ছাত্র রাজনীতির উপকার অপকার নিয়ে এই দশকে বেশ আলোচনা হয়েছে। কেউ সম্পূর্ণ বন্ধের পক্ষে বলেছেন, কেউবা বলছেন লেজুড়বৃত্তিক রাজনীতির অবসানের কথা। ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক নেতৃত্ব যোগান দিতে প্রচলিত ছাত্ররাজনীতির বিকল্প কি হতে এমন প্রশ্নে উঠে আসছে বিজ্ঞ জনের মতামত থেকে। আবার বাংলাদেশের ছাত্র রাজনীতির গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের কথা উঠে আসছে প্রত্যেকটি আলোচনায়৷
বাংলাদেশের ছাত্র রাজনীতির ইতিহাস বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠালাভের ইতিহাসের সাথে জড়িত। স্বাধীনতা সংগ্রামের পুরোটা সময় জুড়ে, ১৯৪৮ সালে জন্ম নেয়া পূর্ব পাকিস্তান মুসলীম ছাত্রলীগ যার বর্তমান নাম বাংলাদেশ ছাত্রলীগ ও তৎকালীন ছাত্র সংগঠনগুলোর ত্যাগ তিতিক্ষা জড়িয়ে আছে যা প্রশ্নাতীত। বাঙ্গালীর স্বাধীকার আন্দোলন উত্তাল সময়ের প্রতিটি ক্ষণে ছাত্র জনতার উপস্থিতি ছিল উল্লেখযোগ্য ৷ ৫২ থেকে ৬৯ এর আন্দোলনে ছাত্ররাই ছিল সম্মুখে। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধকে সম্ভাব্য করে তোলে ছাত্র শ্রমিক ও বুদ্ধিজীবী শ্রেণী। ডান ও বাম ছাত্র সংগঠনগুলোর সদস্যরা সশস্ত্র সংগ্রামে অংশ নিয়েছেন, তাঁদের হাজার হাজার নেতাকর্মী রণাঙ্গনে শহীদ হয়েছেন।
সোনালী অতিত হারালো কোথায়?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ ( ডাকসু) যাকে আদর করে ডাকা হতো বাংলাদেশের দ্বিতীয় সংসদ। সে সংসদ থেকে উঠে আসা ছাত্র নেতারা জাতীয় রাজনীতিতে সবাই প্রস্ফুটিত হতে পারেন নি। তাদের অধিকাংশই দলীয় রাজনীতি দিয়েই ডাকসুতে প্রবেশ করেছেন, পরবর্তীতে লেজুড়বৃত্তিক রাজনীতি বাইরে যেয়ে নতুন কোন ধারা তৈরি করতে পারেননি ৷ স্বাধীনতা উত্তর বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের নামে খুবই জনপ্রিয় রাজনৈতিক সংগঠন হয়ে উঠেন জাসদ, পরবর্তীতে বাসদ কেউই গণমুখী রাজনীতি করতে পারে নি। যদিও তাদের দলের চালিকাশক্তি ছিল স্বাধীনতা সংগ্রামের সংগঠকদের মধ্যে অন্যতম ছাত্রনেতারা ৷
১৯৭৯ সালে জন্ম নেয়া জাতীয়বাদী ছাত্রদল, স্বৈরতন্ত্রের সময় জন্ম নেয়া বাংলাদেশ ছাত্র সমাজের বিরুদ্ধে পরবর্তীতে অস্ত্রের রাজনীতি আমদানির অভিযোগ উঠেছে । সেভেন মার্ডার সহ নানান আলোচিত হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে শিক্ষাঙ্গনে। যদিও ৯০ এর স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে ছাত্রলীগ, ছাত্র দল সহ বাম ছাত্রসংগঠনগুলো যুগপৎ আন্দোলন করে দেশে গণতন্ত্র ফিরিয়েছে ৷ ৯০ এ গণতন্ত্র ফিরলো ঠিকই, সেই সাথে লেজুড়বৃত্তিক রাজনীতির কুফলও দেখা দিতে শুরু করলো।
ইতিহাস সাক্ষী ৯০ এর দশক থেকে পালাক্রমে সরকার পরবর্তনের সাথে সাথে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠনগুলো বল্গাহীন হয়ে উঠেছে ৷এর মধ্যে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোর ছাত্র সংগঠন বিশেষ করে ইসলামী ছাত্র শিবিরসহ অন্যান্য ধর্ম ভিত্তিক ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশের রাজনীতিতে আলোচিত হয়েছে।ধর্মভিত্তিক ছাত্র সংগঠনগুলোর মধ্যে ইসলামী ছাত্র শিবির আলোচিত ও সমালোচিত হয়েছে এবং দলীয় অবস্থানের কারনে ক্যাম্পাসগুলোতে তাদের রাজনীতি নিষিদ্ধ হয়েছে।
গতো দুই দশকে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্র সংগঠনগুলোর নিজেদের আভ্যন্তরীণ কোন্দল, সিট বানিজ্য, প্রভাব বিস্তারকে কেন্দ্রকরে গন্ডগোল, বিরোধী সংগঠনের উপরে চড়াও হওয়া, চাঁদাবাজি, ধর্ষণ রাহাজানি সহ নানা অপকর্মের অভিযোগ নিয়মিতভাবে উঠে এসেছে ছাত্র সংগঠনগুলোর বিরুদ্ধে৷ ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের লাগাম টানতে বারবার ব্যর্থ হয়েছে দলীয় শীর্ষ নেতৃত্ব । নাগরিক সমাজ ও বিভিন্ন মহল থেকে প্রশ্ন উঠেছে, ছাত্র রাজনীতির আদৌ প্রয়োজন রয়েছে কিনা?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যম্পাসে রাজু হত্যাকান্ড, বুয়েটের সনি হত্যা, ২০১০ সালের আবুবকর হত্যাকান্ড, বিশ্বজিতকে মিডিয়ার উপস্থিতিতে কুপিয়ে হত্যা করা , নববর্ষের রাতে টিএসসি এলাকায় বাঁধন এক নারীর শ্লীলতা হরণ, ২০১৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের এহসান রফিকের চোখের কর্ণিয়া নষ্ট করে দেয়া, ২০১৮ সালের এপ্রিলে কোটা সংস্কারের দাবীতে ঢাকায় আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের উপর হামলা, নিরাপদ সড়ক আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী স্কুল কলেজের শিক্ষার্থীদের মিরপুর ও ধানমণ্ডিতে শারিরীক নির্যাতন, বুয়েটের শিক্ষার্থী দেশপ্রেমিক আবরার ফাহাদ হত্যাকাণ্ড বাংলাদেশের ছাত্র রাজনীতিকে বারবার কলংকিত করেছে।
অতি সম্প্রতি সিলেটের এম সি কলেজে স্বামীকে বেঁধে রেখে স্ত্রীকে গণধর্ষণের ঘটনা সর্বকালের সব অপকর্মের মাত্রা ছাড়িয়েছে।
সিট দখল, হল দখল, টেন্ডারবাজী, চাঁদাবাজি, প্রশ্নপত্র ফাঁস, মাদক ব্যবসা, সব শেষ ধর্ষণ নামক ভয়াবহ অপরাধ ছাত্ররাজনীতির ইতিহাসের মুকুটে কুৎসিত পালক রুপে যুক্ত হয়েছে৷
এথেকে উত্তোরণের উপায় কি?
লেজুড়বৃত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করে ছাত্রসংসদকেন্দ্রীক ছাত্ররাজনীতির কথা বলেছেন অনেকে। ইদানীংকালে ছাত্র রাজনীতির কালচারে পরিবর্তনের জন্য সর্বমহল থেকে আলোচনা হচ্ছে। শিক্ষালয়গুলো পাঠদান ও গবেষণা নির্বিঘ্ন করতে নানান পদক্ষেপের সুপারিশ করা হচ্ছে। ছাত্র রাজনীতি বলি হয়ে বিভিন্ন সময় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ হয়ে যাওয়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর সেশন জট ঠেকাতে ক্যাম্পাসে রাজনীতি নিষিদ্ধ করবার প্রস্তাবও উঠে এসেছে৷ কিছুদিন আলোচনার পর আবার থেমে যাচ্ছে। রাজনৈতিক দলগুলো সংস্কারের ব্যাপারে উদাসীন৷ ছাত্র রাজনীতি ভবিষ্যত নেতৃত্ব যোগান দিচ্ছে , দলীয় প্রোগ্রাম বাস্তবায়ন ও প্রটোকল প্রদানের লক্ষ্যে ছাত্র সংগঠনগুলো যে ভূমিকা রাখছে এর বিকল্প তারা দেখছেন না৷ প্রচলিত ছাত্ররাজনীতিতে ত্রুটি থাকলে অধিকাংশ দলই তা চালিয়ে নেয়ার পক্ষে।
প্রচলিত ছাত্ররাজনীতির বিকল্প কি হতে পারে?
আমাদের দেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্যে প্রমাণ মেলে বাঙ্গালী সংগঠন প্রিয় জাতি। আমাদের জনপদের মানুষের সংগঠন চর্চার ইতিহাস বহু পুরনো। অরাজনৈতিক সেবাধর্মী সংগঠন প্রতিষ্ঠার করে জনসেবার ইতিহাস তেমনি পুরনো। আবহমান কাল ধরে সাংস্কৃতিক ও সামাজিক সেবাধর্মী সংগঠনগুলোতে নেতৃত্বের চর্চা হচ্ছে। হালের বিদ্যলয়ের স্কাউট, ক্লাব, বিতর্ক করা ছেলে বা মেয়েটা কলেজ বা বিশ্ববিদ্যলয়ে গিয়ে আলো ছড়াচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধুদের সাথে গড়ে তোলা অরাজনৈতিক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলো মানুষের সেবা করছে৷ এমনি শহর থেকে গ্রামে প্রতিনিয়ত গড়ে উঠছে নানা সাংস্কৃতিক ও সামাজিক সংগঠন। কেউ কাজ করছে স্বেচ্ছা রক্তদান নিয়ে, কেউ দরিদ্রদের ১ টাকার আহারের সংস্থানে, কেউ কাজ করছে স্বাস্থ্য সেবা নিয়ে, মাদক ও বাল্যবিবাহ নির্মুলে এগিয়ে আসছে অদম্য তরুণেরা৷ পরিবেশ রক্ষা, মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বিভিন্ন তারুণ্যনির্ভর সংগঠনের কাজকর্ম চোখে পড়ার মতো। গ্রামে মফস্বলে গড়ে উঠছে পাঠাগার, ক্রীড়াচক্র, সংঘ; নিজেদের কমিউনিটিতে সেবা প্রদান করে তরুণেরা কমিউনিটির ভবিষ্যত নেতা হয়ে উঠছেন।
নেতৃত্ব তৈরির এই যে সহজাত প্রক্রিয়া সেখান থেকে ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক নেতৃত্বের যোগান সম্ভব নয়? জীবনের প্রথম অধ্যায়ে যে তরুণেরা নিজ উদ্যোগে মানুষের সেবায় এগিয়ে আসে তারা কি দেশকে ভালবাসতে পারবে না? ভবিষ্যতে রাজনৈতিক জীবনে দেশের স্বার্থ রক্ষা করতে পারবে না? প্রথাগত ছাত্র রাজনীতির সহমত ও প্রটোকল কালচারের বাইরে সমাজ, সরকার ও রাজনীতি, আইন, মানবাধিকার শিক্ষার জায়গা নেই?
সহজাত প্রক্রিয়ায় বেড়ে উঠা বর্ন লিডাররা প্রথাগত রাজনৈতিক দলে জায়গা পেলে, তাদেরকে রাজনৈতিক দলগুলোতে রাজনীতির সুযোগ করে দিলে, সে কালচার শুরু হলে ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক নেতৃত্ব যোগানের পথ মসৃন হবে। সেই সাথে লেজুড়বৃত্তিক ছাত্র রাজনীতি বন্ধ হলে শিক্ষার্থীরা তাদের একাডেমিক উন্নয়নে পূর্ণ মনোযোগ দিতে পারবে। শিক্ষাকাল কমে আসবে, ক্যাম্পাসগুলো নিরাপদ হবে। শিক্ষক রাজনৈতি নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে৷ শিক্ষকরাও দলীয় রাজনীতির নামে অন্ধ লেজুড়বৃত্তি শুরু করেছেন৷ শিক্ষক রাজনীতির ফলাফল হচ্ছে দলীয় অপেক্ষাকৃত কম মেধাবীদের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ প্রদান, স্বজনপ্রীতি, অবৈধ সুবিধাগ্রহণ সহ আরো নানান আপত্তিকর কাজকর্ম। ছাত্ররাজনীতির সাথে শিক্ষক রাজনীতি বন্ধ হবারো যৌক্তিক দাবী রাখে। সংস্কার একতরফা হতে পারে না। শিক্ষাঙ্গন নিরাপদ করতে, একাডেমিক সেবা নির্বিঘ্ন রাখতে ছাত্র ও শিক্ষক রাজনীতির বিকল্প ভাবতে হবে।
সামাজিক -সাংস্কৃতিক সংগঠন চর্চা, স্বেচ্ছাসেবা ও কমিউনিটি সার্ভিসের মধ্য দিয়ে উঠে আসা তরুণ নেতৃত্ব রাজনৈতিক দলগুলোতে জায়গা পেলে দেশপ্রেম ও মূল্যবোধকে সম্বল করে সম্প্রীতির এক নতুন বাংলাদেশ গড়তে পারবে বলে আশা রাখি ।
লেখকঃ আইনজীবী ও সম্পাদক ভাওয়াল বার্তা