পলিটিক্যাল ইসলাম
Advertisements

পলিটিক্যাল ইসলাম নিয়ে নিও-ট্র্যাডিশনালিস্ট ঘরানার অনেক স্কলারদের সাথে আমাদের তাত্ত্বিক ও পদ্ধতিগত মতপার্থক্য থাকলেও, ইসলামিজম নিয়ে তাঁদের কিছু সমালোচনা নিয়ে ভাববার যথেষ্ট সুযোগ আছে। বিশেষ করে হামযা ইউসুফের ইসলামিজম নিয়ে অনেকগুলো সমালোচনার একটা হলো- “Modern Islamic politics is just reactionary.” এটাকে আপাতদৃষ্টিতে অত্যুক্তি মনে হলেও, আসলে ব্যাপারটা নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করলে এই সমালোচনার সত্যতা আমাদের চোখে ধরা পড়ে।

এটা আসলেই সত্যি যে, রাজনৈতিক ইসলামের চিন্তা নিয়ে বা সে পরিবেশে যারা বড় হয়, তারা একটা ‘প্রতিক্রিয়াশীল’ পরিচয় নিয়েই বড় হয়। ব্যাপারটা এরকম যে, আমরা আমাদের আদর্শিক শত্রুর চিন্তা বা কাজকর্ম দিয়ে নিজেদের চিন্তা ও করণীয় ঠিক করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি। অর্থ্যাৎ আমাদের কোর ডিসকোর্স তৈরি হয় আমাদের আদর্শিক শত্রুর বিপরীত কিছু করার মধ্যমে। যেমন, আজকে সেক্যুলার বা বামপন্থী কোন দল এটা করছে, ফলে আমরা তাদের বিপরীতটা করবো; আজকে আমেরিকা ওটা করছে, তাহলে আমরা এর বিপরীত এটা করবো।

আদর্শিক শত্রুর বিপরীত কিছু করাটা অবশ্যই খারাপ কিছুনা এবং আমাদের সেগুলো করতে কোন সমস্যা নাই। কিন্তু সমস্যাটা তখনই শুরু হয়, যখন আমাদের চিন্তা বা করণীয় এর বোধ এবং প্র্যাক্টিসগুলো আমাদের নিজস্ব ডিসকোর্সের অংশ হিসেবে নয়, বরং শত্রুর ‘বিপরীত’ করার মতো ‘প্রতিক্রিয়াশীল’ চিন্তা থেকে আসে। অর্থ্যাৎ এখানে আমাদের একশন আমাদের নিজেদের ভেতর থেকে, আমাদের ট্র্যাডিশন থেকে আসেনা; বরং এটা আমাদের বিপরীত ঘরানা দ্বারা প্রভাবিত হয়।

অথচ আমাদের নিজস্ব ডিসকোর্স তৈরি হওয়ার কথা ছিলো আমাদের নিজেদের ভেতর থেকে; নিজস্ব ট্র্যাডিশন থেকে, কুরআন-সুন্নাহ থেকে। এটা আমার শত্রুর রিভার্স ইমিটেশন/বিপরীত অনুকরণ থেকে তৈরি হওয়ার কথা না। অথচ আমাদের ক্ষেত্রে সেটাই দেখা যাচ্ছে। এই নিজস্ব ট্রেডিশনের বদলে কোন নির্দিষ্ট শত্রুকে বিপরীতে নিজের আইডেন্টিটি বা ডিসকোর্স তৈরি করার সমস্যা হলো, এই ডিসকোর্স বা আইডেন্টিটি অনেক লিকুইড। শত্রুর পরিবর্তনের সাথে সাথে আমাদের আইডেন্টিটি ও ডিসকোর্সও পরিবর্তিত হয়ে যায়। বস্তুত আমাদের একেবারেই নিজস্ব ডিসকোর্স বা পরিচয় বলে কিছু থাকেনা, যার প্রতি আমাদের একধরনের কনভিকশন থাকবে।

আমাদের এই লিকুইড আইডেন্টিটি আমাদের মধ্যে নিজদের কাজের প্রতি সাকিনাহ-র বদলে এক ধরনের অস্থিরতার জন্ম দেয়। কারণ প্রশান্তির জন্য বা অন্তত ঈমানের স্বাদ পাওয়ার জন্যও কনভিকশন এবং এক ধরনের শৃঙ্খলা ও ফোকাস এর দরকার পড়ে; নিজের মূলে প্রোথিত হওয়ার বোধ এর লাগে- যেটা আমাদের নেই।

তো, এখন এই ধরনের প্রতিক্রিয়াশীল পরিচয় নিয়ে বড় হওয়া ইসলামপন্থীদের তরুণেরা- যাদেরকে সিচুয়েশনাল রাজনৈতিক বিরোধিতার আলোকে নিজেদের কর্মপন্থা সাজাতে হয় (যেটা তাদের অন্তর থেকে আসেনা, তাদের ট্রেডিশন থেকে আসেনা, যার প্রতি তাদের কোন কনভিকশন নাই)- তারা দেখা যায় কিছুদিন পরই নিজেদের কাজ নিয়ে হতাশ হয়ে পড়ে। যেটা হয়ত আমাদের দুই প্রজন্ম আগেও, আমাদের বাবাদের সময়েও বা ইসলামী আন্দোলনের প্রথম দিককার সময়ে দেখা যায়নি।

আমাদের সময়ে, বিশেষ করে তরুণদের মাঝে, আরো বিশেষভাবে বললে যাদের ভেতর সবসময় এক ধরনের ‘সংস্কারের’ তাড়না বিরাজ করছে, তাদের মধ্যে এ সমস্যাটা বেশ প্রবলভাবে দেখা যায়। এর কারণ মূলত, এই সংস্কারপন্থীদের তরুণদের ভেতর আইডেন্টিটির পরিবর্তনটা খুব নিয়মিতভাবে ঘটছে। তাদের শত্রু বারবার পরিবর্তিত হচ্ছে, ফলে তাদের নিজেদের পরিচয়ও বারবার পরিবর্তন করতে হচ্ছে। যদি বর্তমান জামায়াত ঘরানার সংস্কারপন্থী তরুণদের কথা ধরা হয়- আগে হয়ত যেখানে তাদের ‘শত্রু’ ছিলো তাবলীগ বা কওমী মাদ্রাসার হুজুর, সেখানে এখন তাদের শত্রু জামায়াত নিজে। (অন্যান্য ঘরানার ইসলামপন্থীদের তরুণদের অবস্থাও একই)। তো এই পরিচয়ের ক্রম-পরিবর্তনের ফলে যা হয় তা হলো, তাদের ভেতরে ইসলামি কনভিকশনের বোধটা প্রোথিত হতে অনেক সময় নেয়।

এই জায়গায় জামায়াতি চিন্তার একটা সমস্যা হচ্ছে যে, তারা রাজনৈতিকতাকে নিজেদের অস্তিত্বের বা ইসলামপন্থার একমাত্র মোড হিসেবে উপস্থাপন করতে গিয়ে অন্যান্য ব্যবহারিক, মনস্তাত্ত্বিক ও আধ্যাত্মিক দৃষ্টিভঙ্গিকে এড়িয়ে যায়। রাজনীতি আমাদের অস্তিত্বের লড়াইয়ে প্রধান মোড, সেটা অবশ্যই ঠিক আছে; কিন্তু প্র্যাকটিক্যাল ফিল্ডে মানুষের সাইকোলজিকে রাজনৈতিক করে দিলে যেটা হয় যে, সে মানুষ রাজনীতিতে ব্যর্থ হলে তার পুরো জীবনটাই তার কাছে ব্যর্থ মনে হয়।

মনস্তাত্বিকভাবে রাজনৈতিক হয়ে যাওয়া মানে ব্যাপারটা দাঁড়ায় যে, আমরা ইসলামের দাওয়াত দিচ্ছি, কারণ আমরা ‘আওয়ামীলীগ’কে ক্ষমতা থেকে সরাতে চাই। কিংবা আমরা ব্যক্তিগত রিপোর্ট রাখতেছি, এর কারণ নিছকই আমরা একটা রাজনৈতিক দলে শপথ দিয়েছি বলে। কিন্তু ব্যাপারটা তো এরকম হওয়ার কথা ছিলো না। আমাদের কনভিকশন কিংবা উদ্দেশ্য তো এত ঠুনকো না। এই জায়গাটা আমাদের আধ্যাত্মিক অনুশীলনের ঘাটতিকে নির্দেশ করে।

এখানে হামযা ইউসুফ বলছেন যে, আমাদের একটা শেকড় থাকা উচিত, যেটা হবে আমাদের ট্রেডিশন থেকেই আসা। আমরা আমাদের ক্রিয়েটিভিটির পরিস্ফুটনও ঘটাবো আমাদের ট্রেডিশনের মধ্য দিয়েই। আপনার নতুন কিছুও, আপনার সংস্কারের রূপরেখাও যদি ট্রেডিশনের ভেতর দিয়েই আসে, সেটা মানতে আমাদের আপত্তি নাই। কারণ, এক্ষেত্রে আপনার আপনার কনভিকশনকে বাদ দিতে হচ্ছেনা।

সেক্যুলারিজমঃ এটা কেবলি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও রাষ্ট্রের মধ্যকার বিভাজন ?

সমস্যাটা শুরু হয় তখনই, যখন কেউ তার ট্র্যাডিশন থেকে বের হয়ে গিয়ে ক্রিয়েটিভিটি দেখাতে চায়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় যে, এ মানুষগুলো মানসিকভাবে স্থির না। অবজার্ভেশন এটাই বলে যে, মুসলিম বিশ্বের এই মডার্নিস্টদের বেশিরভাগরই একই অবস্থা; মানসিকভাবে এরা হয় অস্থির, ব্যক্তিগত জীবনে অসুখী, অথবা দেখা যায় এরা প্র্যাক্টিসিং না।

তো, বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও, ইসলামিস্ট ঘরানার এই সংস্কারপন্থী তরুণদেরও লিব্রেলিজম, মডার্নিজমের দিকে আগ্রহী হয়ে ওঠার সবচেয়ে বড় কারণ হচ্ছে, এরা বেড়ে ওঠেছে একটা এন্টি-উলামা, এন্টি-তাসাউফ, এন্টি-মাযহাব পরিবেশে। তারা ‘রিজন’, ‘ক্রিয়েটিভিটি’ এই ধরনের লোভনীয় পরিভাষাগুলো শুনে বড় হয়েছে। ফলে তারা যখনি নিজস্ব ট্র্যাডিশন বা ইসলামকে বাদ দিয়ে এই ক্রিয়েটিভিটি দেখাতে গেছে, এরা জগাখিচুড়ি বাঁধাইছে এবং হতাশাগ্রস্থ কিংকর্তব্যবিমূঢ় একটা অবস্থার দিয়ে গেছে। এর পরবর্তী ধাপে এদেরকে দেখা যায় বিভিন্ন বাম/লালনীয় ঘরানায় ঘোরাফেরা করতে, বিশেষ করে ভার্সিটির ছেলেপেলেগুলো।

কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, প্রায় সময়ই এরা সেই অবস্থা থেকে ফিরে আসতে পারেনা। কারণ, ফিরে আসার মতো সেরকম সফিস্টিকেইটেড প্ল্যাটফরম পায়না তারা। আর যে অল্প কয়েকজন ফিরে আসে, তারা ফিরে আসে সালফিজমের হাত ধরে। এই জায়গা থেকে সালাফিজম প্রশংসা পাওয়ার দাবিদার, তারা একটা সার্ভিস দিচ্ছে। কিন্তু সেটা সামগ্রিক কোন সমাধান না, কারণ দিনশেষে সালফিজম নিজেই অস্থিরতার এক ইসলামি ভার্সন।

তো,আমাদের ইসলামিজম নিয়ে চিন্তাভাবনা করা মানুষদের এ বিষয়গুলো নিয়ে ভাবার স্পষ্ট জরুরত আছে। আমাদের প্রতিক্রিয়াশীল আইডেন্টিটিকে কিভাবে আরো আমাদের ঐতিহ্যে প্রোথিত, নিজস্ব বয়ান ও নিজেদের দৃঢ় প্রত্যয়ের জায়গা থেকে আসা একটা পরিচয়ে রূপ দিতে পারি সেটা নিয়ে কাজ করা দরকার। নিজেদের চারিত্রিক-আধ্যাত্মিক উন্নয়নের দিকেও নজর দেয়াটা জরুরি।

Advertisements