২০১৯ সালের ২১ মে। তরুণ গণমাধ্যমকর্মী ফাগুন রেজার নিথর দেহ পাওয়া গিয়েছিলো রেললাইনের পাশে। সাব-এডিটর হিসেবে দেশের অন্যতম একটি গণমাধ্যমের ইংরেজি বিভাগে কাজ করা ফাগুন প্রথমে নিখোঁজ হয়েছিলেন, পরে তার লাশ পাওয়া যায়। ঘটনাটি সাতষট্টি মাস পেরিয়ে গেলেও এখনো হত্যার প্রকৃত মাস্টারমাইন্ডদের আনুষ্ঠানিকভাবে চিহ্নিত করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই), জামালপুরের কর্মকর্তারা দাবি করেন, কিলার গ্রুপ চিহ্নিত হয়েছে এবং এক অভিযুক্তের ১৬৪ ধারার স্বীকারোক্তিও পাওয়া গেছে। তবুও হত্যাকাণ্ডে সংশ্লিষ্ট আরও চারজনকে এখনো জিজ্ঞাসাবাদের আওতায় আনা হয়নি। বিচার প্রক্রিয়ার এই ধীরগতি শুধু ফাগুনের পরিবার নয়, পুরো সমাজকেই হতাশ করছে।
ফাগুনের লাশ এমনভাবে রেললাইনের পাশে রাখা হয়েছিলো যেন দ্রুত কোনো ট্রেন এসে তার শরীর ছিন্নভিন্ন করে ফেলে। তবে ভাগ্যক্রমে স্থানীয়দের নজরে আসায় সেই চেষ্টাটি ব্যর্থ হয়। এরপরও লাশকে “বেওয়ারিশ” হিসেবে দাফনের এক অদ্ভুত চেষ্টা শুরু করে জামালপুর রেলওয়ে পুলিশ। তারা ফিঙ্গারপ্রিন্ট নিয়ে পরিচয় নিশ্চিত করার সহজ সুযোগ থাকলেও অজানা কারণে সেই উদ্যোগ নেয়নি।
পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে হয়ে উঠেছিল যখন জানা যায়, লাশটি দ্রুত বেওয়ারিশ কবরস্থানে দাফনের তোড়জোড় চলছে। পুলিশের কয়েকজন কর্মকর্তার তৎপরতায় এবং তাদের প্রেরিত ছবির মাধ্যমে নিশ্চিত হওয়া যায় যে এটি ফাগুন রেজার দেহ। সেই প্রচেষ্টায় বাধা দেয়ার ফলে লাশ দাফনের পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়। কিন্তু কেন এমনটি করা হয়েছিলো? উত্তর খুঁজতে গিয়ে বারবার প্রশ্ন উঠে আসে ক্ষমতা, প্রভাব এবং নিষ্ঠুর রাজনৈতিক বাস্তবতার।
ফাগুনের সাংবাদিকতা যে এ হত্যাকাণ্ডের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ, তা অস্বীকার করার উপায় নেই। এর পাশাপাশি, আমার নিজের সাংবাদিকতা, আমার বাবার এবং মামার সাংবাদিকতা—সব মিলিয়েই হয়তো এটি একটি টার্গেটেড হত্যাকাণ্ড ছিলো। ফাগুনের পরিবারের রাজনৈতিক পরিচয় এবং বাংলাদেশে সাংবাদিকতার ইতিহাসে আমাদের পরিবারের অনস্বীকার্য অবদানও হয়তো এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে কাজ করেছে।
ডয়চে ভেলে এবং অন্যান্য গণমাধ্যমে প্রশ্ন উঠেছিল—ফাগুনের প্রকাশিত কোনো সংবাদ কি তার মৃত্যুর কারণ হয়েছিলো? এর সঠিক উত্তর আজও অজানা। তবে এটুকু স্পষ্ট, গণমাধ্যমে তার কাজ তাকে নির্দিষ্ট কিছু ব্যক্তির রোষানলে ফেলেছিল।
ফাগুন রেজার মৃত্যু শুধু একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, এটি দেশের সামগ্রিক গুম ও হত্যার মর্মান্তিক চিত্রের একটি প্রতিফলন। গুমের পর লাশ গুম করার চেষ্টার উদাহরণ আমাদের চারপাশে বিরল নয়। “গুমের পর লাশও গুম : কারও লাশ রেললাইনে, কারও নদীতে”—এই শিরোনামে প্রথম আলোর একটি প্রতিবেদন গুম ও হত্যার ভয়াবহ বাস্তবতা তুলে ধরেছিল। যারা তাদের প্রিয়জনকে হারিয়েছেন কিন্তু এখনো তাদের লাশ খুঁজে পাননি, তাদের যন্ত্রণা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না।
আমি নিজে একজন পিতা। আমি জানি, আমার ছেলের কবর কোথায়। আমি সেখানে গিয়ে তার জন্য প্রার্থনা করতে পারি। কিন্তু যারা এখনও তাদের সন্তানদের সন্ধান পাননি, তাদের কষ্ট কতটা ভয়ানক, তা আমি কল্পনা করলেও শিউরে উঠি।
প্রকৃতি কখনো অন্যায় বিনা দণ্ডে যেতে দেয় না। ফাগুন হত্যাকাণ্ডের একজন কথিত মাস্টারমাইন্ড, যাকে “অস্পৃশ্য” বলা হয়েছিল, তিনি এখন হত্যার অন্য একটি মামলায় কারাগারে রয়েছেন। এটি হয়তো সরাসরি ফাগুনের মামলার বিচার নয়, তবে এটুকু আশ্বাস দেয় যে অন্যায়কারীদের শেষ পর্যন্ত পালানোর সুযোগ নেই।
ফাগুন রেজার মতো তরুণ সাংবাদিকদের হত্যা শুধু একটি পরিবারের ক্ষতি নয়, এটি একটি জাতির গণতন্ত্র এবং মানবাধিকারের ওপর সরাসরি আঘাত। তার হত্যার প্রকৃত কারণ এবং মাস্টারমাইন্ডদের চিহ্নিত করে বিচার নিশ্চিত করা শুধু ফাগুনের প্রতি নয়, দেশের সাংবাদিক সমাজ এবং বিচার ব্যবস্থার প্রতি ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠার জন্য অত্যন্ত জরুরি।
ফাগুনের গল্পটি আমাদের মনে করিয়ে দেয়, অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে কখনো থেমে থাকা উচিত নয়। তার রক্তের দাগ মুছে ফেলার চেষ্টা যারা করেছে, তারা সফল হতে পারেনি এবং পারবেও না।
একজন পিতা হিসেবে এই লেখাটি আমি বুকে পাথর বেঁধে লিখেছি। ফাগুনের কথা স্মরণ করতে গিয়েও নিজের আবেগকে আটকে রাখা কঠিন। তবে এটি শুধু আমার ব্যক্তিগত শোক নয়; এটি আমাদের সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় দায়বদ্ধতার প্রতিচ্ছবি।