Killing the youth
Advertisements

আন্দোলনের সময় উত্তরায় পুলিশের গুলিতে নিহত মোখলেছুর রহমান দুর্জয়ের লাশ দুদিন পর টঙ্গীর একটি বিলে উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনার পেছনে উঠে এসেছে রোমহর্ষক ও বেদনাদায়ক তথ্য। গত ১৮ জুলাই বিকেল ৪টার দিকে উত্তরা পূর্ব থানার সামনে পুলিশের গুলিতে তিনি নিহত হন বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ১৮ জুলাই বিকেলে উত্তরা পূর্ব থানার সামনে মোখলেছুর রহমান পুলিশের এপিসি (আর্মড পার্সোনেল ক্যারিয়ার) গাড়ির সামনে বুক পেতে দাঁড়ান। তাঁর প্রতিবাদের সময় এপিসির ভেতরে থাকা এক পুলিশ সদস্য গুলি চালান। গুলিবিদ্ধ হয়ে তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। এরপরও এপিসির চালক গাড়ি পেছনে নিয়ে তাঁর মাথার ওপর দিয়ে চালিয়ে দেন। এ সময় উপস্থিত জনতা চিৎকার করে থামানোর চেষ্টা করলেও, ততক্ষণে মোখলেছুর রহমানের মগজ বেরিয়ে যায়। এই মর্মান্তিক দৃশ্য ভিডিও ও ছবিতে স্পষ্টভাবে ধরা পড়ে।

ঘটনার দুই দিন পর, ২০ জুলাই ভোরে টঙ্গী পূর্ব থানার পুলিশ গুদারাঘাটের মরকুন বিল থেকে ভাসমান অবস্থায় তাঁর লাশ উদ্ধার করে। লাশের পকেটে থাকা মোবাইল ফোনের সিম খুলে অন্য ফোনে লাগিয়ে পুলিশ তাঁর পরিবারকে খবর দেয়। শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ মর্গে ময়নাতদন্ত শেষে মরদেহ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়। জামালপুরের সরিষাবাড়ীর হিরণ্যবাড়ী গ্রামে জানাজা শেষে তাঁর দাফন সম্পন্ন হয়।

২০ জুলাই টঙ্গী পূর্ব থানায় ৩৮ নম্বর মামলা দায়ের করা হয়। এজাহারে নিহত মোখলেছুর রহমানের বাবা হাবিবুর রহমান উল্লেখ করেছেন, “আমার দৃঢ় বিশ্বাস, অজ্ঞাতনামা আসামি বা আসামিরা পারস্পরিক যোগসাজশে আমার ছেলেকে হত্যা করে লাশ গুম করার জন্য পানিতে ফেলে দেয়।” তবে হাবিবুর রহমান দাবি করেছেন, তিনি কোনো মামলা করেননি। থানায় গেলে তাঁদের থেকে কয়েকটি কাগজে স্বাক্ষর নেওয়া হয়, তবে সেগুলো কীসের জন্য ছিল তা জানা নেই। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এসআই উৎপল কুমার বলেন, মামলায় তেমন কোনো অগ্রগতি হয়নি।

নবগঠিত সংগঠন ‘জুলাই রেভল্যুশনারি অ্যালায়েন্স’-এর আহ্বায়ক সালেহ মাহমুদ রায়হান বলেন, তিনি ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন। তাঁর ভাষায়, “মোখলেছুর রহমান তখন বারবার দুই হাত মেলে পুলিশের সামনে দাঁড়াচ্ছিলেন। বিকেল ৪টার দিকে এপিসির সামনে দাঁড়িয়ে বুক পেতে দেন। এপিসির ভেতর থেকে পুলিশ গুলি করলে তিনি নিচে পড়ে যান। উঠে বসার চেষ্টা করলেও এপিসির চাকা তাঁর মাথার ওপর দিয়ে যায়।”

মোখলেছুর রহমান কনক্রিট ডেভেলপারস লিমিটেডে সেলস অ্যান্ড মার্কেটিং এক্সিকিউটিভ হিসেবে কাজ করতেন। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. নূর কুতুবুল আলম জীবন জানান, মোখলেছুর অত্যন্ত মার্জিত ও ভদ্র স্বভাবের ছিলেন। তিনি মাঝেমধ্যে ক্লায়েন্টদের সঙ্গে প্রজেক্টে যেতেন।

মোখলেছুর কবিতা লিখতে পছন্দ করতেন এবং তাঁর সামাজিক মাধ্যমের পোস্টে প্রতিবাদী মনোভাব প্রকাশ পেত। একটি পোস্টে তিনি লিখেছিলেন:

“বিদ্রোহের দামামা বেজেছে আজ, আরও আরও বাজুক;রক্ত দিয়ে বুলেট কিনব, এগিয়ে দিয়েছি বুক।মনে রাখিস, পরাজয়ের সাথে আমার আজন্ম আড়ি;আমার মৃত্যু মানেই তোর দাফন, তোদের দাফন সারি সারি।”

সরিষাবাড়ী উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা অরুণ কৃষ্ণ পাল এবং উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. মো. শফিকুল ইসলাম জানান, গণঅভ্যুত্থানে হতাহতের তালিকা তৈরির সময় স্থানীয় কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে মোখলেছুরের নাম শহীদের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। তবে উত্তরা পূর্ব থানার ঘটনায় তাঁর নিহত হওয়ার তথ্য সরকারি রেকর্ডে কীভাবে অন্তর্ভুক্ত হলো, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

উত্তরা পূর্ব থানার তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মুজিবুর রহমানকে ২ আগস্ট বদলি করা হয়। তাঁর স্থলে আসা ওসি মহিবুল্লাহর সঙ্গেও যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি। তদন্ত কর্মকর্তা এসআই উৎপল কুমার বলেন, মোখলেছুর পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছেন কিনা সে বিষয়ে তাঁদের কাছে কোনো তথ্য নেই।

মোখলেছুর রহমানের মৃত্যুর ঘটনাটি একাধিক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। পুলিশের গুলিতে মৃত্যুর পর লাশ বিল থেকে উদ্ধারের ঘটনায় কীভাবে প্রকৃত অপরাধীরা ধরা পড়বে, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। পরিবার এবং প্রত্যক্ষদর্শীরা স্পষ্টতই বলছেন এটি একটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড, যা ন্যায়বিচারের দাবি রাখে।

সূত্রঃ সমকাল

Advertisements