বাঙালি মুসলমানের বয়ান এখনো পরিস্কার হয়নি। সুলতানি আমলে এই বয়ান তৈরি হওয়া শুরু হয়েছিল। রাষ্ট্রভাষা ফারসি হলেও বাংলা ভাষায় এ অঞ্চলের মুসলিমদের জীবন ও বিশ্ববীক্ষা সমান্তরালভাবে তৈরি হচ্ছিল। এরপরে মুঘল আমলে বাংলা দিল্লীকেন্দ্রিক সাম্রাজ্যের অংশীদার হলেও বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে বাঙালি মুসলমানের বয়ান তৈরি হবার ধারা অব্যাহত ছিল।
বাঙালি মুসলমানের বয়ান নির্মাণের এই ধারায় ছেদ আসে বাংলায় ব্রিটিশ উপনিবেশবাদ কায়েমের সূত্রে। এলিট মুসলিমরা ক্ষমতা হারায় ব্রিটিশ উপনিবেশবাদীদের হাতে। ব্রিটিশ উপনিবেশবাদীদের সহযোগিতা করেছিল সেসময়ের সুযোগসন্ধানী বিভিন্ন গোষ্ঠী। এই সুযোগসন্ধানীদের একটা বড় অংশ ছিল উচ্চবর্ণ ও ধনিক-বণিক হিন্দু সম্প্রদায়ের। এরা শুধু রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক ক্ষমতার সহায়ক শক্তি হয়নি। এরা সুলতানি আমল থেকে শুরু হওয়া বাঙালি মুসলমানের সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক বয়ান নির্মাণের ধারাটিকেও আর স্বাভাবিকভাবে বিকশিত হতে দেয়নি।
বিশেষ করে ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের পরবর্তী প্রায় পঞ্চাশ বছর বাঙালি মুসলমানের জন্য ছিল এক সার্বিক দুর্দশা ও পতনের কাল। বাঙালি মুসলিম এলিট ও সাধারণ কৃষিজীবি শ্রেণি নির্বিশেষে পুরো জনগোষ্ঠীকেই এই চরম বিপর্যয় কাল অতিক্রম করতে হয়েছিল। আর এই সময়েই ব্রিটিশ উপনিবেশবাদের সহযোগী গোষ্ঠী হিশেবে প্রতিবেশী হিন্দু সম্প্রদায়ের একটি উচ্চবর্ণ গোষ্ঠী বাঙালি মুসলমানদেরকে পিছনে ফেলে ক্ষমতার জুনিয়র পার্টনার হয়ে উঠতে থাকে। ইংরেজী ভাষা শিক্ষা সূত্রে এরা ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনব্যবস্থায় একটা সুবিধাজনক জায়গা করে নেয়। সেই সূত্রে আধুনিক ইউরোপীয় জ্ঞান-বিজ্ঞান শিক্ষায়ও তারা এগিয়ে যায়। এদের হাতে যে আধুনিক বাঙালি বয়ান তৈরি হতে থাকে সেখানে বাঙালি মুসলমান হয়ে পড়ে নিতান্ত প্রান্তিক এবং কোন কোন ক্ষেত্রে একেবারে অপর কিংবা বহিরাগত।
বাঙালি মুসলমানের বয়ান এইভাবে উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে হারিয়ে যায়। কলকাতা নগরে যে ভদ্রলোক বাঙালি হিন্দু বয়ান নির্মিত হয় সেখানে বাঙালি মুসলমান এ অঞ্চলের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী হওয়া সত্ত্বেও যথার্থ সম্মান ও মর্যাদা পায়নি। এমনকি যে আধুনিক বাংলা ভাষা এইসময়ে তৈরি করা হয় সেখানে বাঙালি মুসলমানের লোকজ-দেশজ এবং ধর্মজ-কৃষ্টিজ শব্দাবলী ও বাকরীতি অপসারণ করে এক তৎসম-তদ্ভব শব্দ ও বাকরীতি প্রভাবিত “প্রমিত” বাংলা ভাষা তৈরি করা হয়। এই কৃত্রিম পশ্চিম বঙ্গীয় আধুনিক বাংলা ভাষা বাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী বাঙালি মুসলমানের বয়ান ধারণে সক্ষম ছিল না। আধুনিক বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি এভাবে এদেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে একটি উপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া ভাষা ও সংস্কৃতিতে পরিণত হয়।
এরপরে বিশ শতকের প্রথমার্ধ থেকে শুরু হয়েছিল এই থমকে যাওয়া বাঙালি মুসলমানের বয়ান ও প্রতিবয়ান নির্মাণের পুনর্যাত্রা। কিন্তু এই যাত্রা সহজ ছিল না। পদে পদে তার জন্য ছিল মগজধোলাইজনিত বিভ্রান্তি ও বিপত্তি। কোনটি হবে তার রাষ্ট্রভাষা, কোনটি হবে তার রাষ্ট্র, ধর্ম ও সংস্কৃতির সম্বন্ধ সে কিভাবে মোকাবেলা করবে ইত্যাদি প্রশ্নে সে সুস্পষ্ট অবস্থান নিতে পারেনি। দোদুল্যমানতা এবং দ্বিধা-দ্বন্দ্বে সে বিভ্রান্ত ও বিভক্ত হয়ে পড়েছে। আর বর্তমান কালে এই বিভক্তি ও দোদুল্যমানতার সুযোগ নিচ্ছে প্রতিবেশী আধিপত্যবাদী শক্তি।
তাই বাঙালি মুসলমানের যেমন নিজস্ব একটি পরিস্কার বয়ান থাকা দরকার, তেমনি দরকার বিপ্রতীপ বয়ানগুলির বিপরীতে একটি প্রতিবয়ান। এই বয়ানগুলি হতে হবে স্বাধীন ও আপন সত্তা নির্ভর। হতে হবে নিজস্ব ভাষা, শব্দ ও বাকরীতিতে উপস্থাপিত। একে ধারণ করতে হবে এই জনপদের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর জীবন ও বিশ্ববীক্ষা। সর্বোপরি সেখানে থাকতে হবে এ অঞ্চলের মানুষের মর্যাদা, কল্পনা, মনন ও ইতিহাসনির্ভর সমাজ ও সভ্যতা নির্মাণ আকাঙ্খার প্রতিফলন। যতদিন বাঙালি মুসলমানের এই বয়ান ও প্রতিবয়ান তৈরি না হবে ততদিন উপমহাদেশ ও বিশ্বমঞ্চে সে মর্যাদার আসন পাবে না।