৭৭৯ মেগাওয়াটের ৫ বিদ্যুৎকেন্দ্র উদ্বোধন করলেন প্রধানমন্ত্রী
Advertisements

বাংলাদেশের সাথে জাপানের সম্পর্কের ৫০ বছর পূর্তিতে আগামী ২৫ থেকে ২৮ এপ্রিল পর্যন্ত জাপান সফর করবেন শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রীর সফরে দু’পক্ষের মধ্যে আট থেকে ১০টি সমাঝোতা স্মারক ও চুক্তি সই হওয়ার সম্ভাবনা আছে বলে পররাষ্ট্র দফতর জানিয়েছে। আর উত্তর-পূর্ব ভারত এবং নেপাল ও ভুটানের বাজার ধরতে বাংলাদেশে অর্থনৈতিক হাব প্রতিষ্ঠার যে পরিকল্পনা করছে জাপান, এই সফরে সে বিষয়ে জাপানের প্রধানমন্ত্রী ফুমিও কিশিদার সাথে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিস্তারিত আলাপ হবে বলে জানা গেছে।

গত মাসে ভারত সফরের সময় বাংলাদেশ ও ভারতকে কেন্দ্র করে জাপানের প্রধানমন্ত্রী ফুমিও কিশিদা বিনিয়োগ প্রস্তাব দেন। বাংলাদেশে ১২৭ কোটি ডলার বিনিয়োগ প্রস্তাব অনুমোদন করে জাপান ।

জাপানের বিনিয়োগ পরিকল্পনার মধ্যে একটি শিল্পাঞ্চল তৈরিসহ বাংলাদেশে শিল্প স্থাপন ও বন্দর তৈরিতে বিনিয়োগ রয়েছে। শিল্পাঞ্চলে উৎপাদিত পণ্য তারা ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল, নেপাল ও ভুটানে বাজারজাত করতে চায়। এজন্য তারা যোগাযোগ অবকাঠামোও গড়ে তুলতে চায়। জাপান ৩০ কোটি মানুষের আবাসস্থল ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল এবং বঙ্গোপসাগর এলাকায় উন্নয়নে নজর দেবে।

বাংলাদেশের তিনটি অবকাঠামো প্রকল্পে বিনিয়োগ করবে জাপান। যার মধ্যে আছে মাতারবাড়ি এলাকায় নতুন একটি বাণিজ্যিক বন্দর। এই বন্দরের সাথে ত্রিপুরাসহ ভারতের স্থলবেষ্টিত উত্তর-পূর্বাঞ্চল সংযুক্ত হবে। তবে এই বন্দরের মাধ্যমে তারা বৃহত্তর আন্তর্জাতিক বাজারও ধরতে চায়।

এই সফরে জাপানের প্রধানমন্ত্রী ফুমিও কিশিদার সাথে বৈঠক ছাড়াও শেখ হাসিনা তার সম্মানে নৈশ ভোজে অংশ নেবেন। তিনি জাপানের সম্রাট নারুহিতোর সাথেও সাক্ষাৎ করবেন। সফরে প্রধানমন্ত্রী একটি বিনিয়োগ সম্মেলন, স্থানীয় বাংলাদেশীদের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানসহ কয়েকটি দ্বিপক্ষীয় অনুষ্ঠানে যোগ দেবেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অবদান রাখায় কয়েকজন জাপানি বন্ধুর হাতে ‘ফ্রেন্ডস অব লিবারেশন ওয়ার’ শীর্ষক সম্মাননা তুলে দেবেন প্রধানমন্ত্রী।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র সেহেলী সাবরীন সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন, সফরে দু’পক্ষের মধ্যে সই হওয়া চুক্তি বা সমাঝোতা স্মারকের মধ্যে রয়েছে মেট্রোরেলের সমীক্ষা, জাহাজভাঙা শিল্পের আধুনিকায়ন, কৃষি প্রক্রিয়াজাতকরণ আধুনিকায়ন, বিনিয়োগ সহায়ক মেধাস্বত্ব, শিল্পের মানোন্নয়নের অংশীদারত্ব এবং শুল্ক খাতের সমন্বয়। প্রতিরক্ষা খাতেও তিনটি সমাঝোতা সই হতে পারে। এছাড়া ঢাকা ও টোকিওর মধ্যে সরাসরি ফ্লাইট চালু এবং নারায়ণগঞ্জ ও নারুতুর মধ্যে টুইন সিটি চালুর বিষয়েও ঘোষণা আসতে পারে।

প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ হাসিনা এর আগে পাঁচবার জাপান সফর করেন। তিনি প্রথমবার জাপান সফর করেন ১৯৯৭ সালের জুলাই মাসে।

বিশ্বব্যাংকের সাথে ১২৫ কোটি ডলারের ঋণ চুক্তি

জাপান থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২৮ এপ্রিল যুক্তরাষ্ট্র যাবেন। বিশ্বব্যাংকের সাথে সম্পর্কের সুবর্ণজয়ন্তী পালন উপলক্ষে তিনি ওয়াশিংটনে বিশ্বব্যাংকের একটি বিশেষ অনুষ্ঠানে অংশ নেবেন। ১ মে ওয়াশিংটনে বিশ্বব্যাংকের সদর দফতরে সমাপনী অনুষ্ঠানে শেখ হাসিনা প্রধান অতিথি হিসেবে যোগ দেবেন।

অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) সূত্র জানায়, প্রধানমন্ত্রীর এই সফরে বিশ্বব্যাংকের সাথে একাধিক প্রকল্পে অন্তত ১২৫ কোটি ডলারের ঋণসহায়তার চুক্তি হতে পারে, বাংলাদেশী মুদ্রায় যা প্রায় ১৩ হাজার কোটি টাকা।

আঞ্চলিক যোগাযোগ বৃদ্ধির জন্য বিশেষ করে নেপাল ও বাংলাদেশের সাথে বাণিজ্য সম্প্রসারণে সড়কসহ অন্য যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন প্রকল্পে ৭৫ কোটি ডলার এবং ভাঙন থেকে নদীতীর রক্ষা ও বন্যা নিয়ন্ত্রণের আরেকটি প্রকল্পে ৫০ কোটি ডলার দিচ্ছে বিশ্বব্যাংক।

এছাড়াও আরো দুই-তিনটি প্রকল্পে ঋণসহায়তা নিয়ে আলোচনা চলছে। দর-কষাকষি চূড়ান্ত হয়ে গেলে প্রধানমন্ত্রীর সফরের সময় এসব ঋণচুক্তি হতে পারে। সে ক্ষেত্রে সহায়তার পরিমাণ আরো বাড়বে।

গত ৫০ বছরে বাংলাদেশকে সব মিলিয়ে তিন হাজার ৮০০ কোটি ডলার দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। বর্তমানে ৫৭টি চলমান প্রকল্পে এক হাজার ৬০০ কোটি ডলার বিনিয়োগ করেছে বিশ্বব্যাংক।

বিশ্বব্যাংকের সাথে গত পাঁচ দশকের সম্পর্ক সবচেয়ে বড় ধাক্কা খায় পদ্মা সেতুর অর্থায়ন নিয়ে। পদ্মা সেতুতে ১২০ কোটি ডলার দেয়ার কথা ছিল বিশ্বব্যাংকের। কিন্তু দুর্নীতি হতে পারে, এমন অভিযোগ তুলে ২০১১ সালে অর্থায়ন থেকে সরে দাঁড়ায় সংস্থাটি। শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ নিজস্ব অর্থায়নে ৩২ হাজার কোটি টাকায় পদ্মা সেতু নির্মাণ করে।

পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘বিশ্বব্যাংকের সাথে পদ্মা সেতু নিয়ে আমাদের যা হয়েছে, তা ভুলে যাওয়াই ভালো। আমাদের মধ্যে তাদের ঋণ নিয়ে দ্বিধা ছিল। কিন্তু মনে হয়, ওই দ্বিধা কেটেছে। আশা করি, আলোচনা করে ১২৫ কোটি ডলার কেন আরো বেশি ঋণ পাওয়া যাবে। এতে বাজেট বাস্তবায়ন সহজ হবে এবং রিজার্ভ ও ডলারের ওপর চাপ কমবে।’

‘বিশ্বব্যাংকের ঋণ পরিশোধে ৩৫-৩৬ বছর সময় পাওয়া যায়। আর শুরুর ছয় বছর ঋণ শোধ করতে হয় না। সুদের হারও নামমাত্র। ফলে বিশ্বব্যাংকের ঋণ বাংলাদেশের এখনকার অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে জরুরি। আইএফএফ-এর ঋণ আমাদের জন্য উপকারী হয়েছে। বিশ্বব্যাংকের ঋণও আমাদের কাজে লাগবে।’

তার মতে, ‘জাপান সফরও ইতিবাচক ফল বয়ে আনবে। ১২০ কোটি ডলার তারা তো এরই মধ্যে অনুমোদন করেছে। তারা অরো অনেক বিনিযোগ করবে। ফলে এই সফর অর্থনৈতিক দিক দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের এখন উচিত হবে যেখান থেকেই ডলার পাওয়া যায়, তা নিয়ে আসা।’

আর সাবেক রাষ্ট্রদূত মেজর জেনারেল (অব.) শহীদুল হক বলেন, ‘বিশ্বব্যাংকের চেয়ে প্রধানমন্ত্রীর জাপান সফর নিয়ে বেশি আগ্রহী। কারণ উত্তর-পূর্ব ভারতে কেন্দ্র করে জাপান এই এলাকায় বিশাল বিনিয়োগ পরিকল্পনা করছে। তারা বাংলাদেশে পণ্য তৈরি করে সেখানে রফতানি করবে। আবার ওই এলাকায়ও তারা ইন্ডাষ্ট্রি করবে। তা আবার বাংলাদেশের মাতারবাড়ি থেকে ভারতের অন্য অংশে রফতানি করবে। এই এলাকায় তারা ৭০ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি বিনিয়োগ করবে। এই বিনিয়োগের কতটা বাংলাদেশ পাবে, সেটাই এখন দেখার বিষয়। আমরা মনে হয়, প্রধানমন্ত্রীর এই সফর তার জন্য একটি বড় সুযোগ। বাংলাদেশ আলাপ আলোচনার মাধ্যমে বাংলাদেশের জন্য বিনিয়োগ যত বাড়িয়ে নিতে পারে, ততই ভালো।’

তিনি বলেন, ‘এখানে চীনকে পিছনে ফেলার একটি ভূরাজনৈতিক চিন্তা আছে জাপান ও ভারতের মাধ্যমে পশ্চিমাদের। চীনাদের বেল্ট এন্ড রোড ইনিশিয়েটিভ এর অধীনে আমাদের জন্য একটি প্রকল্প ছিল বাংলাদেশ-চায়না-ইন্ডিয়া-মিয়ানমার ইকোনমিক করিডর। ওটা আমাদের জন্য খুবই ভালো ছিলো। কিন্তু ভারতের জন্য এটা হয়ে ওঠেনি। এখন জাপান যেটা ভারতকে কেন্দ্র করে করছে, সেটা আমাদের বিকল্প সুযোগ হিসেবে নিতে হবে।’

বিশ্বব্যাংক প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘পদ্মা সেতুর ঘটনার পর বিশ্বব্যাংক কিন্তু বাংলাদেশের অন্যান্য প্রজেক্টে তাদের সহায়তা অব্যাহত রেখেছে। তারা কিন্তু বাংলাদেশকে ছেড়ে যায়নি। পদ্মা সেতু নিতে তিক্ততার সৃষ্টি হলেও তার বরফ এখন গলছে। বিশেষ করে আইএমফ ঋণ দেয়ার পর বাংলাদেশ যে ঋণ পরিশোধে সক্ষম তার আস্থা তৈরি হয়েছে। ফলে এখন বিশ্বব্যাংকসহ আরো দাতারা বাংলাদেষকে ঋণ দেবে। আইএমএফ-এর শর্ত পূরণও শুরু করেছে বাংলাদেশ। তবে ঋণের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।’

আগামী ৬ মে বৃটেনের রাজা তৃতীয় চার্লসের অভিষেক অনুষ্ঠান। ওই অনুষ্ঠানে যোগ দেয়ার কথা রয়েছে শেখ হাসিনার। তিনি ওয়াশিংটন থেকে ৪ এপ্রিল লন্ডন যাবেন। ৯ মে প্রধানমন্ত্রীর দেশে ফেরার কথা রয়েছে।

সূত্র : ডয়চে ভেলে

Advertisements