ডোনাল্ড ট্রাম্প পুনরায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে তার আফগানিস্তান নীতির বিষয়ে বিভিন্ন রকমের আলোচনা হচ্ছে। বেশিরভাগ বিশেষজ্ঞের মতে, তিনি তার প্রথম মেয়াদে যে নীতি অনুসরণ করেছিলেন, সেই নীতির পরিপ্রেক্ষিতে তিনি নতুন মেয়াদেও আফগানিস্তান নিয়ে বড় কোনো পরিবর্তন করবেন না। ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহার ও তালেবানের সঙ্গে সরাসরি আলোচনা শুরু করার পথে যে সিদ্ধান্তগুলো নেওয়া হয়েছিল, তার ধারাবাহিকতা বজায় রাখার সম্ভাবনা বেশি।
২০১৭ সালে প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর ট্রাম্প আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘস্থায়ী উপস্থিতি নিয়ে তার অবস্থান স্পষ্ট করেছিলেন। তিনি বারবার বলেছিলেন যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আফগানিস্তানে দীর্ঘকালীন উপস্থিতি অনেক ব্যয়বহুল এবং কার্যকর হয়নি। এর ফলে, তিনি আফগানিস্তান থেকে দ্রুত সেনা প্রত্যাহারের পক্ষে অবস্থান নেন। ২০২০ সালে দোহা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, যা আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের পথ তৈরি করে এবং পরবর্তীতে তালেবানের ক্ষমতায় ফিরে আসার সুযোগ সৃষ্টি করে।
দোহা চুক্তির মাধ্যমে ট্রাম্প তার প্রশাসনের আফগান নীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড় নিয়েছিলেন। আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা বের করে আনা এবং তালেবানের সাথে শান্তি চুক্তি করা তার প্রশাসনের একটি বড় অর্জন হিসেবে চিহ্নিত হয়। তবে, এই চুক্তি নিয়ে অনেক সমালোচনা রয়েছে, বিশেষ করে আফগান সরকারের সঙ্গে পরামর্শ না করেই তালেবানদের সঙ্গে আলোচনা করা এবং সেনা প্রত্যাহারের বিষয়টি ত্বরান্বিত করা নিয়ে। অনেকেই মনে করেন, এতে আফগানিস্তানের রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সহিংসতা আরও বাড়তে পারে।
যখন ট্রাম্প তার দ্বিতীয় মেয়াদে ফিরে আসবেন, তখন তার নীতি বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বাস্তববাদী এবং “আমেরিকা ফার্স্ট” দৃষ্টিভঙ্গি অনুসরণ করবে। তার পররাষ্ট্রনীতি সর্বদা যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিয়েছে, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য ব্যয়বহুল বিদেশী সংঘাতগুলোকে কমিয়ে আনার জন্য। আফগানিস্তানসহ অন্যান্য অঞ্চলে সামরিক জটিলতার পরিবর্তে তিনি বাস্তবমুখী চুক্তি করার পক্ষে। এই পরিপ্রেক্ষিতে, তার প্রশাসন হয়তো আফগানিস্তানে ব্যয়বহুল সামরিক উপস্থিতির পরিবর্তে আরও বেশি কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক উদ্যোগ নেবে।
তালেবানও মনে করে যে, ট্রাম্পের প্রশাসন তাদের জন্য আরও সুবিধাজনক হতে পারে। আফগান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র আবদুল কাহার বালখি একবার উল্লেখ করেছিলেন যে, আফগান সরকার আশা করছে যে ট্রাম্পের প্রশাসন “উভয় দেশের মধ্যে সম্পর্কের ক্ষেত্রে বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ গ্রহণ করবে” এবং উভয় জাতি একটি নতুন অধ্যায় শুরু করতে পারবে। এ থেকে বোঝা যায় যে, তালেবানরা তাদের প্রথম প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের শাসনামলের মতো কিছুটা আশাবাদী, কারণ ট্রাম্পের প্রশাসন তাদের সঙ্গে সরাসরি আলোচনা করেছিল এবং আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের জন্য পথ তৈরি করেছিল।
তবে, যদিও ট্রাম্প প্রথম মেয়াদে তালেবানদের সঙ্গে কিছুটা বাস্তববাদী সম্পর্ক গড়েছিলেন, তিনি নিশ্চিতভাবেই তালেবানকে তাদের ইচ্ছামত চলতে দেবেন না। বিশেষ করে, ট্রাম্প তাদের ওপর নির্ভরশীলতা বা প্রভাব বাড়ানোর কোনো ইচ্ছা রাখেন না। যদি তালেবান দোহা চুক্তির অধীনে প্রতিশ্রুতি পূরণে ব্যর্থ হয়, ট্রাম্প সম্ভবত মার্কিন সহায়তা কমিয়ে দিতে বা শর্তসাপেক্ষে তা দিতেও প্রস্তুত থাকতে পারেন। তিনি “আমেরিকা ফার্স্ট” দৃষ্টিভঙ্গির অংশ হিসেবে বিদেশী সাহায্য কমানোর পক্ষেই আছেন এবং আফগানিস্তানে মার্কিন সহায়তা কমিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে পারেন, যা তালেবানদের ওপর চাপ সৃষ্টি করবে।
অন্যদিকে, তালেবান ক্ষমতা দখলের পর, আফগানিস্তানের দরিদ্র জনগণের জন্য প্রতি সপ্তাহে প্রায় ৪০ মিলিয়ন ডলার মার্কিন মানবিক সহায়তা গুরুত্বপূর্ণ ছিল। যদি এই সহায়তা কমে যায় বা বন্ধ হয়ে যায়, তবে আফগানিস্তানের অর্থনৈতিক সংকট আরও গভীর হতে পারে, যার প্রভাব পড়বে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা ও দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতির ওপর। সহায়তা কমে গেলে এটি আফগানিস্তানের শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা এবং খাদ্য নিরাপত্তার ক্ষেত্রে ব্যাপক ক্ষতি করতে পারে, যা মানবিক বিপর্যয়ের দিকে নিয়ে যেতে পারে।
ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে, বিশ্বজুড়ে আফগানিস্তান হয়তো তার অগ্রাধিকার তালিকায় থাকবে না। ইউক্রেন এবং প্যালেস্টাইনের মতো অন্যান্য বৈশ্বিক সংকটের কারণে আফগানিস্তান ওয়াশিংটনের পররাষ্ট্রনীতির এজেন্ডার বাইরে চলে যেতে পারে। তবে, আফগানিস্তান নিয়ে ট্রাম্পের সিদ্ধান্ত বিশ্বব্যাপী নিরাপত্তা এবং আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা প্রভাবিত করবে। তার সিদ্ধান্তগুলি শুধু আফগান জনগণের জন্য নয়, বরং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ পরিণতি নিয়ে আসতে পারে।
এমন পরিস্থিতিতে, আফগানিস্তানে তার নীতি গ্রহণের ক্ষেত্রে সঠিক ভারসাম্য রক্ষা করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আফগানিস্তানে সামরিক হস্তক্ষেপ বা সহায়তার কষ্টকর পরিণতি ছাড়াই, তিনি যদি সঠিক কূটনৈতিক উদ্যোগ গ্রহণ করেন, তাহলে একদিকে যেমন আফগান জনগণের জন্য সহায়তা সম্ভব, তেমনি অন্যদিকে সবার জন্য নিরাপত্তার ঝুঁকি কমানো সম্ভব হবে। তবে, যদি ট্রাম্প অতিরিক্ত নির্দিষ্ট নীতি গ্রহণ করেন, যার ফলে আফগানিস্তান আরও অস্থিতিশীল হয়ে ওঠে, তাহলে আফগানিস্তান এবং বিশ্বের অন্য অংশে একটি নতুন সংকট সৃষ্টি হতে পারে।
সংক্ষেপে, ট্রাম্পকে তার দ্বিতীয় মেয়াদে আফগানিস্তান নীতিতে সফল হতে হলে বাস্তববাদী বিচ্ছিন্নতা এবং বৈশ্বিক নেতৃত্বের দায়িত্বের মধ্যে সঠিক ভারসাম্য খুঁজে বের করতে হবে, যাতে তিনি একটি সংঘর্ষ শেষ করার চেষ্টা করে অন্য কোনো ভয়ানক সংঘর্ষ সৃষ্টি না করেন।
আল-জাজিরার মতামত পাতায় আজিজ আমিনের লেখাটি ভাওয়াল বার্তার পাঠকদের জন্য অনুবাদ করা হয়েছে।