শকুনই একমাত্র প্রাণী, যা রোগাক্রান্ত মৃত প্রাণী খেয়ে হজম করতে পারে এবং অ্যানথ্রাক্স, যক্ষ্মা, খুরারোগের সংক্রমণ থেকে অবশিষ্ট জীবকুলকে রক্ষা করে। প্রসঙ্গত, অ্যানথ্রাক্স আক্রান্ত মৃতদেহ মাটিতে পুঁতে রাখলেও তা একশ বছর সংক্রমণক্ষম থাকে। উপকারি এই প্রাণী এখন মহাবিপন্নের তালিকায়। বর্তমানে দেশে শকুনের সংখ্যা কমবেশি ২৬০টির কাছাকাছি। স্বাধীনতার সময়েও দেশে শকুনের সংখ্যা ছিল ৫০ হাজারের বেশি। দেশে শকুনের সংখ্যা এভাবে কমে যাওয়ার পেছনে দায়ী করা হচ্ছে পশুপালন খাতে কিটোপ্রোফেন ও ডাইক্লোফেনাক সোডিয়ামের মতো অনিরাপদ ওষুধের ব্যবহারকে। বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে পশুপালন খাতে কিটোপ্রোফেন-জাতীয় ওষুধের ব্যবহার বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছে মন্ত্রিসভা।
সত্তরের দিকে দেশে ৫০ হাজারের মতো শকুন ছিল। ওই সময় শকুনের ব্যাপক উপস্থিতি থেকে বেশকিছু গণকবরও শনাক্ত হয়েছিল। এরপর গত কয়েক দশকে বাংলার আকাশ থেকে শকুনের সংখ্যা কমেছে আশঙ্কাজনক হারে। বিষয়টি সামনে আসার পর শকুনের সংখ্যা বৃদ্ধি ও সংরক্ষণে উদ্যোগী হয় সরকার। তবে শকুন সংরক্ষণে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণের পরও পাখিটির সংখ্যা কমে যাওয়া ঠেকানো যায়নি। এর কারণ অনুসন্ধান করে বিশেষজ্ঞরা দেখতে পেয়েছেন, পশুপালনে কিটোপ্রোফেন ও ডাইক্লোফেনাক সোডিয়ামের মতো ওষুধের ব্যবহার বৃদ্ধির কারণে শকুনের সংখ্যা কমছে। এরই মধ্যে পশুপালনে ডাইক্লোফেনাক সোডিয়ামের ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছে সরকার। কিটোপ্রোফেন বন্ধেও সিদ্ধান্ত হয়েছে গতকালই ।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক ভার্চুয়াল মন্ত্রিসভা বৈঠকে গতকাল পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের এ-সংক্রান্ত প্রস্তাবে অনুমোদন দেয়া হয়। গণভবন থেকে প্রধানমন্ত্রী ও সচিবালয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে মন্ত্রীরা ভিডিও কনফারেন্সিংয়ের মাধ্যমে বৈঠকে যোগ দেন।
সভা শেষে সচিবালয়ে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, গবাদিপশুর ব্যথানাশক কিটোপ্রোফেন-জাতীয় ওষুধের প্রভাবে শকুনের সংখ্যা নেমেছে ২৬০টিতে। দেশে মহাবিপন্ন এ শকুন রক্ষায় কিটোপ্রোফেন-জাতীয় ওষুধের উৎপাদন বন্ধে সায় দিয়েছে মন্ত্রিসভা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শকুনের প্রধান খাদ্য পশুপাখির মরদেহ। এর মধ্যে বড় একটি অংশ থাকে খামারে পালিত গবাদিপশু। দেশের খামারগুলোয় কিটোপ্রোফেন ব্যবহার করা হয় পশুর ব্যথানাশক হিসেবে। পশু মারা যাওয়ার পরও তার দেহে এ ওষুধ থেকে যায়। এসব মরদেহ ভক্ষণ করেই এ ওষুধের বিষক্রিয়ায় এখন পর্যন্ত অসংখ্য শকুনের মৃত্যু হয়েছে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
গতকালের ব্রিফিংয়ে খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, দেশে আশঙ্কাজনকভাবে শকুনের সংখ্যা কমে গেছে। সত্তরের দিকে দেশে ৫০ হাজারের মতো শকুন ছিল, এখন মন্ত্রণালয়ের হিসাবে মাত্র ২৬০টি শকুন আছে। তাও রয়েছে সংকটপূর্ণ অবস্থায়। এর অন্যতম কারণ হলো কিটোপ্রোফেন-জাতীয় ব্যথানাশক ব্যবহার। এ ওষুধে শকুনের মৃত্যু হয়। ওষুধ কোম্পানি ও বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক মন্ত্রণালয় প্রস্তাব নিয়ে এসেছে কিটোপ্রোফেন ওষুধ যদি বন্ধ করা না যায় তাহলে শকুন এ দেশে বাঁচবে না। আর শকুন না থাকলে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হবে। সেজন্য কিটোপ্রোফেন বন্ধের প্রস্তাব দিয়েছে তারা।
এ পর্যন্ত শকুন সংরক্ষণে সরকারিভাবে বেশকিছু পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। এসব পদক্ষেপের আওতায় শকুন রক্ষায় খুলনা ও সিলেটের ৪৭ হাজার হেক্টর এলাকাকে বন্যপ্রাণীর জন্য নিরাপদ এলাকা ঘোষণা করা ছাড়াও শকুনের প্রজননকালে ক্ষতিকর রাসায়নিক যেমন—ডাইক্লোফেনাকমুক্ত খাবার সরবরাহ, পাখিটির আবাসস্থল হিসেবে ব্যবহূত গাছ চিহ্নিত করে তার নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ এবং অসুস্থ শকুন উদ্ধার ও সুস্থ করে সাফারি পার্কে ছেড়ে দেয়াসহ বিভিন্ন ধরনের কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হয়েছে। এসব পদক্ষেপ সত্ত্বেও শকুন সংরক্ষণে সফলতা আসছিল না দেশজুড়ে ডাইক্লোফেনাক সোডিয়াম, কিটোপ্রোফেন-জাতীয় ওষুধের ব্যবহারের কারণে। বিষয়টির গুরুত্ব বিবেচনায় ডাইক্লোফেনাক সোডিয়ামের পর এবার কিটোপ্রোফেনের ব্যবহারও বন্ধ করা হচ্ছে।
মন্ত্রিপরিষদ সচিব গতকালের প্রেস ব্রিফিংয়ে জানান, কিটোপ্রোফেন-জাতীয় ওষুধের ব্যবহার বন্ধ করে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় ‘ম্যালোক্সিক্যাম’ নামে একটি ওষুধ ব্যবহারের পরামর্শ দিয়েছে। এটির পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া খুব কম। এটি ব্যবহার করলে শকুন বা অন্যান্য পাখির ক্ষেত্রে কোনো অসুবিধা হবে না। তাদের জীবনেরও ঝুঁকি থাকবে না। মন্ত্রিসভা এটিও অনুমোদন করেছে। এর (ম্যালোক্সিক্যাম) কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই, ওষুধটি বাজারে পাওয়া যাচ্ছে। ওটা (কিটোপ্রোফেন) তুলে নিলে কোনো ক্ষতি হবে না।