মওলানা ভাসানী
Advertisements

আজ এই মহান নেতার ৪৬ তম মৃত্যুদিন। প্রথমে একটা বক্তব্য পড়ে নিন-“সকল বস্তুই আল্লাহর সৃষ্ট এবং সব মানুষই আল্লাহর দাস এবং সব দাসই ভাই-ভাই, অতএব তুমি যাহা সৃষ্টি করিতে পার না তাহা লইয়া ভাইয়ে ভাইয়ে ঝগড়া করিও না। একাত্ম হও, সমতা স্থাপন কর, তাহা হইলেই শান্তি আসিবে।”-ভাসানী ( ভাসানীর কথা, সম্পাদনা: আজাদ খান ভাসানী)

রাজনৈতিক নেতা হিসেবে বাংলার ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র ভাসানী। কিন্তু আমাদের অভাগা কপাল। তারে ইসলামিস্টরা যেমন ভুল বুঝছেন। তেমনি ভয়াবহ রকম উল্টা ব্যাখ্যা করেছেন মার্কসবাদিরা।ভাসানী প্রশ্নে ইসলামিস্টদের একটা কমন ডায়গল ছিল সে ইহুদি নাসারদের দালাল। অন্যদিকে দেওবন্দিরা তাকে মনে করতো সে তো বামদের নিয়ে চলে ফলে ঈমানই নাই। তথাকথিত মডারেটা ইসলামি দল যখন তাকে নাস্তিক ও ইসলামের দুষমন বলে প্রচার করেছিল। তাতে মওলানা খুব কষ্ট পেয়ে সারা রাত জায়নামাজে বসে কান্না-কাটি করেছিল (আমার সাথে এক সাক্ষাতকারে এই তথ্য জানিয়েছেন শেষ জিবনে ভাসানীর সহকারী ইরফানুল বারী ভাই)

অন্যদিকে বামরা তাকে মওলানা, ইসলামিস্ট বলেই জানতো। তার জনপ্রিয়তা ও জনগনের তার উপর আস্থাটাকে ব্যবহার করতে চেয়েছিল বামরা। আর ভাসানী দেখেছিলেন জালেমের বিরুদ্ধে যেই আছে তাকেই সাথে নেয়া দরকার। হোক সে মুসলিম, হোক সে কমিউনিস্ট। তার সব পরিচয়ের বাইরে হকের পথে যে থাকবে সেই মিত্র লড়াইয়ের ময়দানে।

এমনকি প্রাণ প্রকৃতি ও মনুষ্যবোধ ও আল্লাহর কুদরতকে বুঝতে চেষ্টা করার জন্য তিনি যে শিক্ষা ও ধরণের ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয় করতে চাইতেন তার বিস্তারিত বিবরণ তিনি লিখেছেন। আজ এগুলা সব চেয়ে জরুরী দরকার।
এখন যে জাহেলিয়াতি চলছে তার বিরুদ্ধে ভাসানীর শিক্ষা ও পথই আমাদের প্রকৃত ‘সত্য’ পথের দিশা দিতে সক্ষম।
কেন এই দুই গ্রুপই ভাসনীকে ভুল বুঝল। এবং আজও আমরা ভাসানীকে বুঝতে পারি নাই। তার জন্য লম্বা আলাপে যাবো না।

আমি গত ৫/৬ বছর ধরে ভাসনীকে বুঝতে চেষ্টা করে বহু পরিশ্রম করে এখন খুব কনফিডেন্টলি বলতে পারি বাংলাদেশের মানুষ তো বটেই যারা ভাসনীকে নিয়ে কাজ করেছেন তারা ভাসনীকে বুঝে নাই।যেমন আবুল মকসুদ একজন গান্ধিবাদি। তিনি ভাসানী গবেষক। অথচ ভাসানী ঠিক গান্ধীর উল্টা জিনিস। এবং গান্ধীকে লিখিত ভাবে ক্রিটিক করেছেন। (দেখুন, ‘অহিংসা ও বিপ্লব’- ভাসানী, প্রথম প্রকাশ হক কথা, পুনঃপ্রকাশ জবান)

কিন্তু গান্ধীবাদি মনন নিয়ে তিনি করলেন ভাসানী গবেষণা। ফলে তার লেখা কিছু তথ্যের জোগান ছাড়া ভাসানীকে বুঝতে তেমন কোন কাজে আসলো না। অন্যদিকে নুরুল কবীর লিখেছেন, রেড মওলানা। আসলে মাওলানার কোনো রং ছিল না। এসবই রং আরোপের চেষ্টা মিস রিডিং তৈরি করেছে।এই অবস্থার কারণ কি? অনেক কারণের মধ্যে ছোট করে দুইটা বলেই কথা শেষ করছি আজকের মতো :

১.
নম্বর কারণ হল- ভাসানীর জীবনে ক্ষমতার কোনো গুরুত্ব ছিল না। তিনি সব সময় চর্চা করেছেন রাজনীতির। এবং সেই রাজনীতি যখন তাঁর চিন্তার বইরে মানে ‘হক’- এর বাইরে গিয়ে প্রচণ্ড জনপ্রিয় ও ক্ষমতা দখলের যোগ্য হয়ে উঠেছে তখনই তিনি তা ছেড়ে দিয়েছেন, সেই সংগঠন ভেঙে দিয়েছেন। সেই চক্র থেকে সরে এসেছেন। অন্যদের সামনে এগিয়ে যেতে দিয়েছেন। কেউ হল, জাতির পিতা, কেউ হল বেয়াই।

তিনি চলে গেছেন আবার কৃষকদের কাছে। আবার নোতুন করে শুরু করেছেন। ফলে যারা ক্ষমতার দিক থেকে ভাসানীকে বুঝতে চান তারা দেখতে পান এক ব্যর্থ নেতাকে। বুঝতে পারেন না উনার রাজনীতি গঠনের নিরন্তর প্রক্রিয়াকে। এরা সব কিছু দেখে ক্ষমতার চোখ দিয়ে। বুঝতে পারেন না রাজনৈতিকতার দিকটা।

২.
নম্বর কারণ হল- রবুবিয়াত ও ‘হুকুমতে রব্বানী’ এবং ‘পালনবাদ’-কে বুঝতে না পারা। ইসলাম ও রাজনীতি কোন আলাদা বিষয় না। যারা আলাদা করে ইসলামের মধ্যে নোতুন করে রাজনীতি আবিস্কার করেন এরা মূলত আধুনিকতাবাদি ফ্যাতনার অবতারণা করেন ইসলামের নামে (বিস্তারিত বাখ্যার দাবি রাখে এটা- আজ এখানে সম্ভব না)। হুকুমতে রব্বানি এমন এক রাজনৈতিক ধারণা যা বুঝতে খুব খাঁটি ঈমান এবং সরাসরি কুরানের জ্ঞান দরকার। রবের হুকুম মতো শাসন। কে করবে? করবে যিনি রবের প্রতিনিধি বা খলিফা। এটা তিনি যুক্ত করলেন আবার পালনবাদের সাথে।মানে, আল্লাহ বান্দাকে লালন-পালন করেন তাঁর দয়া ও অনুগ্রহে। এবং এটা করা হয় আল্লাহর তরফে অন্য বান্দাদের দিয়েই। তার কথা সঠিক ভাবে পালন করা বান্দার উপর ফরজ দায়িত্ব।পিতা-মাতা যেমন সন্তান লালন-পালন করেন। প্রতিবেশির প্রতি হক, অন্যধর্মের মানুষের হক সবই আল্লাহ রক্ষা করতে বলেছেন সরাসরি। এইসব বিষয়ই সরাসরি আল্লাহর আদেশ। মানে ফরজ। এটাকে তিনি পালনবাদ আকারে বুঝতে চাইলেন। এটাই রাজনীতির মূল কথা।

কাজেই এই বিষয়টাকে কেন্দ্রে রেখেই তিনি হুকুমতে রব্বানীর দিকে রাজনীতিকে নিয়ে গেলেন। অবশ্যই এই ধারণার জন্য তিনি তাঁর ওস্তাদ মহান দার্শনিক আজাদ সুবহানীর কাছে ঋণী। যা হোক এই যে হুকমতে রব্বানী তা না বুঝে তথাকথিত দারুল উলূমের আলেমরা, না বুঝেন মাডারেটরা, না বুঝেন মার্কসবাদিরা। ফলে ভাসানীর মহান সাধনাকে না বুঝে উনার পপুলারিটিকে ধরে ফ্যানাটিক আলোচনা হয়। এইবারের মৃত্যু দিনেও হচ্ছে।

Advertisements