প্রধানমন্ত্রিত্ব আমার জন্য কোনো কিছু নয়
Advertisements

দণ্ডপ্রাপ্ত বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়াকে চিকিৎসার জন্য বিদেশ নেওয়ার দাবি প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, খালেদা জিয়াকে বাসায় থাকার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। এর বেশি আর দয়া দেখানো আমাদের পক্ষে সম্ভব না। গতকাল ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষ্যে ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ আওয়ামী লীগের উদ্যোগে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে আয়োজিত স্মরণ সভায় প্রধান অতিথির ভাষণে একথা বলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

তিনি বলেন, খালেদা জিয়া অসুস্থ তাকে বিদেশে পাঠানোর আহ্লাদের আর শেষ নেই। এতিমের অর্থ-আত্মসাত করে সাজাপ্রাপ্ত আসামি কারাগারে ছিল। আমি এইটুকু দয়া করেছি, যে ঠিক আছে বয়োবৃদ্ধ অসুস্থ মানুষ। জেলখানায় হাঁটতে-চলতে, ওঠতে-বসতে অসুবিধা হয়। আমার যেটুকু ক্ষমতা আছে তার মাধ্যমে তাকে আমি তার বাসায় থাকার সুযোগটা করে দিয়েছি।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, এখন উনি (খালেদা) সেজেগুজে মেকাপ নিয়ে, একেবারে ভ্রু-ট্রু এঁকে হাসপাতালে যান আর এদিকে তার ডাক্তাররা রিপোর্ট দেন। খুবই খারাপ অবস্থা। মানে অবস্থা নাকি যায় যায়, তার লিভার নাকি পচে শেষ। লিভার সাধারণ পচলে মানুষ কী বলে? সেটা আমি মুখে বলতে চাই না। কী খেলে তাড়াতাড়ি লিভার পচে সেটা তো আপনারা ভালোই জানেন। আর দ্বিতীয় কথা হচ্ছে, আমার কাছে কোন মুখে বলে। আমার বাবা-মা, ভাই তাদের হত্যা, ইনডেমনিটি দিয়ে, খুনিদেরকে ক্ষমা করে বিভিন্ন দূতাবাসে চাকরি দিয়ে পুরস্কৃত করেছিলেন জিয়াউর রহমান। এরশাদ এসে তাদের রাজনীতি করার সুযোগ দিল। খালেদা জিয়া ক্ষমতায় এসে আরেক ধাপ (বেশি)।

তিনি আরও বলেন, আমি ওই কথা জিজ্ঞেস করবো ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার পর যারা আমাদের নেতাকর্মীদের হত্যা করেছে সেই বিচারটা হতে দেয়নি। যতগুলো আলামত ছিল নষ্ট করেছে, জজ মিয়া নাটক বানিয়েছে, যে এই ধরনের ঘটনা ঘটালো তার জন্য আমাদের কাছে এত করুণা-দয়া চায় কীভাবে, সেটাই আমার প্রশ্ন। বার বার আমাকে যারা হত্যা করতে চেয়েছিল-তারপরও তো আমরা করুণা করেছি।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, তার জন্য দয়া দেখাতে হবে। দয়া তো দেখিয়েছি আর কত দয়া দেখাবো। যে আমাকে খুন করতে চেয়েছে, আমার বাবা-মা, ভাইদের হত্যার সঙ্গে জড়িত তার জন্য যথেষ্ট দয়া দেখানো হয়েছে। যে আমার হাজার হাজার নেতাকর্মীকে হত্যা, পঙ্গু করেছে। দিনের পর দিন নির্যাতন করেছে। অনেক দেখানো হয়েছে, এর বেশি আর দয়া দেখানো আমাদের পক্ষে সম্ভব না।

বিদেশ যেতে নাটক সাজানো হচ্ছে মন্তব্য করে শেখ হাসিনা বলেন, এখন তারা আরেকটা নাটক সাজাচ্ছে। আপনারা দেখেছেন যে গাড়িতে করে হলুদ শাড়ি পরে তিনি হাসপাতালে গেলেন এখন রিপোর্ট দিয়েছে খুবই খারাপ অবস্থা বিদেশে না পাঠালে নাকি চিকিৎসা হবে না। এভারকেয়ার তো চমৎকার চিকিৎসা করেছে। সব থেকে আধুনিক চিকিৎসা, সব থেকে ব্যয়বহুল চিকিৎসা তাকে দিচ্ছে। আসামিকে কে কবে বিদেশে পাঠায়, চিকিৎসার জন্য। তাহলে কারাগারে কোন আসামি আর বাদ থাকবে না। সবাই দাবি করবে আমাদেরকেও চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠান। আমরা কী সবাইকে পাঠাবো?

বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কা হবে না : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন, বাংলাদেশ তার উন্নয়নের ধারা থেকে কখনোই শ্রীলঙ্কার মতো পরিস্থিতিতে পতিত হবে না, বরং সব বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেই এগিয়ে যাবে। একটা কথা মনে রাখবেন (দলের নেতাকর্মীদের) যে- বাংলাদেশ কখনই শ্রীলঙ্কা হবে না, হতে পারে না।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, আজকে কেউ কেউ শ্রীলংকা বানাচ্ছে বাংলাদেশকে। আমি আপনাদের একটা কথা জানাতে চাই, যেহেতু আপনারা আমাদের নেতা-কর্মী তাই আপনাদের এ কথাটা শুনতে ও জবাব দিতে হয়। আপনারা একটা কথা মনে রাখবেন- বাংলাদেশ কখনও শ্রীলংকা হবে না, হতে পারে না।

সরকার প্রধান বলেন, বাংলাদেশের যে পরিস্থিতি, তাতে শ্রীলংকা হয়েই গিয়েছিল ২০০১ থেকে ২০০৬ সালে বিএনপির শাসনামলে। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, সে সময় পাঁচ বার দেশ দুর্নীতি চ্যাম্পিয়ন হয়, দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি, বিদ্যুত ও পানির জন্য হাহাকার, মানুষের কর্মসংস্থান নাই, তার ওপর জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাস, ২১ আগষ্টের গ্রেনেড হামলা, সারাদেশে বোমা হামলা, সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবিরিয়াকে হত্যাসহ বিভিন্ন জায়গায় গ্রেনেড হামলা। আর তখনই মানুষ আন্দোলনে রাস্তায় নামতে বাধ্য হয়। কাজেই শ্রীলংকার সেই অবস্থান থেকেতো বাংলাদেশকে উদ্ধার করে নিয়ে আসতে সমর্থ হয়েছি। কাজেই আজকের বাংলাদেশ কেন শ্রীলংকা হবে?

তিনি বলেন, আমাদের যে অর্থনীতির গতিশীলতা সেটা যেন অব্যাহত থাকে এবং অর্থনৈতিকভাবে আমাদের দেশটা যাতে এগিয়ে যেতে পারে সেজন্য সুপরিকল্পিত পদক্ষেপ নিয়ে তাঁর সরকার এগোচ্ছে।

দেশের সার্বিক উন্নয়ন বিবেচনাতেই তার সরকার উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করে থাকে উল্লেখ করে তিনি বলেন, বিরাট অংকের উন্নয়ন প্রকল্প এটা নিলে পরে বিরাট অংকের একটা কমিশন পাবো, সে কথা চিন্তা করে শেখ হাসিনা কোন প্রকল্প নেয় না।

শেখ হাসিনা বলেন, ২০০৯ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ কেবল উন্নয়নশীল দেশেই উন্নীত হয়নি। আমরা স্যাটেলাইট বঙ্গবন্ধু-১ উৎক্ষেপন করেছি, বিশ^ব্যাংকের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে নিজেদের টাকায় পদ্মা সেতু নির্মাণ করেছি এবং করোনার মধ্যে অর্থনীতির চাকাকে সচল রাখতে সক্ষম হয়েছি।

তিনি বলেন, পদ্মা সেতু শুধু সেতুই নয়, এই সেতু হচ্ছে বাংলাদেশ গর্ব, সম্মান এবং আত্মমর্যাদাবোধের প্রতীক। কারণ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে আমরা অস্ত্র হাতে তুলে নিয়ে যুদ্ধ করে বিজয় অর্জন করেছি, আমরা বিজয়ী জাতি। আমরা কারো কাছে মাথা নোয়াব না, হেরে যাব না। আমাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ দিয়ে লাভ নেই।

করোনার পর যুদ্ধ (রাশিয়া-ইউক্রেন) এবং একে ঘিরে নানারকম স্যাংশনের পরিপ্রেক্ষিতে উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য বাজেট বরাদ্দে দেশ এবং জনগণের প্রয়োজনানুপাতে বাস্তবায়নের জন্য এবিসিডি ধাপ করে দিয়েছেন যাতে কোনটার পর কোনটা বাস্তবায়িত হবে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, সরকার ‘ধার করে ঘি খাওয়ার নীতি’তে যেমন বিশ্বাসী নয়, তেমনি বাংলাদেশের যে ঋণ রয়েছে তা সময়মত পরিশোধ করতে থাকায় এসব বিষয়েও কোন সমস্যার তিনি আংশকা করছেন না।

তিনি বলেন, ২০১৩, ১৪ ও ১৫ সালে অগ্নি সন্ত্রাস ও জ্বালাও পোড়াওয়ের মাধ্যমে সাধারণ মানুষকে বেঁচে থাকার অধিকারটুকু দেয়নি সেই বিএনপির কাছ থেকে মানবতা এবং মানবাধিকারের কথা শুনতে হয়। তারপরও তিনি বিএনপির সাজা প্রাপ্ত নেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে অসুস্থতার বিচারে সহযোগিতার করার লোক দিয়েছেন। জেলের বদলে তার নির্বাহী ক্ষমতা বলে বাসায় থেকে চিকিৎসার সুযোগ গিয়েছেন। অথচ খালেদা জিয়ার স্বামী জিয়াউর রহমান তার বাবা-মা ভাই ভাইয়ের স্ত্রীসহ পরিবারের সদস্যদের হত্যায় যারা জড়িত তাদের ‘ইনডেমনিটি’র মাধ্যমে দায়মুক্তি দিয়ে বিভিন্ন দূতাবাসে চাকরী দিয়ে পুরস্কৃত করেন।

তিনি বলেন, খালেদা জিয়া আরো এক ধাপ এগিয়ে খুনীদের ’৯৬ সালের ১৫ ফ্রেব্রুয়ারীর নির্বাচনে প্রার্থী করে বিজয়ী ঘোষণা করে বিরোধী দলের নেতার আসনে বসায়। আওয়ামী লীগ সরকারে এসে জাতির পিতার হত্যাকান্ডের বিচার শুরু করলে মামলার রায় ঘোষণার দিনও বিএনপি হরতাল ডেকেছিল বলেও তিনি উল্লেখ করেন।

১৯৭৫ সালের ১৫ অগাষ্ট যারা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নির্মমভাবে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে হত্যা করেছে তাদের আপনজন, বিচারের আওতায় আসা যুদ্ধাপরাধীদের সন্তান ও যারা নানা অপরাধ করে বাংলাদেশে থেকে পালিয়েছে তারা বাংলাদেশের বিরুদ্ধে দেশে বিদেশে নানা ধরনের অপপ্রচার চালাচ্ছে জানিয়ে সবাইকে সতর্ক থাকার এবং বিভ্রান্ত না হওয়ার আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী।
শেখ হাসিনা বলেন, বাঙালিকে তিনি (বঙ্গবন্ধু) গভীরভাবে ভালোবেসেছেন। তাকে যখন বিশ্ব নেতারা সতর্ক করেছেন মিসেস গান্ধি নিজে বলেছিলেন যে কিছু একটা ঘটছে আপনি সতর্ক হন। তাঁর জবাব ছিল না,এরা তো আমার সন্তানের মতো। এরা আমাকে কেন মারবে?

কোন বাঙালি তাকে মারতে পারে এটা জাতির পিতা কোনদিন বিশ্বাসই করেননি উল্লেখ করে বঙ্গবন্ধু কন্যা বলেন, আর বিশ্বাসঘাতকরা আজ দলে বলে ফুলে ফেঁপে উঠে বড় বড় কথা বলছে।

যে সমস্ত দেশ বাংলাদেশের মানবাধিকার নিয়ে কথা বলে তাদের উদ্দেশ্যে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তারা মানবাধিকারের কথা শোনায় আমাদেরকে। মানবাধিকার নিয়ে তত্ত্বজ্ঞান দেয়। কিন্তু আমার কাছে যখন এই কথা বলে বা দোষারোপ করে তারা কি একবারও ভেবে দেখে যে আমাদের মানবাধিকার কোথায় ছিল যখন আমরা আপনজন হারিয়েছি? স্বজন হারানোর বেদনা নিয়ে কেঁদে বেড়িয়েছি।

বৈশ্বিক সংকটের কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, অপচয় রোধ করতে হবে,সব কিছুর ব্যবহার সীমিত করতে হবে,সঞ্চয় করতে হবে এবং সাশ্রয়ী হতে হবে।

পরশ-তাপসকে মঞ্চে ডেকে নিয়ে কাঁদলেন শেখ হাসিনা : পাঁচ বছরের পরশ, তিন বছরের তাপস। বাবা-মায়ের লাশ পড়ে আছে। দুটি বাচ্চা বাবা-মায়ের লাশের কাছে গিয়ে চিৎকার করছে। বাবা ওঠো, বাবা ওঠো..। মা ওঠো, মা ওঠো…। সেদিন কেউ সাড়া দেয়নি।
এভাবেই ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ঘাতকের বুলেটে নিহত শেখ ফজলুল হক মনি ও তার স্ত্রী আরজু মনি হত্যাকাণ্ডের স্মৃতিচারণ করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কান্নাজড়িত কণ্ঠে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আজকে এখানে পরশ ও তাপস বসে আছে।’ তখন প্রধানমন্ত্রীর চোখ যায় পরশের দিকে। তাপস মঞ্চে থাকলেও পরশ ছিলেন না। তিনি নিচে প্রথম সারিতে বসেছিলেন।

তখন প্রধানমন্ত্রী বলেন, পরশ সামনে চুপ করে বসে আছে। পরশ আয়, আয় কাছে আয়। ওকে নিয়ে আসো..। পরশ আসলে তাপসও এগিয়ে গিয়ে ভাইকে জড়িয়ে ধরে কান্না করেন। দুই ভাই ও প্রধানমন্ত্রীর কান্নায় তখন ভারী হয়ে ওঠে পরিবেশ। অনুষ্ঠানে উপস্থিত সবার তখন চোখে পানি।

এসময় শেখ হাসিনা নিজেকে সামলে নিয়ে বলেন, ‘আজকে ওরা বড় হয়ে গেছে…।’ পরে মঞ্চে উঠে প্রধানমন্ত্রীর পা ছুয়ে সালাম করেন যুবলীগ চেয়ারম্যান শেখ পরশ।
শেখ ফজলুল হক মনি ও আরজু মনি দম্পতির দুই সন্তান শেখ ফজলে শামস পরশ ও শেখ ফজলে নূর তাপস। পরশ বর্তমানে যুবলীগের চেয়ারম্যানের দায়িত্বে। আর শেখ তাপস ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র।

ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সভাপতি আবু আহমেদ মন্নাফির সভাপতিত্বে ও ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এস এ মান্নান কচির সঞ্চালনায় সভায় আরও বক্তৃতা করেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস, উত্তর সিটির মেয়র আতিকুল ইসলাম, ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ বজলুর রহমান, দক্ষিণের সাধারণ সম্পাদক হুমায়ুন কবির, আওয়ামী লীগ নেতা নুরুল আমিন রুহুল, সাদেক খান, আব্দুল কাদের খান, শহীদ সেরনিয়াবাত প্রমুখ।

সূত্রঃ ইনকিলাব

Advertisements