বিপুল প্রত্যাশা নিয়ে ওবামা ক্ষমতায় আসলেও ক্ষমতা থেকে বিদায় নেওয়ার সময় ওবামার কপালে জুটেছে যুদ্ধবাজের তকমা। ওবামা আফগানিস্তানে ড্রোন দিয়ে নিরীহ মানুষ হত্যা করেছেন। লিবিয়া এবং সিরিয়ায় গণতন্ত্র পাচার করতে গিয়ে কোটি মানুষের জীবন তছনছ করেছেন।
বাইডেনও অনেকটা ওবামার সঙ্গে মিল রেখেই বিপুল প্রত্যাশা নিয়ে ক্ষমতায় এসেছেন। কিন্তু শুরুতেই তার আদেশে সিরিয়ার হত্যা করা হয়েছে ১৭ জন নিরীহ সিয়িয়ান।জো বাইডেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে ক্ষমতা নেওয়ার পর তার নির্দেশে জানামতে এটাই প্রথম হামলা।
ট্রাম্পের বর্ণবাদী শাসনের বিরুদ্ধে বাইডেনের বিজয়ে শান্তির বার্তা ছিল।কিন্তু মার্কিন রাজনীতির অলিগলি সম্পর্কে ওয়াকিবহালরা বাইডেনের নীতির মধ্যে বরং যুদ্ধের সম্ভাবনা দেখছেন।
এই সম্ভাবনাকে মজবুত করেছে বাইডেনের নিয়োগকৃত মন্ত্রী এবং উপদেষ্টাদের অতীত কর্মকাণ্ড। মোটাদাগে ওবামা আমলের যুদ্ধের কারিগরেরা আবার ওয়াশিংটনে ফিরে এসেছেন। নড়াচড়া শুরু হয়েছে অস্ত্র বাজারে। আর হতাশায় মুখ ঢাকতে শুরু করেছে মধ্যপ্রাচ্যের মানুষ।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী পদে নিয়োগ পেয়েছেন অ্যান্টনি ব্লিংকেন। ব্লিংকেন ওয়াশিংটনের ক্ষমতাবৃত্তের অনুগত, যিনি প্রায় দুই যুগ ধরে মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির নীতিনির্ধারকদের একজন। ব্লিংকেন ওবামা আমলে সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন।
লিন্ডা টমাস-গ্রিনফিল্ডকে জাতিসংঘে মার্কিন দূত হিসেবে মনোনীত করেছেন বাইডেন। নিন্দুকেরা কৃষ্ণাঙ্গ গ্রিনফিল্ডকে ডেমোক্র্যাটদের কন্ডোলিৎসা রাইস বলে অবহিত করেন। শুরুতে বাইডেনের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা পদে সুসান রাইসের নাম শোনা গেলেও নিয়োগ পেয়েছেন জেইক সুলিভ্যান।
ব্লিংকেনের মতো সুলিভ্যানও ওয়াশিংটনের ক্ষমতাবৃত্তের অত্যন্ত কাছের মানুষ। হিলারির সহযোগী হিসেবে ইরান পরমাণু চুক্তিসহ মার্কিন কূটনৈতিক অঙ্গনে সুলিভ্যান পরিচিত নাম। বাইডেন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরিকে তাঁর জলবায়ুবিষয়ক বিশেষ দূত হিসেবে বেছে নিয়েছেন।
তবে সবকিছু ছাড়িয়ে গিয়েছে ব্রেট ম্যাকগার্কের বিতর্কিত নিয়োগ। মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক সমন্বয়ক হিসেবে বাইডেন ম্যাকগার্ককে নিয়োগ দিয়েছেন। সিরিয়া ভেঙে যে তিন-চারটি নতুন রাষ্ট্রের চিত্র অঙ্কন করা হচ্ছে, তা অনেকটাই ম্যাকগার্কের চিন্তাপ্রসূত
বাইডেনের নিয়োগকৃত এই সব কূটনৈতিক পশ্চিমা গণমাধ্যমে ঝানু কূটনৈতিক এবং মার্কিনদের স্বার্থ রক্ষার কারিগর হিসেবে অবহিত করলেও এই সব কূটনৈতিকদের অতীত মিহিন নয়। বরং প্রায় সবার বিরুদ্ধে রয়েছে মিথ্যা যুদ্ধের অভিযোগ। নতুন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ব্লিংকেন যেভাবে ২০০৩ সালের ইরাক যুদ্ধের এবং বর্তমান ইয়েমেন যুদ্ধের অন্যতম হোতা, ঠিক একইভাবে ব্রেট ম্যাকগার্ককে বলা হয় সিরিয়া যুদ্ধের অন্যতম নকশাবিদ। ম্যাকগার্কের নীতির ওপর নির্ভর করে ওবামা পিকেকের সঙ্গে মৈত্রী স্থাপন করেছিলেন, যা তুরস্ককে প্রায় ভেঙে দেওয়ার উপক্রম তৈরি করেছিল। সিরিয়াকে পরিণত করেছে শ্মশানে। ব্রেট ম্যাকগার্কের নিয়োগ প্রমাণ করছে যে বাইডেনের আমলে সিরিয়ার গৃহযুদ্ধের সমাধান তো মিলবেই না বরং যুদ্ধের পরিধি বিস্তৃত হবে। একই সঙ্গে জেইক সুলিভ্যান যেভাবে হিলারি ক্লিনটনের লিবিয়া আক্রমণের সঙ্গী ছিলেন, ঠিক একইভাবে জন কেরির বিরুদ্ধে সিরিয়ার যুদ্ধ দীর্ঘায়িত এবং ২০১৬ সালে তুরস্কের ব্যর্থ সেনা অভ্যুত্থানে মদদের অভিযোগ রয়েছে।
বিরোধকে সংঘর্ষে রূপ দেওয়ার নীতি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই মার্কিন পররাষ্ট্রনীতিতে খোদাই করে লিখে নেওয়া হয়েছে। সংঘর্ষ জিইয়ে রাখার মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যের প্রাকৃতিক সম্পদ এবং ইসরায়েলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার গতানুগতিক মার্কিন পররাষ্ট্রনীতিতে ফিরে যাবেন বাইডেন।
জন কেরি, অ্যান্টনি ব্লিংকেন, ব্রেট ম্যাকগার্ক এবং জেইক সুলিভ্যানের প্রত্যাবর্তনের মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যে আবার যুদ্ধের সম্ভাবনা বৃদ্ধি পেয়েছে। ইয়েমেন, সিরিয়া গৃহযুদ্ধের সমাপ্তির সম্ভাবনা শূন্যে হ্রাস পেয়েছে। লিবিয়ার দ্বিখণ্ডিত করার পরিকল্পনা খরস্রোতা হয়েছে। দুর্বল হয়ে পড়বে মধ্যপ্রাচ্যে উপনিবেশবাদবিরোধী আন্দোলন, বেগবান হবে ইসরায়েলের অবৈধ বসতি স্থাপন।
সিরিয়ার যুদ্ধ এবং আইএসএসকে থামাতে অ্যান্টনি ব্লিংকেন এবং ম্যাকগার্ক পিকেকের সিরিয়ান শাখা ওয়াইপিজিকে একটি সেনাবাহিনীতে রূপান্তরিত করেছে। ওবামা আমলে মার্কিনদের সহায়তায় জন্ম নেওয়া বাহিনীর সদস্য আজ ৫০ হাজার ছাড়িয়েছে। মার্কিনরা ২০২১ সালে ওয়াইপিজির জন্য বরাদ্দ রেখেছে ২০০ মিলিয়ন ডলার। অত্যাধুনিক মার্কিন হাতিয়ার এবং অর্থ সরবরাহ করে এই সেনাবাহিনীকে অপ্রতিরোধ্য করেছে। এমনকি স্বল্পমাত্রার বিমান বিধ্বংসী রাডারও সরবরাহ করেছে। এই বৃহৎ একটি সেনাবাহিনীকে পাশ কাটিয়ে সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ সমাধানের সম্ভাবনা শূন্য। তুরস্ক কোনোভাবেই নিজ সীমান্তে ওয়াইপিজির নেতৃত্বে নতুন রাষ্ট্র মেনে নেবে না। তাই সংঘর্ষ অনিবার্য। সময় বলে দেবে এই সংঘর্ষে মার্কিনরা নাকি আঙ্কারা পিছু হটবে।
সিরিয়ার মতো লিবিয়ার গৃহযুদ্ধ নিয়েও বাইডেন প্রশাসন কোনো সুসংবাদ দিতে পারবে না। ইউরোপিয়ানদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে মার্কিনরা অবৈধ যুদ্ধবাজ হাফতারকে ক্রমাগত উৎসাহ দিয়ে যাচ্ছে। আসলে ত্রিপোলির জাতীয় ঐকমত্যের সরকার এবং হাফতারের মধ্যে বিরোধিতাকে পুঁজি করে মার্কিনরা কোরিয়া উপদ্বীপের কায়দায় লিবিয়াকে দুটি রাষ্ট্রে পরিণত করতে চায়।
বর্তমান ত্রিপোলিকে ঘিরে একটি এবং বেনগাজিকে নিয়ে একটি দেশ গঠন হবে। গাদ্দাফিকে হত্যা করে লিবিয়াকে এক দশকব্যাপী গৃহযুদ্ধের দিকে ধাবিত করার অন্যতম কুশীলব জেইক সুলিভ্যান নিয়োগ পেয়েছেন বাইডেনের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হিসেবে। সিরিয়ার মতোই লিবিয়ার মানুষের শিগগিরই মার্কিনদের যুদ্ধ থেকে মুক্তির সম্ভাবনা কম।
তবে অভিবাসী মুসলিম আর মার্কিন উদারনৈতিকদের নিজ আবক্ষে আটকে রাখতে বাইডেন বেশ কিছু পরিবর্তন আনতে পারেন মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে। প্রথমত, পরিবর্তন আসতে পারে ফিলিস্তিন প্রশ্নে। বাইডেন ট্রাম্পের বন্ধ করে দেওয়া ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের জন্য অর্থ বরাদ্দের তালা আবার খুলতে পারেন। জেরুজালেম থেকে মার্কিন দূতাবাস ফিরিয়ে না নিলেও ফিলিস্তিনিদের খুশি রাখতে পূর্ব জেরুজালেমে একটি মার্কিন কনস্যুলেটের সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে দিতে পারেন।
দ্বিতীয়ত, স্বল্প পরিসরে হলেও ইরান চুক্তিতে ফিরতে পারেন। তৃতীয়ত, নামকাওয়াস্তে সৌদি বিশেষ করে বিন সালমানকে শাসাতে পারেন। কিন্তু এই সবকিছুই কাঠামোগত কোনো পরিবর্তন আনবে না মধ্যপ্রাচ্যে। মার্কিনদের চাপিয়ে দেওয়ার বিরতিহীন যুদ্ধের ইতি টানবে না।
বাইডেন যখন ওয়াশিংটনের ক্ষমতাবৃত্তের অংশীদার এই সব যুদ্ধপ্রিয় কর্তাদের পররাষ্ট্রনীতির চেয়ারে বসিয়েছেন, তখন বিশ্ববাসী কীভাবে বাইডেনের মধ্যে শান্তির ঝলক দেখতে পায়, তা বোঝা মুশকিল। গণতন্ত্র, মানবাধিকার কিংবা নারী স্বাধীনতা নয় বরং মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিনদের প্রধান লক্ষ্য ধর্ম, ভাষা এবং শিয়া-সুন্নি বিরোধকে উসকে সংঘর্ষ জিইয়ে রাখা।
বিরোধকে সংঘর্ষে রূপ দেওয়ার নীতি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই মার্কিন পররাষ্ট্রনীতিতে খোদাই করে লিখে নেওয়া হয়েছে। সংঘর্ষ জিইয়ে রাখার মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যের প্রাকৃতিক সম্পদ এবং ইসরায়েলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার গতানুগতিক মার্কিন পররাষ্ট্রনীতিতে ফিরে যাবেন বাইডেন। যে গতানুগতিক মার্কিন পররাষ্ট্রনীতিতে বৈধভাবে চুক্তির মাধ্যমে ফিলিস্তিনিদের মাতৃভূমি থেকে উৎখাত করা হয়, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার নামে সিরিয়া, লিবিয়া এবং ইয়েমেনে গৃহযুদ্ধের ময়দান প্রস্তুত করা হয় আর ইরানকে মোকাবিলা আর সংস্কারের নামে বিন সালমানের বর্বরতাকে নীরবে উৎসাহিত করা হয়।
রাহুল আনজুম: মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক গবেষক।