করোনাভাইরাসের ডেল্টা ধরনের স্থলে ভাইরাসটির নতুন ধরন ওমিক্রন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, বাংলাদেশেও করোনার এ প্রাণঘাতী ধরনের নতুন ঢেউ নিশ্চিতভাবে দেখা দেবে।
তারা আশঙ্কা করছেন, মানুষের মাস্ক পরা ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার চরম অনীহার মধ্যে যদি করোনার নতুন এ ধরন মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়ে তাহলে টিকা না নেয়া আট কোটি মানুষের ওপর এটি চরম আঘাত হানতে পারে বিশেষ করে শিশু ও বয়স্কদের ওপর।
ওমিক্রন ডেল্টার চেয়ে তিন গুণ বেশি সংক্রমক। এ জন্য বিশ্লেষকরা সরকারকে পরামর্শ দিয়েছেন, জনগণকে করোনার সব স্বাস্থ্যবিধি মানাতে প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে জোরদার করা এবং পাশাপাশি বিমান ও স্থল বন্দরের মাধ্যমে দেশে আসা যাত্রীদের সঠিকভাবে স্ক্রিনিং করা ও তাদের কোয়ারেন্টাইন নিশ্চিত করা।
তারা মনে করেন, দ্রুত সংক্রমক করোনার এ ধরনের বিস্তার রোধ করতে ওমিক্রন-আক্রান্ত দেশগুলো থেকে আসা সব যাত্রীদের প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইনে রাখা উচিত।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) সাবেক ভিসি অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম, রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুশতাক হোসেন ও গণবিশ্ববিদ্যালয়ের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. বিজন কুমার শীল ইউএনবির সঙ্গে আলাপকালে এসব কথা বলেন।
অধিকাংশ মানুষ মাস্ক না পরায় ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে না চলায় কোভিড সংক্রমণ বাড়তে পারে বলে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকও উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
দেশে গত কয়েকদিন ধরে করোনায় শনাক্তের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে এবং ১১ ডিসেম্বর প্রথমবারের মতো দেশে দু’জনের দেহে করোনার ওমিক্রন ধরন শনাক্ত হয়।
সম্ভাব্য নতুন ঢেউ
বিশিষ্ট ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেছেন, দেশে ইতোমধ্যেই ওমিক্রন ধরনে দু’জনকে শনাক্ত করা হয়েছে। তাই ‘এর ঢেউ বাংলাদেশে আসতে পারে এবং যারা বিদেশ থেকে আসছে তাদের ব্যাপারে আমাদের খুব সতর্ক থাকতে হবে।’
তিনি বলেন, কোভিড সংক্রমণ আবার বাড়তে শুরু করেছে এবং আগামী ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত তা ধীরে ধীরে বাড়তে পারে। ‘তাপমাত্রা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে মার্চে নতুন ঢেউয়ের মুখোমুখি হতে পারে। মার্চের মাঝামাঝি সময়ে আক্রান্তের সংখ্যা উদ্বেগজনকভাবে বেড়ে যাবে।’
এই বিশেষজ্ঞ বলেন, সাধারণত অন্যান্য শ্বাসযন্ত্রের ভাইরাস ও ইনফ্লুয়েঞ্জার মতো ফ্লুয়ের বাধার কারণে শীতকালে কোভিড সংক্রমণ কম থাকে।
অধ্যাপক মুশতাক হোসেন বলেন, আফ্রিকা ও ইউরোপের দেশগুলোর মতো আগামী দিনে ওমিক্রনের ঢেউ প্রত্যক্ষ করার ঝুঁকিতে রয়েছে বাংলাদেশ। ওমিক্রন ইতোমধ্যে কিছু আফ্রিকান ও ইউরোপীয় দেশে কমিউনিটি ট্রান্সমিশন পর্যায়ে রয়েছে। তাই বাংলাদেশে ওমিক্রনের প্রাদুর্ভাব ঘটবে না বলে মনে করার কোনো কারণ নেই।
দু’জন বিদেশ ফেরত মানুষের দেহে ওমিক্রন শনাক্তের পর আর কেউ আক্রান্ত না হলেও কয়েকদিন পর সংক্রমণের হার বাড়তে পারে বলে জানান তিনি।
‘করোনাভাইরাস সংক্রমণ চীনের উহান ও ভারতে ডেল্টা ধরন শনাক্ত হওয়ার পর অনেকেই ভেবেছিলেন বাংলাদেশে আসবে না। কিন্তু সেগুলো ভুল প্রমাণিত হয়েছে। তাই আমরা বাংলাদেশে ওমিক্রনের কমিউনিটি ট্রান্সমিশনের আশঙ্কা করছি।’
বিশিষ্ট মাইক্রোবায়োলজিস্ট বিজন কুমার শীল বলেন, ওমিক্রন শিকড় গভীর করার পর ধীরে ধীরে দেশের বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়বে।
তিনি বলেন, এক মাসের মধ্যে এক শ’টিরও বেশি দেশে ছড়িয়ে ওমিক্রন তার অত্যন্ত সংক্রামক প্রকৃতিকে দেখিয়েছে। ‘তাই আমি মনে করি না আমরা এই ভাইরাস থেকে মুক্তি পাব।’
প্রতিরোধ ব্যবস্থা জোরদারকরণ
অধ্যাপক নজরুল বলেন, ভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে ঘরে মাস্ক পরা জরুরি। ‘কিন্তু আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষ স্বাস্থ্যবিধি মানতে অনিচ্ছুক।’
তিনি বলেন, বাজার, পর্যটন কেন্দ্র এবং সামাজিক ও রাজনৈতিক সমাবেশে ভিড় কমাতে সরকারের এখনই পদক্ষেপ নেয়া উচিত।
এই বিশেষজ্ঞ বলেন, করোনার আরটি-পিসিআর পরীক্ষায় নতুন নেগেটিভ ছাড়া বিদেশ থেকে কোনো যাত্রীকে ঢুকতে দেয়া উচিত নয়।
এছাড়া আক্রান্তদের চিকিৎসার জন্য হাসপাতালগুলোকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে প্রস্তুত রাখা উচিত বলে মনে করেন তিনি।
অধ্যাপক মুশতাক বলেন, দেশের প্রবেশপথে সর্বোচ্চ সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেয়া উচিত। ‘করোনার নেগেটিভ সনদ ছাড়া প্রবেশ বন্ধ করা এবং আগতদের অবশ্যই ১৪ দিনের প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইনে থাকতে হবে।
তিনি বলেন, সামাজিক জমায়েত প্রতিরোধ করা এবং স্বাস্থ্যবিধি কঠোরভাবে বজায় রাখা গুরুত্বপূর্ণ। ‘টিকা না দেয়া ব্যক্তিদের যত তাড়াতাড়ি সম্ভব টিকা দেয়া প্রয়োজন।’
এছাড়াও অধ্যাপক মুশতাক বলেন, যারা এ ধরনে আক্রান্ত হবে এবং যারা তাদের সংস্পর্শে আসবে তাদের কন্ট্রাক্ট ট্রেসিংয়ের মাধ্যমে আইসোলেশনে রাখতে হবে। ‘মানুষকে মাস্ক পরা ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে এবং গণসমাবেশ এড়াতে বাধ্য করার জন্য সরকারের আইন প্রয়োগ করা উচিত।’
তিনি বলেন, করোনার নেগেটিভ সনদ থাকলেও ওমিক্রন আক্রান্ত দেশ থেকে যারা আসেন তাদের ১৪ দিনের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইনে রাখা উচিত।
ড. বিজন বলেন, ভারতে ওমিক্রন ছড়িয়ে পড়ায় দেশটি থেকে অবৈধ অনুপ্রবেশ বন্ধ করতে সীমান্ত এলাকায় সরকারের তীক্ষ্ণ নজর রাখা উচিত। ‘ভারতে আশঙ্কাজনকভাবে শনাক্ত বাড়লে সীমান্ত বন্ধ করে দেয়া উচিত।’
মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে ভিটামিন সি সমৃদ্ধ ফলমূল ও খাবার গ্রহণ করা উচিত বলেও জানান তিনি।
শিশুদের নিয়ে সতর্ক থাকতে হবে
অধ্যাপক নজরুল বলেন, প্রাপ্তবয়স্কদের মৌসুমি ভাইরাস ও ফ্লুয়ের বিরুদ্ধে এক ধরনের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা থাকে। ‘এছাড়া প্রায় অর্ধেক প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ ইতোমধ্যে করোনার টিকা পেয়েছেন। সুতরাং তারা ওমিক্রন দ্বারা কম সংক্রমিত হতে পারে। তবে করোনার এ ধরনে শিশুরা ঝুঁকিতে রয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘শিশুরা এ ভাইরাসে আক্রান্ত হলে তারা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। বিভিন্ন দেশে দেখা গেছে যে ওমিক্রন প্রাপ্তবয়স্কদের তুলনায় শিশুদের জন্য মারাত্মক। কিছু শিশু মারাও গেছে। তাই আমি মনে করি ওমিক্রন আমাদের দেশের শিশুদের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে।’
অধ্যাপক নজরুল বলেন, বয়স্ক ব্যক্তি যারা বিভিন্ন রোগে ভুগছেন তারাও ওমিক্রনের জন্য খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। ‘তাই আমাদের শিশু ও বৃদ্ধদের নিয়ে সতর্ক থাকা উচিত।’
অধ্যাপক মুশতাক বলেন, দেশের অর্ধেকেরও বেশি মানুষ এখনো টিকা নেয়নি এবং তাদের মধ্যে অনেক বয়স্ক ব্যক্তি বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত। ‘এমনকি যারা টিকা পেয়েছেন তারাও ওমিক্রনে আক্রান্ত হতে পারে। তবে তারা গুরুতর অসুস্থ নাও হতে পারে।’
রোববার এক ব্রিফিংয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মুখপাত্র ডা. রোবেদ আমিন সতর্ক করে বলেন, অনেক দেশে ওমিক্রনে আক্রান্ত হয়ে শিশুদের হাসপাতালে ভর্তির সংখ্যা বেড়েছে। ‘তাই ওমিক্রন সংক্রমণকে হালকাভাবে নেয়ার সুযোগ নেই।’
করোনার ওমিক্রন ধরন প্রায় ১১০টির মতো দেশে ছড়িয়ে পড়েছে বলেও জানান তিনি।
সূত্র : ইউএনবি