মৃতদের প্রতি আপনি কেমন মর্যাদাবোধ চর্চা করতে পারবেন তার ধারণা বা স্বক্ষমতা মৃত্যুর মধ্যে নাই। আপনি কী ধরণের জীবন আসলে যাপন করেন বা জীবনকে আপনি কীভাবে দেখেন তার উপরই নির্ভর করে মৃত্যু ও মৃতের প্রতি আপনার ট্রিটমেন্ট কি হবে। ফলে আমাদের প্রথম সমস্যা হলো, জীবন ও মৃত্যু এই দুইটাকে আলাদা করে বা বিচ্ছিন্ন করে দেখা হয়। এটার দার্শনিক সমস্যা নিয়ে নিচে একটু আলাপ করবো। তার আগে কিছু খুচরা কথা সেরে নেই।
ক.
আপনি যখন কারো সাথে প্রতারণা করেন সাথে সাথে আপনার একধরনের মৃত্যুর হয়ে যায়। বা বলা যায় আপনি আত্মহত্যা করেন। আপনি যখন মিথ্যা বলেন সাথে সাথে আপনি নিজের পরম/ডিভাইন সম্ভবনা ধ্বংস করে ফেলেন। তখনও আপনার মৃত্যু হয়ে যায়।
উপরের কথাটা খুব সুন্দর নীতি কথার মতো শুনাচ্ছে। এবং এর সাথে সবাই কমবেশি একমত কিন্তু এটা খুব হাস্যকর রকমের পুরানা আমলের নীতিবাগিশগিরি। ফলে অনেকের মুচকি হাসির কারণ হতে পারে এই ধরণের নীতিবাক্য। যখন চালাকীকে বুদ্ধি, জ্ঞান, বিচক্ষণতার প্রতিশব্দ আকারে গ্রহণ করা হয়ে যায় তখন এই ধরণের পুরানা আমলের নীতিবাক্য একটু হাস্যকর মনে হওয়া খুবই স্বাভাবিক। আবার প্রশ্ন আসবে আমি যেটাকে প্রতারণা মনে করছি অন্যজন সেটাকে ন্যায্য মনে করতে পারে! আমি যেটাকে মিথ্যা মনে করছি অন্যজন, অন্য সমাজে সেটাকে সত্য বা মিথ্যা নাও মনে করতে পারেন। সে ক্ষেত্রে আমার কথার মধ্যে যে জেনারেলাইজেশন আছে তা তো সমস্যাজনক। হুম। সঠিক। রাইট ক্রিটিক। কিন্তু আমি মোটেও সেন্টিমেন্টাল-মোরালিস্ট না। বা কোন ধরণের স্লেভ মোরালিটিকে আঁকড়ে ধরার দাওয়াই দিই নে। বরং এই ধরণের স্লেভ বা দাস্যনীতির বিরুদ্ধেই সোচ্চার থাকি।
তা হলে উপরের কথাগুলো কোন অবস্থান থেকে বলছি? একটু ব্যাখ্যা করি- আপনি দেখবেন কিছু কিছু বিষয়ে আমাদের সেল্ফ কমিটমেন্ট আছে। সেটা ধর্ম, সমাজনীতি, আইন বা একদম প্রাকৃতিক আবেগ-অনুভূতি থেকে শুরু করে বস্তুগত জায়গা বা যে কারণেই আমাদের মধ্যে পয়দা হোক না কেন। জীবন পরিচালনার ক্ষেত্রে আমাদের কতগুলো আত্ম-প্রতিশ্রুতি থাকে। নিজের সাথে নিজের কতগুলো বিষয়ে একধরণের মিমাংসা থাকে। আপনি যখন সেই মিমাংসার সাথে একমত হয়ে যান। এবং সেই সব পজিশনকে ধারণ করেন। সেগুলোর প্রতি কমিটেড থাকেন কিন্তু সেই কমিটমেন্ট থেকে কোন কারণে নিজেকে সরিয়ে আনেন বা নিজের নীতির বিরুদ্ধে নিজেই অবস্থান নেন বা অন্তরের আপনি আর বাহিরের আপনি যখন মুখোমুখি দাঁড়িয়ে যান; তখন একটা ডিজঅর্ডার তৈরি হয় সেল্ফের ভেতরই। আধুনিক মানুষ এই কারণে কোন না কোনোভাবে মানসিক সমস্যার শিকার হতে বাধ্য হয় জীবনের কোন না কোন পর্যায়ে।
এই যে নিজের সত্যের সাথে বেঈমানী করার বিষয়টি, আমি সেই অবস্থাকে একধরণের মৃত্যু বা আত্মহত্যার অবস্থা বলছি। এটার মধ্য দিয়ে আপনার নিজের নৈতিক বোধ এবং সত্ত্বার স্বাধীনতাকেও হত্যা করা হয়।
এই যে নিজের সত্যের সাথে বেঈমানী করার বিষয়টি, আমি সেই অবস্থাকে একধরণের মৃত্যু বা আত্মহত্যার অবস্থা বলছি। এটার মধ্য দিয়ে আপনার নিজের নৈতিক বোধ এবং সত্ত্বার স্বাধীনতাকেও হত্যা করা হয়
তো এই ধরণের আত্মঘাতি কাজের পরেও, আত্মহত্যার পরে তো আর মানুষের পক্ষে ঘুরে দাঁড়ানো সম্ভব না। নতুন করে কোন কিছু শুরু করা সম্ভব না। কিন্তু দেখা যাচ্ছে প্রতারণা, মিথ্যা, চালাকি ও ধোকার মাধ্যমে (নিজে যেটার প্রতি কমিটেড সেই ধরণের নৈতিক অবস্থান থেকে সরে যাওয়ার পরেও) অনেক মানুষ ঠিকই জীবন ধারণ করছেন। নিজের ও আশ-পাশের মানুষের বিবেচনায় সফলও হচ্ছেন। এবং এই ধরণের প্রতারক, চালাক ও কূটকৌশলী লোক যদিও নিজেরা আবার এটার শিকারে পরিণত হওয়ার ব্যাপারে সবসময়ই বেশি সতর্কও থাকেন। ফলে তাদের জীবন থমকে যাওয়ার বদলে বেশ গতিশীলই হতে থাকে। এটা তাদের খুব প্রভাবিত করে না। তার পরেও তারা জীবনকে চালিয়ে নিয়ে যেতে থাকেন। কীভাবে এটা সম্ভব হয়?
।মিডিয়া সংস্কৃতি ও ক্ষমতার উন্মাদনা
কেউ যদি মনে করে সে তো নিজের মনের মধ্যে সত্যকে গোপনে ধরে আছেন, সত্যকে সত্য আর মিথ্যাকে মিথ্যা বলে মানেন, কিন্তু যে কোন কারণে সে অন্যের সাথে একটু প্রতারণা বা চালাকির আশ্রয় নিচ্ছেন। অনেকে তো এখানে আবার মানবিকতারও যুক্তি হাজির করে। মানবিকতার দোহাই দিয়েও এই ধরণের জুলুমী কায়-কারবার করে থাকেন। এর পরের লেখায় মানবিকতার সমস্যা নিয়ে আলাপ করবো। তাই এটা এখন থাক।
মনে রাখতে হবে যেকোন প্রতারণাই আত্ম-প্রতারণা। আপনি যদি মনে করেন এতে অন্যজন ক্ষতিগ্রস্থ হবে আপনি পার পেয়ে যাবেন তা হয় না। এর ফলে যে হিউম্যান এসেন্সটার মৃত্যু হয়- এটাকে সাথে সাথে রিপেয়ার করতে না পারলে মানুষ জীবনে একবার প্রতারণা বা মিথ্যার আশ্রয় নেয়ার পরে চিরদিনের মতো এমনিতেই এই পথ থেকে সরে আসতো; অবশ্য এই এসেন্সটার গুরুত্ব যদি বুঝতে পারতো। এবং কি জিনিস যে হত্যা করছে তার বিষয়ে যদি হুশ থাকতো। তাহলে, কোন পুলিশিং দরকার হতো না। কিন্তু ঘটনাটা যা ঘটে তা বেশ ইন্টারেস্টিং। প্রতারক, মিথ্যাবাদি, জালেম সাথে সাথে বেঁচে থাকার লজিক হাজির করে। প্রয়োজনের লজিক হাজির করে। দায়িত্ব বা কারো প্রতি ভালোবাসার কারণে সে মিথ্যা বলে, প্রতারণা করে, ঘুষ দিয়ে চাকরী নেয়। অন্যায় সুবিধা আদায় করে। ক্ষমতার অপব্যবহার করে। নিজের লোভকে বৈধতা দেয়ার জন্য সে হয়তো পরিবারের কল্যাণের লজিক তৈরি করে। ফলে সে যত বড় বা ছোট অন্যায়ের মধ্যেই নিজেকে নিয়ে যাক না কেন সাথে সাথে তাকে বেঁচে থাকার লজিক হাজির করতে হয়। ফলে যে হিউম্যান এসেন্সে সে হারিয়ে ফেললো তা তার মতো করে পুনঃজন্ম লাভ করে মিথ্যা-মিথ্যি ভাবে হলেও। সে সমাজিকভাবে স্বজ্জন, ধর্মকর্মতেও খুব নিয়মিত, প্রকৃতিপ্রেমী, খুব মানবিক মানুষ হিসেবে সমাজে ও পরিবারে ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতার অর্জন করে ফেলতে পারে এই ছদ্ম লজিককে কাজে লাগিয়ে। এভাবে সফলতার চলতি হিসেবের নিরিখে তার জীবনের উত্থান-পতনের সংগ্রামে নিজেকে সফলও ভাবতে থাকে। তার পরে সে সবার মতোই মৃত্যুর দিকে শরীরী এগিয়ে যেতে থাকে। এটা সে করতে পারে কারণ তার কাছে মৃত্যুর ধারণাটা কেবল শরিরী/বায়োলজিক্যাল। তাই জিন্দালাশ হয়েও সে মনে করে এখনও তো মরি নাই। ভোগের ক্ষমতা যেদিন শেষ হবে সেই দিন তার মৃত্যু হবে এর বাইরে সে মৃত্যুকে কোথাও স্থান দিতে পারে না। তার চর্চায় মৃত্যু জীবন থেকে অতি বিচ্ছিন্ন। সংক্ষেপে মুটামুটি এমনই একটা কমন চিত্র আমাদের সামনে দেখতে পাই !
এখন এখানে সমস্যটা কি ঘটে? সমস্যাটা ঘটে মানুষ একটা জীবন যাপন করে মানে বেঁচে থাকে কিন্তু সে কোনদিনও বুঝতে চেষ্টা করে না বা খুঁজতে চেষ্টা করে না এই জীবনের মধ্যে সে যেটাকে মানুষের জীবন বলছে তাতে আসলেই ‘হিউম্যান এসেন্স’টা কি? তাঁর একজিসটেন্সটাকে সে বুঝতে চেষ্টা করে না। এইটা খুঁজেতে গেলে সে যে সম্পদের খনিটা পাবে তাকে রক্ষার জন্য তাকে একটা সংগ্রামে নামতে হবে। আমাদের বেশির ভাগই এই সংগ্রামের ভয়েই মানুষের জীবন থেকে পালিয়ে যাই। মানুষ তখন হিউম্যান এসেন্সে ও তাঁর একজিনটেন্সকে আমলে না নিয়ে আমলে নেয় হিউম্যান কন্ডিশনকে। নিজের অবস্থাকে সে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়। এবং সত্যের ধারণার একটা পারসনিফিকেশন বা ব্যক্তিআয়ন করে ফেলে।
মানুষ একটা জীবন যাপন করে মানে বেঁচে থাকে কিন্তু সে কোনদিনও বুঝতে চেষ্টা করে না বা খুঁজতে চেষ্টা করে না এই জীবনের মধ্যে সে যেটাকে মানুষের জীবন বলছে তাতে আসলেই ‘হিউম্যান এসেন্স’টা কি?
তখন নিজের সত্ত্বার সত্য থেকে ছিটকে পরে এরপর থেকে নকল করতে থাকে মানুষের জীবনের ধারণার নামে নিজের জন্য যেটা সুবিধা হয় সেইটাই যৌক্তিক করে তুলে নিজের কাছে। কিন্তু আপনি একবার মিথ্যা বলার মধ্যদিয়ে বা প্রতারণা করার মধ্য দিয়ে মানুষের জীবনের যে এসেন্স সেটা থেকে আপনি সরে যান, সেল্ফ কমিটমেন্ট থেকে পালিয়ে যান, আপনি যদি সংকল্প করেন জীবনে যাই হোক, মিথ্যা বলব না বা প্রতারণা করবো না, না খেয়ে মরে গেলেও করবো না; তখন আপনাকে অনিবার্যভাবে সংগ্রামী হতে হবে। নিজের ভেতর একটা লড়াকু এজেন্সি ডেভলপ করতে হবে। যিনি একজন বীরের মতো চারপাশের সাথে লড়ে যাবে। এটার মধ্য দিয়েই কেবল মাত্র আপনার হিউম্যান এসেন্সে বা আপনার মানুষী-আত্মমর্যাদাকে রক্ষা করতে পারবেন। এবং এটা একটা মানুষ তখনই করতে সক্ষম হয় যখন সে মনে করে সরাসরি মৃত্যুর সামনে এসে দাঁড়ালেও সে কখনও নিজের সত্তার সাথে বিট্রে করবে না। কোন এবসার্ড লজিক দিয়ে নিজের সেল্ফকে বুঝ দিবে না। তখনই কেবল মাত্র এই বীরের জন্ম দেয়া নিজের পক্ষে সম্ভব হতে পারে। এটা অতি জটিল করেও আলোচনা করা যায়। আমি খুব সহজে বলতে চেষ্টা করছি। ফলে মিথ্যা, প্রতারণা, লোভ এগুলাকে চর্চার পরেও মানুষ যে আবারও নিজেকে মানুষ হিসেবে ক্লেইম করে মাথা উঁচা করে বাঁচতে শুরু করে তার জন্য আগেই বলেছি, সে হাজির করে বেঁচে থাকার লজিক। কিন্তু এই লজিকটা একটা ‘টটলজি’/বাকোয়াজি। এখানে তো সত্যের ধারণা নাই। দেকার্ত থেকে কান্ট কেউ’ই সত্যের ধারণার সংযোগ ছাড়া লাজিকের বা রিজনিং এর কোন গ্রহণযোগ্যতাকে আমলে নিবেন না। বরং এই যুক্তিকে ব্যবহার করে আসলেই সত্যে পৌঁছানো সম্ভব কি না তার ক্রিটিক্যাল আলোচনা তো কান্ট করেছেনই। কাজেই এসব ক্ষেত্রে মানুষ যে যুক্তির অবতারণা করছে নিজেকে বুঝ দেয়ার জন্য, এগুলা কোনভাবেই যুক্তি না, এগুলা পিওর ইতরামি। এখানে কোন ট্রু- এসেন্স নাই যা তার ‘মানুষ’ পরিচয়কে ধারণ করতে পারে। ফলে এই যুক্তিগুলো লজিক অব ক্রাইম, এবং এটা একটা সময় প্যাশন অব ক্রাইমেরও জন্ম দেয়। এটা তখন সমাজে একটা সিস্টেম আকারেও ডেভলপ করে। ফলে এইভাবে হিউম্যান এসেন্সকে হত্যার মধ্য দিয়ে যে মানুষগুলো আমরা বেঁচে থাকি এরাই জিন্দালাশ। এরাই যখন মৃতদের জন্য শোকে ফেঁটে পরে, মানবিকতার জন্য গলা ছাড়ে তখন যে অবস্থার তৈরি হয় তাকেই বলেছি কৌতুতকর অবস্থা। বিষয়টা আরও একটু ব্যাখ্যা করে এই লেখা শেষ করি।
।ক্ষমতা-রাজনীতি ও ভাসানী
খ.
জ্যাক দেরিদা লেকচার দেয়ার জন্য যেসব লেখা-লেখি করেছেন তার পরিমান ছিল প্রিন্ট কাগজে ১৪ হাজার পৃষ্টা। সেইসব লেকচার তিনি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে দিয়েছেন। মৃত্যুর পর সেগুলা বিভিন্ন শিরোনামে বই আকারে বের হতে শুরু করেছে। ২০১৯ সালে সেইসব লেকচারের কিছু অংশ থেকে ‘লাইফ-ডেথ’-নামে একটা বই প্রকাশ হয়। এখানে দেরিদা যে জটিল আলোচনা করেছে তা বিস্তারিত ব্যাখ্যা করতে হলে বেশ বড় লেখা লিখতে হবে। আমি জাস্ট একটু নোট রেখে যাচ্ছি। আগ্রহীরা যেন নিজ থেকে উদ্যোগী হয়ে চিন্তা করতে পারেন।
দেরিদা বলছেন, life-death. এই যে মাঝখানের একটা হাইফেন তিনি ব্যবহার করেছেন এটা বুঝতে পারা খুব গুরুত্বপূর্ণ। তিনি হেগেলের ‘সাইন্স অব লজিক’ বইটার আলোচনাও করেছে এখানে। তিনি দেখাচ্ছেন হেগেল যেভাবে ডাইলেকটিক্যাল পদ্ধতিতে দেখেন। লাইফ হাইফেন ডেথ বিষয়টা তেমন না।
দেরিদার লাইফ-ডেথ ধারণাটার পার্থক্য আকাশ-পাতাল। ডেথকে লাইফ থেকে আলাদা করে দেখার প্রচেষ্টা থাকে এই সব ক্ষেত্রে। লাইফকে বিশেষ কিছু পজিশনের আলোকে বুঝতে চেষ্টা করা হয়
সাধারণত আমরা লাইফ এন্ড ডেথ বা লাইফ অর ডেথ এমন ভাবে দেখতে অভ্যস্ত, লাইফের পরে যে এন্ড বা অর টাইপের একটা শব্দ থাকে, এই শব্দগুলো দ্বারা লাইফের সাথে ডেথের যে ধরণের ডাইলেকটিক্যাল যেটার বাজে বাংলা হলো দ্বন্দমূলক (আমি এই বাংলা ব্যবহারের পক্ষে না। এতে হেগেলের চিন্তার কিছুই ধরা পরে না, দ্বন্দ কেবল বিপরীতার্থক না। অন্তর্গতও হতে পারে। কিন্তু এই অনুবাদে হেগেলের চিন্তার মূল ভাবটাই হারিয়ে গেছে। আমরা দ্বন্দমূলক বলতে যা বুঝি আর হেগেরের ডাইলেকটিক ম্যাথড যা বুঝায় তার মধ্যে বিস্তর ফারাক আছে) সম্পর্ক আমরা দেখি এটার সাথে দেরিদার লাইফ-ডেথ ধারণাটার পার্থক্য আকাশ-পাতাল। ডেথকে লাইফ থেকে আলাদা করে দেখার প্রচেষ্টা থাকে এই সব ক্ষেত্রে। লাইফকে বিশেষ কিছু পজিশনের আলোকে বুঝতে চেষ্টা করা হয়। দেরিদার চিন্তার দিকগুলো নিয়ে বিস্তারিত কথা বলতে গেলে এই লেখা শেষ করতে পারবো না আজকে। ফলে আমি এই বিষয়টা নিজের বুঝবার জন্য যে ভাবে তুলে নিয়েছি সেই কথা ছোট করে বলেই শেষ করতে হবে।
লাইফ-ডেথ- কথাটা এমন একটা হাইফেন দিয়ে লেখার মধ্য দিয়ে দেরিদা এই বিষয়ে চিন্তার (হেগেলের পরের) ধারার মধ্যে একটা পার্থক্য সূচনা করলেন। সেটা হলো, তিনি লাইফ মানে জীবনকে ডেথ থেকে আলদা করে দেখছেন না। ফলে এই মৃত্যু বায়োলজিক্যাল বা শরীরি মৃত্যুর ধারণা মাত্র নয়। লাইফ-ডেথ কথাটার বাংলা সহজে আমরা করতে পারি, জীবন-মৃত্যু। কিন্তু এখানে অনুবাদ করতে হবে জীবনময়-মৃত্যু। আর যারা জীবন থেকে মৃত্যুকে আলাদা করে দেখেন। একটা বাইনারী আকারে দেখেন এবং বেঁচে থাকার যুক্তিতে নিজের সত্ত্বার সত্য থেকে সরে আসেন। তাদের বলা যায় living-death। এটারই বাংলা করেছি জিন্দালাশ। এই প্রসঙ্গের সাথে সংযোগের জন্যই দেরিদার শব্দটা এই লেখাতে এতো গুরুত্ব দিয়ে ব্যবহার করছি। আরও একটু পরিস্কার করে বলতে চেষ্টা করতে পারি।
আমরা দেখতে পাচ্ছি, যখন আমরা মৃত্যুকে জীবন থেকে আলদা করে দেখতে শুরু করবো তখন সহজেই আমরা লিভিং-ডেথ এর পথে হাটতে শুরু করবো। একটা মানুষ যদি মনে করে সে চিরন্তন সত্যকে ধারণ করবে এবং সেটাকে মনে রেখে জীবনে চলবে তাহলে সে সব সময় সজাগ থাকছে সে যেকোন মুহূর্তে কারণে-অকারণে মারা যেতে পারে। শরীরকে সে হারাতে পারে। ফলে বেঁচে থাকার যুক্তিতে তার মধ্যে যে এরোগেন্স, অহং ভোগ বাসনা ইত্যাদি তৈরি হয় তার খপ্পরে পরে যতক্ষণ বেঁচে আছে ততক্ষণ ‘হিউম্যান এসেন্স’কে খর্ব করে এমন কোন কিছু সে সহজে করতে চাইবে না। বরং যেহেতু মৃত্যুকে সে সবচেয়ে নিশ্চিত বলে জানে, সে চাইবে এই মৃত্যুর বিনিময়ে হলেও এই এনেন্সকে সে ধারণ করবে। সমুন্নত করবে বা রাখবে। এই ধরণের বুঝ থেকেই ইডিওলজির চেয়ে জীবনের মূল্যকে তুচ্ছ করে মানুষ সংগ্রামের দিকে ধাবিত হয়। কিন্তু ইডিওলজির আগেই ব্যক্তি-স্তরে নিজের সত্তার সাথে এই বুঝ বা এই মিমাংসা না হলে ইডিওলজি তখন রিচুয়াল হয়ে উঠতে পারে। সেটা অন্য আলাপ। ফলে life-death বিষয়টা বুঝতে পারলে আমরা living-death হওয়ার খপ্পর থেকে নিজেদের বাঁচাতে পারি। তাই এখানে দেরিদার চিন্তার গুরুত্বটা হাল্কা ভাবে নেয়ার সুযোগ নাই।
অনেক বিপদ ও সমস্যা আসবে জীবনে আবার জগত অনেক সুন্দর। বেঁচে থাকা কতো আনন্দময় কিন্তু একদিন তো মরে যেতেই হবে! ফলে আগেই জগতকে গুডবাই বলে দিয়ে জেন্তে-মরার লাইন ধরলে যে সমস্যাটা হয় তা হলো, নিজের সত্ত্বার সত্যের সাথে সংগ্রামের মুখোমুখি হওয়ার আগেই কাফনের কাপড়ে আশ্রয় নেয়া
এখানে স্মরণ রাখার জন্য বলি, এটা কিন্তু লালন পন্থা বা সাধু, সূফীদের জেন্তে মরার ধারণার মতো না। লালন পন্থায় সাধুরা জীবিত অবস্থায়ই সেলাই ছাড়া সাদা কাফনের কাপড় পরেন (খেলকা ধারণ করেন)। ‘জেন্তে-মরা’-ধারণাটা তাদের সাধণার একটা গুরুত্বপূর্ণ দিক। কিন্তু এটার সমস্যা হলো, এই রিচুয়াল রপ্ত করার মধ্য দিয়ে বাস্তবতার বিমূর্তায়ন করা হয়। বাস্তবিক ভাবে মৃত্যুকে মোকাবেলা করার আগেই ডেথকে প্রতিকী ভাবে চর্চার এই শোকাতুর রিচুয়াল মূলত একধরণের অন্টলজিক্যাল স্কেপটিসিজম। এটার বাংলা পড়তে পারেন সত্তার সহজ সত্য থেকে পলায়ন। ফলে এটার মধ্যে জীবনের কোন গৌরব নাই। এরাও একধরণের লিভিং-ডেথ। জীবন দুঃখময়। অনেক বিপদ ও সমস্যা আসবে জীবনে আবার জগত অনেক সুন্দর। বেঁচে থাকা কতো আনন্দময় কিন্তু একদিন তো মরে যেতেই হবে! ফলে আগেই জগতকে গুডবাই বলে দিয়ে জেন্তে-মরার লাইন ধরলে যে সমস্যাটা হয় তা হলো, নিজের সত্ত্বার সত্যের সাথে সংগ্রামের মুখোমুখি হওয়ার আগেই কাফনের কাপড়ে আশ্রয় নেয়া। ফলে জীবনের যে বিপুল ও সংগ্রামী সম্ভবনা থাকে তার আর বিকাশ হয় না। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, যারা এই তত্বকে বাজারজাত করেন এরা এটাকে বিপ্লবী রাজনীতির জন্য জরুরী ও সহি পথ হিসেবে হাজির করেন। অথচ এটার মধ্যে কোন হিউম্যান এসেন্স বা একজিসন্টেসকে অর্জন করার কোন সংগ্রাম নাই। ফলে লাইফ-ডেথ থেকে এই জেন্তেমরার দল কিন্তু আলাদা। ফাইফ-ডেথ জানে মৃত্যু জীবনের অংশ এবং এটাকে সব সময় সাথে নিয়ে তাঁর সত্য এসেন্সে বা সত্ত্বাকে সে সমুন্নত রাখার সংগ্রাম করে যায়। সে পালায় না। সে ফাইট কারে। স্কেপ করে না। একদল যেমন মিথ্যার ভিতর দিয়ে নিজের সত্যের সথে বেঈমানী করে আত্মহত্যা করে আর একদল এই ধরণের রিচুয়ালের (অনেক সময় এই রিচুয়ালগুলোকেই ধর্ম ও সংষ্কৃতি বা আত্মপরিচয়ের মূল বিষয় করে তুলে অনেকে) আশ্রয়ে গিয়ে সত্ত্বার সত্য প্রকৃতি ও সংগ্রামী বিকাশের পথ থেকে স্কেপ/পলায়ন করে লিভিং-ডেথ হয়ে যায়। এদের বিপ্লবী ভূমিকাতো দূরের কথা জীবনের প্রতি নূনতম হকও আদায় হয় না।
কাজেই যাদের নূনতম দার্শনিক বোধ আছে তারা এই ধরণের রিচুয়ালিস্ট নিহিলিজমকে রাজনৈতিক বা মুক্তির দিশা বলে চর্চা ও জনগনের সামনে হাজির করতে পারেন না। এখানে কোন ট্রুথ নাই। আমি এখানে বিস্তারিত না লিখলেও পাঠক হয়তো বুঝতে পারছে ফরহাদ মজহার বা এই ধারার যারা আছেন তারা মূলত স্কেপিস্ট/পলায়নপর। সোফিস্ট/ছদ্দ দার্শনিক। তাই আমি সবার বা বিশেষ ভাবে কারো নাম নিচ্ছি না। এগুলা যারা করেন তারা চিন্তার দিক থেকে খুবই ভালনারেবল অবস্থায় আছেন।
শোক মূলত সে যে জীবনটা রেখে গেল তার জন্যই। কত স্মৃতি, কত প্রেম, কত আশা সব তো জীবনকে ঘিরেই। ফলে মৃত্যুর জন্য শোক খুব বেশি আসলে থাকে না। মৃত্যুতে খোদ মৃত্যুর জন্যই শোক নাই। মৃত্যুতে মৃত্যুর এসেন্স বা সত্যও এইভাবে হারায়ে যাচ্ছে
আবার এই পলানপরাতাকে তারা ডিভাইন অর্ডার এর আলোকে জাস্টিফাই করার চেষ্টা করে। এটা আর এক ধরণের ইতরামি। এই কারণে ভাবান্দোলন বা ফকির লালনকে যারা বিপ্লবী রাজনৈতিক ও দর্শন আকারে এই সামাজে চর্চা করেন তাদের ফটামির ব্যাপারে আমি সবসময়ই সতর্ক করি আপনাদের।
যাহোক আমি দেরিদার লাইফ-ডেথ কথাটা এভাবে ব্যবহারের গুরুত্বটা বুঝতে গিয়ে দেখলাম, আসলে জীবনেই তো আমরা মৃত্যুর মধ্যে হাবুডুবু খাই। এই মৃত্যু বায়োলজিক্যাল বা শরীরি মৃত্যু না হলেও আমরা জিন্দালাশে পরিণতি হই প্রতিনিয়ত মৃত্যুকে জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখতে গিয়ে। মানুষের মৃত্যুকে অনেক ভাবে দেখা যায়। ডেথ ইজ এ কনসিকুয়েন্স অব লাইফ। মৃত্যু জীবনেরই একটি অভিঘাত/প্রতিক্রিয়া বা পরিক্রমা। ফলে আমরা যখন শোক করি তখন শোকের মধ্যে একটা অংশ থাকে স্মৃতির আর একটা অংশ থাকে মৃতের হারিয়ে ফেলা জীবনের জন্য শোক। যে জীবনটা সে হারাইলো সেটার জন্য মৃত ব্যক্তির কোন শোক বা অনুপাত নাই কিন্তু আমাদের শোকের সীমা থাকে না। এই শোকের একটা বড় অংশ আমরা বেঁচে থাকবো আর সে থাকবে না- এই জনিত আবেগ থেকে জেগে ওঠে। এই যে স্মৃতির ভারবাহী আমাদের হতে হচ্ছে সেটাও শোককে আরও উস্কে দেয়। অন্যদিকে শোক মূলত সে যে জীবনটা রেখে গেল তার জন্যই। কত স্মৃতি, কত প্রেম, কত আশা সব তো জীবনকে ঘিরেই। ফলে মৃত্যুর জন্য শোক খুব বেশি আসলে থাকে না। মৃত্যুতে খোদ মৃত্যুর জন্যই শোক নাই। মৃত্যুতে মৃত্যুর এসেন্স বা সত্যও এইভাবে হারায়ে যাচ্ছে।
তাই দেখা যাচ্ছে মৃত্যুর জন্য আসলে মানুষের খুব বেশি কিছু করারও নাই। মিলান কুন্দেরার কথার আলোকে যদি বলি, এভাবে বলতে পারি- মৃত্যুতে আমাদের মূলত তিন ধরণের অনুভূতি হয়। এক. প্রতিটি মৃত্যুই আমাদের দুঃখিত করে। দুই. কিছু কিছু মৃত্যু আমাদের বিষ্মিত ও বিপন্ন করে। তিন. খুব কম মৃত্যুই আমাদের নাড়িয়ে দেয়।
আমাদের বরং চিন্তা করতে হবে চারপাশে-এই যে বিপুল জিন্দালাশ নিয়ে আমরা বেঁচে আছি এবং এরা যে জিন্দালাশ সেই হুশও যে এদের নাই তাদের জন্য কি ভাবে শোক প্রকাশ করবো? তাদের জন্য শোক প্রকাশ করা সম্ভব হলে বরং মৃত্যুর জন্য শোক প্রকাশ করা সহজ হবে। এরা বেঁচে থেকেও বেঁচে নাই। ফলে তাদের বেঁচে থাকার এই শূন্যতাকে বুঝতে পেরে যখন আমরা জিন্দা লাশের জন্য শোকাতুর হয়ে উঠবো- সেই শোক প্রকৃত মৃত্যুর শোকের কাছা-কাছি পৌঁছাতে অনেক বেশি সক্ষম করবে আমাদের।
তা না হলে আমরা এখন মৃত্যুর জন্য যে ধরণের শোক করি তাতে জীবনের মর্যাদা যেমন থাকছে না তেমনি থাকছেনা প্রকৃত মৃত্যুকে উপলব্ধি করবার অবস্থা। আনুষ্ঠানিকতা ও মৃত্যুর কারণের দিকে মনযোগ দিতে গিয়ে খোদ মৃত্যুর মহিমাকেই আমরা হারিয়ে ফেলেছি। মৃত্যু হারিয়েছে মৃত্যুর মর্যাদা।
কিন্তু লিভিং-ডেথকে মোকাবেলা করতে পারলে আমরা জীবনের মধ্যে মৃত্যুর এসেন্সেকে ভালোমতো রপ্ত করতে পারবো। এই জন্যই আমার প্রচেষ্টা হলো জিন্দালাশের জন্য বরং বেশি শোক আমাদের মধ্যে থাকা দরকার, তাহলে প্রতি মুহূর্তে সত্তার সত্যকে ধারণ করে আমরা বেঁচে থকার সংগ্রামে নিজেকে নিয়োজিত করতে পারবো। ফলে জিন্দা-লাশের দশা থেকে আগে আমাদের নিজেদের মুক্ত করতে হবে। এর জন্য দরকার আত্ম-প্রতিজ্ঞা ও সত্ত্বার সত্যকে টিকিয়ে রাখার জন্য সংগ্রামী ভূমিকায় নিজেকে উপনিত করা। সত্যের জন্য সংগ্রাম ছাড়া মৃত্যু আর কোনভাবে মহিমা অর্জন করতে পারে বলে আমার জানা নাই।