বাংলাদেশের ১০৮টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মাত্র ১৮টিতে রয়েছে 'বাংলা' বিভাগ
Advertisements

বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের (ইউজিসি) দেয়া তথ্য অনুসারে, বাংলাদেশে এখন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ১০৮টি। তারমধ্যে মাত্র ১৮টি বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘বাংলা’ বিষয়ের আলাদা বিভাগ রয়েছে। আবার এরমধ্যে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে শুধু দুই বছরের মাস্টার্স কোর্স চালু আছে আর একটিতে ২০২১ সাল থেকে ছাত্র ভর্তি স্থগিত আছে। তারমানে মাত্র ১৬টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিষয়ের চার বছরের স্নাতক (সম্মান) কোর্স চালু আছে। এ ১৬টি বিশ্ববিদ্যালয়ের সবগুলোতেও আবার স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সহ পূর্ণ বাংলা বিভাগ নেই।

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বাংলা বিভাগের সংখ্যা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বিভাগের পরিচালক মো. ওমর ফারুখ জানান, “যে কোন বিষয়ের বিভাগ চালুকরণ নির্ভর করে সে বিষয়ে ছাত্রদের চাহিদার উপর। কোনো বিষয়ের ছাত্র পাওয়া না গেলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সে বিষয়ের উপর বিভাগ বা প্রোগ্রাম কোর্স রাখতে চায় না। বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালগুলোর ভাষ্য অনুযায়ী ছাত্রদের মধ্যে বাংলা নিয়ে পড়বার আগ্রহ কম। কারণ বাংলা নিয়ে পড়ে কাজ করবার ক্ষেত্র কম। চাকরি বাকরির ক্ষেত্রে এই বিষয়ের চাহিদা কম। সাধারণত বাংলা নিয়ে পড়তে চাইলে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভূক্ত কলেজগুলোর উপর নির্ভর করা হয়। তবে ইউজিসি একটা উদ্যোগ নিয়েছে, কোনো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগ খুললে ইউজিসি তাদের আর্থিক ও অন্যান্য সহযোগিতা করবে। এই উদ্যোগ নেয়ার পর গত কয়েকবছরে কয়েকটা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগ খোলা হয়েছে। তবে তাও সংখ্যায় অপ্রতুল।”

ইউজিসি কর্তৃক প্রত্যেক বিশ্ববিদ্যালয়ে সব বিভাগেই ১০০ নম্বরের ‘বাংলা ভাষা ও সাহিত্য’ ও ‘বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস’ নামে দুটি পূর্ণ কোর্স পড়ানো বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। ২০১৬ সালের ১১ আগষ্ট ইউজিসির পূর্ণ কমিশনের ১৪৪তম সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এই ১০০ নম্বরের বাংলা কোর্স চালু করার কথা দেশের সকল প্রাইভেট ও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের। কিন্তু কার্যত দেখা যাচ্ছে অনেক বিশ্ববিদ্যালয়েই এই সিদ্ধান্ত মানছে না। কোর্স দুটি সিলেবাসে অন্তর্ভুক্ত করছে না বলে তারা কারিকুলাম সংশোধন করে অনুমোদনের জন্য পাঠায় না। কারণ বাংলা বিষেয়ের এ দুটি কোর্স অন্তর্ভুক্ত না করলে সংশোধিত কারিকুলামের অনুমোদন ইউজিসি দেবে না। তাই কারিকুলাম তৈরির দীর্ঘসূত্রিতা, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের অনীহা, অলাভজনক বিষয় বলে মনে করা, ইত্যাদি কারণে কোনো উদ্যোগই আর আলোর মুখ দেখছে না। অর্থাৎ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বানিজ্যিকভাবে লাভজনক মনে করে না বলেই বাংলা কোর্স চালুর ব্যাপারে তাদের অনীহা। ফলে কোনো ছাত্র পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভূক্ত কলেজগুলোর কোনোটাতে বাংলা নিয়ে পড়বার সুযোগ না পেলে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে পারার সুযোগও কম। খোঁজ নিয়ে আরো জানা গেছে, যেসব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বাংলা বিভাগ আছে তার অধিকাংশেই অন্য বিভাগের শিক্ষকদের চেয়ে বাংলা বিভাগের শিক্ষকদের বেতন অনেক কম।

এই সকল বৈষম্য নিয়ে কথা হলে রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচারর্য ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ড. বিশ্বজিৎ ঘোষ বলেন, “বাংলাদেশে বাংলা ভাষার অবস্থা এখন স্বদেশে পরবাসীর মতোন। ভাবতেও বিষ্ময় লাগে, আজ থেকে ৭০ বছর আগে এ দেশে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন সংঘটিত হয়েছিলো। এবং এই ভাষার জন্যই তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা আন্দোলন করেছিলো, বুকের রক্ত ঢেলে দিয়েছিলো। অথচ সেই বাংলাদেশেই এখন বাংলা ভাষা এতো অবহেলিত। আমাদের সংবিধানের তিন নম্বর অনুচ্ছেদে স্পষ্ট উল্লেখ আছে, বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষা বাংলা। কিন্তু আমরা তার প্রতিফলন সে মাত্রায় লক্ষ্য করি না। আমাদের উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে দেখি, বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কোথাও কোথাও বাংলা ভাষায় লেখা নিষিদ্ধ, অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের বাংলায় বক্তৃতা ও পাঠদান নিষিদ্ধ, নিয়মবিরুদ্ধ। যে সকল বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগ চালু আছে সেগুলোতেও ভালোভাবে পাঠদান হয় না। এর পিছনে একটা বড় কারণ হলো শিক্ষাকে পণ্যে রূপান্তর করা। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা এখন ব্যবসার একটি বড় ক্ষেত্র। যেহেতু বাংলাভাষাকে আমরা আমাদের জীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে পারিনি তাই বাজারে বাংলার অবস্থা ভালো নয়। যদি শিক্ষা, চাকরি ও দৈনন্দিন সকল কাজে বাংলাকে আমরা যুক্ত করতে পারতাম তাহলে বাংলা শেখার ক্ষেত্রে আগ্রহ তৈরি হতো। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বাংলা পড়াতে বাধ্য হতো। রাষ্ট্রীয়ভাবে বাংলাভাষাকে আমাদের কর্মক্ষেত্রের সাথে, পেশার সাথে যুক্ত করতে হবে। তাহলে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষও বাংলা ভাষাকে গুরুত্ব দিতে, বাংলা বিভাগের শিক্ষকদের ন্যায্য পারিশ্রমিক ও সম্মানি দিতে বাধ্য হবেন। যতদিন সেটা না হবে ততদিন বাংলা ভাষা এইরকম অবহেলিত থেকে যাবে। এক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন, শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে শুরু করে সকল বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী মহলের এগিয়ে আসা দরকার। আমরা এখন মধ্যম আয়ের দেশ। আর্থিকভাবে আমরা অনেকটাই স্বাবলম্বী। এখনই উচিৎ বাংলাকে, বাংলা ভাষাকে আধুনিক তথ্য প্রযুক্তির সঙ্গে, কর্মক্ষেত্র, চাকরী ও বিভিন্ন পেশার সঙ্গে সংযুক্ত করা। তাহলেই বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হবে। নতুবা বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বাংলাকে প্রাধান্য না দেয়ার ব্যাপারে এ সমস্ত অযুহাত দেখিয়ে যাবে।”

বাংলা ভাষার অন্যতম কথাসাহিত্যিক ও বাংলা একাডেমির সভাপতি সেলিনা হোসেন বলেন, “বাংলা আমাদের মাতৃভাষা, মর্যাদার ভাষা। এ ভাষা আমাদের অস্তিত্বের শেকড়, একে উপেক্ষা করার কোনো যুক্তি নেই। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এখন শুধুমাত্র বানিজ্যিক উদ্দেশ্যে পরিচালিত হচ্ছে অথচ রাষ্ট্র ও সমাজের প্রতি তাদের দায়বদ্ধতা আছে। বাংলা নিয়ে পড়াশোনা করে কাজের ক্ষেত্রও আমাদের আছে। স্কুল-কলেজগুলোতে ভালো বাংলা শিক্ষকের অভাব আছে। যেহেতু ছেলেমেয়েরা বাংলা নিয়ে পড়ছে না, তাই বাংলা ভাষার শিক্ষকও তৈরি হচ্ছে না। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগ চালুকরণ বাধ্যতামূলক হতে হবে। তাছাড়া অন্যান্য যে বিষয়ের উপরেই পড়ানো হোক না কেনো, ১০০ নম্বরের বাংলা ভাষার শর্ট কোর্সটি অবশ্যই চালু রাখতে হবে। সকল বিশ্ববিদ্যালয়ে এটা পড়াতে হবে। এ ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে আরো কঠোর হতে হবে। তাছাড়া, শিক্ষক, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী সকল মহল থেকে এ ব্যাপারে সচেতনতা তৈরি করতে হবে।”

সূত্রঃ ভিওএ

Advertisements