২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকার পিলখানায় সংঘটিত বিডিআর বিদ্রোহের সময় প্রথম গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর বন্দি ছিলেন মেজর (অব.) জায়েদী আহসান হাবিব। বিদ্রোহের সময় তাকে ২৪ রাইফেল ব্যাটালিয়নের সুবেদার মেজর গোফরান মল্লিকের বাসায় বন্দি করে রাখা হয়েছিল। সেখানেই তিনি জানতে পারেন যে ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপসকে বিডিআরের মহাপরিচালক (ডিজি) করার ষড়যন্ত্র হয়েছিল এবং তার অনুগতদের ঊর্ধ্বতন পদে বসানোর পরিকল্পনাও গ্রহণ করা হয়েছিল। বন্দিদশায় প্রতিটি মুহূর্তে মৃত্যুর প্রহর গুনেছেন জায়েদী। তবে ভাগ্যক্রমে তিনি জীবিত ফিরে আসতে সক্ষম হন।
বিদ্রোহের সময় মেজর জায়েদীর রুমে আশ্রয় নেয় লুনা নামের এক তরুণী, যিনি ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স বিভাগের প্রথম বর্ষের ছাত্রী ছিলেন। পিলখানার ভিতর গোলাগুলি শুরু হলে নিরাপত্তার খোঁজে তিনি ওই বাসায় চলে আসেন। সন্ধ্যা গড়িয়ে গেলে টিভিতে প্রচারিত সংবাদে জানা যায়, আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ জাহাঙ্গীর কবির নানক ও মাহাবুব আরা বেগম গিনি পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছেন। তবে পরিস্থিতি ক্রমেই উত্তপ্ত হতে থাকে।
একপর্যায়ে, এক সৈনিক বন্দুক হাতে ঘরে প্রবেশ করে। সে বন্দুক লোড করার সময় মেজর জায়েদী মৃত্যুর জন্য নিজেকে প্রস্তুত করেন এবং তাকে ব্রাশ ফায়ার করতে বলেন। তবে লুনার উপস্থিতি দেখে সেই সৈনিক গুলি না চালিয়ে সেখান থেকে চলে যায়। কিছুক্ষণ পর লুনাও সেখান থেকে চলে যান।
মেজর জায়েদীর ছোট ভাই একজন সেনা কর্মকর্তা ছিলেন। তার সহায়তায় তিনি নিজের ব্যাটালিয়নের কমান্ডিং অফিসারের (সিও) সঙ্গে যোগাযোগ করেন। পরবর্তীতে সুবেদার মেজর গোফরান মল্লিক আবার বাসায় ফিরে এসে তাকে সাবধান করেন যে, তার অবস্থান বিদ্রোহীদের কাছে প্রকাশ হয়ে গেছে। রাত গভীর হলে একদল সশস্ত্র বিদ্রোহী বাসায় প্রবেশ করে একটি গোপন বৈঠক করে। সে সময় গোফরান মল্লিক তাকে জানান, বিদ্রোহের মূল পরিকল্পনার সঙ্গে তাপস যুক্ত ছিলেন এবং এটি ছিল একটি বৃহৎ ষড়যন্ত্রের অংশ।
পরদিন সকালে বিদ্রোহীদের মধ্যে উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় হয় এবং একপর্যায়ে গোফরান মল্লিক মেজর জায়েদীকে পোশাক পরিবর্তন করে অন্যত্র যাওয়ার ব্যবস্থা করে দেন। তাকে ৪ নম্বর গেটের সামনে নিয়ে যাওয়া হয়, যেখানে সেনা কর্মকর্তা, তাদের পরিবার এবং সাধারণ মানুষের উপস্থিতি ছিল। বিদ্রোহীদের একটি দল কয়েকজনকে আলাদা করে ডাকে, যা দেখে সবাই মনে করেন, তাদের হত্যা করা হবে। ঠিক সেই সময় এমপি রেজা সেখানে উপস্থিত হয়ে তালিকা চেয়ে নেন এবং পরিস্থিতি কিছুটা পরিবর্তিত হয়।
এই সুযোগে মেজর জায়েদী সিভিল পোশাকধারী জনতার ভিড়ে মিশে যাওয়ার চেষ্টা করেন। তার এক ব্যাটম্যান, মিজান, যিনি বাংলাভিশনে ড্রাইভার হিসেবে কাজ করতেন, তাকে চিনে ফেলে এবং গাড়িতে করে নিরাপদে বাসায় পৌঁছে দেন। এরপর তিনি এবিসি রেডিওতে ঘটনার বিবরণ দেন।
মেজর জায়েদী বিডিআর বিদ্রোহের মামলায় সাক্ষ্য প্রদান করেন এবং কোর্টে জবানবন্দি দেন। তবে তদন্ত কমিটিতে তার দেওয়া বক্তব্যের অনেক গুরুত্বপূর্ণ অংশ এড়িয়ে যাওয়া হয়। বিশেষ করে বিদ্রোহের পেছনে কারা যুক্ত ছিল, সে বিষয়ে তাকে কোনো প্রশ্ন করা হয়নি।
পিলখানা হত্যাকাণ্ডের পর শেখ হাসিনা সেনানিবাসে গেলে কিছু সেনা কর্মকর্তা তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানান, যার ফলে অনেকের ক্যারিয়ার ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সে সময় মেজর জায়েদী হাসপাতালে ছিলেন এবং তাকে ওই সভায় উপস্থিত হতে দেওয়া হয়নি।
বিদ্রোহের পর তিনি সেনাবাহিনীতে ফেরত যান এবং পরবর্তীতে শান্তিরক্ষা মিশনে যোগ দেন। ২০২২ সালে তিনি মেজর পদেই অবসর গ্রহণ করেন, যদিও ২০০৩ সাল থেকে তিনি একই পদে ছিলেন এবং কোনো পদোন্নতি পাননি।