গত কয়েক দিনে ইরাকের রাজধানী বাগদাদে ইরান ও সৌদি আরবের মধ্যে সরাসরি আলোচনা এবং এ ক্ষেত্রে ইরাক সরকারের মধ্যস্থতার খবরাখবর বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে।
সৌদি আরব সরকার ২০১৬ সালে ইরানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করেছিল। এরপর গত পাঁচ বছরে সৌদি আরবের সঙ্গে সম্পর্ক পুন:প্রতিষ্ঠার জন্য ইরান বহুবার তার আগ্রহ বা প্রস্তুতির কথা জানিয়েছে। কিন্তু তেহরানের এ আগ্রহের তোয়াক্কা না করে রিয়াদ ইরানের সঙ্গে উত্তেজনা জিইয়ে রাখার নীতিতেই অটল থাকে। শেষ পর্যন্ত অনেক বিলম্বে হলেও ইরাক সরকারের মধ্যস্থতায় রাজধানী বাগদাদে ইরান ও সৌদি নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের মধ্যে বহু প্রত্যাশিত বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। তাই পাঁচ বছর পর রিয়াদ কেন হঠাৎ তেহরানের সঙ্গে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা ও সরাসরি আলোচনায় বসতে সম্মত হয়েছে সেটাই এখন বড় প্রশ্ন।
ধারণা করা হচ্ছে, ইরানের সঙ্গে আলোচনায় বসতে সৌদি আরবের আগ্রহের অন্যতম একটি বড় কারণ হচ্ছে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন। এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যুক্তরাষ্ট্র শক্তিশালী অবস্থানে রয়েছে এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও তা বাস্তবায়নে তারা বড় ভূমিকা রাখছে। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সমর্থন নিয়ে সৌদি আরব সরকার সমগ্র মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে দাপটের সঙ্গে নিজের শক্তিমত্বা প্রদর্শনের চেষ্টা করেছে। শক্তি প্রদর্শন করতে গিয়ে সৌদি সরকার বেশ কিছু বড় বড় ভুল করে বসেছে। উদাহরণ স্বরূপ কাতার ও ইরানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করা এবং ইয়েমেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করার কথা উল্লেখ করা যায়। প্রকৃতপক্ষে, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ওপর নির্ভরশীলতাই ছিল সৌদি আরবের শক্তির উৎস। কিন্তু মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ট্রাম্প পরাজিত হওয়ার পর ওয়াশিংটনের পররাষ্ট্র নীতিতে পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এ অবস্থায় সৌদি সরকারও তাদের পররাষ্ট্র নীতিতে পরিবর্তন আনতে বাধ্য হচ্ছে। সাড়ে তিন বছর পর ২০২১ সালের জানুয়ারিতে রিয়াদ দোহার সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের উদ্যোগ নেয়ার পর তেহরানের সঙ্গেও রিয়াদ সম্পর্ক স্বাভাবিক করার পদক্ষেপ নেবে বলে তখনই গুঞ্জন উঠেছিল।
ইরানের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনে সৌদি আরবের আগ্রহের পেছনে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হচ্ছে, আঞ্চলিক উত্তেজনা সৃষ্টিতে রিয়াদের ভুল পররাষ্ট্র নীতির কারণে সেদেশটির অভ্যন্তরে সৃষ্ট ব্যাপক অসন্তোষ। কেননা কাতারের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে এবং ইরানের সঙ্গে উত্তেজনা সৃষ্টি ও গণ্ডগোল বাধিয়ে এ অঞ্চলে সৌদি আরবের রাজনৈতিক অবস্থান অনেক দুর্বল হয়ে পড়েছে এবং অর্থনৈতিকভাবেও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সৌদি সরকার পশ্চিম এশিয়ায় ইরানভীতি ছড়ানোর জন্য ব্যাপক চেষ্টা করলেও তা শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়েছে বরং রিয়াদই এখন বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে। ধারণা করা হচ্ছে এ অঞ্চলে সৌদি আরবের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ মিত্র অর্থাৎ সংযুক্ত আরব আমিরাতও ইরানের সঙ্গে উত্তেজনা কমিয়ে আনার চেষ্টা করছে।
ইরানের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনে সৌদি আরবের আগ্রহের পেছনে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের পরিবর্তিত পরিস্থিতি এবং ইয়েমেন যুদ্ধে তাদের পরাজয়।
ইয়েমেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে রিয়াদ তেহরানের সঙ্গে এক ধরনের প্রক্সি যুদ্ধে লিপ্ত। কিন্তু ছয় বছরের যুদ্ধে প্রমাণিত হয়েছে সৌদি আরব ইয়েমেন যুদ্ধের চোরাবালিতে আটকা পড়েছে। সামরিক বিজয় অর্জন তো হয়নি উল্টো তারা এখন প্রচণ্ড মার খাচ্ছে এবং এ যুদ্ধে সৌদি আরবের বিপুল আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে। ইরান ও সৌদি আরবের মধ্যে বৈঠকের বিভিন্ন কারণের কথা উল্লেখ করে আল জাজিরার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘ইয়েমেনের আনসারুল্লাহ যোদ্ধারা সৌদি আরবের তেল, গ্যাস ক্ষেত্র, শোধনাগার, বিমানবন্দর, গুরুত্বপূর্ণ জ্বালানি কেন্দ্রগুলোতে হামলা চালিয়ে তাদের অনেক ক্ষতি সাধন করার কারণে হঠাৎ রিয়াদ তেহরানের সঙ্গে আলোচনায় বসতে ব্যাপক আগ্রহ দেখিয়েছে। কারণ ইয়েমেন ইস্যুতে সৌদি জনমনে ব্যাপক অসন্তোষ দেখা দিয়েছে এবং তারা দ্রুত কূটনৈতিক সমাধানের দাবি জানাচ্ছে’।
এ ছাড়া, সৌদি আরব এ অঞ্চলে ইরানের শক্তি ও প্রভাব নষ্ট করার জন্য দখলদার ইসরাইলের সঙ্গে অনানুষ্ঠানিক গোপন সম্পর্ক স্থাপন করলেও সেই সম্পর্ককে তারা প্রকাশ্যে আনার সাহস পাচ্ছে না। কারণ তারা জানে এতে করে মুসলিম বিশ্বে রিয়াদের অবস্থান দুর্বল হয়ে পড়বে।
যাইহোক, পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন, ভ্রাতৃপ্রতিম শক্তিশালী দুই মুসলিম দেশ ইরান ও সৌদি আরবের মধ্যকার আলোচনা এবং কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের উদ্যোগ মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনের আভাস। এ দুই দেশের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপন ইয়েমেন যুদ্ধ বন্ধের পাশাপাশি সমগ্র পশ্চিম এশিয়ায় প্রক্সিযুদ্ধ অবসানে ভূমিকা রাখবে বলে আশা করা হচ্ছে। তবে এ দুই মুসলিম দেশের সম্পর্ক স্থাপনের উদ্যোগে ইসরাইল ক্ষুব্ধ হবে এতে কোনো সন্দেহ নেই। কেননা এতে ইসরাইল ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং অন্তত তেলআবিব-রিয়াদ সম্পর্ক স্থাপনের উদ্যোগ দুর্বল হয়ে পড়তে পারে।
পার্সটুডে