সক্ষমতা ও সাহস রাখে। এর সোজা অর্থ হল, রাষ্ট্রদূত অনিল ত্রিগুণায়াত এরই কথা অনুযায়ী দেখা যাচ্ছে, পশ্চিমা দুনিয়ায় ভারতের ভাত নেই, পাত্তাই নাই। তারা নিজেকে নিয়ে আছে। আর ভারতকে চীনের বিরুদ্ধে ব্যবহার করার তালে আছে কেবল। এর বাইরে ভারতের কোথাও পাত্তা নাই। তাই অন্য জায়গা ভারতের গুরুত্বের কথা বলতে গেলে যতটুকু যা আছে তা নয়া নেতা চীনেরই উদ্যোগের ভিতরের কথাই উল্লেখ করতে হচ্ছে। যে চীনকে আবার আপাতত দেখা যাচ্ছে, ভারত শত্রু মনে করছে। কিন্তু চীন ব্যাপারটাকে দেখছে এক অবজেকটিভ ফেনোমেনা আকারে। আমেরিকার অর্থনৈতিক সক্ষমতা কমে গেলে সেই দুনিয়াতে নেতা থাকবে চীন আর চীনের পিছনে উঠে আসতে পারে ইন্ডিয়া (যদি সে অপ্রয়োজনীয় মুসলমান ঘৃণা চিরদিনের জন্য ত্যাগ করে সরে আসে, এই অঞ্চলকে শান্তি দেয়, অর্থনীতিতে মন দেয়)। আর চীনের দিক থেকে, চীন আগেভাগেই ভারতের সব সম্ভাবনাগুলোকে নিজের ইচ্ছায় নাকচ করতে পারে না। এই অসততা উলটা চীনকেই একসময় ক্ষতিগ্রস্থ করবে। অবজেকটিভ ফেনোমেনাকে রুখে দেয়া যায় না। রুখে দিবার চিন্তা করে বোকা-হিংসুক আর গর্দভেরা। বুদ্ধিমানেরা সাগরে ঘুর্ণিঝড় দেখা দিলে ওর সাথে লড়তে যায় না, খাপ খাইয়ে নেয়া আর কম ক্ষতি কিসে হবে সেই পথে ঝড়ের সামনে যায়।

তবু বহুবার লিখেছি ভারতের ন্যাচারাল ফ্রেন্ড মানে বিষয়-আশয় বা অর্থনৈতিক স্বার্থবিষয়ক কমন ও প্রধান পার্টনার হবে চীন। এটাই অবজেকটিভ নিয়তি। (অবজেকটিভ [objective] বলতে যেটা কোন কর্তা-মানুষ ঠিক করে নাই। ন্যাচারাল ভাবে হয়েছে। যেটাকে আমরা অনেক সময় বলি আল্লায় ঠিক করেছে।) আমেরিকা ভারতের পিঠে হাত রেখে ভারতকে ‘মুই কি হনু রে’ অবস্থা করে এই নিয়তি থেকে দূরে ঠেলে সরিয়ে রাখা নিশ্চিত করতে প্রাণপণ চেষ্টা করে যাচ্ছে; সেটা এই শতক মানে গত বিশ বছর ধরে। কিন্তু সবক্ষেত্রেই ফলাফল আমেরিকা আ ভারতের জন্য শুণ্য। তবু, ভারত আমেরিকান আকাঙ্খা মোতাবেক নিজেকে সেই বাক্সে ঢুকিয়েছে। ভেবেছে, সে পরাশক্তি হয়ে গেছে বা যাচ্ছে। ভারতের বিদেশ মন্ত্রণালয় বা জয়শঙ্কর ইত্যাদি এরা “কথিত পরাশক্তি হয়ে যাবার” এই মিথ্যা কল্পনা ইলিউশন মায়ায় ভারতের মিডিয়াকে (প্রতীকীভাবে দৈনিক দাহিন্দু এর সুহাসিনী হায়দারের কথা ভাবা যায়) প্রভাবিত করে চলেছিল দশক ধরে। কিন্তু এবার করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে সব ন্যাংটা হয়ে যায়। এই ভারত তার নাগরিককে করোনায় বেড দূরে থাক অক্সিজেন দিতে পারে নাই। মরলে সৎকার বা সাধারণ মাটি দিবার ব্যবস্থাটুকুও করতে পারে নাই, ব্রীজের উপরে নিয়ে বা নদীতে নিয়ে ফেলে দিয়ে নুন্যতম মানুষের মর্যাদা নষ্ট ও অপমান করেছে। তাই সুহাসিনী আর তাকে দেখানো পরাশক্তির স্বপ্ন তিনি বইতে রাজী হয় নাই। সে উলটা এখন ঐ মিথ্যা স্বপ্নকে প্রকাশ্যেই প্রশ্ন করে থাকে। তবু কারো কারো হুশজ্ঞান কখনই হয় না। যেমন দ্যাপ্রিন্টের ফরেন ডেক্সের নয়নিমা বসু [NAYANIMA BASU]। তালেবানদের কাবুল দখলের আগে তাকে ভারতীয় সামরিক বিমানে এমবেডেড জার্নালিজম করতে আফগানিস্তানে নেয়া হয়েছিল। সে এখন তালেবান ইস্যুতে মোদী সরকারের পারফরমেন্সের পক্ষে প্রধান ভক্ত-প্রচারক; একেবারে – ফ্লায়িং হাই মানে আকাশে উড়ছেন অবস্থা!। অথচ খোদ জয়শঙ্করই এখনই বুঝে গেছে কত ধানে বড় জোর কত চাল হয়। সে ইতোমধ্যেই জানান দিচ্ছে ভারত কোন যুদ্ধে-টুদ্ধে নাই। জয়শঙ্কর এখন গ্লোবালাইজেশন ও গ্লোবাল বাণিজ্যের ভক্ত। বলছেন, সব দেশই একালে একসাথে (বাণিজ্য নিয়ে) কাজ করতে বাধ্য […… globalisation. It reflects the compulsions of countries to work together. ]। কিন্তু নয়নিমাদেরকে কে এসব বুঝাবে।

এটাই গত বিশবছর ধরে চলে আসছে। প্রণব বা মোদি কারো আমলেই ভিন্ন কিছু হয়নি। বুশ-ওবামা আমলে এই ব্যক্তিত্বরা ১৬ বিলিয়ন ডলারের আমেরিকান রফতানির বাজার সুবিধা ভারতকে দিয়েছিলেন আর তাতেই এটা আমেরিকান বিদেশনীতির অঙ্গ অংশ হয়ে গেছিল। আর তাতেই জাতিবাদী ভারত কেঁচো হয়ে, চীনের বিরুদ্ধে অপ্রয়োজনীয়ভাবে অপরের জন্য ভারতীয় শের হয়ে গিয়েছিল। এমনকি ট্রাম্প ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে ক্ষমতায় এসেই সেসব রপ্তানি সুবিধা বাতিল করে দিলেও ভারত আর আমেরিকার হাত ছাড়তে পারেনি। অথচ এখন দাবি করছে তারা আমেরিকার সাথে সামরিক জোটে যাবে না! এ জন্যই এটাকে মাংস খাব না কিন্তু ঝোল খাবার লোভ বলেছি। ফলে এখনো আমরা আসলেই জানি না যে যদি বাইডেন ১৬ না হোক ১০ বিলিয়ন ডলারের রফতানি সুবিধা ভারতকে এখন দেন সেক্ষেত্রে ভারত কি বাইডেনের সামরিক জোটে যাবে না বলতে পারবে? আমরা নিশ্চিত করে বলতে পারি না। এই হল পরাশক্তি ভাবধরা ভারতের নিজ সম্পর্কে বিবেচনাবোধ!

বুদ্ধিমানরা জানে একসাথে সব দ্বন্দ্বের মীমাংসা করতে যাওয়া যায় না। কারণ এটা কার্যকর পদ্ধতি নয় আর, তা সফল করাও যায় না। প্রত্যেকবারে নতুন জেগে থিতু হয়ে উঠা প্রধান দ্বন্দ্বটারই কেবল মীমাংসা করে করে আগাতে হয়; যেমন এখনকার মূল দ্বন্দ্ব চীন-আমেরিকার। ফলে ভারতের দিক থেকে তা মোকাবিলার এটিচুড হতে হবে চীন-ভারত এক দিকে বনাম আমেরিকা, এভাবে দ্বন্দ্বের পক্ষ-বিপক্ষ সাজানো। এরপর তা সমাধান হয়ে গেলে বা এই দ্বন্দ্ব-নিরসন বা বিনাশ হয়ে গেলে তখন আবার মুখ্য দ্বন্দ্ব হিসেবে তা চীন-ভারত দ্বন্দ্ব হতে পারে। ততদিনে ভারতের অর্থনৈতিক মুরোদ অন্যকে বলার মতো করে বাড়িয়ে নেয়া যাবে আর তা দরকারও; যদিও এমনটা অর্জনের আগে দুটা আরো অভ্যন্তরীণ সংস্কার ভারতকে করতেই হবে। এক. হিন্দুত্ববাদ ত্যাগ করে দেশের সবাই নাগরিক ও সমান অধিকারের – এমন এই পরিচয়ে নাগরিক অধিকারভিত্তিক এক নয়া ভারতরাষ্ট্র তাকে গড়ে নিতেই হবে। আর দ্বিতীয়টা প্রথমটারই অনুষঙ্গ। তা হল নেশন স্টেট বা জাতিরাষ্ট্র ধারণা সমুলে ত্যাগ করা। ফলে হিন্দুত্ববাদ বা হিন্দু জাতিবাদ বাদ দিতে হবে। এমনকি নাদান অবুঝ ট্রাম্পের মত অর্থনৈতিক জাতিবাদও বাদ দিতে হবে। কারণ ইতোমধ্যে আমরা সবাই এক গ্লোবাল বাণিজ্য লেনদেনের যুগে একেবারে ঢুকে গেছি। আর এটা ‘ওয়ান ওয়ে’।

এই ‘পুলসিরাত’ পার হতে পারলে ভারত পরে সবকিছু হতে পারবে। নইলে ‘কিছুই নয়’। এর আগে আগামি ভারতের ২০২৪ সালের নির্বাচনে বিজেপি হেরে গেলে নতুন যারাই কোয়ালিশনে ক্ষমতায় আসুক তারা সম্ভবত চীনের অর্থনৈতিক পার্টনার হওয়ার পথ ধরবে। আর তাতে অর্থনৈতিকভাবে ভারত আরো দ্রুত সক্ষম হওয়ার পথ ধরবে। কিন্তু তবু আমেরিকার থেকেই ভারত সামরিক সরঞ্জাম কিনবে। কারণ ভারতের পারসেপশন হল তার সম্ভাব্য প্রধান শত্রু চীন। তাই ভারত চীনের থেকে অনেক কিছু কিনলেও অস্ত্র কিনতে পারে না, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তা চীনের সাথে সম্পর্ক ক্ষতি করবে না। কাজেই ভারতে এমনটা ঘটার সম্ভাবনার দিকে এখন পরিস্থিতি যাবে বলে অনুমান করছে অনেকে। আর সেক্ষেত্রে আপাতত ভারতকে কোয়াড থেকে বের করে দিলেও আমেরিকার সাথে মোদীর ঘনিষ্ঠতা থেকে যেতেই আমরা দেখব। আমেরিকার ভারতকে দরকারের চেয়ে মোদীর ভারতের আমেরিকাকে বেশি দরকার, পারসেপশন এমনই নানান কারণে। তবে বর্তমান হিন্দুত্ববাদের ভারতের নেতৃত্বের উপর আমেরিকারও তেমন আস্থা নেই। অর্থাৎ চাইলে ভারতের জন্য বিকল্প পথ আছে, এটার রেকর্ড থাকল এতে!

‘আটলান্টিক’ আওয়াজটা আবার বেশি উঠছেঃ
আটলান্টিক [Atlantic] এক মহাসাগরের নাম, যা মূলত আমেরিকাকে ইউরোপ থেকে আলাদা করেছে মনে করে তা গুরুত্ব দিয়ে দেখা হয়। সেদিকে তাল রেখে ‘আটলান্টিক’ অনেক কিছুরই নাম রাখা হয়ে থাকতে দেখা যায়। এমনই প্রতীক বা ইঙ্গিত অর্থে ‘আটলান্টিক-এর একটা মানে হল – যা কিছু আমেরিকা ও ব্রিটেন (ইউরোপ) মিলে অন্যদের বিরুদ্ধে তাই ‘আটলান্টিক’। এখন এখানে আলোচ্য ইস্যুতে, আমেরিকা ও ব্রিটেন দু’দেশ মিলে অস্ট্রেলিয়াকে জাপটে ধরে তাকে এশিয়ায় সামরিক কেন্দ্র বানাতে চাচ্ছে। তাও আবার পরমাণুকেন্দ্রিক সামরিকতা। ফলে এটাও যেন এক আটলান্টিক সামরিকতা! এই হল আমেরিকার এই নয়াজোটের তাতপর্য।

কিন্তু বাইডেন বেখবর হয়ে আবার নিজেকে পুরানা স্টাইলে প্রভাবশালী ক্ষমতাবান ‘বীর’ সাজতে চাইছে। কারণ মূলত দুনিয়াতে ইতোমধ্যে সামরিক অস্ত্রে পরমাণু টেকনোলজির ব্যবহার বন্ধ করা, নাহলে নুন্যতম কমানোর প্রতিশ্রুতি দিয়ে সবাই নানান রিজিওনাল চুক্তি করছে। এবং ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে যেমন জ্বালানি ও বিদ্যুতের উৎস হিসেবে পরমাণু টেকের ব্যবহার কমানোর দিকে সারা দুনিয়া ঝুঁকে পড়েছে, জনমতও সেদিকে। অথচ এমনকালেই বাইডেন-বাবাজি পরমাণু-সাবমেরিন (SSBN) দিয়ে কী করে এশিয়ার যুদ্ধের নাট্যমঞ্চ সাজাতে আসে? সে কেমন কথিত এই আটলান্টিক শক্তি?

এ পেছনের মুল কারণ সম্ভবত এটাই যে কথিত এই আটলান্টিক শক্তির উদ্যোগ আসলে অন্যের ঘাড়ে মানে ও অষ্ট্রেলিয়ার উপর দিয়ে যাবে। বাইডেনের “আটলান্টিক শক্তি” এশিয়াতে আসছে একারণে যে, এর যুদ্ধের নাট্যশালা থেকে আমেরিকা-বৃটেন থেকে অনেক দূরে? তাই কী? আপাতত বাইডেনদের তাই মনে হচ্ছে বটে কিন্তু তাই কি? না। অচিরেই বাইডেন এর বিরোধিতা সামলাতে হয়রান হয়ে যাবেন!

ফ্রান্স প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ কেন?

এই ত্রিদেশীয় সামরিক চুক্তি ও জোট খুলে বসাতে ইউরোপের দ্বিতীয় শক্তি ফ্রান্স প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হয়েছে। কেন? এর কারণও সাবমেরিন। যে সাবমেরিনভিত্তিক জোটের কথা আমরা এখন শুনছি – আমেরিকা-ব্রিটেনের আর সাথে আলাপ আলোচনার কালে সমান্তরালে অস্ট্রেলিয়া ফ্রান্সের সাথেও তাদের থেকে সাবমেরিন কিনবে বলে আলোচনা প্রায় সমাপ্ত করে এনেছিল। ত্রিদেশীয় চুক্তিতে যেটা আছে তাতে আগামি ১৮ মাসের মধ্যে কয়েকটা নয়া পরমাণু-সাবমেরিন আমেরিকা-ব্রিটেন বানিয়ে দিবে। আর এজন্যই ত্রিদেশীয় চুক্তি হয়েছে, এটাই ওর মুলকথা। কিন্তু বেশি বুদ্ধিমান বলে অষ্ট্রেলিয়া আসলে সে ভীষণ বোকা আর লোভী। তার স্বপ্ন যে সে ঐ অঞ্চল সাম্রাজ্য খুলে বসবে আর আমেরিকা-বৃটেন তাকে দূরে বসে সহায়তা দিবে আর লভ্যাংশ গুণবে। এই লোভীর খবরই নাই যে “সাম্রাজ্যরূপে দোকান” খুলে বসার দিন ১৯৪৫ সালে বিশ্বযুদ্ধের মধ্য দিয়ে শেষ হয়ে গেছে। দুনিয়াতে কেউ আর এখন সাম্রাজ্য নয়, সব দোকান বন্ধ। অটোমান, জার কিংবা বৃটিশ বা ফরাসী ইত্যাদি সব কলোনি সাম্রাজ্য একালে নাজায়েজ, আর এটাই জাতিসংঘের জন্মভিত্তি। যদি সাম্রাজ্য ব্যবস্থা ফিরিয়ে দেখতে চান তো দুনিয়াকে ১৯৪৫ সালের আগের দুনিয়ায় ফিরাতে হবে। পারবেন?

তাহলে এযুগে কী সম্ভব? অর্থনৈতিক শক্তি জোট হওয়া সম্ভব। চীনের বেল্ট-রোড মহাপ্রকল্প এমন জোট সম্ভব। এমনকি বিনিয়োগের মুরোদে দেখাতে পারলে বাইডেনও পালটা আরেক কোন মহাপ্রকল্প জোট খাড়া করতে পারেন। [যদিও ঐ বিনিয়োগের মুরোদটাই অনিশ্চিত]। তো অষ্ট্রেলিয়া নিজ কোন মুরোদ দেখিয়ে ঐ অঞ্চলে সবার উপরের এক ‘সাম্রাজ্য’ নেতা হবেন? বিপুল কোন বিনিয়োগ সক্ষমতা আছে তাঁর? নাকি লেটেস্ট পরমাণু-সাবমেরিন? এই অসারবস্তু চিন্তাটা বুঝবার মত কেউ কী অষ্টেলিয়ায় নাই? অবিশ্বাস্য! ঘটনা আরো আছে।

কিন্তু ফরাসিদের হারিয়ে কথিত আটলান্টিক জোটের আমেরিকা ও ব্রিটেন কোন কারণে এগিয়ে গেল? কারণ বাইডেনও তো খুবই বুদ্ধিমান। তার এখন নিজেকে বাঁচাতে অস্ত্র বিক্রি বারাতে চান, নিজরাষ্ট্রের দায় ও পরিচালন ব্যয় কমানোই মুল লক্ষ্য। তাই অষ্ট্রেলিয়ার এই দিবাস্বপ্ন জানলেও পরমাণু-সাবমেরিন বেচাই তার একমাত্র লক্ষ্য। অষ্ট্রেলিয়া বুদ্ধিমান সাজতে গিয়ে আমেরিকার পাশাপাশি ফ্রান্সের কাছ থেকে বিকল্প হিসাবে রেডিমেড তৈরি থাকা সাবমেরিন কিনবার সম্ভাবনা যাচাই করেছিলেন। যার মুল্য ছিল প্রায় ৯০ বিলিয়ন। আর এখানেই দাও মারেন বাইডেন আর আরেক চাপাবাজ প্রধানমন্ত্রী বরিস। তারা অষ্টেলিয়াকে বুঝান যে এটা তারা অষ্টেলিয়াকে নতুন বানিয়ে দিলে অনেক কম খরচে হবে। আর এতেই ফরাসী ম্যাক্রোর কাস্টমার ছুটে যায়। বলা যায় বাইডেন লোভ দেখিয়ে ভাগিয়ে নিয়ে গেছেন বলে ফ্রান্স মনে করে।

ফলে মুলকথা আমেরিকা-বৃটেন অস্ট্রেলিয়াকে নিজেদের কোলে তুলে নিতে সক্ষম হয়। আর এতে ক্ষুব্ধ ফ্রান্সের প্রতিক্রিয়া হয় দেখার মত। ফ্রান্সের ক্ষুব্ধ কূটনৈতিক মন্তব্য- ওরা ‘পিঠে ছুরি মেরেছে’ [“It’s a stab in the back. We had established a trusting relationship with Australia, and this trust was betrayed,” ], মানে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। ইউরোপীয় মিডিয়া বলছে এটা ৫০ বিলিয়নের বেশি ইউরোর ডিল […France-slams-australia-us-e50b-submarine-deal…]। ভারতের ঐ থিঙ্কট্যাংক বলেছে এতা ৯০ বিলিয়ন ডলারের ডিল [Australia’s decision to scrap its $90 billion nuclear submarine contract with France’s Naval Group ]।
আর ফরাসী প্রধানমন্ত্রী ম্যাঁক্রোর এমন প্রতিক্রিয়া বলছে এটা আসলে যতটা সামরিক জোটের ঘটনা বলে দেখানো হচ্ছে এটা এর চেয়েও বেশী অস্ত্র ব্যাবসায়িক।

তাই ঘটনার আসল দিক অন্যখানে। ফ্রান্সের এই প্রতিক্রিয়া থেকে পরিষ্কার যে, এটা নেহাত সামরিক জোটের মামলা নয়। কারণ এটা আসলে যুদ্ধজোট নয়, ৯০ বিলিয়ন ডলারের এক বিনিয়োগ ও লাভালাভের প্রকল্প! তাই তো নাকি? এটা অর্থনৈতিক লাভালাভেরই জোট। অন্য দেশকে লুটে যে অর্থনৈতিক লাভালাভ হবে, এরও ভাগাভাগি করে খাওয়ার জোট। ভারতীয় নেভি অফিসারও এই ইঙ্গিতই দিয়েছেন। অতএব ফরাসিদের তাড়িয়ে এটা তাহলে আমেরিকা-ব্রিটেন সে প্রকল্প নিয়ে নিয়েছে এর ঝগড়া। সেটা হোক! কিন্তু কথা হল, এটা এখন কী ধরনের আটলান্টিক জোট হল? ফরাসিরা নিশ্চয় ভেসে আসেনি, ভেসে যাবেও না! তবে অবিলম্বে এখানে ন্যাটোকে ভেঙে নতুন পরিস্থিতির উপযোগী করে সাজানোর ইঙ্গিত দেখা যাচ্ছে। আটলান্টিক শব্দটা বেশি উঠে আসার কারণ এসবেরই পেছনে লুকানো। ওদিকে ইতোমধ্যে ক্ষুব্ধ ফরাসী প্রধানমন্ত্রী ম্যাঁক্রো অষ্টেলিয়া ও আমেরিকা থেকে রাষ্ট্রদুত প্রত্যাহারের ঘোষণা করেছেন। অর্থাৎ ব্যাপারটা খুব সহজে মিটছে না।

চীনের প্রতিক্রিয়া:
নতুন AUKUS জোট, দক্ষিণ চীনসাগর ঘিরে এশিয়ায় এই আরেকটা সামরিক জোট হচ্ছে, এতে চীনের ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া হবে তা স্বাভাবিক। তবু চীনের প্রতিক্রিয়া অতটুকুতেই সীমাবদ্ধ নয়। যেমন, চীন এক শব্দের এক ছোট মন্তব্য করেছে – ‘ইরেসপন্সিবল’ মানে দায়িত্বজ্ঞানহীন [‘Aukus’ security pact irresponsible]। খুবই গভীর অর্থবোধক মন্তব্য সন্দেহ নেই। কেন?

চীন-আমেরিকার অর্থনৈতিক সক্ষমতাই মূল দ্বন্দ্ব বা বিরোধ; মানে গ্লোবাল সিস্টেমের নেতৃত্ব হল বিরোধের কেন্দ্র। যা মূলত অর্থনৈতিক সক্ষমতা কেন্দ্রিক- আর সেই নেতৃত্বের অবস্থান থেকে আমেরিকা ক্রমেই ঢলে পড়ছে; বিপরীতে চীন উঠে আসছে। এই হলো বাস্তবতা। তার একটা বড় প্রকাশ হল, ইন্ডেপেন্ডেন্ট স্টাডি রিপোর্টগুলো থেকে পাওয়া –BBC REPORT অথবা REUTERS বলছে আগামী ২০২৮ সালের মধ্যে অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে চীন আমেরিকাকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে। এখানে খুবই খেয়াল করে লক্ষ্য করার ব্যাপারটা হল, এখানে অর্থনৈতিক সক্ষমতা নিয়ে কথা হচ্ছে, কোনো সামরিক সক্ষমতা নয়, কোনো রাজনৈতিক চিন্তার বিরোধ বা সক্ষমতাও নয়। অর্থাৎ এটা একেবারেই অবজেকটিভ সক্ষমতা, সাবজেকটিভ একেবারেই নয়। এর মানে হল, আমেরিকা এই যুদ্ধ করে এই যুদ্ধে জয়লাভ করলেও তাতে চীনের চেয়ে আমেরিকা অর্থনৈতিক সক্ষমতায় সমান হতে পারবে না।

অর্থনৈতিক সক্ষমতা যুদ্ধে অর্জনের বিষয়ই নয়। তাহলে আমেরিকা-ব্রিটেন সাথে এক অস্ট্রেলিয়াকে – এভাবে নিয়ে তারা যুদ্ধজোট সাজাচ্ছে কেন? যুদ্ধে জিতলে অস্ট্রেলিয়াও কি চীনের সমান অর্থনৈতিক সক্ষমতা অর্জন করবে? কোনই সম্ভাবনা নাই। এছাড়া এটা কলোনিদখলের যুগ আর নয় যে অষ্ট্রেলিয়া বাইডেনের সহায়তা কোন দেশকে দখল করে তার সম্পদ বৈধ বলে নিজের দাবি করতে পারবে। অথবা যারা সাবমেরিন সাপ্লাই দিয়েছে তাদেরকে চুরি লুটের কোন ভাগ দিতে পারবে।

এছাড়া আরো মারাত্মক দিক হল, এই সামরিক জোট চুক্তিটা করা হল আবার একটা পরমাণু-যুদ্ধের হুমকি তৈরি করে। এটার সাফাই ন্যায্যতা কী? এবার এমনকি যুদ্ধে অস্ট্রেলিয়া বিজয়ী হলেও কি সে নিজ অষ্ট্রেলিয় বাসিন্দাদের জীবন রক্ষা করতে পারবে? তারা পরমাণুর রেডিয়েশনের মধ্যে বেঁচে থাকবে কী করে? যারা চুক্তিটা নিয়ে খুবই ব্যস্ত এই শাসক রাজনৈতিক নেতারা তাদের বাঁচাবেন কী করে? এবার আমেরিকা-ব্রিটেনের কি এ ব্যাপারে অস্ট্রেলিয়াকে ঠে্লে দেওয়ায় ওসব নাগরিকদের প্রতি তাদের কোনো দায় নেই?

কেউ নিজেকে “মানুষ” বলে দাবি করলে, তাঁর ন্যূনতম দায়িত্বজ্ঞান বোধ থাকলে এমন সিদ্ধান্ত তিনি নিতে পারে না; যেখানে পরমাণু শক্তির বাণিজ্যিক বা সামরিক সর্ববিধ ব্যবহার বন্ধ করা, ন্যূনপক্ষে একেবারে কমানো – এটাই এখনকার মুখ্য গ্লোবাল ট্রেন্ড এবং প্রবল গ্লোবাল জনমতও বটে।

চীনের সাথে কোন দেশের বিরোধ করার, বিশেষ করে রাজনৈতিক বিরোধিতা করার জন্য পশ্চিমের বহুবিধ জেনুইন বিষয় আছে। আর তা দোষের কিছুওও নয়। তাই সেগুলো নিয়ে সদর্পে লড়া তর্ক-বিতর্কে লিপ্ত হওয়া, প্রাতিষ্ঠানিক ফোরামে বাধা দেয়া দরকারও সম্ভবত যাতে চীন তা অন্তত অনেকটাই গ্রহণ করতে বাধ্য হয়। কেবল ব্যাপারটাকে ডায়লগের মধ্যে রাখতে পারতে হবে। তা অবশ্যই আমেরিকা করতেই পারে। কিন্তু তাই বলে এই বাধা দেয়া আমেরিকার AUKUS জোট করবে পারমাণবিকভাবে? এরা হিটলারের চেয়েও ঘৃণিত ব্যক্তিত্ব হবে! তাও আবার একটা অর্থনৈতিক সক্ষমতার বিরোধে? এতে এমনকি পশ্চিম বা আটলান্টিকের বাসিন্দাদেরকেও দায় নিতে হবে! তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদেরকে ঠেকানোর দায়িত্ব তাদেরও আছে। এই ইস্যুতে আজীবন তাদের জবাবদিহিতা করতে হবে।

এশিয়ায় বাংলাদেশসহ আমরা কেউ অবশ্যই কোনো অর্থনৈতিক জোটের বাইরে অন্য কোনো সামরিক বা যুদ্ধজোটে যুক্ত হতে পারি না। কমবেশী আমাদের সবার মনোভাব যুদ্ধজোট বিরোধী। ওবামার ‘এশিয়া পিভোট নীতি’ ফেল করেছিল একারণেই। পরের কোয়াডও প্রায় ফেলের পথে একই কারণে। সাউথ চায়না সি-এর আশপাশের (অস্ট্রেলিয়া জাপান ছাড়া) যেমন আসিয়ানভুক্ত কোনো দেশ এসব কোন উদ্যোগ না জোটে অংশ নেয়নি। অর্থাৎ যাদের সাথে চীনের সমুদ্রসীমা বিরোধ আছে এমন কোনো দেশ আমেরিকার কোন জোটে কখনো অংশ নেয়নি, আশ্রয় নেয় নাই। অর্থাৎ তারা ন্যায্যভাবে তাদের চীনের সাথে বিরোধের অবশ্যই মীমাংসা চায়; কিন্তু আমেরিকার কোলে চড়ে নয়, কিংবা আমেরিকার পাতা কোনো যুদ্ধজোটে যোগ দিয়ে নয়। একারণের আমেরিকান সব উদ্যোগ মূলত ফেল করছে একের পর এক। আমেরিকার এই ব্যর্থতাই কি যথেষ্ট প্রমাণ নয় যে, ঐ অঞ্চলের কেউ ওখানে কোনো যুদ্ধজোট গড়ার দরকার মনে করে না? এর পরেও আমেরিকা ছাড়েনি। এবার পারমাণবিক যুদ্ধের দামামা নিয়ে ব্যবসা করতে এগিয়ে এসেছে। মনে হচ্ছে আবার এশিয়ার জন্য এক মহাদুর্যোগ সামনে! এটাও আমাদেরকে অবশ্যই পার হতেই হবে!

লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
goutamdas1958@hotmail.com

Advertisements