শিল্পবিপ্লবের ফলে ইউরোপের বিভিন্ন পুঁজিবাদী গোষ্ঠী ইংরেজ, ডাচ, ওলন্দাজ, স্পেন প্রভৃতি দেশে কাচাঁমাল সংগ্রহ ও নতুন বাজার সৃষ্টির লক্ষ্যে বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়ে।
সাম্রাজ্য বিস্তার ও উপনিবেশ স্থাপনে পরস্পর প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়। বণিকবেশি এই সাম্রাজ্যবাদীরা ভারতবর্ষের রাজন্যবর্গের পরস্পর কলহ ও দুর্বলতার সুযোগে প্রথমে বাংলা,বিহার,উড়িষ্যা দখল করে নেয়।
পরবর্তীতে মুঘল সম্রাটদের দুর্বলতা ও অযোগ্য নেতৃত্বের ফলে ইংরেজ-বেনিয়াগোষ্ঠী দিল্লির মসনদ দখলে নিয়ে নেয়।
ইংরেজরা ক্ষমতা দখলে নিয়ে এদেশের জনসাধারণ বিশেষ করে মুসলিমদের ওপর নির্যাতন-নিপীড়নের বিভীষিকা কায়েম করে। দস্যু বাহিনীর মতো এ দেশের ধন-সম্পদ শোষণ করে বিলেতে পাচার করে।
মুসলমানের শিক্ষা সংস্কৃতি,তাহযীব-তামাদ্দুনের ওপর আগ্রাসন চালায়। একদিকে মানবতার ওপর জুলুম-নির্যাতন, অপরদিকে দ্বীন-ধর্মের ওপর বিভিন্ন রকম আক্রমণ। ফলে পৃথিবীর ইতিহাসে জঘন্যতম, লোমহর্ষক নির্যাতনের শিকার হয় ভারতবর্ষের মানুষ।
এ পরিস্থিতিতে ইমামুল হিন্দ শাহ্ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলবির সুযোগ্য সন্তান মুসনাদে হিন্দ শাহ আব্দুল আযীয ভারতবর্ষকে ‘দারুল হারব’ (শত্রুকবলিত দেশ) ঘোষণ করলেন। এই ফতোয়া দিশেহারা মুক্তিকামী মানবতাকে সঠিক সিদ্ধান্ত ও কর্মপন্থা গ্রহণের রাহনুমায়ী করে।
শাহ্ আব্দুল আযীযের আদর্শিক চেতনা ও জিহাদী অনুপ্রেরণায় ময়দানে আগমণ করলেন শহীদে বালাকোট আমিরুল মুমিনীন সাইয়্যিদ আহমদ শহীদ (রহ.)।
ইলম, আমল আর যোগ্যতায় তিনি এমন একজন কামেল ব্যক্তিত্ব ছিলেন, যিনি সঠিক লক্ষ্যে আঘাত হানতে সক্ষম হোন।
তরবিয়াত ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তিনি এমন একটি দল তৈরি করেন, যারা ইমানি চেতনা, আমল আর ত্যাগ-কোরবানির জন্য ছিলেন সাহাবাগণের পদাঙ্ক অনুসারী। ‘ফুরসান ফিন নাহার ওয়া রুহবান ফিল লাইল’ এর বাস্তব নমুনা।
সাইয়্যিদ আহমদ ইবন ইরফান ১৭৮৬ সালের নভেম্বর মাসে ভারতের উত্তর প্রদেশের রায়বেরলী নামক স্থানে জন্মগ্রহণ করেন। চার বছর বয়সে তাকে মক্তবে পাঠানো হয় কিন্তু লেখাপড়ার প্রতি তার সবিশেষ আগ্রহ ছিল না।
যখন তিনি শাহ আব্দুল আযীযের দরবারে আগমণ করেন তখন শাহ আব্দুল আযীয বুঝতে পারছেন এই যুবকের স্বভাব ও প্রকৃতি লেখাপড়ার প্রতি নাই বরং প্রয়োজনীয় ইলম তাকে ঐশীভাবেই সরবরাহ করা হবে।
তিনি সাইয়্যিদ আহমদ শহীদকে তরবিয়াতের মাধ্যমে খোলফত প্রদান করেন এবং দাওয়াত, ইরশাদ ও জিহাদের মিশনের প্রস্তুতি গ্রহণ করতে বলেন।
শাহ আব্দুল আযীয সাইয়্যিদ আহমদকে আমীর এবং আপন ভাতিজা মাওলানা শাহ ঈসমাইল ও জামাতা মাওলানা আব্দুল হাইকে উপদেষ্টা মনোনীত করে সশস্ত্র বাহিনী গড়ে তোলেন। দাওয়াত, তরবিয়াত ও ইসলাহী মিশন নিয়ে সায়্যিদ আহমদ ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চল সফর করেন।
তার রুহানী প্রভাবে দেশব্যাপী ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি হয়। তিনি স্বদেশের স্বাধীনতার লক্ষ্যে জিহাদী চেতনা তৈরি ও মুজাহিদ সংগ্রহ করতে থাকেন।
এভাবে দাওয়াত ও ইসলাহের মাধ্যমে মুজাহিদ সংগ্রহ করে সাইয়্যিদ আহমদ শহীদ ইংরেজ-বেনিয়াদের জুলুম-নির্যাতন থেকে উপমহাদেশের জনসাধারণকে মুক্তি দিতে সীমান্ত প্রদেশের দিকে আগ্রসর হোন।
সিন্ধু, কান্দাহার ও কাবুল হয়ে সীমান্ত অঞ্চলে তিনি স্বাধীনতার ঘাটি স্থাপন করেন। ১৮২৭ সালের ১০ জানুয়ারি সেখানে তিনি অস্থায়ী সরকার গঠন করেন। এই সরকারে প্রশাসন, অর্থ, সমর ও বিচার ইত্যাদি পৃথক পৃথক বিভাগ গঠন করেন। সায়্যিদ আহমদ অস্থায়ী সরকারের আমীর মনোনীত হোন।
তিনি সকল মুরিদদের থেকে বায়আত নেন। স্থানীয় পাঠান সরদারগণও তার হাতে বায়আত গ্রহণ করেন। বিজিত অঞ্চলে তার নামে খুতবা দান শুরু হয় এবং নিজস্ব মুদ্রা চালু করা হয়।
সাইয়্যিদ আহমদ শহীদের অস্থায়ী সরকারের ক্রমবর্ধমান জয়যাত্রা ব্রিটিশ সরকার, শিখ সম্প্রদায় ও স্বার্থান্বেষী পাঠান সরদারগণ তার গতিরোধ করার চেষ্টা করে। শিখ ও পাঠানদের পরাজিত করতে পারলেও ইংরেজদের পরাজিত করা সম্ভব হয়নি।
কারণ ইংরেজরা কখনো মুজাহিদদের সঙ্গে সম্মুখ সমরে আসতো না। দূর থেকে স্বদেশী অন্য কোন শক্তিকে লেলিয়ে দিত। আবার তাদের অনুগত বিদআতি আলেমদের দ্বারা সাইয়্যিদ সাহেব ও তার মুজাহিদদেরকে ‘ওহাবি’ অপবাদ দিয়ে পাঠানদের মধ্যে বিভ্রান্তি ছড়িয়ে দেয়।
এভাবে ইংরেজরা সুজাউদ্দৌলার দ্বারা রোহিলাদের এবং নিযামদের দ্বারা সুলতান টিপুকে যেভাবে দমন করেছিল সেভাবে শিখদের দ্বারা মুজাহিদদের দমন করার সিদ্ধান নেয়।
অবশেষে ১৮৩১ সালে বালাকোট যুদ্ধে ইংরেজদের অনুগত রণজিৎ সিংয়ের বাহিনীর সাথে সাইয়্যিদ সাহেব ও মুজাহিদদের তুমুল লড়াই হয়। যুদ্ধে সাইয়্যিদ সাহেব, শাহ ঈসমাইলসহ অসংখ্য মুজাহিদ শাহাদত বরণ করেন।
বালাকোট যুদ্ধে বীরত্ব ও সাহসিকতা, শাহাদাত লাভের তীব্র বাসনা,দুনিয়ায় প্রতি চরম ঘৃণা ও বিতৃষ্ণা, ইমামের প্রতি মহব্বত ও আনুগত্যের এমনিই সব আশ্চর্যজনক ঘটনা প্রকাশ পায়,যা ইসলামের প্রাথমিক শতাব্দীগুলোর স্মৃতিকে আবার জীবন্ত করে তোলে।
সাইয়্যিদ আহমদ শহীদের পরে এই আন্দোলন দিল্লি ও সাদিকপুরের দুটি কেন্দ্র থেকে পরিচালিত হতে থাকে। দিল্লি কেন্দ্রের দায়িত্বে শাহ মুহাম্মাদ ইসহাক দেহলবি আর সাদিকপুর কেন্দ্রের দায়িত্বে মাওলানা বেলায়েত আলী এবং তার পরে মাওলানা ইনায়েত আলী হিজরত ও জিহাদ এবং বিপ্লব ও যুদ্ধের ধারাবাহিতা অব্যাহত রাখেন।
মাওলানা ইনায়েত আলী আজিমাবাদীর খলিফা আমীর আব্দুল্লাহ, আমীর আব্দুল করীমের জামানা পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। মাওলানা ইয়াহইয়া আলী,মাওলানা আহমদউল্লাহ্, মাওলানা আব্দুর রহীম সাদিকপুরী এবং মাওলানা জাফর থানেশ্বরীর নাম ইতিহাসে চীর ভাস্বর হয়ে আছে।
পরবর্তীতে জালেম ইংরেজ সরকার এই সকল মহান বিপ্লবীদের অনেককে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে অনেককে কালা পানির দ্বীপ আন্দামানে দ্বীপান্তর করে।
সাইয়্যিদ আহমদ শহীদের পরবর্তীতে ইংরেজবিরোধী যত বিপ্লব, আন্দোলন ও সংগ্রাম পরিচালিত হয়েছে সবাই বালাকোটের শাহাদাতগাহ থেকে অনুপ্রেরণা পেয়েছে।
শামেলির ময়দান, ১৮৫৭ সালের স্বাধীনতা সংগ্রাম (সিপাহী বিপ্লব), দেওবন্দ আন্দোলন, রেশমি রোমাল আন্দোলনসহ সকল সংগ্রামীদের কাছে সাইয়্যিদ আহমদ শহীদ ছিলেন আদর্শ।
এই মুবারক জামাত মুসলমানদের মধ্যে এক নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করে গেছেন যারা পরিচ্ছন্ন ও পবিত্র জীবনযাপন,তাকওয়া ও পরহেজগারি, ইসলামী শরীয়ত ও রাসূলের সুন্নতের পাবন্দি এবং ধর্মীয় অনুভূতি ও বীরত্বের অনন্য নজির স্থাপন করে গেছেন।
সাইয়্যিদ আহমদ শহীদ ও তার সাথীরা যদিও ইংরেজদের থেকে ক্ষমতা নিতে সক্ষম হয়নি কিন্তু তারা এদেশে নির্ভেজাল তাওহীদ,শিরিক-বিদআত বিরোধিতা, ধর্মীয় নবজাগরণ ও অন্যায় অবিচার, জুলুম-নির্যাতনের বিরুদ্ধে সংগ্রামের যে পতাকা উত্তোলন করে গেছে তা ইংরেজবিরোধী সকল সংগ্রামে অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে।
ভবিষ্যতে যারা বিপ্লব সংগ্রাম ও শরীয়তের পুনর্জাগরণের জন্য কাজ করবে তাদের জন্য সাইয়্যিদ আহমদ শহীদ, শাহ ইসমাইল শহীদ ও বালাকোটের শহীদদের প্রতিটি সদস্যের পয়গাম তাই যা মহান আল্লাহ সূরা ইয়াসিনে উল্লেখ করেছেন, হায়! আমার সম্প্রদায় যদি জানতে পারত কী কারণে আমার প্রতিপালক আমাকে ক্ষমা করেছেন এবং আমাকে সম্মানিত করেছেন।(আয়াত:২৬,২৭)
তথ্যসূত্র: আবুল হাসান আলী নদভী- সীরাতে সাইয়্যিদ আহমদ শহীদ, ইযা হাব্বাত রীহ‘উল ঈমান, W.W. Hunter- Indian Mussalmans, শান্তিময় রায়- ভারতের মুক্তি সংগ্রাম ও মুসলিম অবদান, ড. মুশতাক আহমদ- তাহরীকে দেওবন্দ।